জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ ২৩,২৪

0
1464

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ ২৩,২৪
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২৩

গভীর রাত। রেহজান বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতে’ই তার ঘুম আসছেনা। বিছানা থেকে উঠে জানালা খুলে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে। জানালা থেকে শহরের ব্যস্তময় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। হলদে-লাল আলোর সাথে গাড়ির হর্ন যোগ হয়ে এক কলরবপূর্ণ পরিবেশ। রেহজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার স্মৃতির কোণে ভেসে উঠে একরাতে আলফির সাথে শহরে ঘুরে বেড়ানোর মূহুর্তগুলো। আচমকা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠে রেহজান। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছেনা সে। কাল সকালেই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। তার মা-বাবা তাকে কিছু না বললেও গোপনে যে বিয়ের আয়োজন রেখে রাখছেন সে তা বুঝতে পারছে। এই মূহুর্তে তার ইচ্ছে হচ্ছে আলফিকে ফিরিয়ে আনতে। কান্না থামিয়ে চোখ মুছে রেহজান। ইফার কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনোভাবে কি জ্বীনরাজ্যে গিয়ে আলফিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? কিন্তু সে তো জ্বীনরাজ্যে কিভাবে যেতে হয় জানেনা! এতদিন তাকে এক আবছা অন্ধকার গৃহে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে পালাতে গিয়ে উচু দালান থেকে পড়ে গেছে এইটুকু ই মনে আছে। আশে-পাশের পরিবেশের বর্ণনা তার স্মরণে নেই। হতাশ হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে সে। কান্না কান্না গলায় আলফির নাম ধরে ডাকে। সেই ডাক চাপা পড়ে যায় রাতের নিস্তব্ধতায়।
ইফা একা একা ছাদে বসে আছে। শাহর চলে যাওয়ার পর এই জায়গাটা’ই তার একাকিত্বের সঙ্গী। এখানে এলে মনে মনে শাহরের উপস্থিতি টের পায়। হঠাৎ দেবদারু গাছের ছায়ায় কারো অবয়ব দেখে চমকে উঠে সে। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে ওখানে?” দন্ডায়মান কালো অবয়ব কোনো উত্তর দেয়না। নড়চড়হীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। ইফা অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ধীরে ধীরে সেদিকে এগুচ্ছে। তার শরীর ভয়ে হালকা কাঁপুনি দিচ্ছে। গলা বারবার শুকিয়ে আসছে, সে কয়েকবার ঢোক গিলল। তারপর থমকে গিয়ে উচ্চস্বরে চেচাল,
— “পাড়ার কেউ যদি এভাবে আমাকে ভয় দেখাতে আসিস তবে খুব খারাপ হবে। যে ই হোস, সামনে আয়।”
অবয়ব এবার নড়েচড়ে দাঁড়াল। তারপর ধীরপায়ে ইফা দিকে এগোয়। ইফা এখন আর অত ভয় পাচ্ছেনা, তার মনে হচ্ছে পাড়ার কোনো বাচ্চা ছেলে এসব করছে। অবয়ব টা ততক্ষণে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চেহারা এখনো দেখতে পাচ্ছেনা ইফা। ইফা কিছু বলার আগেই অবয়ব তাকে খুব জোরে একটা চড় দিল। তাতে ইফার মাথা ঘুরে গেল, তার চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। এক পর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

রেহজান চোখ মেলে তাকায়। মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে তার। স্বজ্ঞানে আসতে’ই পিটপিট চোখে চারপাশে একবার নজর বুলায়। তার ঠিক পাশের আসনে ইফাকে অজ্ঞান এবং বাধা অবস্থায় দেখতে পায়। তখন খেয়াল করে তাকেও অদৃশ্য কিছু একটা দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে। রেহজান বুঝে উঠতে পারেনি সে কোথায় আছে? ইফা আর সে এখানে এল কিভাবে? তারা যে কামরায় আছে সেটা আবছা আলোয় পরিপূর্ণ। চারপাশে খালি সাদা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছেনা। রেহজান চাপা স্বরে ইফাকে ডাকে। কয়েকবার ডাকার পর ইফা চোখ মেলে তাকায়। হুশ ফেরার সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে, “আমি এখানে এলাম কি করে?”
