জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-০৯,১০
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০৯
আমার মধ্যে তখনো তিক্ত যন্ত্রণা ঘুরপাক খাচ্ছে। দুলাভাইয়ের কথার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মত মানসিকতা পাচ্ছিনা। তাও মেঝের দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার অপেক্ষা করছিলাম। দুলাভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে কেশে বলা শুরু করলেন,
— আমি জানি, তোমরা দুজন গভীর প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছো। দু’জনার দু’জনকে ছাড়া থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে। তোমরা যদি চাও সব সত্য আর বাস্তবতা মেনে নিয়ে এক হতে তবে আমি তোমাদের সাহায্য করব। তার আগে তুমি একটু চিন্তা-ভাবনা করে নাও বাস্তবতা মেনে নিতে পারবে তো! জেনে-বুঝে জ্বীনজাতির একজনের সাথে আজীবন কাটানোর সাহস তোমার আছে?
ধরে নিলাম তুমি পারবে। কিন্তু একসময় যদি আলফির মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে কিংবা তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে নিতে আসে তখন তুমি কি করবে? আমি চাইনা তুমি তোমার আপুর মত আবেগের ঝোকে ভুল করে বসো। তার মত ক্রেজি হও। তুমি অনেক বুদ্ধিমতী এবং শক্ত ধরণের মেয়ে। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও সেই অনুযায়ী আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নিব।
আমি আর কিছু বলার সুযোগ পেলামনা। দুলাভাই কথাগুলো শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। আমি দরজা আটকে শুয়ে রইলাম। মাথার মধ্যে দুলাভাইয়ের কথাগুলো টাইফুনের মত ঘুর্ণিপাক খাচ্ছে। সত্যি’ই তো এই সম্পর্কের ভবিতব্য কি? অন্য জাতির কাউকে বিয়ে করা জায়েয হবে? আলফির মানসিকতা বা আচরণ কখনো পরিবর্তন হবেনা তার গ্যারান্টি কি? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর অন্ধকারে পথ হারানোর পথিকের মত হাতড়ে বেড়াচ্ছি। এইদিকে একনাগাড়ে ফোনের টোন বেজে যাচ্ছে। আলফি অবিরত কল করায় ফোনটা সাইলেন্ট করে টেবিলের উপর ছুড়ে ফেললাম। মাঝরাতে টের পেলাম কেউ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের উপর দু’ফোঁটা চোখের পানি পড়ামাত্র উঠে বসে ল্যাম্প জ্বালিয়ে অবাককন্ঠে বললাম,
— আপনি এখানে কেন এসেছেন? দরজার দিকে একনজর উঁকি দিয়ে বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলাম, কিভাবে এলেন? কেউ দেখে নিলে কি কেলেঙ্কারি ঘটবে আপনার ধারণা আছে! এক্ষুনি বেরিয়ে যান।
আলফি প্রতিবারের ন্যায় একটানে আমাকে বুকের কাছে জাপটে ধরে। তার হৃদপিন্ডের প্রতিটি স্পন্দন আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। কিছুটা সময় যাওয়ার পর এক ধাক্কায় তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। রোষপূর্ণ চাহনীতে তার দিকে তাকালাম। সে আমার কোলে মাথা ঝুকিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদছে আর মিনমিনে গলায় বলছে,
— ভালোবাসা সংজ্ঞা আমার জানা নেই রেহজান। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কেবল এটা’ই মনে হচ্ছে আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমি বুঝতে পারি আপনার-ও আমার জন্য অনুভূতি কাজ করে। আপনিও আমাকে চান। কেবলমাত্র আলাদা জাতির জন্য সমস্ত কিছু মিথ্যে করে দিতে চাচ্ছেন।
আপনি আর আমি যদি একে অপরের পাশে থাকি, তবে আল্লাহ চাহে কোনো জাত-বিভেদ আমাদের বিচ্ছেদ করতে পারবেনা। এইটুকু বলে সে মাথা তুলে আমার পানে তাকায়।
আমি প্রাণহীনদৃষ্টি মেলে তাকে জিজ্ঞেস করি,
— এই সম্পর্কের ভবিতব্য কি? আদৌ আলাদা জাতিতে সম্পর্ক জায়েয? আমাদের আগামী প্রজন্ম সংকটাপন্ন হবেনা তার নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারবেন?
