জ্বীনবর৩,পর্বঃ২৬,২৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
ভয়ে ভয়ে উনার কক্ষে ঢুকলাম। উনি আমাকে দেখে কোর আন পড়া বন্ধ করে তুলে রেখে কাছে ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই মাথায়-গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, জুহানী ঘুমিয়েছে?
— হ্যা খালা, ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছি।
আমাকে ডাকলে যে?
— তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল। মনোযোগ দিয়ে শুনবি, শুনে ভেবেচিন্তে তোর মতামত টা আমাকে জানাবি।
— কি কথা খালা?
— এই কয়েকদিনে তুই আমাদের অনেক আপন হয়ে গেছিস। তোকে আমাদের খাদিমা মনে হয়না। নিজের মেয়ে মনে হয় তোকে। অনেক মায়ায় বেধে দিয়েছিস সবাইকে।
— এই পরিবারটাকে আমার নিজের পরিবার ই ভাবি খালা।
— সে আমি জানি। কিন্তু আমি তোকে এই পরিবারের একজন করে নিতে চাই স্থায়ীভাবে, তোকে বৈধতা দিতে চাই।
— কি করে?
— আমার বউমা বানিয়ে। আমার বড়ছেলে জুরাইনের বউ বানাব তোকে। তাতে তুই আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যাবি। তোর মত এত ভাল একটা মেয়েই আমার জুরাইনের জন্য খুজছিলাম। জুরাইন ই ও তোকে ভালবাসে, পছন্দ করে সেটা আমি জানি। তুই ভেবেচিন্তে আমাকে জানা।
আশা করি, তোর কোনো আপত্তি ই থাকবেনা। তুই আমার কথায় সম্মতি জানাবি। যেহেতু এটা পুরোজীবনের ব্যাপার তুই একটু ভেবে দেখ কেমন!
এখন যা নামায পড়ে খেয়ে নে।
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ ই দিলনা। বড় একটা ঝামেলায় ফেসে গেলাম। আশ্রয়ের উপায় করতে গিয়ে নিজের বিপদ ই ডাকলাম। যে করে হোক, এই পরিবারের ভুল ভাঙ্গিয়ে আমাকে প্রাসাদে প্রবেশ করতে হবে। তারপর তলোয়ার টা নিয়ে এখান থেকে ফিরে যাব। একের পর এক ঝামেলা হয়ে আসছে, জীবনটাই গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে। যেদিকেই যাই, সব পথ ই এক। দেরী না করে উপায় ভাবতে হবে। কি করে প্রাসাদে যাওয়া যায়!
এসব ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাটতে লাগলাম। কিছুদূরে অনেক মেয়ের জটলা দেখে এগিয়ে আসলাম। কথা বলে জানতে পারলাম প্রাসাদের জ্বীনসর্দার তার নিজের জন্য বিশ্বস্র খাস-জারিয়া খুজছেন। তাই আগ্রহীদের কে কাল প্রাসাদে মনোনয়নের জন্য যেতে বলেছেন। শুনে খুশি হলাম। প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। কোনোভাবে খাস-জারিয়া হিসেবে নির্বাচিত হলে প্রাসাদে থাকার সুযোগ পেয়ে যাব। আর সেটা কাজে লাগিয়ে বিশেষ কক্ষ খুজে বের করব।
বাসায় ফিরতেই জুহানী ছুটে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল,
— এতক্ষণ তুমি ছিলে বুবু? ঘুম থেকে উঠে তোমায় কত্ত খুজলাম। এভাবে না বলে কোথায় যাও তুমি! ভয় লাগেনা পিচ্চি মেয়ে।
— কোথাও যাইনি সোনা। তোমার বুবু তোমার কাছে তো আছে।
বলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। খালা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
— কোথায় গিয়েছিলি মা?
— বাহিরে গিয়েছিলাম।
— এতক্ষণ লাগল কেন ফিরতে?
