জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ ০৫,০৬

0
1266

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ ০৫,০৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০৫

উপরতলায় এসে দাড়াতেই শরীরটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। উপরতলার বারান্দায় টিমটিমে আলোর একটা বাতি জ্বলছে, বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই বাসায় কেউ আছে কিনা! নক করব কি করবনা ভাবতে ভাবতে দুটো টোকা দেওয়ার মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ আসে।
ছেলেটা বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর পাতলা একটা বাদামী টি-শার্ট। টি-শার্ট তাড়াহুড়ো করে পড়ায় সেটার সামনে গলা নেমে এসেছে বুক অবধি। তাতে বুকের কিছু লোম বেরিয়ে এসেছে যা দেখে আমার একটু অস্বস্তি লাগে। চট করে চোখ নামিয়ে ধরাগলায় বললাম,
— ” আপনার জন্য চা এনেছিলাম।”
আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ধন্যবাদ জানায় ছেলেটা। আমি পরনের ওড়নার এককোণা আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে কোনোরকম সাহস সঞ্চার করে জিজ্ঞেস করলাম,
— দুলাভাইকে কি আপনি কিছু বলেছেন? কি এমন বলেছেন আমি জানতে চাই!
ছেলেটা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে কাপটা আবার পিরিচে রেখে আমার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে উত্তর দিল,
— আপনার দুলাভাইয়ের সাথে আমার এখনো দেখা হয়নি।
কথাটা শুনে যতটা রাগ নিয়ে ছেলেটাকে ঝাড়তে এসেছিলাম, ততটা হতাশা নিয়ে ফিরে এলাম। ব্যাপারটা বোঝার মত সাধ্য আমার হলনা। আপুর রুমে ফিরে এসে আপুর পাশে গিয়ে বসলাম,
— আপু দুলাভাই কোথায়?
— বেরিয়েছে একটু। তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি! তোকে খুজেছিল তোর দুলাভাই।
কথাটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র হৃদপিন্ডে ক্রমশ ক্ষুদ্র ঝড় বয়ে গেল। অপেক্ষায় থাকলাম দুলাভাই বাসায় ফেরার। কিন্তু অনেক রাত বাড়ার পর ও দুলাভাই ফিরছেননা, আপু ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। জেগে থাকলে পেরেশানিতে হয়রান হত। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বারবার গেইটের দিকে দৃষ্টিপাত করছি। কখন ছেলেটা আমার বিপরীত দিকে এসে দাড়িয়ে খেয়াল করিনি।
তাকে দেখামাত্র তার উপর হামলে পড়লাম,
— আপনি দুলাভাইকে কিছু একটা নিশ্চিত বলেছেন। সত্যি করে বলুন, কি বলেছেন তাকে? নাহলে আমি আপনাকে ছাড়ছিনা।
ছেলেটা নাক-মুখ কুচকে আমার দিকে তাকায়। টেনশানের চোটে এর সাথে বাংলা বলে ফেলছি, এখন কোনো ইংলিশ ওয়ার্ড আমার মাথায় আসছে না। কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। ছেলেটা আমার পাশে এসে দাড়িয়ে আলতো করে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল,
— বেশী বেশী নাক-মুখ কুচকালে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়। আমি ফোসতে ফোসতে তার দিকে তাকালাম, আমার শরীর তখনো টেনশানে কাপছে। ছেলেটা হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড করে বসল একটানে আমাকে তার বুকে চেপে ধরে মাথায় হালকা হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– ডোন্ট বি আপসেট। এভরিথিং উইল বি ফাইন।
ক্লেম ডাউন।
এক মূহুর্তের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মনে হল। নিজেকে ছাড়াতে ইচ্ছে হলেও পারলামনা। কেমন জানি এক তৃপ্তিকর প্রশান্তি খুজে পাচ্ছিলাম, চিন্তাগুলো ও যেন চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে স্থির হয়ে গেল। শরীরটা হালকা লাগছিল। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা, যখন চেতনায় এলাম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে ফিরে এলাম গম্ভীর মুখে।
প্রায় মধ্যরাতে দুলাভাই ফিরলেন, এসে আমার সাথে তেমন বাক্যবিনিময় করলেননা। তার চোখ-মুখ কঠিন দেখে আমিও কোনো প্রশ্ন করিনি। সকাল হতেই দুলাভাই সবকিছু গোছগাছ করছেন। আপু তো জিজ্ঞেস করে করে হয়রান, কোথায় যাচ্ছি আমরা! কোনো সমস্যা হয়েছে?
দুলাভাই কোনো উত্তর দিচ্ছিলেননা, আমি দৌড়ে গেলাম উপরতলায়। নিশ্চিত ছিলাম, ছেলেটা দুলাভাইকে এমন কিছু বলেছে যার দরুণ তিনি বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু উপরতলায় গিয়ে আমি হতাশ, দরজায় তালা ঝুলছে।
ছেলেটার উপর একসমুদ্র ক্ষিপ্ততা নিয়ে দুলাভাইদের সাথে ক্যাবে উঠলাম।

