জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১১,১২

0
1480

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১১,১২
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১১

সহসা বড় একটা বেদনার দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইফা। পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখল আর কোনো পাতা অবশিষ্ট নেই। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আধছেঁড়া এবং প্রায় বিকৃত পুরোনো বইটার অপলক তাকিয়ে রইল। রেহজানের করুণ পরিণতির শোক তার ভিতরটায় তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। ইফার ঘনিষ্ঠা বান্ধবী জাইমা পাশের চেয়ারটা টেনে বসল, একপলক বইটার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,
— “রেহজানের এমন মৃত্যু কাম্য ছিলনা!” ইফা একরাশ দুঃখ জড়ানো গলায় বলল,
— শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে রেহজান কি সত্যিই মারা গেছে? আলফির কি অবস্থা হয়েছিল? তার বড় বোন কিভাবে পারল এমনটা করতে?
উফফ! আর ভাবতে পারছিনা।

ইফা টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইল। তার মস্তিষ্কের হাজারটা ধাধা তোলপাড় করছে। মাথা তুলে জাইমার খোজে আশেপাশে তাকাল। জাইমা ততক্ষণে দু’কাপ চা নিয়ে হাজির। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইয়ুশফা বলল, “বইটার নিশ্চয়ই আরো কিছু পাতা ছিল।”
— আমি ঠিক জানিনা। দাদুর পুরোনো লাইব্রেরির এককোণায় এটা এই অবস্থায় পড়ে ছিল। এতটা বিকৃত অবস্থা দেখেও ইন্টারেস্টিং লেগেছে বলে নিয়ে নিলাম।
— আচ্ছা এটা কি সত্যি কাহিনী? নাকি কোনো লেখকের কাল্পনিক গল্প?
— অবশ্যই কাল্পনিক গল্প। জ্বীন কখনো মানুষের প্রেমে পড়ে নাকি? তার উপর বিয়ে, আকাশ-কুসুম কল্পনা প্রায়।

ইফা চা শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে জাইমার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। এসেছিল গ্রুপ স্টাডি করতে, কিন্তু জাইমার দেওয়া বইটা পড়ার চক্করে আর কিছু করা হলনা। একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বাসার দিকে পা চালায় সে। বাড়ির সামনে এসে নিচ থেকে উপরের ঘরটায় উকি দেয়। এরপর আবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে, ৫ মিনিট লেট হয়ে গেছে। হতাশামাখা মুখে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সে।
খবরের কাগজ রেখে ইফার রুমের দরজায় টোকা দেন আশফাক ইবনে সিনার। ইফা ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে বসে ভিতরে আসতে বলে। জনাব আশফাক ভিতরে ঢুকে ইফার দিকে তাকায়। ইফার চেহারায় বেশ খানিকটা বিষন্নতার ছাপ। দেখে আশফাকের কলিজা কেপে উঠে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা তুই ঠিক আছিস?”
— একদম। শুধু একটু ক্লান্ত। জনাব আশফাক ইফাকে বিশ্রাম নিতে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসেন। একমাত্র ভাগ্নিকে নিজের মেয়ের মত’ই ভালোবাসেন। ২ বছর আগে ইফার মা-বাবা দুজন অজানা রোগের সংক্রমণে মারা যান। ইফা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেচে ফিরে। তখন আশফাক স্বজন-পরিজনবিহীন ইফাকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।