— প্রাসাদে খাস-খাদেমা নেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। সেটার ব্যাপারেই জানতে গেলাম।
— তুই আমাদের ছেড়ে প্রাসাদে যাবি খাস-জারিয়া হতে? তুই ভুলে যা তুই একজন খাদেমা ছিলি। এসব কিছু তোকে আর করতে হবেনা। তোকে নতুন জীবনের পথ দেখাচ্ছি। সেটা করে ভালোভাবে থাক।আমার ঘর আলো করে সবটা জুড়ে থাক।
ইনশাআল্লাহ অনেক ভাল থাকবি।
— সেটা সম্ভব নয় খালা।
— কেন সম্ভব নয়?
— খালা আমি বিবাহিতা। স্বামীর সাথে ঝগড়া করে তাকে ছেড়ে এখানে চলে এসেছি। ছেড়ে এলেও আমি তাকে মনেপ্রাণে খুব ভালবাসি।
ওকেই আমার স্বামী বলে মানি। তাই তোমার পরিবারের বৈধতা পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কাল আমি প্রাসাদে খাস-জারিয়ার আবেদনপ্রার্থী হিসেবে যাব।
যদি নির্বাচিত হয়ে যাই তোমাদের সাথে হয়ত থাকা হবেনা আর। এক্ষেত্রে তোমার অনুমতি চাই খালা।
খালা ছলছল করা চোখ লুকিয়ে বললেন,
— তোর যা খুশি তুই তাই কর। তোর আপন হতে পারিনি। আমি কে তোকে অনুনতি দেওয়ার? দুদিনের জন্য মায়া দেখাতে এসেছিস কেবল।
বলে খালা হনহন করে তার কক্ষে গিয়ে দরজা এটে দিল। জুহানী কয়েকবার ডেকে থমকে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি সত্যি আমাকে ছেড়ে যাবে বুবু?
— হ্যাঁ। আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
— যেয়োনা বুবু। আমার খুব কষ্ট হবেনা।
— যেতে হবে সোনা। বেচে থাকলে আর আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে।
ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
— তুমি আর আমার সাথে কথা বলবেনা। খুব বাজে তুমি।
দৌড়ে চলে গেল জুহানী। পিছন থেকে ডাকার সাহস পেলামনা। সত্য যেটা সেটাই বলেছি। শত চেষ্টা করলেও ওর কাছে থাকা আমার সম্ভব নয়। আমার কাধের উপর যে অনেক দায়িত্ব।
এমনসময় জুরাইন ঘরে ঢুকল। আমাকে ওকে দেখে নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। ও পিছন থেকে আমার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আমার হাত জড়িয়ে বলল,
— আমার বউ হবে মুসকান? বৈধতা নিবে আমার পরিবারের একজন হওয়ার?
ভেবে দেখো, তুমি একটা পরিবার পাবে। আমার উজাড় করা ভালবাসা পাবে। অনেক ভালবেসে ফেলেছি তোমায় বিশ্বাস করো।
কথা দিচ্ছি আমার ঘরে তুমি রাণীরুপে থাকবে এবং ভালবাসার কোনো কমতি থাকবেনা। আমি শুনে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম,
— জুরাইন ভাইয়া আমি বিবাহিতা।
অনেক আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এভাবে বেগনা নারীকে স্পর্শ করবেননা, এসব কথা কখনো মাথায় আনবেননা। আমার পক্ষে অসম্ভব নিজের স্বামীকে ফেলে আপনার সাথে সংসার সাজানো।
এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। জুরাইন শুনে প্রতিউত্তর না করে কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেল। আমার আর কিছু সহ্য হচ্ছেনা। কখন এখান থেকে বের হব আমি! একের এক ঝামেলায় ফেসে যাচ্ছি। আর দেরী করা যাবেনা।
কাল ই এই ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। ছেড়ে যাব ভাবতে খারাপ লাগছে, এই কয়েকদিনে পুরো পরিবারটাকে অনেক আপন করে নিয়েছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। একদিকে আমার দায়িত্ব, অন্যদিকে আমার স্বামীর প্রতি ভালবাসা। কোনোটাই হার মানতে দিবনা।