আপুর কাপড়গুলো লাগেজ থেকে বের করে ড্রায়ারে গুছিয়ে রাখতে রাখতে চট করে প্রশ্ন করলাম, “এখানে তোর শ্বশুড়বাড়ি আছে, আর তুই সেটা জানতি না?”
আপু একটু নিশ্চুপ থেকে বলল,
— ওকে আমি কখনো তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি। ভেবেছি, বিয়ের পর তো তার পরিবারে নিয়ে আসবে আমাকে। কিন্তু বিয়ের পর ও যখন তার লেশমাত্র দেখলামনা, জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেদিন সে প্রত্যত্তুরে বলেছিল, “আমার সাথে একটা পরিবার বানানো যায়না?”
— তবে কি তোকে বিয়ে করা নিয়ে পরিবারে কোনো ঝামেলা হয়েছিল? তোর বিয়ের ব্যাপারেও তো কখনো কিছু বলিসনি!
— তা জানিনা। সে লম্বা কাহিনী, পরে বলব তোকে।

এই বাসায় ঢুকার আগ পর্যন্ত জানতামনা এটা আপুর শ্বশুড়বাড়ি। শহরের এককোণে এমন পুরোনো তবে আভিজাত্য ধাচের বাড়ী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাসায় পা রাখতেই এক মাঝবয়সী মহিলা অতি সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম উনি আপুর শ্বাশুড়ী, উনি ছাড়াও বাসায় আপুর শ্বশুড়, ননদ, ছোটভাগ্নি, চাচীশ্বাশুড়ী ছিলেন। সবাই এত পরম মমতায় আপুকে গ্রহণ করলেন। আমি একটু বিষম খেয়ে গেলাম যে এতদিন এই পরিবার কোথায় ছিল!
এর আগেও যখন দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করেছি উনার পরিবারে কেউ আছে কিনা! উনি একউত্তরে না বলেছিলেন।

— ভাইয়া আপনি এতদিন আপনার পরিবার নিয়ে কিছু জানাননি কেন?
আমার প্রশ্নে দুলাভাই একটু হোচট খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এখন তো জানলে। আশা করি, তুমিও এখন নিশ্চিন্ত থাকবে তোমার আপুর যত্ন নেওয়ার জন্য তার আরেকটা পরিবার আছে।”
দুলাভাই আমার আসল প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন, যেহেতু উনি বলতে চাননি আমিও জোর করিনি।
জানালা খুলে বাহিরের দিকে তাকালাম, চারিদিকটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত। খুব সুন্দর কড়া বেলী ফুলের ঘ্রাণ আসছে, বাসায় ঢুকতে একপাশে অনেকগুলো ফুলের গাছ খেয়াল করেছিলাম। আমি রুমের ল্যাম্প বন্ধ করে দিলাম, এমন একটা পরিবেশে নিজেকে অনুভব করিনি কতদিন। চোখ বুজে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছিলাম এমনসময় কারো খুব জোরে ভ্যাউউ শব্দে দম আটকে এল। হঠাৎ ভয় পাওয়ায় হৃদপিন্ড এমন লাফালাফি করছিল যেন বেরিয়ে আসবে, একছুটে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। ছেলেটা আমার সামনে দাড়াল, তখনো আমার হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক ধুকপুকানিতে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলনা। সে কালকের মত একটানে আমাকে তার বুকের কাছে জড়িয়ে রাখল। ব্যাপারটায় শক খেলেও আমি যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে শান্ত হয়ে আসলে তার বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললাম,
— অসভ্যের মত আচরণ করেন কেন? আর এই বাড়ীতে আপনি কি করছেন?
সে দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে স্বাভাবিককন্ঠে বলল,
— কারণ এটাও আমার ই বাসা।
— বললেই হলো! আপনি কে হন এই বাসার?
— মালিকের ছেলে।
বুঝতে কষ্ট হলনা, উনি ই আপুর ছোট দেবর। কিন্তু কোথাও যেন হিসেব গড়মিল রয়েই গেল। সেও একবারো নিজের আসল পরিচয় দিলনা, আর দুলাভাইও তার পরিচয় দিলনা৷ সেদিন রাতের ব্যাপার পুরোপুরি না হলেও কিছুটা মাথায় ধরেছে।

