জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-০৭,০৮
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০৭
আলফি চলে যাওয়ার পর থেকে আমার সময়’টা যেন থমকে গেছে। সবকিছুতে বিরক্তি খুঁজে পাই। ওর শূণ্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন বুঝতে পারছি আলফি ছিল আমার সব ভালোলাগার একটা উৎস। ওর চিন্তা আমার মাথায় বেশ ঝেকে বসেছে। প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি সে হয়ত একবার আমাকে ফোন করবে। ওর নাম্বার আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও কল দেওয়ার সাহস পাইনা। কতবার কাপা হাতে নাম্বার ডায়াল করেছি কল করার জন্য, কিন্তু দেওয়া হয়নি একবারো। আমার মত শক্ত মেয়ে সব আত্মপ্রত্যয় ভুলে ওর জন্য প্রচন্ড ইমোশোনাল হয়ে উঠছে! কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব না ভেবে আমার মস্তিষ্ক শুধু তার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলোকে নাড়া দিচ্ছে।
মনভার নিয়ে আপুর পায়ের কাছে গিয়ে বসি। আপু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, বোর হচ্ছিস?” আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজে’ই বলতে লাগল,
— আলফি না থাকায় বাসা’টা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর মত এত সহজবোধ্য মানুষকে ভাই হিসেবে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। পুরো পরিবারটা’ই আমার স্বপ্নের মত।
আমি কোনোরকম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
— ” আসলেই। তা তিনি ফিরছেন কবে? কথা হয়েছে তোর সাথে?”
— নাহ যাওয়ার পর সে ই যে একবার কথা হয়েছিল, আর হয়নি। ফিরতে হয়ত দেরী হবে। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উদাসকন্ঠে অস্ফুটস্বরে বললাম, “ওহ।”
সন্ধ্যের মৃদ্যুমন্দ বাতাসে বেলী ফুলের ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসছে। আকাশ হলুদটে রঙ ধারণ করেছে তাই চারিপাশের সবকিছু’ই হলুদাভ দেখাচ্ছে। এত সুন্দর পরিবেশটাও আমার কাছে তিক্ত লাগছে। বুকের ভিতর আলফি নামের ব্যথাটা থেকে থেকে বেড়ে উঠছে। মস্তিষ্কে একটা বাক্য বারবার বাড়ি খাচ্ছে। আমি কি আলফিকে ভালোবাসি? নিজের মন আমাকে প্রশ্ন করল, “তোর এখনো সন্দেহ আছে? যদি না ভালো’ই না বাসতি, তাহলে তার অনুপস্থিতি তোকে এত পোড়াচ্ছে কেন হতভাগী!”
ফোনের টোনের শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গল। এই শব্দটাকে এখন সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসতে’ই সব বিরক্তি-খারাপলাগা যেন একনিমিষে উধাও হয়ে গেল। তাকে আর কথা বলার সুযোগ দিয়ে অনর্গল তার ভালো-মন্দ সম্পর্কিত একগাদা প্রশ্ন করে বসলাম। সে খুব’ই শান্ত গলায় উত্তর দিচ্ছিল এমনসময় ফোনটা কেটে গেল। বারবার ব্যাক করলাম কিন্তু কল ঢুকছেনা। হতাশ হয়ে তার আবার কল দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু অনেকটা সময় পার হলেও আর ফিরতি কল এলনা। ভাগ্যটা যেন আমার সাথে তামাশা করছে।
ফোনের ওপাশ থেকে বাবার উৎফুল্ল কন্ঠস্বর, “কেমন আছিস রে মা? আমার রওনক কেমন আছে?”
— তোমাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। তোমার কন্ঠ এত উদ্দীপ্ত লাগছে কেন বাবা? কোনো ভালো খবর আছে কি!