সকাল হতেই সব গুছিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে করে জানাইনি, বিদায় বেলা কোনো নতুন মায়ার বাধনে বাধা পড়তে চাচ্ছিনা। জুহানী আমাকে চলে যেতে দেখলে অড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করবে। যার কারণে আমার ওকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবেনা। ঘুমন্ত অবস্থায় ওর কপালে চুমু দিয়ে চলে এসেছি। ভালো থাকুক ও। কখনোই ভুলবনা ওকে।
প্রাসাদের সামনে তো প্রচুর ভীড়। অনেক মেয়ে জটলা বেধে আছে। এক এক জন করে ঢুকছে আর মুখ কালো করে বেরিয়ে আসছে। মনোনিত হতে পারেনি বোধহয়। আমার ও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। আল্লাহ তুমি আমাকে এই সুযোগটা পাইয়ে দাও। যে করে হোক আমাকে নির্বাচিত হতে হবে।
এক সময় আমার ডাক আসল। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম অনেক বিলাসবহুলভাবে সাজানো প্রাসাদটা, আর বড় ও। সৌন্দর্য্য থেক্ব চোখ ফেরানো মুশকিল। এত বড় প্রাসাদের কোন কোণায় বিশেষ কক্ষটি আছে কে জানে।
খাস-দরবারে এসে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করতেই দেখলাম বড় পালঙ্কের এক কোণায় পায়ের উপর পা তুলে এক সুদর্শন ছেলে বসে আছে। বয়স তাওহীদের সমান ই, লম্বাটে, গোলাকার চেহারা, চেহারা দেখেই মনে হয় খুব শক্তিশালী আর কঠিন প্রকৃতির। আদাবের সহিত সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, নাম কি তোমার?
— মুসকান।
— খাস-জারিয়া হতে এসেছ যে কি কি কাজ জানো?
— আলহামদুলিল্লাহ সব ই পারি। ভরসা করে দেখতে পারেন, বাকিটা আমার কাজ ই বলবে।
— আমাকে দেখেশুনে রাখা, আমার সব কাজ করে দিতে পারবে তো?
— আস্থা রাখতে পারেন।
— আমার খাস-জারিয়া হতে হলে সৎ, সাহসী, দক্ষ এবং বুদ্ধিমতী হতে হবে। কেননা, তোমাকে দিয়ে আমি সামান্য ছোট-খাট কাজ করাবনা।
— আমার বিশ্বাস আমার মধ্যে সবগুলোই আছে। তবুও আপনি যাচাই করতে পারেন।
— ঠিক আছে, তাহলে হয়ে যাক এক দফা পরীক্ষা।
— জ্বী, আমি প্রস্তুত।
উনি হাতের ইশারা করতেই এক দাসী আমার সামনে পানিভর্তি পাত্র নিয়ে এল। জ্বীনসর্দার আমার দিকে চেয়ে বলল,
— এই পানিভর্তি পাত্রের দিকে তাকাও, দুটো পাথর আছে সেখানে। একটা সাদা আর একটা রঙ্গিন পাথর। তোমাকে শুধু দেখেই বলতে হবে এখানের কোন পাথর বেশী মূল্যবান? আর কোনটি মূল্যহীন!
আমি পাত্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভালো করে ভাবলাম। দুটো পাথর ই পানির নিচে ঝকঝক করছে, ধাধায় ফেলে দিল উনি এভাবে। কিছুটা সময় পর উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি উত্তর দিতে প্রস্তুত?’ আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, এই পাথর দুটো অধিক মূল্যবান। কিন্তু রঙ্গিন পাথরটা অধিক মূল্যবান। কেননা, সেটা রঙ্গিন পাথর না ওটাই আসল সাদা পাথর। আর যে সাদা পাথরটা আছে সেটা রঙ্গিন পাথর। তার উপর কেবল সাদা প্রলেপ করা হয়েছে।উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কি করে বুঝলে?