রেহজান নিরাবেগ গলায় উত্তর দেয়, “জানিনা। তবে কেউ আমাদের এখানে তুলে এনেছে এটা নিশ্চিত।”
ইফা ভয়ার্তগলায় বলে, “এবার আমরা কি করব? এরা কি আমাদের কে মেরে ফেলবে?” রেহজান কিছু বলার আগে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে সেদিকে তাকায়। ইফাও চোখ বড় বড় করে দরজার দিকে নজর দেয়। শ্বেতশুভ্র বসনে কেউ একজন তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ইফা চেচিয়ে কিছু বলার আগে রেহজান তাকে চুপ থাকার ইশারা করে।
মহিলাটি তাদের দিকে এগিয়ে মিষ্টি গলায় বলে, “স্বাগতম।”
রেহজান ভালো করে মহিলার দিকে তাকাল। পরনে শ্বেতশুভ্র কাপড়, মুখের উপর জর্জেটের ভারী পর্দা, চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। রেহজান ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, “আপনি কে?” মহিলাটি কঠিন স্বরে উত্তর দেয়,
— “আমি কে সেটা এখন জানা খুব জরুরী নয়। তোমরা আমার সাথে চল।” ইফা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কোথায়? আমি কোথাও যাবনা। আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসুন।” মহিলাটি উচ্চশব্দে হেসে উঠল। সেই হাসিতে কামরাটি যেন কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়, “সে তো অবশ্যই। তার আগে তোমাদের আমার সাথে যেতে হবে।” এইটুকু বলে সে ইশারা করে দুজন মেয়েকে ভিতরে ডাকলেন। তার সাজগোজ সাধারণ তবে প্রত্যেকের মুখের উপর পর্দার আস্তরণ। মহিলাটি পুনরায় ইশারা করামাত্র ওরা একটুকরো কাপড় দিয়ে রেহজান আর ইফার চোখ বেঁধে দিল। রেহজান বাধা দিতে চাইলেও হাত বেঁধে রাখার দরুণ পারলনা। মেয়ে দুটো তাদের বাহু ধরে রেখেছিল, আর তারা অন্ধের মত হেঁটে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণপর তাদের চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। রেহজান আর ইফা চোখ মেলে দেখল তারা এক সুরম্য কামরায় অবস্থান করছে। কামরা রঙ্গিন পর্দা এবং দামী আসবাবপত্র দিয়ে গোছানো। সুগন্ধি ফুলের সুবাস কামরার ভিতরে মৌ মৌ করছে। ইফা ভয়জড়ানো কন্ঠে রেহজানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আমাদের কোথায় এনেছে আপু?”