— তোর চেয়ে আমাকে ভালো আর কেউ বুঝেনা। ভালো খবর নিশ্চয়ই আছে। তার জন্য তোদের খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে হবে। তোর জন্য একটা বড়বাড়ির সম্বন্ধ এসেছে। আমার তো খুব’ই পছন্দ হয়েছে। এখন কেবল তুই ফিরলে দেখা-সাক্ষাত করে বাকিটা এগোব।
কথাটা শুনে আমার শিরা-ধমনীর রক্ত যেন আরো দ্রুত গতিতে ছুটছে। কান দু’টো প্রচন্ড গরম হয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। সাথে সাথে ফোনটা কেটে কপালে দুহাত ঠেকিয়ে উবু হয়ে বসে রইলাম। আমার উতলা কয়েকগুন আরো বেড়ে উঠল “আপনি কবে ফিরবেন আলফি?”
দিন কয়েকের মাথায় আলফি ফিরল। পিপাসায় মৃতপ্রায় ব্যক্তি যখন পানি পেয়ে আনন্দিত হয়, আমার মধ্যে ঠিক তেমনি অনুভূতি প্রাণোদন হচ্ছিল। নিজেকে শক্ত রাখা দায় হয়ে পড়েছিল আমার। ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুনি তাকে জড়িয়ে ধরে জমানো কথাগুলো বলে ফেলি। কিন্তু সবার সামনে নিজেকে বহুকষ্টে সামলালাম।
এর মাঝে আলফি সুযোগ পেয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল,
“উপস্থিতি যখন বুঝাতে অক্ষম, অনুপস্থিতি দ্বিগুণ পোড়াতে মোক্ষম।”
কথাটা মানে বুঝতে সময় লাগেনি আমার। সত্য’ই আলফির অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণভাবে পুড়িয়েছে তাই তার গুরুত্ব এবং তার প্রতি অনুভূতিগুলো আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। যা তার উপস্থিতিতে আমার কাছে অপ্রকাশ্যমান ছিল।
আলফি ফেরার পর থেকে তাকে আমি একা পাচ্ছিলামনা। তাতে আমার ভিতর’টায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। কতবার তার রুমের সামনে ঘুরে আসলাম। কিন্তু দুলাভাই তার সাথে জরুরী কথাবার্তায় ব্যস্ত। এমনি সময় হঠাৎ আপুর ব্যথা বাড়ে। আপুকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ছুটে যায় দুলাভাই আর আলফি। সাথে আপুর শ্বশুড় ও যায়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সাথে মেয়েলোক নিতে চায়নি আপুর শ্বশুড়। তাও আপুর শ্বাশুড়ীর অস্থিরতায় বাধ্য হয়ে তাকে সঙ্গে নিল। দুঃশ্চিন্তায় আমি একদন্ড হয়ে স্থির হয়ে বসতে পারছিলামনা। একটা খবরের অপেক্ষায় সারারাত জেগে বসে রইলাম।
মধ্যরাতে দুলাভাই আর আপুর শ্বাশুড়ী ফিরলেন। আশ্বাস দিয়ে জানালেন নরমাল ব্যথা। ডাক্তাররা ডেলিভারির ফিক্সড ডেট দিয়েছেন। সকাল হলে চেক আপ করে আপুকে রিলিজ দিবে। আলফি আর আপুর শ্বশুড় ওখানে’ই আছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিশ্রাম নিতে গেলাম। চোখ দু’টো ঘুমের জন্য বারবার বন্ধ হয়ে আসছে।
সকালে আপু সুস্থাবস্থায় বাসায় ফিরে আসল। আলফির ধূসর চোখ দুটোয় ঘুমহীন রাত্রির ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তখন তেমন কোনো কথা হলনা। সে রুমে গিয়ে গোসল দিয়েই গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।
ছাদের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আজ আকাশে কোনো তারা নেই, চাদ থাকলেক তার আলো নিস্তেজ। ধীরব ধীরে পূর্ণগ্রাস হচ্ছে তার। বাতাসহীন এক অন্ধকার থমথমে পরিবেশে এককোণায় পড়ে থাকা আমি চুপচাপ অপেক্ষার প্রহর গুনছি।
পায়ের শব্দে টের পেলাম আলফি আমার পাশে এসে ঠায় দাড়িয়ে আছে। আমি উঠে দাড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ আমার দিকে নিবদ্ধ। সে ছোট্ট করে মিষ্টি স্বরে আমায় ডাকল, “রেহজান।”
আমি একটু কাছে এগিয়ে আসলাম। সে হয়ত আশা করেছিল আমি তাকে জড়িয়ে ধরব কিংবা অনেক প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ করতে করতে আমার চোখ ছলছল করে উঠবে।
আলফি হতাশা আর কৌতূহলের সংমিশ্রণ কন্ঠে বল,
— রেহজান, আপনি কি নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে পেরেছেন? আমি প্রত্যুত্তরে চুপ করে রইলাম। আলফি এককদম এগিয়ে এসে আমার চোখে চোখে রেখে বলল,
— আমার অনুপস্থিতি কি আপনার হৃদয় কে নাড়া দিতে ব্যর্থ? আমি কঠিন চোখ-মুখে স্বাভাবিক কন্ঠে’ই তাকে প্রশ্ন করলাম,
— আপনি কি সত্যিই জ্বীন?