— আসল জিনিস তার আসল রুপ যেকোনো সময় ই দেখায়। পানির নিচে রঙ্গিন পাথর বেশি ঝকঝক করছিল।
উনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, তুমি মনোনিত হয়েছো। আজ থেকে তুমি আমার খাস-জারিয়া হিসেবে এ প্রাসাদে বিচরণ করবে। দাসী ওকে দাসী মহলে নিয়ে যাও। ওর যাতে কোনো অসুবিধা না হয় দেখবে। মহলে ঢুকে পালঙ্কে গা এলিয়ে দিলাম। আর ভাল লাগছেনা এসব। তাওহীদের কথা ভীষণ মনে পড়ছে।আজ যদি জ্বীনকন্যা না হয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে হতাম তবে সুখে সংসার করতাম দুজন মিলে। আচ্ছা কেমন আছে ছেলেটা? আমার চিঠিটা পড়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। ও কি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করে ফেলল!
কিছুদিনের মধ্যে জ্বীনসর্দারের মন জয় করে ফেলেছিলাম। তার সবকিছু নিপুণভাবে সামলাতে আমি লাগলাম। তার দেখা-শুনা সব আমিই করি।
আমার মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম,
— এই মহলের সবচেয়ে কড়া নিরাপত্তা কক্ষ কোনটা?
— এটা এই মহলের কোথাও পাবেনা।
— তবে কোথায় আছে সে।
আমার দিকে রাগান্বতি চোখে তাকিয়ে বলল খাস-জারিয়া আছো সেটাই থাকো। এসবের বাহিরে আর কোনো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবেনা।
মন খারাপ করে চলে এলাম। এর পেট থেকে কিছু বের করা যাবেনা। যা করার আমাকেই করতে হবে। কিন্তু কি করা যায়।
একটু ভাবার পর একটা বুদ্ধি পেয়েছে। এখন সাবধানে কাজে লাগাতে পারলেই হল। আর কোনো সমস্যা থাকবেনা
.
(চলবে)
জ্বীনবর৩
পর্বঃ২৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
বিকালে জ্বীনসর্দার সুলাইমান যখন রাজকার্যে নিজের কক্ষের বাহিরে গিয়েছিছেন, খুব সাবধানে তার কক্ষে প্রবেশ করলাম। পুরো কক্ষে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম এই আশায় যদি বিশেষ কক্ষটা কোথায় সেটা জানা যায়। খুজতে খুজতে হয়রান হয়ে গেলাম। তাও পেলামনা। এমনসময় কারো আসার ইঙ্গিত পেয়ে বড় ট্রাংকটার পিছনে লুকিয়ে পড়তে গেলাম, ততক্ষণে সুলাইমান আমাকে পিছন থেকে ডাকলেন,
— মুসকান। ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
— জ্বি হুজুর।
— তুমি এইসময় আমার কক্ষে কি করছো? তুমি তো নিশ্চয়ই জানো আমি বেরিয়ে ছিলাম। তবে কেন এসেছো?
কি বলব বুঝতে পারছিনা। কথার যথাযথ সংগতি না পেলে আমাকে সন্দেহ করবে। এর জন্য প্রাসাদ থেকে বের কিংবা কারাদন্ড ও দিতে পারে। তখন আমার এত কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে। হঠাৎ নিজের হাতের আংটির দিকে চোখ পড়ল। খুলে সিন্দুকের পাশে ছুড়ে দিলাম। খোজার ভান করে বললাম,
— আমার প্রিয় আংটিটা কাল রাতের পর থেকে পাচ্ছিনা। সবখানে খুজলাম পেলামনা। ভাবলাম কাল রাতে তো আপনার কক্ষে এসেছিলাম এখানে পড়েছে নাকি। তাই আপনার অনুমতি ছাড়া খুজতে এলাম। ভুল মার্জনা করবেন।
— পেয়েছো?
