জ্বীনবর সিজন ৫,পর্বঃ০১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
দরজার সামনে এসে দাড়াতেই সশব্দে দরজার কপাটগুলো নিজে নিজে নাড়া দিয়ে উঠল । আতঙ্কে চমকে উঠলাম, যদিও এমন ঘটনা আমার সাথে প্রথমবার হচ্ছেনা।
কিন্তু এটা আমার কাছে একপ্রকার পূর্বসংকেত হয়ে উঠেছে খারাপ কিছু হওয়ার।
ভিতর থেকে শব্দ এল, তোকে কি নতুন করে ভিতরে আসার জন্য বলতে হবে? আমি কাপা কাপা কন্ঠে বলে উঠলাম,
“এইতো আসছি।”
ঘন কালো অন্ধকারপূর্ণ জীর্ণ ঘরটায় আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরের দিকে ভীষণ ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া যায়, চারিদিক থেকে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। আমি পিছু হেটে কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করছি যাতে ওর কোনো ক্ষতি না হয়। কিছুটা সময় পরে, মোমের আলো জ্বলে উঠল ঘরটায়। আমি কপাটের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওর সামনে দাড়ালাম।
রাগান্বিতকন্ঠে সে আমাকে বলতে লাগল,
– তোকে দিয়ে কোন কাজটা হয় বলতে পারিস?
তোকে সাথে করে আনাটাই আমার বড় ভুল। তাও আনি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করিসনা। ভীতুরাণী একটা। চল এখান থেকে বের হই।
আমি চুপ করে শুনে ওর পিছু হাটা দিলাম।
বাড়ীটার উঠোনে এসে দাড়ালাম দুজন।
সাহেবমত লোকটি তার চাকরসমেত এল। সালাম করে বলল, কাজটা করতে সক্ষম হয়েছেন তো?
মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আমি কাজটি করতে পারবনা এমন টা আপনি ভাবলেন কি করে?
কাজটা সম্পন্ন হয়েছে, আপনি গুনে গুনে বাকি টাকা আমার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিবেন।
— জ্বী আমি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বুড়িমা আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, ওসব কাজে যদি ওর তোকে অনুপযুক্ত ই মনে হয়, সাথে নিতে যায় কেন? আর এত কথা-ই বা শোনায় কেন?
আমি সহসা চমকে উঠে বললাম,
“এ কি বলছো বুড়িমা! বোনের সাথে তো বোন-ই সঙ্গী হয়ে যাবে বলো। আমার ও ছাড়া কে আছে, ওর ই বা আমি ছাড়া কে আছে!
এসব কাজ কি সবাই পারে বলো! এসব করতে গিয়ে বোনের যদি কোনো বিপদ-আপদ ঘটে যায়, আমি তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবনা। ওকে সাহায্য করতে না পারি, ঢাল হয়ে রক্ষা করার চেষ্টা তো করতে পারব।”
বুড়িমা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর ভাত মাখাতে মাখাতে বলল, তোদের দু’বোনের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
আমিও বুঝিনা, এসব জ্বীনসংক্রান্ত কারবার না করলেই বা কি হয়? বেচে থাকার জন্য আরো অনেক উপায় আছে। নিজের প্রাণের ঝুকি নিয়ে জ্বীন ধরা, তাড়ানো এসব করে ফায়দা কি?
তক্ষুনি পিছন থেকে আফরাহ বলে উঠল,
” বুড়িমা, তোমার সব বিষয়ে এত নাক গলানোর কি আছে? অনধিকাত চর্চা টুকু কি না করলেই নয়!”
মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এখন বুড়িমাকে কত কথা শুনতে হবে বোনের কাছ থেকে। কেন যে বুড়িমা এসব বলতে যায়।
আমি বিনীতস্বরে বললাম, বোন, থাকনা এসব। বুড়িমা এমনিতেই বলছিল। আমাদের নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন উনি, সে দুঃশ্চিন্তা থেকেই এসব বলে ফেলেছেন।
— শোন মুশু, আমার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করুক সেটা আমি পছন্দ করিনা। দুবেলা ভালো-মন্দ খেয়ে বেচে আছি এই কাজের জন্যই। আর কাজটা আমাদের বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে। বাবার পর কাজটা আমি হাতে নিয়েছি।
আমরণ অবধি এটাকে আমি চালিয়ে যাব।
বাহিরের কারো কথায় এসব থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ই উঠে না।
আর যেন এসব নিয়ে কোনো কথা না হয়, তাহলে সবাইকে আমি দূর করে দিব। মনে থাকে যেন।
বোন চলে যাওয়ার পর আমি বুড়িমার দিকে তাকালাম। চোখ দুটো ভিজে আছে। আমি বুড়িমার হাত চেপে ধরে বললাম, কষ্ট পেয়োনা। জানোই তো বোন একটু রাগী, রাগ কমে গেলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবার ফেলে যাওয়া দায়িত্ব সে কাধে তুলে নিয়েছে।
বোন দশ গ্রামের মানুষ সম্মান করে, বোন তাদের সমস্যায় তাদের পাশে থাকে এটা কি কম বল!
