জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ২৫,২৬

0
1682

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ২৫,২৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২৫

ইফা কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে শাহরকে বলল, “আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন?” শাহর ইফার হাত ধরে বলল, “চলো, দিচ্ছি।” ইফা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বার বার বাহিরে তাকাচ্ছে। ভাবছে, রেহজান তার অপেক্ষা করবে তো? অবশেষে হাত ছাড়াতে না পেরে নিরুপায় হয়ে ইফা শাহরের সাথে ভিতরে যায়। শাহর তার হাত ধরে রেখেই পেয়ালায় পানি নিচ্ছে। ইফা শাহরের এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয়। কেন জানি তার মনে হচ্ছে পাশে থাকা ব্যক্তি শাহররূপি কোনো জ্বীন। ইফা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল, “শাহর আপনার মনে আছে আসার আগে আপনি আমায় কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন?” কথাটা শুনে শাহর থতমত খেয়ে তার দিকে তাকায়। হেসে হেসে বলে, “কি প্রতিশ্রুতি?” “বিয়ের আগে আপনি আমার হাত স্পর্শ করবেননা!” এই কথায় শাহর হতভম্ব হয়ে তাৎক্ষণিক তার হাত ছেড়ে দেয়। ইফার বুঝতে বাকি রইলনা এই ব্যক্তি শাহর নয়। ইফা মনে সাহস সঞ্চার করে শাহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এখানে কিভাবে এলাম আপনাকে সবটা খুলে বলছি। আপনি আমার সাথে আপনার আম্মার কামরার চলুন। উনাকে জিজ্ঞেস না করে বলা আমার অপরাধ হবে।” শাহর বিব্রত চাহনীতে তার দিকে তাকায়। পানির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলে, “আম্মা এখন ঘুমাচ্ছে। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। আমি কাল সকালে শুনব। এই নাও পানি, খেয়ে কামরায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ো।” ইফা পানি খেয়ে সাধারণভাবে বিদায় জানিয়ে কামরার দিকে হাঁটা দেয়। শাহর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ইফা কিছুক্ষণ বাদে কামরা থেকে বেরিয়ে আশেপাশে উকি মারল। কোথাও শাহরকে দেখতে না পেয়ে সর্তকতার সাথে পা টিপে টিপে দরজার বাহিরে এসে দাঁড়াল। চারদিকে ভালো করে নজর বুলাল, রেহজান বা খাদেমাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা। তবে ওরা তাকে ফেলে চলে গেল? ইফা চিন্তায় পড়ে যায়, “রেহজান আপু তাকে ফেলে যাওয়ার মত মেয়ে নয়! তবে কি আপু তার অনুপস্থিতি টের পায়নি?” ভাবতে ভাবতে ইফা হাঁটা শুরু করে। যতটুকু শুনেছিল পাহাড় বেশী দূরে নয়, প্রায় ২০মি. এর পথ। ইফা চোখের উপর হাত উচিয়ে পাহাড় দেখার চেষ্টা করল। খানিকটা দূরে পাহাড়ের কিছু অংশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য করে ইফা দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। বাহিরে উজ্জ্বল চাঁদের জ্যোৎস্না, তাই আলো ছাড়া হাটতে তার সমস্যা হচ্ছেনা। চারদিকে কেমন এক সুন্দর সুবাস ছড়িয়ে আছে। ইফার বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। পরক্ষণে ইফার মনে হল কেউ তার পিছু নিয়েছে। তার শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসছে, শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল রেহজানের কন্ঠ। তাকে পিছন থেকে বারবার ডাকছে। ইফা থমকে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঢোক গিলল, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে আরো উচ্চস্বরে তাকে ডাকা হল। ইফা পিছু ফিরে তাকালনা, দ্রুতপদে হাঁটা শুরু করল। বুকের কাছে কোরআন-শরীফ শক্ত করে চেপে ধরে অনবরত আয়াতুল কুরসী পাঠ করতে লাগল। বের হওয়ার আগে রেহজান তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে, ” হাঁটার