— নাহ।
— সিন্দুকের পাশে এটা কি? চকচক করছে।
আমি তক্ষুনি আংটিটা হাতে তুলে নিয়ে খুশি খুশি ভাব করে বললাম,
— হ্যা এটাই তো আমার আংটি। ধন্যবাদ হুজুর।
— এখন তুমি এসো। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
— জ্বি আচ্ছা। বলে ঠোট কামড়াতে কামড়াতে চলে এলাম। কিছুই পেলামনা যা দিয়ে বিশেষ কক্ষ খুজব। এভাবে আর বসে থাকলে চলছেনা। নিজেই খুজে বের করতে হবে। হাটতে হাটতে পুরো প্রাসাদ, প্রতিটা কক্ষ ভাল করে খুজে দেখলাম। কিন্তু তেমন কোনো কক্ষ ই নেই। খাস-জারিয়া বলে কেউ কিছু বললনা, তবুও বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কেউ ভাল চোখে দেখছেনা। তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি কেবল চিন্তিত কি করে বিশেষ কক্ষ টা খুজে বের করব।
নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটা বের করলাম।
মনে মনে জ্বীনদাদুকে স্মরণ করতে লাগলাম। একটু পর আয়না টা কেপে দাদুর প্রতিবিম্বটা দেখতে পেলাম। সালাম করে বললাম,
— আমি প্রাসাদে আছি। কিন্তু এত বড় প্রাসাদের কোথাও বিশেষ কক্ষটা পেলামনা।
— তলোয়ারটা জ্বীনজাতির কাছে এতই মূল্যবান যে সেটা লোকচক্ষুর আড়ালে নিরাপদে রাখা হয়। সেখানে লোকপূর্ণ প্রাসাদের কোণায় রাখবে এমন বোকা তারা নয়। অতএব এটা প্রাসাদের পারিপার্শ্বিক কোথাও নেই কিন্তু প্রাসাদেই আছে।
— কেমন গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে! এটা প্রাসাদের কোথাও নেই কিন্তু প্রাসাদেই আছে। দাদু আপনি জানেন না, বিশেষ কক্ষটা কোথায়?
— আমি মারা যাওয়ার পর বিশেষ কক্ষের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। আর কেবল জ্বীনসর্দার ই বলতে পারে বিশেষ কক্ষটা কোথায়! সবটা তাদের হাতেই থাকে।
— সুলাইমান জ্বীন তো এই ব্যাপারে কিছু বলা তো দূরে থাক মুখেও আনতে চাননা। তার পেট থেকে এসব বের করা আকাশ-কুসুম কল্পনা বৈকি! খুব হতাশ লাগছে।
— সেটা তোমার দায়িত্ব। তুমি কি করে ওর থেকে কথা আদায় করবে! তবে জেনে রাখো আজ রাত মহিমান্বিত রাত। আজ রাতেই আল্লাহ শ্রেষ্ঠ মানুষজাতির পিতাকে পৃথিবীতে পাঠয়েছিলেন। তাই আজ রাত ই তোমার জন্য শেষ সুযোগ। আগামী ৪ঘন্টার মধ্যে যদি তুমি তলোয়ার উদ্ধার করতে না পারো, বিশেষ জ্বীন-উপাধি, অধিকার হারাবে। ৫-১০টা সাধারণের জ্বীনের মত তোমাকে জ্বীনরাজ্যেই জীবনযাপন করতে হবে। তখন তলোয়ার পেলেও তুমি সেটা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে। তলোয়ার নিতে গেলে তোমাকে সুলাইমানের বিশ্বস্ত কিছু কারিন জ্বীনের মুখোমুখি হতে হবে।
ওরা ভীষণ ভয়ংকর। সবসময় আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে।
— আপনি যা বলবেন তাই হবে।