রেহজান ইফার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “ভয় পাসনা। কিচ্ছু হবেনা, ব্যাপারটা বুঝি একটু।” প্রায় আধঘন্টা পর মেয়ে দুটো কামরা থেকে বেরিয়ে গেল, তার কিছুক্ষণ পর কামরায় প্রবেশ করলেন এক মাঝবয়সী মহিলা। ঠিক মাঝবয়সী ও নয়, তার বয়স সঠিক অনুমান করা যাচ্ছেনা। তার গায়ে শুভ্র পাথর বসানো ঢোলা জোব্বা, মাথায় আলখেল্লা। নাক থেকে থুতনীর নীচ পর্যন্ত জর্জেট সাদা কাপড় বাধা। মহিলাটি এসে রেহজান আর ইফাকে বসার ইশারা করলেন। ওরাও বাধ্য মেয়ের মত আসনে বসল। মহিলা এবার ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুখের কাপড় সরালেন। ইফা আর রেহজান তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সব সৌন্দর্য এই নূরানী মুখের কাছে ফিকে, আর তার মিশকালো বর্ণ মণি জ্বলজ্বল করছে সবমিলিয়ে তাকে অন্য জগতের মানুষ মনে হচ্ছে। রেহজান নিজের দৃষ্টি সংযত করে সালাম দিল। তারপর প্রশ্ন করল, “আপনি কে? আমাদেরকে এখানে তুলে আনার কারণ কী?” মহিলা মুচকি হেসে মিষ্টিগলায় বললেন,
— “সব জানতে পারবে। আগে কিছু খেয়ে পেটের উদরপূর্তি করো। তোমাদের শুকনো মুখ দেখেই মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ কিছু খাওনি। খেতে খেতে নাহয় জানবে।”
কিছুক্ষণ বাদে মেয়ে দুটো ফিরে এল হাতে থালা নিয়ে। বিশাল থালা দুটো তাদের সামনে রাখল। ইফা থালার দিকে একনজর তাকাল, থালাভর্তি বিভিন্ন রকম ফল-মিষ্টান্ন। যা দেখে ইফার সত্যিই ক্ষুধা লেগে গেল। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার আগে রেহজান মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলল,
— “আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন তারপর আমরা খাব।” রেহজানের কথায় ইফা হাত সামলে নিল।
মহিলা মুচকি হেসে বলল, “তোমরা বেশ নাছোড়বান্দা। ঠিক আছে, বৃত্তান্ত বলছি। এটা জ্বীনরাজ্য। এখানে তোমাদের আমার নির্দেশে তুলে আনা হয়েছে।” রেহজান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে, ” কেন তুলে এনেছেন?” ইফা রেহজানের হাত নাড়া দিয়ে বলল, “আপু অবশেষে আমরা শাহরের কাছে চলে এসেছি। কিন্তু ও কোথায়? আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে যাব।” ইফার কথায় রেহজান মুচকি হেসে বলল,
— “একটু ধের্য্য ধর।” ইফার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেহজান পুনরায় মহিলার দিকে তাকাল।
— “একি তোমরা খাচ্ছোনা? খাওয়া শুরু করো। তোমরা জ্বীনরাজ্যের অতিথি। না খেলে আমি আর কিছু বলতে পারবনা।” রেহজান আর ইফা কিছুটা ইতস্তত বোধ নিয়ে খাএয়া শুরু করে। সত্যি বলতে, জ্ঞান ফেরার পর দুজনের ই প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মহিলা কিছুক্ষণ ওদের খাওয়ার দিকে নজর দিয়ে হালকা কেশে বলল, “আমি আলফি আর শাহরের আম্মা।” কথাটা শুনে দুজনে খাওয়া বন্ধ করে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ইফা ফিসফিস কন্ঠে রেহজানকে প্রশ্ন করে, “আপু তুমি উনাকে চিনোনি?”
রেহজান ভ্রু কুচকে মহিলাটির দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায়।
— “আলফির আম্মাকে আমি দেখেছিলাম, কিন্তু আপনি তো তিনি নন।” মহিলা উপহাসের হাসি দিয়ে বলল,
— “আমি ছোট-খাটো কাজ কখনো নিজে করিনা। আমার পরিচয়ে আমার বিশ্বস্ত খাদেমা তোমার নিকটে ছিল।”

ইফা ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “উনি তো মারাত্মক মহিলা।” রেহজান অস্ফুটস্বরে বলল,
“তাই তো দেখছি।” ইফা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমাদেরকে কেন তুলে এনেছেন? রেহজান আপু তো আপনার কথামত সব করেছে। আপনার ছেলেরা আপনার কাছে ফিরে এসেছে।” ইফার কথায় মহিলা উচ্চশব্দে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে বলল, “তুমি এখনো বাচ্চাদের মত কথা বলো। আমি অবশ্য বাচ্চা বাচ্চা ভাব পছন্দ করি।”
রেহজান একটু কঠিনস্বরে বলল, “আপনি কিন্তু প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন।” মহিলা একটু চুপ থেকে বলল, “বেশ। আমার ছেলেরা তোমাদের দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তোমাদেরকে ছাড়া ওরা অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাদের কিছু পরীক্ষা নিব। তোমরা যদি তাতে জয়ী হতে পারো তবে’ই তোমাদেরকে পুত্রবধূ করতে আমি রাজি।”
রেহজান আর ইফা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল। রেহজান আচমকিত হয়ে প্রশ্ন করল,
— “এতকিছু করে শেষপর্যন্ত আপনি রাজি হয়ে গেলেন?”