“আপু এবার তো আমি চলে যেতে পারি? বাবা-মাকে তোর শ্বশুড়বাড়ীর ব্যাপারে বলেছি, উনারা এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।”
— আসার পর থেকেই তোর চলে যাওয়ার তাড়া! এই বাড়ীতে তোকে কেউ কিছু বলেছে? কারো কথায় কষ্ট পেয়েছিস?
— দূর, তোর কাছে যত আলতু-ফালতু কথা। কে আমাকে কি বলবে? আর তোর শ্বশুড়বাড়ীর কার কথা আমি বুঝি! উর্দু-আরবি মিলিয়ে কথা বলে, আমি শুধু হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
সত্যি বলতে, আপুর শ্বশুড়দের মত পরিবার আমি কখনো দেখিনি। যেমন শালীন, তেমনি মিষ্টভাষী। আপু এত ভাল একটা পরিবার পাবে সেটা আমি কল্পনা করিনি। আর আপুর দেবর আলফি সে তো একটা ছিনে জোক, সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকে। প্রথম প্রথম দা-কুমড়ার মত সম্পর্ক থাকলেও এখন কিছুটা ভাব হয়েছে তার সাথে। এখন তার মিশে বুঝেছি তার মত ছেলে হয়না, সবসময় আমাকে আর আপুকে মাতিয়ে রাখে। ভাবতে ভাবতে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আলফি আমাদের রুমে ঢুকল।
আপুকে প্যাকেটটা দিয়ে উর্দুতে বলল, “তোমার আর বেয়াইনের জন্য কিছু ব্যান্ডেড চকলেট এনেছি। শুনো, আবার একা খেয়োনা, তোমার বেচারা দেবর কিন্তু শুকিয়ে যাচ্ছে।”
— আমি চকলেট খাইনা, আমার ভাগের সবক’টা উনাকে দিয়ে দে তো আপু। আমার বাংলা কথা বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব হয়ে আপুর দিকে তাকায়। আপুও হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দেয়।
— তাহলে আপনি কি খাবেন?
— নিমের রস। বলে উঠে চলে এলাম, হঠাৎ করে মুড অফ হওয়ায় সব বিরক্ত লাগছে। আপুকে এতবার যাওয়ার কথা বলছি, আপু কানেই তুলছেনা। কেন জানি মনে হচ্ছে, না যেতে পারার কারণে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলব।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর আলফি ছাদে এল, অবশ্য আমি তার ই অপেক্ষা করছিলাম। এই মন খারাপের সময় তার সঙ্গটা আমার অত্যাবশ্যক। এসেই সামনে দাড়িয়ে গলা কেশে হাতের গ্লাসটা এগিয়ে দিল।
— এটা কি?
— নিমের রস।
চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম। আমি রাগের বশে নিমের রস খাব বলেছিলাম ছেলেটা সত্যিই নিমের রস নিয়ে চলে এল। এই বলদ কি জানেনা, নিমের রস খেতে কেমন!
— দেখুন আলফি, আমি মজা করে বলেছিলাম। আমি নিমের রস খাইনা।
— কোনো কথা শুনবনা, আপনি খাবেন বলে আমি কত কষ্ট করে এটা সংগ্রহ করেছি। না খেলে তো আমার পরিশ্রম বৃথা। ঢকঢক করে খেয়ে ফেলুন তো।
— আমি কিছুতেই খাবনা।
— না খেলে আমি নিচে গিয়ে সবাইকে বলে দিব আপনি আমাকে অযথা নাজেহাল করেছেন। মান-সম্মান খোয়ানোর ভয় সবার ই আছে, তাই খেতে বাধ্য হলাম। প্রতি ঢোক আমাকে জোর করে গিলানোর হচ্ছিল, দুই ঢোক শেষে আর না পেরে বাকিটা তার মুখে ছুড়ে দিয়ে নিচে পালিয়ে এলাম।
খাওয়ার টেবিলে তার চোখে চোখ পড়তেই বিড়ালের মত পানসে মুখ করে নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। সে এসে হুংকার ছাড়ল, আজ আমি ভাত-রুটি কিচ্ছু খাবনা। ফ্রিজে যত মিষ্টি আছে দাও, আজ সব খাব।
আমি নিজের খাওয়া রেখে তার খাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি সত্যি ২বক্স মিষ্টি সে একাই খেল। সামান্য তিতো মুখে পড়ে তার এই অবস্থা দেখে পেট ফেটে হাসি আসছিল। এক ফাকে বলে ফেললাম,
— বেয়ানসাহেব, তিতো হলেও জিনিসটা উপকারী।
— আজ বুঝলাম, আপনার মুখে সবসময় এত তিতো কথা কিভাবে উৎপাদন হয়!
বলে শিস বাজিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আমি দাত কটমট করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-০৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার আর আলফির সম্পর্কের একটা নাম হয়েছিল, “বন্ধুত্ব”। কিন্তু তখনো আপনি শব্দটা তুমিতে রুপান্তরিত হয়নি। সবমিলিয়ে আপুর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠছিলাম। আপুর তখনো সবে ৮মাস, ডেলিভারির ডেট ঘনিয়ে আসছে। শ্বশুড়বাড়ীর সবাই তার খুব যত্ন-আত্তি করলেও আমি আপুর খেয়াল রাখতে ভুলতামনা।

