জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ২৭,২৮ শেষ

0
3418

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ২৭,২৮ শেষ
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২৭

গম্ভীরমুখে নিজের কামরার পালঙ্কে পা তুলে বসে আছেন শাহর-আলফির আম্মা। খাদেমা নিরবে কামরায় প্রবেশ করে সালাম দিল। সালামের উত্তর না পেয়ে প্রশ্ন করল,
– “বেগম আপনি কি নিয়ে এত চিন্তিত?” খাদেমার প্রশ্নে মহিলার ধ্যান ভাঙ্গল। রাগে ফুসতে ফুসতে বললেন, “আমি তো মানুষের মেয়ে দু’টো কে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। তবুও ওরা আমার কথার বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করলনা। আমার পুত্ররাও ওদের কথাকে স্বীকৃতি দিল।” খাদেমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “শান্ত হন বেগম। ওরা হয়ত সমস্যার কারণে’ই এভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।” মহিলা ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে খাদেমার দিকে তাকাল। তাতে খাদেমা ভয়ে চুপসে গেল। তারপর মহিলা নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগল, “আমি এর শেষ দেখে তবে ক্ষান্ত হব।” ইফা আর শাহর ভিতর মহলের বারান্দায় পাশাপাশি বসে আছে। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আলফি আর রেহজান। ইফা একবার তাদের দিকে দৃষ্টিপাত দিল। আলফি কিসব জানি বলছে তাতে রেহজান মুখ টিপে টিপে হাসছে আর আলফির চুলে আলতো করে হাত বুলাচ্ছে। ইফার দৃষ্টি অনুসরণ করে শাহর ও ওদের দিকে তাকাল। তারপর ইফাকে জড়িয়ে বুকের একপাশে টেনে নিয়ে এনে বলল, “মন খারাপ তোমার?” ইফা কাদো কাদো মুখ করে বলল, “আমি বাড়ি যাব।” শাহর ইফার মুখের আর বাচ্চার মত কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ইফার গাল টেনে দিয়ে বলল, “যাব তো। আম্মা একটু শান্ত হলে তার অনুমতি নিয়ে আমরা বাড়ি যাব। তারপর….” ইফা কৌতূহলী কন্ঠে বলল, “তারপর কি?” শাহর ইফার নাক টেনে বলল, “এই পিচ্চিটাকে বউ বানিয়ে নিব।” ইফা খানিকটা লজ্জা পেয়ে শাহরের বুকে মুখ লুকোয়। এইসময় তাদের আম্মা এসে উপস্থিত হন। তারা তড়িঘড়ি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে শালীনভাবে দাঁড়ায়। মহিলা গম্ভীরমুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমি তোমাদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। তবে তোমাদের বিবাহে আমি উপস্থিত থাকব। আর বিবাহের সমস্ত আয়োজন আমার ইচ্ছে অনুযায়ী করতে চাই। এতে তোমাদের আপত্তি নেই তো?” রেহজান আর ইফা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, “নাহ আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনাদের আসল পরিচয় যাতে প্রকাশ না পায় এমনভাবে করুন।” মহিলা ঘনঘন মাথা নাড়ালেন, ঠোটের কোণে তার অদ্ভুত রহস্যময় হাসি।