আলফি রিক্তশূন্য চেহারায় অসহায় চাহনীতে আমার দিকে তাকাল। আমি আবেগহীন কন্ঠে জোর এনে বললাম,
— আগে নিজের বিবেকের কাছে এসব প্রশ্ন করুন। আবেগ দিয়ে বাস্তবতা সাজাতে যাবেননা। আপনি প্লীজ এখান থেকে চলে যান। আমি এসব নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াতে চাইনা।
আমি খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে। মুখের উপর সোজা কথা বলতে পছন্দ করি। অযথা ইমোশোন দেখাতে পারিনা। এইজন্য অনেকে ভাবে আমি নন-ইমোশোনাল। ইমোশোন দেখাতে পারিনি বলে যাকে অনেকবছর ধরে পছন্দ করে আসছিলাম সে কখনো আমাকে বুঝতে পারেনি। তাই নিজেকে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। আলফি যেন এতদিনের আমি’কে বদলে দিল। সবকিছু ভুলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আলফি’কে আমি নিজের করে চাই এটা চরম সত্য। কিন্তু বাস্তবতার টানা-পোড়নে মনের সুপ্ত চাওয়াটাকে কবর দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ’ই খোলা নেই। আলফি’র কথায় আমার ধ্যান ভাঙ্গে। চট করে ওড়নায় চোখ দু’টো মুছে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকালাম।
ওর দৃষ্টি বাগানের প্রস্ফুটিত বেলীফুলগুলোর দিকে। শেষ বিকেলের সিগ্ধ রোদ ওর মুখে এসে পড়ছে। রক্তবর্ণা রোদে তার চেহারা আরো মায়াময় হয়ে উঠেছে। এলোমেলো চুল আর চোখের নিচে কালশেটে বর্ণ দাগ নিষ্পাপ একটা চাহনী তৈরী করেছে। আমি তার ধূসর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলামনা। সবভুলে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি । দৃষ্টি আমার দিকে এনে আলফি কান্নাজড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে,
— আপনি সত্যি’ই ফিরে যাচ্ছেন?
— মায়া বাড়িয়ে কি লাভ যেখানে মায়া ত্যাগ করা উচিত! আলফি থম মেরে যায়। তারপর ছলকে উঠা চোখ বুজে বপড় বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
— যেতে চাইলে আটকাবনা। আমি আপনাকে কখনো’ই ভুলতে পারবনা। আর কোনোদিন আপনার সামনে না পড়লেও আমার অস্তিত্ব আপনাকে সবসময় আবিষ্ট করে রাখবে। যেখানে’ই থাকবেন, ভালো থাকবেন।
বলে দ্রুতপদে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে গেল আলফি। এক অজানা ঘূর্ণিঝড়ে আমার পৃথিবী’টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতরে বড় কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট তীব্র হয়ে উঠছে। এখন আলফি’র বাহুডোর ই যেন আমাকে শান্ত করতে পারে। ব্যাগ গুছানোর সময় আপু আমার রুমে ঢুকে বিছানার উপর থাকা পাসপোর্ট, ভিসা পেপার ছো মেরে নিয়ে নেয়। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— আপু এসব কি পাগলামী!
— সেটা আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি এসব কি পাগলামী করছিস তুই? আজীবন উপরের শক্ত ঢালাই দেখিয়ে আমাকে আর কত বোকা বানাবি!
— আমি কাউকে বোকা বানাচ্ছিনা। আমি চলে যেতে চাচ্ছি আমার এখানে আর ভালোলাগছেনা। এসব নিয়ে কোনো কথা বলিসনা।
— ঠিক আছে বলবনা। শুধু এটা জিজ্ঞেস করব, আলফি’র দোষটা কি? বাবার মত তুইও ভিনদেশী বলে মানতে পারছিসনা।
— যা জানিসনা তা নিয়ে কথা বাড়াসনা। আলফি আর আমার মিল কখনোই সম্ভব নয় শুধু এইটুকু জেনে রাখ।
— সবসময় তোর জেদ-একঘেয়েমি উপরে রেখেছিস। নিজের ভিতরটাকে কখনো বুঝতে শিখিসনি। চলে গিয়ে তুই ভালো থাকবি? আলফিকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা এই খবরটা তোর ভিতরকে এতটুকুও নাড়া দেয়নি!