সময় কিংবা নামায পড়াকালীন যে-ই ডাকুক পিছু ফিরে তাকাবিনা। বেশী ভয় লাগলে আয়াতুল কুরসী পড়বি।” ইফা তখন হেসে বলেছিল, “আপু তো তুমি তো আমার সাথে থাকবে। ভয় কেন পাব?” রেহজান উত্তরে বলেছিল, “আমার মন টা কেন জানি খচখচ করছে।” ইফা খানিকক্ষণ পর আর ডাক শুনতে পেলনা। তাও ভয়ে ভয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে আরো দ্রুত হাঁটতে লাগল। রেহজান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আশেপাশে একবার তাকাল, চারদিকে ঘন বিশাল বিশাল ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাকসহ বিভিন্ন শব্দ ভেসে আসছে। তাতে এই আবছা অন্ধকার পরিবেশ ভয়ংকর লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে এল সে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলনা রেহজান। দরজার বাহিরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে কিসের এক ঘোরে সে একা’ই হাঁটা শুরু করেছিল। এখন হুঁশে আসার পর নিজেকে ঘন ঝোপঝাড় ভর্তি জঙ্গলে আবিষ্কার করে। রেহজানের খানিকটা ভয় করতে লাগল। কিভাবে বের হবে এখান থেকে? সবগুলো পথ একইরকম লাগছে। ভেবে ভেবে সামনের সরু পথে এগোয়, কিছুক্ষণ হাঁটার পর খেয়াল করল ঘুরে ফিরে সে একই জায়গায় চলে এসেছে। এভাবে একে একে ডান-বামের পথে গিয়েও পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে এসেছে রেহজান। এবার সে সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। চারপাশের ঝোপঝাড় এত ঘন যে সে বুঝতে পারছে না বের হওয়ার রাস্তা কোনদিকে? হঠাৎ তার ভাবনায় আসে, “এই কোনো জ্বীনের কারসাজি না তো?” ছোটবেলায় একবার শুনেছিল জ্বীনরা মানুষের পথ ভুলিয়ে বারবার একই জায়গায় নিয়ে আসে। রেহজান মনে সাহস সঞ্চার করে আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে সামনে পথে এগোতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে জঙ্গল থেকে বের হতে সক্ষম হয়। রেহজান মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দরজার সামনে ফিরে আসে। খাদেমা আর ইফাকে কোথাও দেখতে পেলনা সে। এক অজানা আশংকায় রেহজানের হৃদপিন্ড কেঁপে উঠে। ইফাকে নিয়ে একগাদা দুশ্চিন্তায় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ইফার নাম ধরে কয়েকবার উচ্চস্বরে ডেকেও কোনো সাড়া পেলনা রেহজান। খাদেমা ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রেহজানকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” রেহজান হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ইফা কোথায়?” খাদেমা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “ও এখানে নেই। আমি তো ওকে বের হতেও দেখিনি। আমার মনে হয় ও কোন ফাঁকে পাহাড়ে চলে গেছে।” রেহজানের কলিজার পানি শুকিয়ে আসে, মনের মধ্যে বারবার কু-ডাক ডাকছে। খাদেমার হাত থেকে আলোর কুপি নিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে সে। ইফা পাহাড়ের চূড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবশেষে নির্বিঘ্নভাবে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইফা। জোরে জোরে হেঁটে কিছুটা হাপিয়ে উঠেছে সে। চূড়ার গুহায় বিছানো পাটির উপরবিশ্রাম নিতে বসে। আশে-পাশে উঁকি দিয়ে রেহজানকে না দেখতে পেয়ে তার ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। “তবে কি রেহজান আপু ও তার মত কোনো বিপদে পড়েছে?” এই ভেবে দ্রুত গুহা থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসে ইফা। আরেকটু এগিয়ে আসতে চোখে পড়ে রেহজান তার দিকেই আসছে। তার চোখ দুটো’তে খুশির ঝলক দেখা যায়। রেহজান এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ইফা হাসিমুখে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি? আমার