এক বিকালে হঠাৎ নেমে আসা এক পশলা বৃষ্টি দেখে হুট করে ভিজতে যাওয়া অভ্যাস থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি। তাতেই ঘটল যত বিপত্তি! ছাদে শ্যাওলাপানিতে পিছল খেয়ে ডান হাত ভেঙ্গে ফেললাম। আমার হাত প্লাস্টার করতে দেখে আপুর সে কি কান্না! বিরক্ত হয়ে এক ঝাড়ি দিলাম,
–” এমন মরাকান্না জুড়েছিস কেন? হাত ই তো ভেঙ্গেছে, মরে তো যাইনি!”
কার কথা কে শোনে! আমার কথায় তার আবেগ দমেনা, বরং ফুটন্ত ভাতের ফেনার মত টগবগ করে। দুলাভাই আমার অবস্থা দেখে বিষন্নবোধ করলেন। বিমর্ষচিত্তে বারবার বললেন,
— “আমাদের তোমার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আমি তোমাকে স্ব-দায়িত্বে এনেছিলাম, কিন্তু তা পালনে ব্যর্থ হলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
— “এতে আপনার কি দোষ! আমার ই সর্তক থাকা উচিত ছিল। আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, এভাবে সবাইকে অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলার জন্য।”
দুলাভাই সেইসময়টায় আমার যত্নে কোনো ক্রুটি রাখেননি, তাকে নিজের আপন বড়ভাইয়ের আসনে বসিয়ে ফেলেছিলাম। দুলাভাইও অনেকটা সহজ হয়ে এলেন আমার সাথে। বড় ভাইয়ের মত স্নেহ-ভালোবাসা দিতেন।
হাত ভাঙ্গার সময় আলফি বাসায় ছিলেননা। বাসায় ফিরে খবর পেয়ে ছুটে এলেন আমাকে দেখতে। পানি জমে থাকা লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে টানা একঝাড় বকে তবে উনি ক্ষান্ত হলেন। বলতে গেলে, আলফি ই তখন আপুকে অবসর দিয়ে আমার খেয়াল রেখেছিল। চুল বাধতে গিয়ে আমার কোমড় অবধি লম্বা চুল দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
“বিনুনি করলে গলায় পেচিয়ে শ্বাস আটকে যাবেনা তো!” তার বোকামত প্রশ্নে সেদিন হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছিল। চুল বাধতে পারতনা তাও কোনোরকম পেচিয়ে মাথার উপর আস্ত পিরামিড বানিয়ে বলত,
— “এটা নিউ হেয়ারস্টাইল, বাজারে খুব চলছে।”
আপুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ও নিয়ে নিলেন উনি। আমাকে খাওয়াতে গিয়ে আমার হা করার সঙ্গে নিজেও বড় হা করত। উনার এসব ব্যাপারগুলো আমার হাত ভাঙ্গার যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখত।