কথাটা শুনে আমি ব্যাগ গুছানো বন্ধ করে আপুর দিকে তাকালাম। মূহুর্তে আমার কি হয়ে গেল টের পেলামনা। আপুকে কাছে টেনে অনবরত জিজ্ঞেস করলাম। আপু জানাল, কাল বিকালের পর থেকে আলফি বাসায় ফিরেনি। ফোন ও সুইচ অফ। একটু আগে রুস্তম বেরিয়েছে ওর খোজ করতে। না পেলে থানায় জিডি করবে।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখি আপুর শ্বাশুড়ী এককোণায় বসে নিশ্চুপে কাদছেন। বাকিরাও চিন্তায় অস্থির।
আপুর শ্বাশুড়ী আমাকে দেখে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমার হাত টেনে নিজের রুমে নিয়ে চলে আসেন। তারপর দরজা লক করে কেদে কেদে বলেন,
— আমাকে যখন আলফি প্রথমবার মা ডেকেছিল আমি সেই ডাকে থমকে গিয়েছিলাম। এত মধুময়, আবেগী ডাক বুকের ভিতর’টা এক শীতল ঠান্ডা অনুভূতি এনে দিয়েছিল। আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। জ্বীনের বাচ্চা জেনেও ওকে নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম দেখিনি। বরং ওর আমার প্রতি ভালোবাসা দেখে মনে হত সে আমার নিজের ছেলে। জ্বীন জেনেও এতগুলো বছর আমি তো ওকে বুকে ধরে লালন-পালন করতে কার্পণ্য করিনি। তবে তোমার কেন তাকে মেনে নিতে এত আপত্তি?
ভবিষ্যতের কথা ভাবছো তো? যেখানে সৃষ্টিকর্তা তোমাদের জুটি বেধে দিয়েছেন সেখানে তুমি কিসের চিন্তায় উতলা! তোমরা দু’জন একে অপরের ভাগ্যে থাকলে, আল্লাহ তোমাদেরকে মিল লিখে রাখলে কি নিয়ে এত সংশয়-দ্বিধা!
আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, সব উনার ইচ্ছেতে’ই হচ্ছে।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু মাথায় ঘুরছে, আলফি কোথায়? ওকে ফেরাতে হবে। আমি পাগলের মত বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলাম আলফিকে খুজতে। কিন্তু কোথাও খুজে পেলামনা। দুলাভাই এসে জানাল উনিও আলফির খোজ পাননি। থানায় জিডি করে এসেছেন, তারা খোজ পেলে’ই জানাবে। শুনে সবাইকে এক বিমর্ষতা আকড়ে ধরল। আমি শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম, আলফিকে যেন ফিরে আসে।
.
(চলবে)
জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-১০
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
ঈশান কোণে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা, চারিদিকে হালকা ঝড়ো বাতাস বইছে। বিকেলটা’কে এখন সন্ধ্যা নামার পূর্বমূহুর্ত মনে হচ্ছে। ছাদের কোণায় দাড়িয়ে রাস্তার ব্যস্ত মানুষগুলোর ছুটোছুটি দেখছি একমনে। কখন যে খোপা আলগা হয়ে চুলগুলো বাতাসে উড়তে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। আপু কিছুক্ষণ আগে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য ডাক ছাড়ল। তা আমার কর্ণকুহরে অন্দরে প্রবেশ করলনা। ঠায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আলফি অপরাধী চোখ-মুখ নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি তার দিকে ফিরে-ও তাকালামনা। নামার উদ্যোগ নিতে’ই সে দুইহাত প্রসারিত করে আমার পথ আটকাল। মাথা নিচু করে বলল,
— দুঃখিত। আমার এভাবে সবাইকে চিন্তায় ফেলা উচিত হয়নি। তার কথায় আমার জমানো ক্ষোভ মূহুর্তে বাঁধ ভেঙ্গে কন্ঠে উপচে পড়তে লাগল।
— আমি নাহয় আপনার কেউ না। আমার চিন্তা করা না করায় আপনার কিছু এসেও যায়না। কিন্তু আপনার পরিবারের কথা তো একবার ভাববেন, যারা এতদিন স্নেহে-যত্নে আপনাকে আগলে রাখল তাদের কষ্টের কথা তো মাথায় রাখবেন।
— আমি কেবল আপনার করা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে গিয়েছিলাম। আর উত্তর নিয়ে’ই ফিরে এসেছি।
— আমার কোনো উত্তরের প্রয়োজন নেই। আপনি জানেন আমিও আপনাকে নিজের করে আজীবন পাশে চাই। বাকি’টা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তার হাতে ছেড়ে দিলাম। আলফি বিস্ফোরিত নেত্রে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি প্রথমবারের মত স্বেচ্ছায় আলফির হাত ধরলাম। হাতটা এত তুলতুলে কেন ঠিক যেন একদলা তুলোর পাজড়! আলফি ঠোটে মুচকি হাসি, আর দৃষ্টিতে একরাশ ঘোর লেগে আছে। আমার শক্ত ধাচের রূপের আড়ালের অন্য রুপ দেখে সে হয়ত প্রচন্ড অবাক। আমি তার হাত আমার দুহাতের মুঠোয় রেখে বললাম,
— আমাদের চলার পথ অন্যান্য দাম্পত্য জীবনের মত এত মসৃণ হবেনা হয়ত। হতে পারে অনেক প্রত্যাশিত কিছু আমাদের অপেক্ষায় আছে। পাশে থেকে একসাথে সব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে লড়াই করতে আপনি প্রস্তুত তো?