যে কি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল!” রেহজান ইফার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “চলো এখান থেকে।” ইফা অবাক হয়ে রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন আপু? আমরা তাহাজ্জুদের নামায পড়ব না! এখনো তো অনেক সময় আছে।” রেহজান রাগান্বিত দৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকায়। ইফাকে চড় দেওয়ার জন্য হাত উচিয়ে তোলে। ইফা আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলে। চড় দেওয়ার আগমূহুর্তে রেহজানের গায়ে কোথা থেকে কুপির আগুন এসে পড়ে। ইফা তাকিয়ে দেখে রেহজান কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। রেহজানরুপী ব্যক্তি হুংকার ছাড়তে ছাড়তে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রেহজান এগিয়ে এসে ইফাকে জড়িয়ে ধরে। ইফা রেহজানকে পেয়ে বাচ্চাদের মত ফ্যাল ফ্যাল করে কেঁদে উঠে। ইফাকে কোমলভাবে সামলে তাকে নিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকে রেহজান নামাযের প্রস্তুতি নেয়। দুজন নামায পড়াকালীন টের পায় বাহিরে বিভৎস রকমের তান্ডব হচ্ছে সাথে ভয়ংকর রক্তহিম করা শব্দ। গুহার মুখে অনেক ছোট টুকরো পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। ভয়ে ইফার চোখ-মুখ শুকিয়ে যায় তবুও নামায থেকে বিরত থাকেনা কেউ ই। নামায শেষ লম্বা মুনাজাতে কান্না ভেঙ্গে পড়ে রেহজান। ইফা ও কেঁদে কেঁদে মুনাজাতে দুয়া করে। অতঃপর দুজন কুরআন পড়তে বসে, গুহার ভিতরে জ্বালানো কুপির আবছায় দুজনে মিষ্টি সুরে তিলাওয়াত করে। প্রায় অনেকক্ষণ আগে বাহিরের তান্ডব বন্ধ হয়ে এসেছে, দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে ফযরের আযান। দুজন নামায আদায় করে একসাথে গুহার মুখে এসে দাঁড়ায়। স্বল্প আলোয় দেখতে পায় অসংখ্য পাথর এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। খাদেমা তাদের সালাম জানিয়ে গুহার ভিতরে আসে। দুজনের চোখে কাপড় বেঁধে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের কামরায়। কামরায় ঢুকে ইফা বাধঁন খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। দুহাত মাথার নিচে রেখে রেহজানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে, “এরা আমাদের চোখ কেন বেঁধে দেয়? কই কাল রাতে তো বাঁধেনি!” রেহজান ইফার পাশে শুয়ে বলল, “আমার ধারনা হচ্ছে এটা ওরা নিরাপত্তার খাতিরে করে। রাতের বেলা আধাঁর ছিল তাই হয়ত দেয়নি, তাছাড়া কাল রাতে ঘটা ঘটনাগুলো ও কারণ হতে পারে। জানতাম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ হবেনা। আল্লাহর রহমতে আমরা পেরেছি।” ইফা আনমনে হতাশার কন্ঠে বলে, “শাহরকে কবে দেখতে পাব আপু? আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।” রেহজান ইফার কথায় গভীর চিন্তার অতলে তলিয়ে যায়।
রেহজান ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের আযান কানে ভেসে আসছে। ইফাকে ডাকতে ডাকতে উঠে বসে চুলে হাতখোপা করে ঘোমটা টেনে নেয় রেহজান। সেই সকালে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেউ তাদের এরমধ্যে ডাকেও নি, কি অদ্ভুত! রেহজানের ডাকে ততক্ষণে ইফা উঠে বসে। ইফা চোখ ডলতে ডলতে বলে, “সন্ধ্যা হয়ে গেছে?” রেহজান মাথা নাড়িয়ে বলে, “হুম। চল আগে নামায সেরে নিই।” নামায শেষ করে উঠতেই খাদেমা এসে কামরায় প্রবেশ করল। খাদেমাকে দেখে রেহজান প্রশ্ন করে, “এত বেলা হয়ে গেল, আপনি আমাদের ডাকতে এলেন না যে!” খাদেমা প্রত্যত্তুরে বলে, “আমি ব্যস্ত ছিলাম। তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।” ইফা ভ্রু কুচঁকে প্রশ্ন করে, “আপনার বেগম কোথায়? উনি কি আমাদের ফিরে আসার কথা জানেন না?”