প্রতিরাতে টের পেতাম আমি ঘুমিয়ে পড়া অবধি উনি সামনের বারান্দায় পায়চারি করতেন, কখনো বা বই হাতে নিয়ে আমার জানালা বরাবর বসে বারবার উকি দিয়ে আমাকে দেখতেন। কখনো মনে হত গভীর রাতে উনি আমার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতেন, গায়ের কম্বল ঠিক করে দিতেন কিংবা বৃষ্টি হলে এসে এসি বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু যখন টের পেতাম চোখ খোলামাত্র তাকে দেখতে পেতামনা। মনে হয়েছিল, এটা আমার কল্পনা। গভীররাতে আমার রুমে আসার মত বোকামি উনি অন্তত করবেননা।
হাতের প্লাস্টার খুলে ফেলার পর যখন আস্তে আস্তে হাত নাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম তখন উনি দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে চোখে একরাশ বেদনা-ভীতি নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল, আমি হাতে ব্যথা পেলে উনি কোকড়িয়ে উঠবেন।
আলফি হঠাৎ একটা ইন্টারেস্টিং কাজ করলেন। হুট করে রাতের বেলা কল দিয়ে বললেন,
” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বারান্দায় আসুন, জ্যোৎস্না দেখতে বের হব।” কেন জানি তার মুখের উপর কখনো না শব্দটা বলতে পারতামনা। আমিও বেশ উৎসাহ নিয়ে আকাশী রঙ্গের পাকিস্তানি থ্রি-পিস পড়ে পরিপাটি সাজে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। তিনিও বেরিয়ে মূহুর্তে আমার এক হাতে টেনে রকেটগতিতে ছুটে বাহিরে নিয়ে এল।
চুপচাপ দুজন রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাটছিলাম আর আড়চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। খেয়াল করলাম উনিও আজ বেশ পরিপাটিরূপ নিয়ে বেরিয়েছেন। কনুই অবধি হাত গোটানো পরনের মিষ্টি রঙ্গে শার্টে ল্যাম্পের হলুদাভ আলোয় উনাকেও দেখতে মিষ্টি লাগছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তার খোচা খোচা দাড়িতে হাত বুলাতে, পরক্ষণে এমন অসভ্য ইচ্ছে ভেবে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসত। এখন তার ধূসর চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়না আমার, বরং সুযোগ পেলে বারবার লুকিয়ে তাকাই।

উনার সাথে তখন কাটানো মূহুর্তগুলো স্মরণীয় ছিল। ল্যাম্পের আলোতে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে রাতের ছোট্ট শহরটা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন, রাস্তার ধারে অভূতপূর্ব পরিবেশে ধাবার মজাদার ভিন্ন স্বাদের চা-তন্দুরী রুটি খাইয়েছেন, সবার শেষে আমার উড়তে থাকাখোলা চুলে নিপুনভাবে খোপা বেধে দিয়েছেন। সেই এক এক মূহুর্তের অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়তুল্য।

ফোনের অপরপাশ থেকে শোনা খবরটা আমাকে কিছু মর্মাহত করল। চোখে জল নামার বদলে আমার ঠোটের কোণে উপহাসের হাসি ফুটল। এইকারণে আমি বারবার দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ ভরসা ছিল আমার অনুভূতির দাম সে দিবে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের মেঝে থেকে উঠে দাড়াতে দেখি আলফি আমার পানে কাতরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কিছু বলার আগে একটানে আমাকে তার বুকে টেনে জড়িয়ে রাখল,
— রেহজান, ফেলা আসা ভালোবাসার মূল্য কি এতই বেশী যে চোখের সামনে বিস্তীর্ণ অনুভূতির ভালোবাসা তুচ্ছ মনে হচ্ছে?
আমি নিচের ঠোট কামড়ে ধরে মাথা উচিয়ে আলফির দিকে তাকালাম। টের পাচ্ছি তার শরীর থেকে থেকে কেপে উঠছে। আবারো কিছু বলতে যাব এর আগে আলফি আমার হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ঘনঘন ঢোক গিলে বলল,
— রেহজান, সেদিনের উপভোগ্য প্রতিটি সুন্দর মূহুর্তের দাম যদি চাই দিবেন?
— কি চান?
— এমনি হাজারো অনেক মূহুর্ত আপনার সাথে কাটাতে চাই। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলামনা। শুধু ভাবছিলাম আলফির জন্য আমার অন্তরে যা আছে তা কি ভালোবাসা নাকি কেবল আন্তরিকতার টান!
— আমি একটু সময় চাই নিজের অনুভূতিগুলোকে বোঝার জন্য। আলফি আর কিছু বললনা। ঘন ঘন মাথা নাড়াতে নাড়াতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল।

সারারাত মাথার মধ্যে গেথে যাওয়া ভাবনাগুলো আমাকে ঘুমাতে দিলনা। তখনো স্থির হতে পারছিলামনা আলফিকে আমি ভালোবাসি কিনা! পরেরদিন বিকাল গড়ালেও আলফির সাথে আমার আর দেখা হলনা, আপুর কাছে জানতে পারলাম ও কোনো জরুরী কারণবশত সকালে দেশের বাহিরে গেছে। ওখানেই হয়ত থাকতে হবে কয়েক মাস। খুব দ্রুত ফ্লাইট ঠিক হয়েছিল বিধায় কাউকে বলে যেতে পারেনি। বুক ফুড়ে একটা ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল, বুকের বা পাশটা কেমন এক অজানা ব্যথায় ছেয়ে গেল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here