— “অবশ্যই। কারণ, আমি এতদিন যা করেছি আমার ছেলেদের ভালোর জন্যই। আজও যা করছি ওদের সুখ আর ভালোর কথা ভেবে। তোমরা কি আমার প্রস্তাবে রাজী?”
ইফা গদগদ কন্ঠে আহ্লাদীস্বরে বলে উঠে, “জ্বী আমি রাজি। আমি শাহরকে আর হারাতে চাইনা।” মহিলা এবার রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান একটু সময় নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, “আমিও রাজি।”
মহিলা মুচকি হেসে বলল, “তবে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হও । তোমরা আপাতত বিশ্রাম নাও। আমি সময় হলেই কি করতে হবে বলে যাব।” এই বলে মহিলা প্রস্থান করলেন। ইফা আনন্দিত হয়ে বলল, “আমি ভাবতেও পারিনি আল্লাহ আমাকে আরেকটা সুযোগ দিবেন। তুমি খুশী হওনি আপু?” রেহজান মুচকি হেসে বলল,
— “খুশি হয়েছি। কিন্তু কি পরীক্ষা নিবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। সংশয় হচ্ছে এটা নতুন কোনো ফাঁদ নয় তো!”
রেহজানের কথা ইফা ভাবনায় পড়ে যায়। সবকিছু সে যত সহজ ভাবছে আসলে তা অত সহজ নয়….

(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-২৪
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

মহিলা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর খাদেমা দুজন ফিরে এল। ততক্ষণে পাশের সুরম্য গোসলখানা থেকে রেহজান আর ইফা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল। খাদেমা দুজন তাদের দিকে পরিধানবস্ত্র এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। ইফা কপালে ভাঁজ ফেলে রেহজানের দিকে তাকাল। রেহজানকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। ইফা নিচুগলায় বলল, “আপু তুমি কি কোনোকিছু আঁচ করতে পারছো?” রেহজান না সূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে এতকিছু করার পর উনি আমাদের কে মেনে নিতে চাইছেন।” ইফা কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে,
–” আপু এটাও হতে পারে আলফি আর শাহর উনাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন!” রেহজান চোখ তুলে বলল,
— ” হতে পারে। তাই উনি পরীক্ষা জুড়ে দিয়েছেন। আমার ধারণা হচ্ছে উনি আমাদের খুব কঠিন কোনো পরীক্ষায় ফেলবেন। তাতে আমরা উত্তীর্ণ না হতে পারলে উনি উনার ছেলেদেরকে অন্তত বুঝ দিতে পারবেন।” ইফা গম্ভীর হয়ে যায়। শাহরকে ফিরে পাওয়ার যে এক আশা তার মনে উদিত হয়েছিল, তা যেনো ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রদীপের শিখার ন্যায় প্রাণপণে টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে। এভাবে চিন্তায়-আশঙ্কায় একদিন কেটে গেল। মহিলা তখনো কোনো খবর পাঠাননি। তাছাড়া তাদের এই কামরায় বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ। দরজার সামনে সর্বক্ষণ পাহারাদার ছিল। এই বন্দিদশা কর্মকান্ড রেহজান আর ইফার সন্দেহকে শক্ত করে তুলছে। প্রায় বিকালের দিকে একজন খাদেমা এসে তাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বলল। রেহজান আর ইফা প্রায় ভয়ে ভয়ে খাদেমাকে অনুসরণ করে কামরা থেকে