— “উনি জ্বীনরাজ্যে নেই। জরুরী প্রয়োজনে বেরিয়েছেন। ফিরলে অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।” এই বলে খাদেমা বেরিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর অন্য এক মেয়ে এসে তাদের খাবার দিয়ে গেল। ইফার এখন বেশ বিরক্তবোধ হচ্ছে। এত কষ্ট করে মহিলার দেওয়া নির্দেশ মেনে সব করার পরও শাহরের দেখা পাচ্ছেনা। বুকের ভিতর তীব্র হতাশা বন্দি পাখির ন্যায় ডানা ঝাপটাচ্ছে। রেহজান ইফার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, “চিন্তা করিসনা। আশা করি উনি উনার প্রতিশ্রুতি রাখবেন।” রেহজানের কথায় ইফার মন ভার কমলনা। ওর হঠাৎ ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। মামার কথা খুব মনে পড়ছে। মামা কি তার খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন? এখান থেকে ফিরে সে মামাকে কি জবাব দিবে? আর এখান থেকে সে কবে ফিরতে পারবে! ইফা চুপচাপ উঠে গিয়ে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে রইল। রেহজান ইফার এই অবস্থা দেখে তাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর ইফা চোখ মেলে উঠে বসে। কামরায় রেহজানকে কোথাও দেখতে পেলনা। মন ভার করে উঠে কামরার বাহিরে চলে এল রেহজানকে খুঁজতে। কামরা থেকে বেরিয়ে দেখে পুরো মহল আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আশেপাশে কেউ নেই। ইফার মাথায় বুদ্ধি আসে, “এখন সে শাহরকে একনজর দেখে আসবে। কেউ টের পাবেনা।” এই ভেবে অন্দরমহলের দিকে হাঁটা দেয় ইফা। রেহজান গোসল সেরে কামরায় ফিরে ইফাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবনায় পড়ে, “খাদেমা কি ইফাকে ডেকে নিয়ে গেছে?” ইফাকে ডাকতে ডাকতে সেও ভিতর মহলের দিকে চলে যায়। ইফা সেই জায়গায় এসে দাঁড়ায় যেখানে এসে সেদিন শাহরকে বসে থাকতে দেখেছিল। মৃদ্যুকন্ঠে শাহরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভিতরের দিকে যায় সে। এমনসময় আবছা আলোয় দেখে কেউ তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা শাহর ভেবে দৌড়ে কাছে এসে দেখে একজন আগন্তুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার লালরঙ্গা চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। উপরের অংশ দেখতে ছাগল জাতীয় প্রাণীর মত, পা দুটো ঘোড়ার মত। মাথা কুকুরের ন্যায়, তাতে দুখানা মস্ত শিং। প্রাণীটি তার ভাল্লুকের মত ঘন পশমওয়ালা লম্বা নখযুক্ত হাত দিয়ে ইফার গলা শক্ত করে চেপে শুন্যে উঠিয়ে নেয়। ইফা চাইলেও চিৎকার করতে পারছে, গলা চেপে ধরার যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে সে মারা যাবে। রেহজান ভিতরমহলে এসেও ইফাকে পায়না। চারদিকে এত আবছা অন্ধকার দেখে তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এমনসময় ভারী কিছু একটা গড়াতে গড়াতে তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। হাতের আলোর কুপি দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে দেখে ইফার ছিঁড়ে ফেলা মাথা। দেখে চিৎকার করে দুপা পিছিয়ে যায় রেহজান। পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘুরে তাকায় সে। দেখতে পায় বিভৎস কদাকার চেহারার একজন অর্ধউলঙ্গ লোককে। তার শরীর থেকে পুঁজ পড়ছে, মাথার খুলির এক অংশ বেরিয়ে এসেছে। এসব দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রেহজান। চিৎকার করার মত শক্তিটুকুও সে পাচ্ছেনা। লোকটি এগিয়ে এসে রেহজানকে দূরে ছুড়ে মারে। ছিটকে এসে দেয়ালের সাথে বাড়ি খায় সে। যন্ত্রণায় কোকড়ে উঠে রেহজান। লোকটা আবার এগিয়ে আসছে তার দিকে।
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-২৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