উনি একা ছন্নছাড়া মানুষ, জার্নালিজমকে পেশা আর ট্রালেভিং নেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ভালোই আছেন। মা-বাবাহীন মেয়েটাকে কাছে পেয়ে দায়িত্বশীল হতে শিখেছেন সবে। ইফাও বেশ বুদ্ধিমতী এবং চঞ্চল ধরণের মেয়ে। পাকিস্তানের লাহোরের একটা ভালো কলেজে পড়াশোনা করে। এখানে সে নিজেকে সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে। আশফাক পুনরায় খবরের কাগজে মুখ গুজতে’ই কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে বাড়ীওয়ালীকে দেখে রাশভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— আপনি অসময়ে কি মনে করে?
— ইফার জন্য খাবসা নিয়ে এসেছি। মেয়েটা বেশ পছন্দ করে তো।
আশফাক কোনো প্রত্ত্যতুর না করে খবরের কাগজ পড়ায় মন দেয়। ইফা তখন ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়িয়েছে। বাড়ীওয়ালী আন্টিকে দেখে ছুটে এসে তার হাত থেকে বক্সটা নিল। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
— আন্টি চা বসিয়েছি খেয়ে যাও। মামা তোমাকে এক কাপ দিব? আশফাক আড়চোখে মহিলার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ালেন।

ইফা দূর থেকে তাদের এই চোখাচোখি দেখে মুচকি হাসল। বাড়ীওয়ালী আন্টি অনেক আগে থেকে তার মামাকে বেশ পছন্দ করে, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছিল। মামা নাকোচ করেছিলেন। আন্টিও দমে যাননি, রোজ একবার মামাকে না দেখে গেলে তার শান্তি লাগেনা। মানুষ হিসেবে আন্টি খুব ভাল, ইফাকে বেশ আদর করেন। এইকারণে মামা বাসা বদলাতে চাইলেও ইফার আপত্তির কারণে পারেনি।

বাসাটা তিনতলা, সামনে কিছুটা খালি জায়গা। তার সাথে একটা সরু রাস্তা। ইফা ও তার মামা নিচতলায় থাকে, দ্বিতীয়তলায় আন্টি ও তার বৃদ্ধ মা। তিনতলায় থাকে এক গোমড়ামুখো ছোকরা। বেশ কিছুদিন আগে উঠেছে। সবার সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ইফা কৌতূহলের বশে দু-একবার কথা বলতে চেয়েছে ছেলেটা কোনোরকম ফর্মালিটি সেরে কেটে পড়েছে। এরপর আর ইফা নিজে যেচে কথা বলতে যায়নি। তবে কৌতূহল থেকে ছেলেটার উপর নজর রাখে।

টুকটাক কাজ সেরে পড়তে বসে ইফা। বইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে রেহজান-আলফি’র কথা। এখন কেন জানি তারও ইচ্ছে করছে একটা জ্বীনকে বিয়ে করতে। সব জ্বীনরা কি আলফির মত ভালোবাসতে জানে? এতটা কেয়ারিং হয়? হঠাৎ মাথায় ভূত চাপে সে ও একটা জ্বীনবর খুজবে। তারপর তাকে নিয়ে আলফির কাছে যাবে। আর বের করবে রেহজানের মৃত্যুর রহস্য। ইস! রেহজান যদি মারা না যেত তবে কত সুন্দর একটা সংসার হত তাদের। রেহজানের কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা ভারী হয়ে আসে ওর।

নিজেকে হালকা করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ছাদের দিকে। চোখ আটকে যায় ছাদের এক কোণায় দাড়িয়ে থাকে ৬ফুটের বেশী মানুষটাকে। ইফা ধীরে ধীরে গিয়ে তার পাশে দাড়ায়। খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও মানুষটা তার দিকে ফিরেও তাকায়না। বেশ রাগ হয় ইফার, তাও নরমকন্ঠে বলে,
— শুনেছি সন্ধ্যাবেলা একা ছাদে থাকলে জ্বীন-পরী ধরে বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটা ভ্রু কুচকে ইফার দিকে তাকায়, তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলে,
— আপনি কি সেই কারণেই এসেছেন?
— বেশ বুদ্ধিমান আপনি। আমিও তাই চাই। আমাকে বিয়ে করে নিক তারপর আজীবন পস্তাক।
ইফার কথায় ছেলেটা হাসল। মুক্তোঝরা হাসি যাকে বলে। ইফা মুগ্ধচোখে হা করে তাকিয়ে দেখে। যারা খুব কম হাসে, তাদের হাসিটা’ই বেশী সুন্দর হয়। কথাটা ছেলেটার সাথে যায়। ছেলেটা হাসি থামিয়ে জ্বলজ্বল করা চোখে বলে উঠে,