বের হল। ওরা মহলের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আশেপাশে কত লোকজন কিন্তু তারা তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। ইফা ফিসফিস কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এরা সবাই কি জ্বীন?” রেহজান চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “হুম হয়ত। জ্বীনরাজ্যে জ্বীন ই থাকার কথা।” ইফা কৌতূহলবশত অন্যদিকে পা বাড়ালে খাদেমা হুংকার ছাড়ে, “আমাকে অনুসরণ করো।” রেহজান ইফার হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায়। মহলের শেষ মাথার কামরার সামনে এসে খাদেমা দাঁড়িয়ে গেল। চোখ না তুলে কামরা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ভেতরে যাও!” রেহজান আর ইফা কামরার ভিতরে ঢুকল। মহিলা সেখানকার পালঙ্কে গা গুটিয়ে বসে আছেন। রেহজান আর ইফা সালাম দিল। মহিলা সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে বসতে ইশারা করলেন। তারপর মহিলা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “জ্বীন মানুষের বিয়ের ব্যাপারে শুনেছো কখনো?” ইফা রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান স্পষ্টগলায় বলে, “নাহ।” মহিলা মুচকি হাসে, তারপর বলে, “তোমরা যদি জ্বীন বিয়ে করো তবে তোমাদেরকে জ্বীনরাজ্যে থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জ্বীনদের ভয়ানক আসল রুপ দেখতে হবে। এমন বদ্ধ কামরায় জীবন কাটাতে হবে। কোনো জ্বীন যদি জানতে পারে তোমরা জ্বীনরাজ্যে আছো তোমাদের কতল(খুন) করতে পারে।” ইফার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান চিন্তিত গলায় বলল, “আপনি কি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন? আর আমরা তো আপনার ছেলেদের ধারেকাছেও নেই, আপনিই আমাদের তুলে এনেছেন। বিয়ের কথাও আপনি বলেছেন।”
–” হ্যা বলেছি। এখন বিয়ের পরবর্তীতে তোমাদের জীবন যাপন কেমন হবে তাও বলছি। তোমরা এখানে থাকতে পারবেনা কোনোমতেই। এই জায়গা না তোমাদের থাকার উপযোগী না তোমাদের জন্য নিরাপদ!”
ইফা এবার প্রশ্ন করে বসল, “সব জেনে তাহলে আমাদেরকে তুলে আনলেন কেন?” মহিলা রহস্যময় চোখে তাদের দিকে তাকায়, তারপর নিচুগলায় বলে, “তোমরা হয়ত এখানে থাকতে পারবেনা, কিন্তু শাহর-আলফি তোমাদের কাছে থাকতে পারবে। তোমাদের সাথে বিবাহ করে জীবনযাপন করতে হলে তাদেরকে সাধারণ জ্বীন হিসেবেই বাকিজীবন কাটাতে হবে। তারা জ্বীনরাজ্যে আর ঢুকতে পারবেনা। শক্তি-সামর্থ্যহীন জ্বীনের ন্যায় বাকিটা জীবন মানুষের মত কাটাতে হবে।” কথাটা শুনে রেহজান আর ইফা অবাক হয়।
পরক্ষণে মহিলা আবার বললেন, “শাহর-আলফি এই ব্যাপারে শুনেছে। তারা সবকিছু জেনেও রাজি তোমাদের সাথে বাকি জীবন কাটাতে। তাই আমি তোমাদেরকে তুলে আনলাম এটা জানতে আমার ছেলেরা যাদের জন্য এত নড় ত্যাগ স্বীকার করছে, নিজের বাসস্থান-পরিবার ছাড়া হচ্ছে তারা আসলেই আমার ছেলেদের যোগ্য কিনা?”
রেহজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এখন আপনার কি মনে হচ্ছে? আপনি কি আপনার ছেলেদের ত্যাগ মেনে নিবেন?”