ইফার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমূহুর্তে অদ্ভুত- কিম্বাকার প্রাণীটির হাতে কেউ আঘাত করে, সাথে সাথে প্রাণীটি তাকে ছেড়ে দেয়। শুন্য থেকে মেঝেতে পড়ার আগে কেউ তাকে কোলের মধ্যে ঝাপটে ধরে। ভয়ে সে তখন হিতাহিতজ্ঞান শূন্য, আধবোজা চোখ মেলে তাকানোর মত সাহস হচ্ছেনা। খানিকক্ষণের মধ্যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। রেহজানের সামনে এসে দাঁড়ায় আলফি। হুংকার ছেড়ে বলে, “তোমাকে হুকুম করছি এখান থেকে চলে যাও, নতুবা জান নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবেনা।” আলফির কথায় আগন্তুক অদৃশ্য হয়ে যায়। আলফি রেহজানের দিকে ফিরে তাকিয়ে তার কাছে এসে বলল, “রেহজান তুমি এখানে?” রেহজানের তখনো হাত-পা কাঁপছে। সর্বাঙ্গে ঘাম ছুটছে, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। অস্পষ্ট ভাবে কেঁদে কেঁদে বলল, “ইফা কোথায়? ইফাকে খুঁজে দাওনা…” আলফি রেহজানকে একটানে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তাতেও রেহজান শান্ত হচ্ছেনা। আলফি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ” একটু শান্ত হও। আমি ইফাকে খুঁজে আনব। চলো আমার সাথে।” রেহজান ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইফার ছেড়া মাথাটা যেখানে দেখেছিল সেখানে একনজর তাকায়, সেখানে ইফার বিচ্ছেদ্য মাথাটা নেই। রেহজানের কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আলফির হাত চেপে ধরে বলল, “ইফার কাটা মাথা এখানে ই ছিল। কোথায় গেল? ইফাকে কি খারাপ জ্বীনগুলো মেরে ফেলেছে?” ভিতর ঘর থেকে শাহরের গলার স্বর ভেসে আসে, ” ভাই, দ্রুত এদিকে আসুন। ইফা এখানে।” আলফি রেহজানকে শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, “ইফার কিচ্ছু হয়নি। জ্বীনগুলো তোমাকে ভয় দেখিয়ে দূর্বল করে আক্রমণ করার জন্য ই এমন ভ্রম সৃষ্টি করেছে।” রেহজান ইফার মাথার কাছে বসে আছে, ইফার ডান হাত শক্ত করে ধরে অপলক ইফার দিকে তাকিয়ে তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। আলফি আর শাহর বিছানার অন্যপ্রান্তে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রেহজান এখনো স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলছেনা, এই কারণে দুজনের উদ্বিগ্নতা আরো বাড়ছে। প্রায় কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইফার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরা মাত্র সে রেহজানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। শাহর ইফার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে আলফি বাধা দিয়ে বলল, “ওদেরকে স্বাভাবিক হতে দাও।” রেহজান ইফার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “আল্লাহর রহমতে তোর কোনো ক্ষতি হয়নি। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।” ইফার চোখ পড়ে শাহর আর আলফির দিকে। আচমকিত হয়ে প্রশ্ন করে, “তোমরা?” রেহজান কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল, “ওরা আমাদেরকে উদ্ধার করেছে।” ইফা আতংকিত চোখে রেহজানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “আপু ওরা কি সেসব ব্যাপার সম্পর্কে জানে? মহিলা আমাদের বারবার বারণ করেছেন। এর জন্য উনি আমাদেরকে আবার ওদের থেকে বিচ্ছেদ করে দিবেন না তো?” রেহজান প্রত্যুত্তরে কিছু বলেনা, গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে। শাহর এগিয়ে এসে ইফার হাত শক্ত করে ধরে, তারপর ঠোটের কাছে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে বলল, “ইফা তুমি এখানে কিভাবে এসেছো? কখন এসেছো?” ইফা বাকা চোখে একবার রেহজানের দিকে তাকায়। শাহরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। আলফি রেহজানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এসো আমার সাথে।” রেহজান ইতস্ততবোধ নিয়ে আলফির হাত ধরে তার সাথে চলে যায়। শাহর দু’হাতে ইফার গাল জড়িয়ে বলক, “ভয় পেয়োনা। আমি তোমার পাশে আছি, নির্ভয়ে আমাকে সবটা খুলে বলো।” রেহজান নিচুগলায় আলফিকে সব বলার পর আলফি এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। রেহজানের কপালে ছোট স্পর্শ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। রেহজান চোখ বন্ধ করে আলফিকে জড়িয়ে ধরল। এতদিন পর সে প্রশান্তি অনুভব করছে, সে চাচ্ছে এই মূহুর্ত যেন কখনো শেষ না হয়। আলফি কান্না থামিয়ে রেহজানের গালে হাত রেখে বলল, “এসব করতে ভয় করলনা? যদি খারাপ কিছু হয়ে যেত!” রেহজান মুচকি হাসে, আলফির হাতের উপর হাত রেখে বলল, “ভালোবাসায় ভয় কিসের? ভয় পেলে তোমাকে জয় করে নিতাম কিভাবে? তোমার সাথে সারাজীবন একসাথে কাটানোর চাইতে আর কোনোকিছুই