আমার প্রশ্নে আলফি চোখ বিস্ফোরিত হয়ে এল, তার ঠোটগুলোর কম্পন আমি অনুভব করছি। থমথমে পরিবেশটা আমাদের দুজনের নীরবতায় আরো কঠিন হয়ে উঠল।
.
(চলবে)
জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-০৮
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
নীরবতার দেয়াল কেবল বিস্তৃত হচ্ছে। আলফি এখনো তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে কিছু একটা ভাবনায় ব্যস্ত। আমার ওর চুপ থাকা সহ্য হচ্ছিলনা। গলার স্বর উচিয়ে পুনরায় বললাম,
— আমি সত্যিটা বলুন। আপনি আসলে’ই জ্বীন? হ্যা কিংবা না। আলফি চোখ তুলে আমার দিকে একপলক তাকায়। তারপর কিছু না বলে ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে যায়। পিছু ডাকলাম কয়েকবার কিন্তু সে কর্ণপাত করলনা। আমি রিক্তশূন্য মুখে আবার ছাদের মেঝেতে’ই বসে পড়লাম। আলফি কেন উত্তর না দিয়ে চলে গেল প্রশ্নটা আমার মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন একটা অবাস্তব প্রশ্ন কখনো কাউকে করতে হবে আমি ভাবতেও পারিনি। তবে আলফির এভাবে পালিয়ে যাওয়া আমাকে ব্যাপারটা গুরুতর ভাবাচ্ছে।
দেয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে চোখ বুজতে’ই কালকে মধ্যরাতের ঘটনা চোখে ভেসে উঠল।
দুলাভাই হসপিটাল থেকে ফেরার পর আমাকে রুমে ডাকলেন। আচমকা এভাবে ডাকতে দেখে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আপুর গুরুতর কোনো সমস্যা হয়নি তো! সাতপাচ ভাবতে ভাবতে দুলাভাইয়ের দরজায় কড়া নাড়লাম। উনি হাতের কাজ করতে কারতে গম্ভীর স্বরে দরজা লক করে তার সামনে বসতে বললেন। আমি চুপচাপ তার আদেশমত কাজ করলাম। কিছু সময় নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি আপুর ব্যাপারে কিছু বলার ছিল?”
দুলাভাই ল্যাপটপ অফ করে আমার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছি। উত্তেজিত না হয়ে মনোযোগ দিয়ে আগে আমার কথাগুলো শুনবে।” আমি মাথা নাড়লাম।
— রেহজান, আমি জানি আলফি আর তোমার মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশিকিছু চলছে। এই ব্যাপারটায় আমার আপত্তি আছে তা নয়, আমি বরং খুশি ই। কিন্তু যেহেতু তোমরা একে অপরের প্রতি সিরিয়াস, সেহেতু তোমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি সত্যটা বলতে বাধ্য হচ্ছি।
আমাদের ব্যাপারটা দুলাভাইয়ের মুখে এভাবে শুনে আমি লজ্জায় নেতিয়ে পড়লাম। শেষের কথাগুলো আমার কানে বাজল। কিছুটা অস্থির হয়ে কৌতূহলমিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, “কি সত্য?”