আলফি একটানে আমাকে বুকের কাছে জাপটে ধরল। তার বেড়ে যাওয়া শব্দ উত্তোলিত হৃদস্পন্দন আমি অনুভব করতে পারছি। আমার খুলে যাওয়া চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে হালকা বিলি কাটতে কাটতে বললেন,
— শেষ নিঃশ্বাস অবধি আপনার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ইনশা-আল্লাহ সব খারাপ সময়ের বিপরীতে আমরা জয়ী হব।
দুই পরিবারের মত নিয়ে আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হল। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বিয়ের কার্য অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সবাই। ভিসাসংক্রান্ত ঝামেলার কারণে আমার পরিবার বিয়ের আগে পাকিস্তানে আসতে পারছেনা। তবে উনারা জানিয়েছেন, বিয়ের তারিখে আসার চেষ্টা করবেন। সম্ভব না হলে বিয়ের পর পর’ই উপস্থিত হবেন। আমার বিয়ের সকল দায়িত্ব দুলাভাইয়ের উপর অপর্ণ করলেন, দুলাভাই-ও হাসিমুখে দায়িত্বের ভার নিয়ে উনাদেরকে আশ্বাস দিলেন। মা-বাবা, রাফিন আসবেনা জেনে মনটা বিমর্ষিত ছিল। আপু আমাকে ছোট্ট বাচ্চাদের মত বুঝাচ্ছিল। ভীষণ ভালোলাগছিল আমার আবেগী বোনটা আজ দায়িত্বশীলের মত আচরণ করছে। বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে আমাকে আগের বাসায় নিয়ে এল আপু। পরিবারের লোকজন দুপক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে। আপু, তার চাচীশ্বাশুড়ী আর ননদ কনেপক্ষ হয়ে আমার সাথে আলাদা বাসায় উঠলেন। দুলাভাই উকিলের কাজ করার দায়িত্ব নিলেন।
সবমিলিয়ে এক অপূর্ব মূহুর্ত পার করছিলাম। বিয়ের সকল আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে গেছে। আলফি হাতে হাতে দুলাভাইকে এসব সাহায্য করছে, তাই বিয়ের আগে আমাদের দুজনের ও দেখাদেখি হচ্ছিলনা। টুকটাক কথাবার্তায় তা সীমাবদ্ধ। মেহেদী রাঙ্গা হাত দেখে বারবার চেহারা লাজরঞ্জিত হয়ে যাচ্ছিল। কাল রাতে আমাদের বিয়ে এইকথা ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম। জানিনা, ভাগ্যে কি আছে! তবে সব যেন ভালোই ভালোই হয়ে যায়।
ফোনের স্ক্রিনে আলফির নাম ভাসামাত্র কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে ফিসফিস কন্ঠে উপরতলায় আসতে বলা হল। সবার অগোচরে, বাড়ীভর্তি লোকচক্ষু ফাকি দিয়ে উপরতলায় ছুটে এলাম। সারারার ওড়না মাটিটে লুটোপুটি খাচ্ছে সেদিকে নজর নেই আমার।
আলফি মুখ থেকে কালোচাদর সরিয়ে আমার দিকে বিমোহিত চাহনীতে তাকাল। আমি সেই চাহনীতে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেলাম। আজ আমাকে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মাঝ বরাবর সিথি করে দুইপাশে কার্লি করে চুল ছেড়ে দেওয়া সাথে ম্যাচিং করে বড় টিকলী-ঝুমকো পড়িয়েছে, পরনে মেরুন রঙ্গের সারারা, হালকা ব্রাইড সাজ আর দুইহাত ভর্তি শুকিয়ে যাওয়া মেহেদী।
আলফি এগিয়ে আমার বামহাতের মাঝখানের আঙ্গুলটা শক্ত করে ধরল আর অস্ফুটস্বরে বলল, আমার জান্নাতের হুর। আমি এইদিক সেদিক তাকিয়ে তাড়া দিলাম,