ইফাকে দেখে আশফাক সাহেব উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এতদিন কোথায় ছিলিরে তুই?” ইফা একনজর শাহরের দিকে তাকায়। কিছুটা দম নিয়ে বলল, “মামা আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল তখন শাহর ই আমাকে উদ্ধার করে। মানসিক অবস্থা তেমন ভাল না থাকায় শাহরের বাড়ীতে’ই ছিলাম।” আশফাক সাহেব কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, “তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাচ্ছিনা!” শাহর অবাকদৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পিচ্চি ইফা কখন যে বড়দের মত কথা বলতে শিখে গেল। আলফি আর রেহজান বাসায় প্রবেশ করামাত্র রওনক এসে রেহজানকে হাজার প্রশ্ন করতে শুরু করল। রেহজান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোমলকন্ঠে বলল, “আমাকে একটু জিরোতে দিবি?” রওনক রেহজান এমন কোমলস্বরে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। সে যখন ই রেহজানকে বকাবকি করত কিংবা বাড়াবাড়ি রকমের প্রশ্ন করত তখন রেহজান উল্টো তাকে বকা দিয়ে চুপ করাত। আজ বোনের অন্যরুপ দেখে আলফির দিকে ভ্রু কুচকে তাকালে আলফি সবক’টা দাত দেখিয়ে বোকামার্কা হাসি দেয়।
শাহর-আলফির আম্মা মাঝবয়সী মহিলার বেশে ইফার বাড়ীতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসলেন। ইফার মামা ভ্রু কুচকে একবার মহিলাকে পরখ করে দেখলেন। এটা জেনে বেশ অবাক হলেন শাহর-আলফি দু’জন আপন ভাই। মহিলা মুচকি হেসে বললেন, “ভাই আপনার মেয়েটাকে আমার শাহরের বউ হিসেবে চাই। না করবেননা, আমি কিছুদিন পর হজ্জ্বের জন্য রওনা দিব। তাই দেরী করতে চাইনা।” শেষমেষ ইফার মামা আশফাক সাহেব মত দিলেন। ইফা আর রেহজান মহিলার কাছে এসে বসল। ইফা বলল, “আম্মা আপনি আমাদের ডেকেছিলেন?” মহিলা উৎফুল্ল দেখিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি তোমাদের পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করিয়েছি। বিয়ের তারিখ ও ঠিক করা হয়েছে। বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেলছি। আমি চাচ্ছিলাম বিয়ের আগে তোমরা আর আমার ছেলেদের সাথে দেখা না করো, কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ স্থগিত রাখো। আর যেহেতু তোমাদের দুজনের’ই মা এখানে উপস্থিত নেই তাই আমি তোমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নিচ্ছি। এই কয়েক’টা দিন তোমরা আমার কাছেই থাকো।” রেহজান আর ইফা আপত্তি করলনা। আলফি আর শাহরকে রুস্তমের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, রেহজান আর মহিলা ইফাদের বাসায় থেকে গেল। মাঝরাতে দরজায় কারো নক করার আওয়াজে মহিলা অতি সন্তুপর্ণে দরজা খুললেন, খাদেমা চাদর মোড়ানো অবস্থায় ভিতরে ঢুকার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “যা আনতে বলেছিলাম এনেছো তো?” খাদেমা চাদরের নিচ থেকে একটা রৌপ্যের কৌটা বের করে মহিলার হাতে দিতে দিতে বললেন, “আপনি কি তাদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিচ্ছেননা?” মহিলা কৌটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ক্রোধমিশ্রিত স্বরে বলল, “এমন অবাধ্য মেয়েদের আমি নিজের মেয়ে হিসেবেও কখনো মানতামনা… এত বড় দুঃসাহস এদের আমাকে হেয় করে? আমার কথাকে মূল্যায়ন করেনা? আমিও দেখব এরা কিভাবে এই দুনিয়ায় সুখে সংসার করে!”