— জানি তুমি এই জেনারেশনের মেয়ে হয়ে কথাটা বিশ্বাস করবেনা তবুও এটা’ই সত্য। আর সত্যটা হল আলফি একজন জ্বীন।
আচমকা কথাটা শুনে আমি অবাক-সন্দেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দুলাভাইয়ের গম্ভীর চেহারা দেখে আমার মনে হচ্ছে না উনি মজা করছেন।
— আপনি কিসের ভিত্তিতে এত দৃঢ়কন্ঠে এটা বলতে পারছেন? আলফি জ্বীন এটা সুস্থমস্তিষ্কের কেউ কখনো’ই বিশ্বাস করবেনা।
— তুমি হয়ত জ্বীনদের ব্যাপারে তেমন কিছু’ই জানোনা। তারা মানুষের সাথে এমনভাবে মিশে থাকে, আপাততদৃষ্টিতে তাদের ঠাহর করা মুশকিল। আলফিও তেমন একজন। তাকে দেখতে মানুষের ন্যায় লাগলেও সে জ্বীনজাতির একজন।
আমার কেন জানি এখন রাগ হতে লাগল, সহ্য করতে পারছিলামনা এসব অবাস্তব কথা। রেগে চেচিয়ে উঠলাম,
— দুলাভাই সে আপনার ভাই। এসব কি বলছেন ভেবে বলছেন তো! আপনার কথাগুলো আমার ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। আপনি বিশ্রাম নিন, আল্লাহ হাফেজ।
উঠে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই থেমে গেলাম। ঘোরলাগা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম।
দুলাভাই মাথা নাড়িয়ে পুনরায় কথাটা বললেন,
— ঠিক ই শুনেছো। আলফি আমার আপন ভাই নয়, ইনফ্যাক্ট ও আমার পরিবারের ই কেউ নয়।
আমি ফিরে এসে আগের জায়গাতে ধপ করে বসে গেলাম। আমার শরীর অজানা কারণে কাপছে। ডানহাতের পিঠ দিয়ে বারবার ঘমার্ক্ত কপাল মুছছি। দুলাভাই আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
— আমরা জাতে ইরানী, খুব ছোট্টবেলায় আব্বা দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে৷ স্থায়ী হয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানের শহরগুলো এত ঘনবসতিপূর্ণ ছিলনা। শোনা কথা ছিল প্রায়শ অধিকাংশ বাসা খালি পড়ে থাকত জ্বীনের উপদ্রবে। “জ্বীনের বাড়ী” নামে খ্যাত এমন এক পরিত্যক্ত বাসায় আমরা উঠি। আব্বা সাহসী ছিলেন এসব জ্বীন-ভূত বিশ্বাস করতেননা। তাই অনেকের বারণ সত্ত্বেও সস্তায় এমন বাসা ভাড়া পেয়ে উঠে যান আমাদেরকে নিয়ে। বাসায় উঠার পর থেকে আমরা আলাদা একজনের অস্তিত্ব খুজে পাই।
এইটুকু বলে দুলাভাই থামলেন। আমি পানি খাওয়া শেষ করে দুলাভাইয়ের দিকে আগ্রহের সহিত তাকালাম। আমার সায় পেয়ে দুলাভাই হাত মুষ্টি করে বলল,
— সে ছিল নিতান্ত ৫ বছরের বাচ্চা। রাতে উপরতলা থেকে তার কান্নার আওয়াজ আমাদের ভীত করে তুলত। যা দিনের বেলায় শুনতামনা। অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, সে উপরতলা থেকে কখনোই নিচতলায় নামতনা। প্রথম ২দিন আব্বা ব্যাপারটা বিড়ালের কান্না বলে ভেবেছিলেন। তাই আমরাও কেউ উপরতলায় গিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করিনি। যেহেতু আমরা কেবল নিচতলা ভাড়া নিয়েছিলাম, তাই উপরে যাওয়ারঅও দরকার হয়নি।
৩য় দিন আম্মা রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি আর আমার বোন বাহিরে খেলছিলাম। আম্মার ভাষ্যমতে, সে রান্নাঘরে টুপ করে ঢুকে পড়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে আরবিতে বলে,
— মা, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
আকস্মিক এমন ফুটফুটে বাচ্চা দেখে আম্মা ভয় পেলেও তাকে খেতে দেয়। আব্বা খবর পেয়ে কাজ ফেলে বাসায় এসে দেখে ছেলেটি আম্মার কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে।