জ্বীনদাদু বিদায় নিতেই আমার চিন্তা আবার জড়ো হল। হাতে মাত্র ৪ঘন্টা আছে, এর মধ্যেই যা করার করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করব? সুলাইমান জ্বীন কিছুতেই আমাকে বিশেষ কক্ষের কথা বলবেননা। ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গেলাম। জ্বীনসর্দার হিসেবে সুলাইমান খুব ই উৎশৃঙখল। মদ্যপান, জলসা হারাম জেনেও সে সবে অভ্যস্ত। মেয়েলোক নিয়ে নষ্টামি তো আছেই।
তার পছন্দের পানীয় নিয়ে তার কক্ষে ঢুকলাম। বসে বসে কিসব জানি ভাবছিলেন। আমি যেতেই পাশে বসতে বলে বললেন,
— আজ সারা প্রাসাদ ঘুরেছো শুনলাম।
— আসার পর তেমন ঘুরে দেখিনি। তাই আজ ঘুরে দেখলাম, আপনার রাজত্ব-রাজ্য দুটোই সুন্দর আর সুশৃঙখল।
— হতেই হবে। এ হচ্ছে জ্বীনসর্দার সুলাইমানের রাজত্ব।
আমার দাদু হামনাদ খালিদ মারা যাওয়ার পর আমিই গোটা রাজ্য নিজের মত করে চালাচ্ছি।
মনে মনে অবাক হলাম। উনি আর কেউ নয়, আয়নায় দেখা জ্বীনদাদুর নাতী। এত ভালো একটা জ্বীনের নাতী হয়েও এত উৎশৃঙখল ভাবা যায়না।
— এই নিন আপনার পানীয়।
— আহ! এনেচো? দাও। ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, দাদু আমায় একদম ই যোগ্য মনে করত না এই রাজত্ব পরিচালনার জন্য। তার মতে, আমার উপর নাকি মোটেও ভরসা করা যায়না। ক্বারিন জ্বীন পালি তো কি হয়েছে? ওরা না হয় একটু খারাপ ই, পুরো জগতে খারাপ কেউ কি নেই? আমি তো মনে মনে বলি দাদু এসো দেখে যাও, আমি কত সুনিপুনভাবে রাজ্য চালাচ্ছি। জ্বীনি তলোয়ার তোমার থেকেও বেশি সুরক্ষায় আমি রেখেছি।
বলে পাগলের মত হাসতে লাগল।
আমার টোটকা কাজ করেছে। আস্তে আস্তে নেশায় বুদ হয়ে মাতলামি শুরু করেছে সুলাইমান জ্বীন। এবার কেবল পেট থেকে কথা বের করা দরকার।
— কোথায় আছে সেই জ্বীনি তলোয়ার?
— এক বিশেষ কক্ষে। অনেক নিরাপদে, এই প্রাসাদেই।
— বিশেষ কক্ষটা কোথায়? পুরো প্রাসাদে তো এমন কোনো কক্ষ ই নেই। আপনি মিথ্যে বলছেন।
— মোটেও না। বিশেষ কক্ষটা এই প্রাসাদেই আছে, সবার চক্ষুর আড়ালে।
— কিন্তু কোথায়?
— হুসসসসস! কাউকে বলবেনা তো তুমি?
— না বলবনা। বলুন।
— এই প্রাসাদের মাটির নিচে একটা গুহা আছে। সেখানে একটা কুয়ো আছে ওটার ৩নাম্বার কক্ষেই তলোয়ার টা রাখা। ভীষণ আড়ালে আছেনা বলো?
— কি যে বলেন? এত নিরাপত্তায় রাখলেন কেউ তো টের ই পাবেনা।
— সেইজন্য ই তো রেখেছি। কত মূল্যবান তলোয়ারটা।
এটা যার কাছে থাকে সেই ই এই জ্বীনরাজ্য হাতের মুঠোয় রাখতে পারে। কেউ তার গায়ে আচড় ও কাটতে পারেনা। কিন্তু আমি এর ব্যবহার জানিনা।
দাদুকে কতবার বলেছি আমাকে শিখাও, শিখালেন না। রাগ উঠে দিলাম তার ঘাড় বরাবর এক কোপ। অনেকদিন বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে মারা ই গেলেন।
দাদুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা শুনে খুব খারাপ লাগল। সুলাইমানের প্রতি চাপা ক্রোধ জন্ম নিল। কিন্তু সেটা সময়মত প্রশমিত করা যাবে। হাতে আর মাত্র দুঘন্টা আছে। উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— গুহা যাওয়ার পথ কোনদিকে?