খাদেমা আকুতিভরা কন্ঠে বলল, “এমন করবেননা বেগম। আপনার পুত্রদের কি হবে? তাদের সুখের কথা চিন্তা করবেননা?” মহিলা উপহাসের হাসি হেসে বলল, “আমার পুত্রদের আবার বিয়ে দিব। এই ভেষজের প্রভাবে ওরা ধীরে ধীরে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে, একসময় নিজেরা নিজেদের সহ্য করতে না পেরে নিজেকে মরতে বাধ্য হবে। আমার পুত্ররা একটু শোকাহত হবে বটে, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।”
খাদেমার কিছুটা খারাপ লাগছে রেহজান আর ইফার জন্য। এমন ভালো মেয়ে সে খুব কম ই দেখেছে, কিন্তু তার কিছু করার নেই। দায়িত্বের কাছে তার হাত-পা বাঁধা। চাইলেও রেহজান-ইফার করুণ পরিণতি সে আটকাতে পারবেনা…

ইফা হাতে থালাভর্তি খাবার নিয়ে মহিলার কক্ষে প্রবেশ করল। মহিলাকে কক্ষে না দেখে কয়েকবার ডাকল, সাড়া না পেয়ে চলে যেতে উদ্ধত হতে গিয়ে দেখে মেঝেতে একটা রৌপ্যের কৌটা পড়ে থাকতে দেখল। কৌটা থেকে এমন উদ্ভত গন্ধ আসছে। রেহজান কৌতূহলে সেটা হাতে নেওয়ামাত্র মহিলা কক্ষে প্রবেশ করলেন। ইফার হাতে কৌটা দেখে মহিলা হুংকার ছেড়ে বললেন, “তুমি এখানে কি করছো?” সাথে সাথে ইফার হাত থেকে কৌটা কেড়ে নিয়ে বললেন, “অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করোনা নাকি!” ইফা অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বলল, “ক্ষমা করবেন। আপনি ঘরে ছিলেননা সেটা আমি জানতামনা।”
– “তাই বলে আমার জিনিসপত্রে হাত দিবে?” ইফা মহিলার ধমকে একটু ভয় পেয়ে গেল, সামান্য কৌটায় হাত দেওয়ায় এভাবে বকছে ভেবে তার কান্না পাচ্ছে।
– “আম্মা কৌটা নিচে পড়ে ছিল। প্রয়োজনীয় হতে পারে ভেবে উঠিয়ে রাখতে গিয়েছিলাম, আমাকে ক্ষমা করবেন।” মহিলা একটু নরম হলেন, “আমার কক্ষে কি বোধ করে এলে?” ইফা কন্ঠে স্বাভাবিকতা এনে টেবিলের উপর থেকে থালা নিয়ে মহিলার সামনে রেখে বলল, “রেহজান আপু কিছু পিঠা-মিষ্টি বানিয়েছে। আপনারা তো এসব বেশ পছন্দ করেন। আমি খুব যত্নসহকারে আপনার জন্য পরিবেশন করে নিয়ে এসেছি।” মহিলা থালার দিকে তাকালেন। বিশাল থালায় কয়েকপ্রকার পিঠে-মিষ্টি সুন্দরভাবে সাজানো। দেখে তার লোভ লেগে যাচ্ছে, মোহনীয় গন্ধ তাকে টানছে। মহিলা গলা পরিষ্কার করে বলল, “ঠিক আছে তুমি যাও। আমি খেয়ে নিব।” ইফা নিরবে কক্ষ থেকে বের হয়ে উকি মেরে দেখল মহিলা গপাগপ করে খেয়ে নিচ্ছেন। তার দৃশ্যটা দেখে ভীষণ ভালোলাগল, সে পুনরায় কক্ষে ফিরে বলল, “আম্মা।” মহিলা খাওয়া বন্ধ করে চমকে উঠলেন, মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলতে পারছেননা। ইফার সামনে এই অবস্থায় ধরা পড়ে তার লজ্জা লাগছে। ইফা মুচকি হেসে বলল, “আম্মা আরো লাগলে বলবেন৷, এসব বিশেষ করে আপনার জন্য ই বানানো হচ্ছে। রেহজান আপু এখনো বানাচ্ছে। আপনার আরো প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন, আমি নিয়ে আসব।” বলে ইফা বেরিয়ে গেল। মহিলা একনজর সেদিকে তাকিয়ে রইলেন আর ভাবছেন, “মেয়েগুলো তাকে শ্বাশুড়ী হিসেবে বেশ সমাদর করছে…” এক মূহুর্তের জন্য তাদের ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে।