— “আমার ছেলেরা বরাবর ই তাদের বাসস্থান আর পরিবার ছাড়া থেকেছে। আমি তাদেরকে সেভাবে রেখেছি যাতে তারা সবসময় নিজেকে এমন একটা দিনের জন্য প্রস্তুত রাখতে পারে। শাহরকেও ৫বছর বয়সে আলফির মত অচেনা জায়গায় ফেলে এসেছিলাম। তবে ওর সাথে আমি প্রায় দেখা করতে যেতাম, কিন্তু আলফির দেখা আমি আর পাইনি।” ইফা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, “আপনি জানতেন এমন একটা দিন আসবে?” মহিলা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“না জানতামনা। তবে প্রায়শ আমাদের জ্বীনগোত্রদের মধ্যে যুদ্ধ চলতেই থাকে। এই যুদ্ধে হয়ত কতল হতে হয় নয়ত জ্বীনরাজ্য ছাড়া হতে হয়। আমার আর আমার স্বামীর যদি কিছু হয়ে যায় এই আশংকায় আমরা আমাদের ছেলেদেরকে এভাবে রেখেছি। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলাম যুবক বয়সে ওদের ফিরিয়ে এনে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিব। ওরা তো যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন আমাদের কিছু হলেও নিজেরা নিজেদের পথ খুজে নিতে পারবে।”
রেহজান মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কাছে সবকিছুই এখন পরিষ্কার হয়েছে। এতদিন আলফির মায়ের চাওয়াটাকে নিতান্ত ই তার আলফিকে কষ্ট দেওয়ার কারণ বলে মনে হত। এখন সে বুঝতে পারছে কেন তার মা নিজের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য এতকিছু করেছে! শুধুমাত্র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের সন্তানদের সাথে জীবন কাটানোর জন্য। রেহজান মহিলার দিকে একনজর তাকাল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে মহিলা কাঁদতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেননা।
রেহজান কোমলকন্ঠে প্রশ্ন করল, “আলফি-শাহর আমাদের সাথে চলে যেতে চাইলে আপনি তাদের আটকাবেননা?”
মহিলা অসহায় কন্ঠে বলল, “না। আমি চাই তারা সুখে থাকুক। আর তারা তো আমার কাছে কিছুদিন ছিল তাতেই আমার মন শান্তি পেয়েছে। এখন যেতে চাইলে আটকাবনা।”
ইফা চোখে পানি টলমল করছে। এক পলশা বৃষ্টির মত তার চোখের পানি ঝরে পড়তে চাইছে কিন্তু ইফা ঠোট কামড়ে ধরে পানি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমাদের কি পরীক্ষা নিতে চান?” মহিলা এতক্ষণে গভীর বিষাদে ডুবে ছিলেন, ইফার কথায় নিজেকে সামলে নিয়ে সচেতন হয়ে বললেন, “রাতে বলব। এখন তোমরা বিশ্রাম নাও।” এই বলে খাদেমাকে ডেকে তাদেরকে তার সাথে পাঠিয়ে দিলেন। ইফা বেরিয়ে এসে চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলনা, তা গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরতে লাগল। ইফা নিশ্চুপে চোখ মুছে খাদেমাকে অনুসরণ করছে। এমনসময় তার ভারী পর্দার ওপাশে চোখ পড়ল। পর্দার একপাশ অনেকটা গুটিয়ে আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ওপাশে বসে থাকা শাহরকে। ইফা শাহরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। শাহর আর আলফি মুখোমুখি বসে আছে আর মাঝেমাঝে টুকটাক কথা বলছে। শাহর দৃষ্টিতে উদাসীনতা, চোখ দুটো বিষাদগ্রস্ত। ইফা শাহরের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে খাদেমা তার হাত চেপে ধরে বলল, “এখন ওদিকে যেওনা। তোমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে বেগম উনাদেরকে তোমাদের এখানে আনার ব্যাপারে জানাতে চাননা।” ইফা মনভার করে রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজানের দৃষ্টি তখনো আলফির দিকে। তার বুকের ভিতর ধক করে উঠছে, ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি আলফির কাছে ছুটে যেতে। এরমধ্যে কেউ একজন পর্দা সম্পূর্ণ টেনে দিয়ে গেল। রেহজান হতাশার চাহনীতে ইফার দিকে তাকিয়ে যাওয়ার ইশারা করল।