অধিক মূল্যবান নয়।” শাহর ইফার মুখে সব শুনে অবাকদৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তারপর ইফার গাল হালকা টেনে দিয়ে বলল, “পিচ্চি মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন দুঃসাহসিক কাজ করতে ভয় পায়না… আগে তো জ্বীন দেখেই অজ্ঞান হয়ে যেত।” ইফা গাল ফুলিয়ে অভিমান দেখায়, “মোটেও না।” শাহর দুহাতে ইফার গলা জড়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল, “এতকিছু কেন করলে?” ইফা চোখ বন্ধ করে বলল, “আপনাকে আজীবনের মত নিজের করে নেওয়ার জন্য, আপনাকে অনেক বেশী ভালোবাসার সুযোগ হারাতে চাইনা বলে…..” শাহরের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল। তার হৃপিন্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে, ইফা তাকে তার নিজের চেয়েও বেশী ভালোবাসে এই যে তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ইফার কন্ঠ শুনে রেহজান আলফির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখে-মুখে তার লজ্জার আভাস। আলফি তার খুব কাছাকাছি এসেছিল, এতটাই কাছে যে আলফির নিঃশ্বাস তার মুখের উপর পড়ছিল। শাহর আলফির দিকে এগিয়ে এসে বলল, ” ভাই আম্মাকে ফেরার জন্য জরুরী তলব করো।” আলফি মাথা নাড়িয়ে বাহিরে চলে যায়।

কামরায় শাহর-ইফা, আলফি-রেহজান আর তাদের আম্মা সহ সবাই মুখোমুখি বসে আছে। ইফা ভয়ার্ত চেহারায় শাহরের জামার হাতা খামচে ধরে আছে আর বারবার রেহজানের দিকে তাকাচ্ছে। রেহজান কপালে ভাঁজ ফেলে মহিলার মুখাবয়বের তাকিয়ে তার মেজাজ বুঝার চেষ্টা করছে। আলফি শান্তকন্ঠে বলল, “আম্মা আপনি আমাদেরকে এসব জানাননি কেন? ওদের এমন ভয়ংকর পরীক্ষায় ফেলা কি খুব জরুরী ছিল?” শাহর ও আলফির
সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আম্মা, ওদের যদি কোনো বিপদ হত আপনি কি তার দায় নিতে পারতেন? আর এভাবে তাদেরকে একা মহলে রেখে যাওয়া উচিত হয়নি!” তাদের আম্মা অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে তাকায়, নীচুকন্ঠে বলল, “তোমরা দুজন তাদের জন্য নিজের জাতি-শক্তি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তাই আমি এটা জানার আগ্রহ হল এরা কি সত্যি তোমাদের যোগ্য!” তারপর উনি একটু থেমে বললেন, “জ্বীনের সাথে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জ্বীনের আসল চেহারা তাদের দেখা উচিত। তাই আমি ওদেরকে একা মহলে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি তারা হিংস্র হয়ে ওদের মারতে চাইবে…” উনি ইফা আর রেহজানের দিকে এগিয়ে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা সত্যিই আমার পুত্রদের যোগ্য সহধর্মিণী। আমি তোমাদের বিবাহে সম্মতি দিলাম। আলফি শাহর তোমরা কি সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত? কোনো সংশয় নেই তো?” আলফি তার মায়ের হাত ধরে বলল, “না আম্মা আমাদের কোনো সংশয় নেই। আপনি শুধু দোয়া রাখবেন।” মহিলা হেসে বললেন, “তাহলে এখানে বিয়ের আয়োজন করি?” ইফা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “ভুল মার্জনা করবেন বেগম। আমার পরিবার কে ছাড়া আমি এভাবে বিবাহ করতে ইচ্ছুক নই। আমার মামা হয়ত আমার খোজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে, আপনি আমাদেরকে আমাদের স্থানে পাঠিয়ে দিন।” রেহজান ও ইফার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আমার ও তাই মত। আমাদের পরিবারের অবর্তমানে বিবাহ করতে চাচ্ছিনা।” মহিলার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। তাও আদুরে গলায় বললেন, “আমি তো সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবনা। তাই চাচ্ছিলাম এখানে বিয়েটা হোক। প্রয়োজন হলে তোমাদের পরিবারের লোকদের উপস্থিত করা হবে…” রেহজান আতকে উঠে বলল, “সেটা আমাদের জন্য ভালো হবেনা। অন্যদের কাছে ওদের জ্বীনপরিচয় আমরা প্রকাশ করতে চাইনা, সবাই ওদের এড়িয়ে চলবে। কিংবা পরিবারের কেউ ওদের জামাই হিসেবে মানতে চাইবেনা।” মহিলা রাগে ভীষণ ফোস ফোস করতে লাগলেন, তার রোষানলপূর্ণ দৃষ্টিতে বারবার রেহজান আর ইফার দিকে তাকালেন। হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন…
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here