— ওই যে আমার সিন্দুকটা দেখছো, যার পাশে তোমার আংটি পড়ে ছিল। ওটার ভিতরেই গুপ্তপথটা আছে। বলে বলে সে নিস্তেজ হয়ে গেল। নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর দেরী করা যাবেনা, এক্ষুনি যেতে হবে। ছোট একটা মশাল জ্বালিয়ে সিন্দুক টা খুললাম। সত্যিই সিন্দুকের ভিতরে অনেক গুলো সিড়ি ধাপে ধাপে নিচের দিকে কাটা। দেরী না করে মশাল নিয়ে নেমে পড়লাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেতরে। অনেকটা হেটে কুয়ার কাছে চলে আসলাম। এতটা আসলাম কিন্তু কোনো বিপদের সম্মুখীন হলামনা। তার মানে, তলোয়ারের নিরাপত্তা কিংবা বিপদ দুটোও কুয়ার মধ্যেই অপেক্ষা করছে। অনেক গভীর সাধারণ কুয়ো। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক ছিটে আলো এসে পড়ছে। মশাল শক্ত করে ধরে কুয়োয় লাফ দিলাম। নিচে পড়ে গিয়ে মাথায় একটু চোট লাগল। তা পাত্তা না দিয়ে আলোটা অনুসরণ করে সেখানে থাকা দরজায় ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই ৩টা দরজা আমার সামনে পড়ল। উপরে আরবিতে লেখা ভেসে উঠল,
— বেছে নাও যেটি তোমার জন্য উত্তম।
যার একটিই তুমি খুলতে পারবে, আর সেটাই তোমার ভাগ্যের ফলাফল নির্ধারণ করবে। ৩টি দরজার একটি স্বর্ণের, একটি জহরতে আরেকটি পান্নার তৈরী। সৌন্দর্যে কেউ কারো থাকে কম নয়। কিন্তু কোনটায় তলোয়ার আছে?
হঠাৎ মনে পড়ল সাদা পাথরের ঘটনা। সেদিন সাদা পাথর ই অধিক মূল্যবান ছিল যেটায় প্রলেপ দেওয়া ছিল। জহরত আর পান্নার দুটো দরজাই সাদা বর্ণের।
তার মানে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া কক্ষেই আছে তলোয়ারটি।
সেটি খুলতেই দেখি সুন্দর কাচের বাক্সে তলোয়ারটি সাজানো। ওটার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কিছু ঘুর্ণিয়মান বাতাস আমাকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে জোরে জোরে আঘাত করছে। রড কিংবা হাতুড়ি দিয়ে মারছে। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। হঠাৎ আমাকে শুণ্য তুলে মাটিতে আছাড় দিল। ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। চারদিক থেকে অগণিত হাসির শব্দ আসছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।
মাটিতে একটা আরবি লেখা ভেসে উঠল,
বহিয়ে রক্তের নহার
ধরিও তলোয়ারের ধার। তবেই তোমার ফলাফল তুমি অবশ্যই পাবে। নিশ্চয়ই উত্তম প্রতিদানই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েকমূহুর্ত ভেবে উঠে ছুটে গেলাম কাচের বাক্সের দিকে। সাথে সাথে চারদিক থেকে বিভৎস চিৎকার, মুখ ভেসে উঠল। সবশক্তি প্রয়োগ করে এক আঘাতে কাচের বাক্স ভেঙ্গে ফেললাম। আমার হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। হাতের সবস্থানে বড় বড় কাচ ঢুকে গেছে। যন্ত্রণা করছে খুব তাও তলোয়ারটা হাতে তুলে নিলাম। সাথে সাথে তলোয়ার থেকে এক বজ্রশক্তি বেরিয়ে চারিদিকে রক্তের বন্যা বয়ে দিল। একটু পরে দেখি বীভৎস আকৃতির কিছু প্রাণীর ছিন্নভিন্ন দেহ এদিক ওদিক পড়ে আছে।