ইফা রেহজানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রেহজান অন্যমনস্ক হয়ে ইফার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বিষাদভরা কন্ঠে ইফা রেহজানকে বলল, “আমার মন মানছেনা আপু। আমি এক্ষুনি শাহরের কাছে যেতে চাই।” রেহজান মুচকি হেসে বলল, “একটু তো ধৈর্য্য ধরতে হবে। আল্লাহ আমাদের জন্য নিশ্চয়ই ভালো কিছু রেখেছেন।” ইফা চিন্তিত হয়ে বলল, “উনি বলেছেন পরীক্ষার ব্যাপারে রাতে জানাবেন। কিন্তু এখনো এলেননা তো!” রেহজান দরজার পানে উকি মেরে বলল, “আমিও তাই ভাবছি।” রেহজানের কথা শেষ হতে না হতেই মহিলা কক্ষে প্রবেশ করলেন। ইফা লাফিয়ে উঠে বসল। দুজন একসাথে সালাম দিল। মহিলা হাসিমুখে সালামের উত্তর নিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে বললেন, “নামায আদায় করেছো?” দুজনে মাথা নাড়াল। তারপর প্রশ্ন করলেন, “কুরআন পড়তে জানো?” দুজনে হ্যা সূচক বাক্যে মাথা নাড়াল। উনি খাদেমাকে ডেকে পাঠালেন। খাদেমা গেলাফ সহকারে দুটো কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মহিলা কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে রেহজান আর ইফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
— “এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক নবীর দুয়া কবুল হয়েছিল। আমি চাই, তোমরা দুজন মধ্যরাতে ওখানে গিয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ো। সাথে কুর আন তিলাওয়াত করে আল্লাহর কাছে শুকরান গুজার করে নিজেদের জন্য দুয়া করো। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ তোমাদের মনের আশা কবুল করবেন।” রেহজান আর ইফা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রেহজান বলল, “ইনশা-আল্লাহ।” মহিলা উঠতে উদ্যত হয়ে খাদেমাকে বলল, “ওদেরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেও।” খাদেমা মাথা নাড়িয়ে মহিলার সাথে বেরিয়ে গেল। ইফা উত্তেজিত হয়ে বলল, “পরীক্ষা এত সহজ কিছু হবে আমি ভাবতেই পারিনি।” রেহজান মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ ভরসা। দেখা যাক কি হয়!” মধ্যরাত হতেই দুজন ওযু করে কোরআন শরীফ আর তজবীহ হাতে কক্ষ থেকে বের হল। খাদেমা সদর দরজার বাহিরে আলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ কেউ ইফার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। ইফা পিছু ফিরে দেখে শাহর তার হাত চেপে ধরে তাএ দিকে তাকিয়ে আছে। ইফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে শাহরকে জড়িয়ে ধরতে যায়, পরক্ষণে নিজেকে সংযত করে বলল, “আপনি এখানে?” শাহর অবাক চাহনী দিয়ে ইফাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “তুমি এই সময় কোথায় যাচ্ছো?” ইফা ঢোক গিলে দরজার দিকে তাকায়। রেহজান ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। ইফা বুঝতে পারেনা শাহরকে কি জবাব দিবে? যাই হোক, সত্যিটা এখন বলা যাবেনা। শাহর উৎকন্ঠা নিয়ে আবার প্রশ্ন করে, “ইফা তুমি এখানে কি করে এলে?” শাহরের প্রশ্নে ইফা চমকে উঠে। বারবার ঢোক গিলছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here