রেহজান আর ইফাকে সাজানো হচ্ছে। সাজের তদারকি করছেন স্বয়ং তাদের শ্বাশুড়ি। ইফার অনেক ইচ্ছে ছিল বাঙ্গালি সাজে বিয়ে করার। কিন্তু শ্বাশুড়ীর কড়া আদেশ গাউন-নিকাব পড়েই বিয়ে করতে হবে। অবশ্য তাতেও তাদেরকে খারাপ দেখাচ্ছেনা। দুজনের জন্য সবকিছু একই ধরণের এনে রেখেছেন মহিলা। তার শুভ্র সাদা রঙ অনেক পছন্দ, তাই তাদের গাউন-নিকাব সব সাদা। মাথার মুকুট আর সাদা পাথরের আংটি ছাড়া আর কোনো গহনা পরানো হচ্ছেনা। হাতে-পায়ে সাদা মোজা, কেবল সাজানো চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সাজ শেষ হলে রেহজান আর ইফা আয়নার দিকে তাকাল। ইফা মিনমিন কন্ঠে বলল, “আপু ইচ্ছে ছিল বিয়েতে বাঙ্গালী সাজ সাজব।” রেহজান হেসে বলল, “সাজ দেখে আমার নিজেকে আরবীয় রাজকুমারী মনে হচ্ছে। শ্বাশুড়ীমায়ের পছন্দ খারাপ না কি বলিস…!”
ইফা মাথা নাড়াল। সত্যিই নিজেকে আরবীয় দেশের রাজকন্যা মনে হচ্ছে। মহিলা দুটো দুধের গ্লাসে ভালো মত কৌটার ভেষজ মিশিয়ে নিলেন। চামচ নাড়াতে নাড়াতে রহস্যময় হাসি দিচ্ছেন। অতঃপর দুধের গ্লাস দুটো ট্রে তে নিয়ে রেহজান-ইফার কক্ষের উদ্দেশ্যে হাটা দিলেন।
রেহজান ইফার হাত ধরে বলল, “আমি জানি শ্বাশুড়ী আম্মা আমাদের উপর এখনো রেগে আছেন। তাই আমাদের উনার কোনো কথা ফেলা উচিত হবেনা। তাছাড়া আমরা উনার সাথে আজীবন থাকব ও না, বিয়ে শেষ হলে উনি ফিরে যাবেন। যতক্ষণ আছেন, তার কথা শুনে চলি। তাতে উনার রাগ কমে যাবে আর আমরা নতুন জীবন শুরুর ক্ষেত্রে দোয়া পাব।” ইফা উৎফুল্ল হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, “তাই হবে আপু।”
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্বঃ২৮ শেষ
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

শাহর-আলফির আম্মা দুধের গ্লাস দুটো নিয়ে ইফা’দের কক্ষে প্রবেশ করলেন। রেহজান আর ইফা তখন রওনকের সাথে গল্পে মশগুল। মহিলা একবার ওদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মেয়ে দু’টোকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে, যে কারো-ই চোখ ফেরানো দায়। মহিলা রওনককে নিজের কাছে ডাকলেন। রওনক এগিয়ে আসতে বললেন, “তোমার বর এখনো গাড়ী নিয়ে এলনা যে? ওরা কখন রওনা দিবে! তাড়াতাড়ি একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নাও তো মা।” রওনক মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রেহজান আর ইফা উঠে এসে মহিলাকে সালাম করল, ওদের এই কান্ড দেখে মহিলা একটু অবাক হল। তারপর মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন। সারাদিন তেমন কিছু খাওনি, তাই আমি একটু দুধ গরম করে আনলাম।” বলে ট্রে থেকে গ্লাস দুটো নিয়ে রেহজান আর ইফার হাতে দিলেন। ইফা একটু নাক কুচকে বলল, “আম্মা আমি তো দুধ খেতে পারিনা। না খেলে হবেনা?” মহিলা থতমত খেয়ে জোর দিয়ে বললেন, “উহু কোনো কথা নয়, পুরো দুধ শেষ করতে হবে। এটা নিয়ম।” রেহজান ইফাকে নিচুস্বরে বলল, “একটু কষ্ট করে খেয়ে নে। তখন কি বলেছিলাম মনে নেই!” ইফা মাথা নাড়াল, শ্বাশুড়ী-আম্মা কে খুশি করার জন্য একগ্লাস দুধ খাওয়া ই যায়। রেহজান-ইফা গ্লাসে চুমুক দিবে দেখে মহিলার চোখ দুটো চরম খুশিতে ঝলকানি দিচ্ছে। এমনসময় কেউ দরজায় নক করল, মহিলা একটু বিরক্ত হলেন। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তোমরা খাও, আমি দেখছি।” ভেজানো দরজা খুলে দিতে কক্ষে প্রবেশ করল সাদা আলখেল্লা-জোব্বা পরিহিত লম্বামতন এক সুঠানদেহী মাঝবয়সী লোক। তার মুখে কালো কাপড়ের মুখোশ। দীপ্তিমান চোখগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। এই অদ্ভুত লোককে দেখে ওরা না খেয়ে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলা লোকটিকে দেখে হকচকিয়ে উঠে বলল, “স্বামী আপনি এখানে?” পুরুষটি ইফা-রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল, “আমার পুত্র এবং তার জীবনসঙ্গীনিদের দোয়া দিতে এসেছি।” তার কথা শুনে ইফা ফিসফিস কন্ঠে বলল, “আপু উনি তাহলে আমাদের শ্বশুড়। কিন্তু উনাকে আগে কখনো দেখিনি কেন?” রেহজান চাপাস্বরে উত্তর দেয়, “আমি শুনেছি উনি প্রায়সময় ই তালীমের কাজে ব্যস্ত থাকেন। চল, সালাম করি।” রেহজান-ইফা সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন বাবা?” ওদের মুখে এত মায়াময় বাবা ডাক শুনে লোকটির বিরস চেহারায় প্রসন্ন ভাব দেখা গেল। উনি এগিয়ে এসে বললেন, “আল্লাহ আমাকে ভাল রেখেছেন। তোমাদের দুজনের ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি, আজ নিজচোখে দেখে মনে হচ্ছে আমার পুত্ররা বেছে বেছে খাটি হিরে খুজে নিয়েছে। দোয়া করি সুখী হও আর আজীবন সুখে-দুঃখে আমার পুত্রদের পাশে থাকো।” লোকটি ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার হাত লেগে একটি দুধের গ্লাস টেবিল থাকে মেঝেতে পড়ে যায়। লোকটি দুঃখী চেহারায় মেঝেতে বসে গ্লাসটির দিকে তাকিয়ে বলল, “দুঃখিত, আমি খেয়াল করিনি।” হঠাৎ উনি একটু চুপ থেকে উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে অপরগ্লাসটি হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে শুকে রেহজানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “এই দুধ তোমাদের জন্য কে এনেছে?” রেহজান একটু বিব্রত হয়ে উত্তর দিল, “আম্মা এনেছেন।” লোকটি এবার মহিলার দিকে এগিয়ে এল। ততক্ষণে মহিলার চেহারায় ভীতি ফুটে উঠেছে। লোকটি রাগমিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “এই দুধে গুল্ম ভেষজের গন্ধ কেন?” মহিলা আমতা আমতা করতে লাগলেন। লোকটি প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে বললেন, “ভেষজ কেন মিশিয়েছো? নিজের পুত্রবধূদের বদ্ধ উন্মাদ করতে চাও? তুমি আসলেই একজন মা?” মহিলা কান্নারত চেহারায় বলল, “আমাকে ক্ষমা করুন স্বামী। আমি রাগের চোটে এই কাজ করে ফেলেছি।” লোকটি দুধের গ্লাস ছুড়ে ফেলে বলল, “তোমার মত পাপীর জায়গা আর আমার পাশে নেই। তোমার সাথে আমি সম্পর্ক বিচ্ছেদ করব। তার আগে তোমার পুত্রদের তার মায়ের আসল রুপ দেখানো উচিত।” কথাটা শুনে মহিলার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে যায়। লোকটি বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে রেহজান পিছু ডাকে, “বাবা, আপনি ওদের এই ব্যাপারে কিছু বলবেননা।” লোকটি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো সে কত বড় অন্যায় করতে যাচ্ছিল? তোমাদের পানীয়তে সে বদ্ধ উন্মাদ হওয়ার ভেষজ মিশিয়েছে। সে কেবল তোমাদের ক্ষতি করতে চায়নি, তার পুত্রদের জীবন ও নষ্ট করতে চেয়েছে।” রেহজান শান্তকন্ঠে বলল, “ভুল মার্জনা করবেন বাবা। আমরা জানি উনি আমাদের উপর রেগে আছেন, হয়ত আমাদের পছন্দ ও করেননা। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি উনার মন জয় করার, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আম্মার যদি এই বিবাহে সম্মতি না থাকে তবে এই বিবাহ হবেনা। মায়ের অসম্মতিতে আমরা এই বিবাহ করে কখনো সুখী হবনা বাবা। কিন্তু আপনি আলফি-শাহরের নিকট এসব বলবেননা। ওরা আজীবন তাদের মাকে ছোট করে দেখবে এটা তাদের মায়ের কাছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হবে।” রেহজানের কথা শুনে মহিলা তুমুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইফা এগিয়ে এসে মহিলার হাত ধরে বলল, “আম্মা চিন্তা করবেননা আপনার অসম্মতিতে কিছু হবেনা। এই বিবাহ বন্ধ করে দিব।” মহিলা এবার অসহায়ের দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকালেন, “আমাকে ক্ষমা করুন স্বামী।” লোকটি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “ক্ষমা ওদের কাছে চাও। আর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত করো।” মহিলা কাদতে কাদতে বললেন, “তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। রাগের বশে আমি অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম। এই বিবাহে আমার পূর্ণ সম্মতি আছে, তোমাদের মত পুত্রবধূ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।” রেহজান-ইফা মহিলার কাছে এসে তার কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করতে লাগল।
ইফা-রেহজান ধীরে ধীরে শামিয়ানায় সজ্জিত মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে। তাদের দুইপাশে রওনক আর তাদের শ্বাশুড়ী। আলফি-শাহর এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে তাদের নিজেদের পাশে এনে বসাল। এরমধ্যে আলেম ও এসে উপস্থিত হলেন। আলফি-শাহর ও সাদা রঙ্গের শেরওয়ানী আর মাথায় টুপি পড়েছে। তাদেরকে আলোকিত শুভ্র নূরের ন্যায় লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সুনিপুনভাবে তাদের বিবাহকার্য সমাধা হল।

ইফা ফুল দ্বারা সজ্জিত কক্ষে উৎফুল্লচিত্তে বসে আছে। তার মামা তার পাশে বসে রসিকতা করে বলছে, “জামাইকে দেখে আমার ভীষণ লাজুক মনে হল। দেখিস তোর সংসার ঝগড়া-ঝাটি ছাড়া স্মুথলি চলবে।” পাশ থেকে নাহার তাড়া দিল, “আপনি ঘরে চলুন তো। মেয়েজামাই এক্ষুনি এসে মামাশ্বশুড়কে দেখলে কি ভাববে?” মামী মামাকে নিয়ে যাওয়ার পর শাহর কক্ষে প্রবেশ করল। ইফার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “জ্বীন বিয়ে করার শখ মিটেছে পিচ্চি?” ইফা মুখ বাকিয়ে বলল, “চড় খেতে খেতে খুব মিটেছে।” শাহর শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর ইফার পাশে বসে তার হাত ধরে বলল, “জ্বীনের চড় খাওয়ার জন্য হলেও তোমার এই জ্বীনকে ভালোবাসতে হবে।” ইফা চোখ বড় বড় করে বলল, “আজীবন কি চড় মেরে যাবেন নাকি?” শাহর হেসে হেসে বলল, “মাঝে মাঝে তোমার আবেগ ঠিক রাখার জন্য দু-একটা মারা যেতে পারে কি বলো!” ইফা মুখ ভেঙ্গাল। তারপর একটু থেমে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলল, “ভালোবাসি ইফা।” ইফা অবাক হয়ে বলল, “এটা কি করে জানলেন?”