ঘুম থেকে উঠলে তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। সে শুধু জ্বীনের বাচ্চা, তার নাম আলফি এইটুকু ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি। আব্বা তাকে খেদিয়ে দিতে চাইলেও আম্মা পারেননি। এতে আব্বা কড়া শাসন করে বললেন,
— এই বাচ্চার মা-বাবা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া একে আমরা রেখে আমাদের নিজেদের বাচ্চার ক্ষতি করতে পারিনা।
কিন্তু আম্মা ছিলেন একরোখা। কিছুতেই উনি বাচ্চাটাকে ছাড়বেননা। একে তিনি সন্তানের মত পালন করবেন। আব্বা আম্মার জেদের কাছে হার মেনে নিলেন সেই থেকে আলফি আমাদের পরিবারের একজন। এসব আমি বড় হওয়ার পর জেনেছি, আর কেউ এসব ব্যাপারে অবগত নয়।
দুলাভাইয়ের বলা কথাগুলো সত্য মনে হলেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনোরকমে নিজের রুমে এসে অবশের মত শুয়ে রইলাম। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও নিজের মন কে শান্ত করতে পারলামনা। সকালবেলা সিদ্ধান্ত নিলাম সত্যটা আলফির কাছ থেকে জানব। আলফি যদি জ্বীন হয়, তবে সেটা তার নিজের ভালো করে জানার কথা। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল, যদি সত্যিই আলফি জ্বীন হয় তাহলে এই সম্পর্কের কি পরিণতি হবে…..
পাশে কেউ বসেছে টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম। আলফি তখনো মাথা নিচু করে আমার পাশে বসে আছে। একটু চুপ থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,
— আপনি আমার নিজের একজন। আপনার থেকে সত্যটা লুকিয়ে রাখতে চাইনা। আমি একজন জ্বীন।
কথাটা শুনে আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলনা। হয়ত আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম এমন একটা উত্তর শুনব। ধীরগলায় বললাম,
— আপনি নিজের জাতির কাছে কেন ফিরে যাচ্ছেন না?
আলফি নাক টেনে নিয়ে ধরাগলায় বলল,
— বুঝ হওয়ার পর থেকে এই পরিবারটাকে নিজের পরিবার হিসেবে জেনেছি। কখনো মনে হয়নি আমি তাদের মত কেউ নয়। আর আমার জাত-পরিবার! যারা ৫বছরের বাচ্চাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল একা একটা বাড়ীতে। ৪দিন আমি অনাহারে ছিলাম, মাটির সাথে শরীর লেগে গিয়েছিল। তাও উপরতলা থেকে সরতাম না এই ভেবে যদি মা-বাবা এসে আমাকে না পায়। সারারাত মায়ের জন্য কাদতাম, আর দিনের বেলা ক্ষিধে নিয়ে ঘুমাতাম। একদিন ক্ষিধে সইতে না পেরে নিচে নেমেছি, মনে হয়েছিল চোখের সামনে যেন মাকে দেখছি। সেদিন থেকে উনি ই আমার মা আর এরাই আমার পরিবার। আমি মনে রাখতেও চাইনি এই পরিবারের ছেলের বাহিরে আমার আর কোনো পরিচয় থাক।
আমি চুপ করে আলফির কথা শুনছিলাম। আলফি হঠাৎ আমার হাতটা তার গালে চেপে ধরে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
— আমি আপনাকে হারানোর ভয়ে সত্যটা কখনো আপনাকে জানাতে চাইনি। আমি সত্যি আপনাকে নিজের মানুষ হিসেবে পেতে চাই। অনুগ্রহ করে, জ্বীন বলে আমাকে ফিরিয়ে দিবেননা! আমাকে সারাজীবন আপনার পাশে থাকার সুযোগ দিন।
আমি আলফির কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। আর এক মূহুর্ত সেখানে না থেকে দৌড়ে রুমে চলে এলাম।
ভিতরে ঢুকে দুলাভাইকে আমার রুমে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি এখানে!”
— কাল পুরো কথা না শুনে চলে এলে, তাই আরো কিছু কথা বলতে এলাম।
আমি স্বাভাবিক হয়ে তার মুখোমুখি বসে বললাম,
— বলুন।
.
(চলবে)