আমি তলোয়ার উদ্ধার করতে পেরেছি, এক্ষুনি এই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। হাতের কাচ গুলো ও তুলে ফেলা হয়নি। এক এক করে টেনে সব কাচ খুলে ফেললাম, রক্ত গলগল করে বের হতে লাগল আরো। জ্বলছে ক্ষতস্থানগুলো।
ওড়নার টুকরো ছিড়ে হাত বেধে নিতে হবে। ওড়না ছিড়তে গিয়ে তাড়াহুড়োয় তলোয়ারের সুচালো অংশ হাতে লাগল। সাথে সাথে ক্ষতস্থান মিলিয়ে যেতে লাগল।
তলোয়ারের শক্তি পূর্ণ কাজ করতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি তলোয়ার নিয়ে উঠে এলাম। সিন্দুক থেকে বের হতেই দেখি সুলাইমান তার তলোয়ার নিয়ে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে তলোয়ার ওর গলায় ধরলাম।
— এই তলোয়ারের কাছে আপনি কিছুইনা। আমি চাইলে এক্ষুনি আপনার গর্দান নামিয়ে দিতে পারি। এই তলোয়ার যতক্ষণ আমার কাছে আছে, এই জ্বীনজগত কিংবা মানুষ্যজগতের কেউ আমার কিছুই করতে পারবেনা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।
শয়তান তোর তো জাহান্নামে ও জায়গা হবেনা। নিজের দাদুকে কষ্ট দিয়ে মেরেছিস। একি কষ্ট তোকেও দিব আমি, তিলে তিলে মরবি তুই। তলোয়ার দিয়ে ওর হাতে একটু আঘাত করে ওর শক্তি ছিনিয়ে নিলাম। তারপর ঠেলে সিন্দুকে ফেলে দিয়ে সিন্দুকের দরজায় তালা দিয়ে দিলাম। এইবার এখানেই তিলে তিলে পচে মরবে শয়তানটা। আমার অর্ধেক কাজ শেষ এখন নিজের জগতে ফেরার পালা। ব্যাগে তলোয়ার ঢুকিয়ে প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা লাগলাম।
ওয়াফাহর জেঠি মুখে পান পুরে চিবাতে চিবাতে বলল, এবার কি ঠিকমত বিয়ে হবে? নাকি তোর মেয়ে আবার পালাবে! সালেহা খাতুন বিস্তর হাসি দিয়ে বলল,
— ও আমাকে ওয়াদা করেছে এই বিয়েটা করবে। সবকিছুই তো ভালোই ভালোই সম্পন্ন হল। একটু পরে বরযাত্রী আর কাজি সাহেব আসবেন। ওদের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে আমার মরেও শান্তি।
ওয়াফাহ জানালা দিয়ে একদৃষ্টে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকজন কত ব্যস্ত। কেউ পানি আনছে, কেউ রান্নায় ব্যস্ত, কেউ অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। সেদিনের মতই বাড়িটা সাজানো হয়েছে। শাড়ি-গয়না পরিয়ে শঙ সাজানো হয়েছে। মুহিবের কথা মনে পড়ছে শুধু, ক্ষণিকের জন্য তার জীবনে উকি মেরে আবার অস্ত নেমে গেছে। শুধু রুহহীন দেহটার ই বিয়ে হচ্ছে, মন তো আগে থেকে মুহিবের কাছে রয়ে গেছে।
লোকজনের শোরগোলের আওয়াজ আসছে। বর এসেছে, বর এসেছে বলে ছোট পিচ্চি গুলো চিৎকার করছে। ওয়াফাহর যেন টনক নড়ছেনা তাতে, আবছা অন্ধকারে প্রাণহীন মূর্তির মত বসে আছে। এত মিহি করে নিশ্বাস ফেলছে তাতে নিজের কাছে নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে। সালেহা খাতুন এক গাল হাসি নিয়ে কাজীসহ ঘরের দরজা খুলে ঢুকল।
ঢুকে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা সালেহা খাতুন। এবার ও ওয়াফাহ বিয়ে না করার জন্য এসব শুরু করেছে।
.
(চলবে)