— “আলফি ভাইয়ার থেকে শিখেছি।” ইফা শাহরকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও ভালোবাসি আমার চড় মারা জ্বীনবরকে।”
রেহজানের মধ্যাঙ্গুলে একটি সুন্দর আংটি পড়িয়ে দিল আলফি। তারপর মুচকি হেসে বলল, “মনে আছে আমাদের হলুদের রাতে লুকিয়ে দেখা করতে গিয়ে তোমার আঙ্গুলের মাপ নিয়েছিলাম। সেই মাপ দিয়ে বিয়ের দিন এই আংটি টা বানিয়েছিলাম। দেরীতে হলেও বিশেষমূহুর্তে তোমাকে আংটি পড়াতে পেরেছি।” রেহজান আলফির গাল টেনে দিয়ে বলল, “জ্বীন হলেও আমার বর অনেক রোমান্টিক।” আলফি বরাবরের মত রেহজানকে একটানে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আগের মত স্পষ্ট বাংলায় বলল, “ভালোবাসি।” রেহজান এক প্রশান্তিতে চোখ বুজে আলফির বুকে নিজেকে সমপর্ণ করল। আলফি রেহজানের কপালে চুম্বন করতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলল আলফি, খুলে ইফাকে দেখে চোখ কপালে উঠল। ইফা ছুটে গিয়ে রেহজানের কাছে বসে গল্প জুড়ল। ইফার পিছনে ঘরে ঢুকল শাহর। তার মুখেও একরাশ হতাশা। ইফা আর রেহজান হেসে হেসে কথা বলছে। আলফি আর শাহর দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাদের সামনে দাড়িয়ে আছে। আলফি ফিসফিস করে বলল, “তুই নিজের বাসরের সাথে সাথে কি আমার বাসর নষ্ট করার প্ল্যান করেছিস?” শাহর অসহায় কন্ঠে বলল, “এই পিচ্চিকে আমি কিভাবে সামলাব আল্লাহ!” আলফি কনুই দিয়ে শাহরের পেটে গুতো দিয়ে বলল, “সে আমি জানিনা। আমার বাসর নষ্ট হলে তোর খবর আছে।” শাহর ইফার হাত ধরে বলল, “চলো বউ, ভাইয়া-ভাবী গল্প করুক।” ইফা চোখ পিটপিট করে বলল, “আপু ভাইয়া কি আমাকে হিংসে করছে নাকি?” রেহজান হাসতে হাসতে আলফির দিকে তাকায়। আলফি নিচের ঠোট কামড়ে ধরে হতাশামাখা মুখে দাড়িয়ে আছে। শাহর ইফার কানে কানে বলল, “এখন তুমি ঠিক করো আজকে জ্বীনবরের আদর খাবে নাকি চড়?” ইফা উঠে দাড়িয়ে যেতে যেতে বলল, “আপু তুমি তোমার জ্বীনবরকে সামলাও, আর আমাকে আমার জ্বীনবর সামলে নিক…” তারপর শাহরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “অনেক চড় খাওয়ার বিনিময়ে জ্বীনবর পেয়েছি বলে কথা…” শাহর মুচকি হাসে। এই চঞ্চল পিচ্চি মেয়েটার মুখে আদুরে “জ্বীনবর” ডাক শুনতে তার ভীষণ ভালোলাগে।
.
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here