বুড়িমা কিছু না বলে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খায়। তারপর কিছু না বলেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আমি উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাহিরের ঝলমলে জ্যোৎস্না দেখতে থাকি। আমি মুশায়রা, আমার ছোট বোন আফরাহ। দু’বোন মিলেই এই ছোট বাসাটায় থাকি, দেখাশুনা বুড়িমা-ই করেন। সেই বাবা-মা থাকাকালীন সময়ে আমাদের দেখাশুনার জন্য এই বাড়ীতে এসেছিলেন। আমাদের বয়স যখন ১৭-১৮ তখন হঠাৎ বাবা মারা যান, বাবার শোকে মাও পাগল প্রায় হয়ে যান, একদিন রাতে হুট করে উধাও হয়ে যান। অনেক খুজার পর পাইনি, একদিন খবর আসে গাড়িচাপা পড়ে মা মারা গিয়েছেন।
এতদিন অবধি বুড়িমা ই আমাদের সাথে ছিলেন। অসহায় এতীম দুটো মেয়েকে সামলেছেন, নিজে পরের বাড়ীতে কাজ করে আমাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন।
এরপর বোন জ্বীনধরা, তাড়ানো এসব আয়ত্ব করে বাবার পথ অনুসরণ করে এসব কাজ শুরু করে। তারপর নিজেদের স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।
বোনও কেমন জানি পালটে যায়। অল্পতে রেগে যায়, স্বাধীনচেতা হয়ে পড়ে। আমিও চেষ্টা করি ওকে না রাগানোর, ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
কখনো কখনো খুব কষ্ট হয় ওর আচরণে, তাও চুপচাপ শুনে থাকি। কেননা, বাবা আমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন ওকে দেখে রাখার, কোনো অবস্থাতেই যেন ওকে ছেড়ে না যাই।
একটুপর আফরাহ আমার ঘরে এসে ডাক দেয়, মুশু।
আমি চোখ মুছে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যা বোন। আয়, কিছু বলবি?
— ঘুমাসনি?
— এইতো ঘুমাব।
— আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস?
— কই না তো।
আফরাহ আমার ডানহাত শক্ত করে ধরে বলল,
— তুই তো জানিস বাবা মারা যাওয়ার পর আমি অন্যরকম হয়ে গেছি। অল্পতেই রেগে যাই, যা’তা বলে ফেলি। কি করব বল? আমার তো আমাদের কথা ভাবতে হয়।
নিজেকে যদি এই জায়গায় আমি প্রতিষ্ঠিত না করতাম কবেই আমাদেরকে সমাজের হায়েনাগুলো ছিড়ে খেত।
আমার কথা ছাড়, তুই এত সরল একটা মেয়ে। কখনোই এই সমাজে টিকতে পারতিনা।
পক্ষান্তরে, তোর ভালোর জন্যই আমি এত কঠিন হয়ে থাকি।
আমার উপর মনে কষ্ট রাখিসনা বোন।
— না, না বোন। তোর উপর আমার কোনো মনোকষ্ট নেই। আমি তো বুঝি সব। এসব একদম ভাবিসনা।
আমি সবসময় তোর পাশে আছি, যেকোনো পরিস্থিতিতে থাকব ইনশা’আল্লাহ।
বলে আফরাহকে জড়িয়ে ধরলাম। আসলেই ওর এত সংগ্রাম-কষ্ট সব তো নিজেদের ভালো থাকার তাগিদে।
— অনেক রাত হল, ঘুমিয়ে পড়।
আমি আসি।
— ঠিক আছে, আয়। বেশী রাত জাগিসনা।
আফরাহ বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি শুয়ে পড়লাম। এতক্ষণ যে খারাপ লাগাটা কাজ করছিল, সেটা সরে গেছে। অনেকটাই হালকা লাগছে নিজেকে।
জানিনা, আর কতটা দিন এভাবে আমার বোনটা ত্যাগ স্বীকার করে যাবে, ওকে কতদিন আগলে রাখতে পারব।
যাদের সাথে ও যুদ্ধে নামে তারা যে কতটা ভয়ানক সেটা ভেবেই আতকে উঠি।
বোন তো বলে, ওরা আমাদের একপ্রকার শত্রু। এরা কখনো মানুষের ভালো চায়না, ক্ষতি করে বেড়ায় সবসময়।
এদের থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলতে হবে।
হঠাৎ প্রচন্ড এক ঝাকুনিতে ঘরটা কেপে উঠল। ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। রুমের লাইটগুলো নিজে থেকে জ্বলতে-নিভতে লাগল। দেয়ালে কালো ছায়া পড়ল, ছায়াটা যেন এদিক ফিরে আমাকেই দেখছে।
কাপা কাপা কন্ঠে আফরাহকে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ ই বের হলনা। ছায়া একটু শব্দ করে উঠল,
— হুসসস।
শব্দ দিয়ে আমাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিল। আমি চুপ করে ছায়াটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। চোখে হঠাৎ-ই ঘুম নেমে আসছে, তাকিয়ে থাকতে পারছিনা এমন অবস্থা।
তারপর আর কিছু মনে নেই।
সকালে উঠে কাল রাতের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম, তেমন কোনো কিছুই মনে পড়ছেনা ঠিক। এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নাস্তা বানিয়ে বোনের রুমে ঢুকলাম। লাইট টা এখনো জ্বলছে, অনেক রাত অবধি জেগে ছিল বোন। অনেকগুলো বই-জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সব তুলে জায়গামত গুছিয়ে রাখলাম। রুমটায় কেমন জানি ভ্যাপসা গন্ধ আর কালো কালো দাগ লেগে আছে মেঝেতে।
বোনকে ডাকতে গিয়েও ডাকলামনা।
এসব নিয়ে আমার বেশী প্রশ্ন করা ওর নিষেধ। জায়গাটা ভালো করে মুছে রুম স্প্রে ছড়িয়ে চলে এলাম।
.
(চলবে)