— এখন চলে যান। কাল রাত পর্যন্ত আমাকে আপনার বধূরূপে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করুন। ঠেলে ঠেলে সিড়ি পর্যন্ত আনতেই আলফি থেমে আমার দিকে ফিরে তাকাল।
মুচকি হেসে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলল,
— আমি আপনাকে ভালোবাসি রেহজান।
চারদিক থেকে এক মিষ্ট অবশ অনুভূতি আমাকে আবিষ্ট করে রাখল। আলফি এর আগে কখনো আমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলেনি। এতদিনে আমি উর্দু ভাষা প্রায় রপ্ত করে ফেলেছিলাম। আলফির মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে আমার ভিতরে তোলপাড় শুরু হল। এক পরম ভালোলাগায় ডুবে রইলাম আমি।
পার্লার থেকে আনা মহিলাগুলো আমার সাজ করিয়ে আয়নার সামনে বসাল। একপলক নিজের দিকে তাকালাম, বিয়েটা পাকিস্তানী ট্রাডিশনাল মেনে হচ্ছে বলে সাজ সেই কালচারে দেওয়া হয়েছে। ভারী পুতি-জরির কাজ করা হালকা মিন্ট কালার গাউন সাথে ভারী কাজের ওড়না, একপাশে সিথি করে টিকলী-জড়োয়া পরিয়েছে, হালকা-ভারী মিলিয়ে গয়না, ব্রাইডাল মেক আপ, খোপায় কয়েকটা গোলাপ ফুল গোজা। প্রতিটি মেয়েকে’ই বউসাজে অন্যরকম সুন্দর লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তেমন লাগছে। আর কিছুক্ষণ রওয়ানা দিব, দুলাভাই গাড়ি নিয়ে আসার অপেক্ষা করছি। মেসেজ টোনের আওয়াজে ফোন হাতে নিলাম। শেরওয়ানি পরিহিত অবস্থায় বরসাজে আলফির ছবি আর নিচে ক্ষুদ্র বার্তা।
“তোমার আগমনের প্রতীক্ষায়…..”
আলফি’র ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে এল মাশা আল্লাহ। সাদা শেরওয়ানিতে ওকে রাজকুমারের মত লাগছে। আলফি যদি এখন আমার সামনে থাকত, নিশ্চিত আমি একনিশ্বাসে কবুল বলার মত ছ্যাচড়ামি করে ফেলতাম।
আপু পাশে এসে দাড়াতে’ই আমার ধ্যান ভাঙ্গল। আপু আমার দিকে তাকিয়ে কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল,
“মাশা আল্লাহ। আমার বোনকে আজ অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে।” আমি মুখ রাঙ্গা করে আনন্দে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ প্রচন্ড কষ্টে আমার নিঃশ্বাসে টান পড়ল। ধীরে ধীরে আপুকে ছেড়ে দিয়ে পেটের দিকে তাকালাম। সদ্য ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। পুরো গাউন রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। আপু এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি আরো ২-৩ বার আমার ক্ষতস্থানে ঢুকিয়ে বের করে নেয়।
আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলামনা, মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। ভীষণ যন্ত্রণায় ক্ষতস্থান হাত দিয়ে চেপে রাখলাম। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথা বের হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল আমার কন্ঠটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলাম। একসময় আমার শরীর-চোখ অবশ হয়ে পড়ে, তখন ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম অন্ধকার মৃত্যুর জগতে….
(চলবে)