— কে পস্তাবে সে যদি তা জানত! সময় থাকতে সর্তক হওয়া ভাল। এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয়, যা একপর্যায়ে কাল হয়ে দাড়ায়।
ছেলেটা মূহুর্তে তরতর করে নিচে নেমে যায়। ইফা অবাক হয়ে একইভাবে দাড়িয়ে ছেলেটার কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করে। অতঃপর নিজমনে ই বলে উঠে,

— দেখা ই যাক কি হয়! তবে আশা ছাড়ছিনা।
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-১২
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

কলেজ যাওয়ার আগে ইফা রাস্তা থেকে তিনতলার বারান্দার দিকে একবার উঁকি মেরে দেখে। বেশ কৌতূহলের বশে’ই প্রতিদিন সে একবার উঁকি মারে। কিন্তু কখনোই ছেলেটাকে বারান্দায় দেখেনা। সারাদিন একটা মানুষ রুমে বন্দি থাকতে পারে সেটা ইফার মাথায় ধরেনা। চোখ বুজে একবার ছেলেটার নাম মনে করার চেষ্টা করে। কি যেন নাম শুনেছিল কিন্তু মনে পড়ছেনা। জাইমা ততক্ষণে ইফার পাশে এসে বসল। ফিসফিস কন্ঠে বলল,
” আমার মনে হয়, আমি একটা ক্লু পেয়েছি।”
ইফা চোখ না তুলে’ই জিজ্ঞেস করে, “কিসের?”
— রেহজানকে কে মারতে পারে? রেহজান চমকে জাইমার মুখের দিকে তাকাল। বিজয়ের আনন্দে জাইমার চোখ দু’টো চকচক করছে। ইফা চাপা গলায় কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করে,
— কে মারতে পারে?
— আলফি। দেখ, আলফি যেহেতু জ্বীন। সে যেকোনো সময় অন্যকে ডাইভার্ট করে নিজের কাজ হাসিল করতে পারে কিংবা অন্যের রুপ ও ধরতে পারে। সো, আলফি রেহজানকে মারার পসিবিলিটি বেশী।
জাইমার এমন কথায় ইফার চোখ কপালে উঠল। সাথে সাথে জাইমার মাথায় গাট্টা মেরে হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, — ফালতু গবেষণা। আলফি রেহজানকে ভালোবাসে, সে কেন রেহজানকে মারতে যাবে?
জাইমা গাট্টা দেওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— এটা’ই তো রহস্য মনে হচ্ছে। আর ও হচ্ছে জ্বীন। আদৌ ভাল নাকি খারাপ সেটা তো উল্লেখ করা হয়নি। তাদের মন কখন কোনদিকে ঘুরে যায় তার ঠিক আছে?
ইফা গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। জাইমার কথাগুলোও ফেলে দেওয়ার মত নয়। জ্বীনজাতির সম্পর্কে ও যতটুকু শুনেছে তারা ভালোর চাইতে খারাপ কাজে বেশী ইনভলপ। কিন্তু এটা মেনে নেওয়ার মত না! আলফির যদি রেহজানকে মেরে ফেলার প্ল্যান থাকত তবে এতকিছুর কি প্রয়োজন ছিল? সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে।

ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার সময় মাঝপথে বৃষ্টিতে আটকে যায় ইফা। একটা ছোট্ট বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে মাথা গুঁজে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করে। মাথার মধ্যে তখনো গোঁজামিলের ধাঁধা মিলানোর প্রচেষ্টা চলছে। একনজর বাহিরের দিকে তাকায়, বৃষ্টির টিপটিপ ফোঁটাগুলো দেখতে ভালোলাগছে। ছাউনির বাহিরে হাত বাড়িয়ে দেয়, বৃষ্টির ফোঁটা তার হাতের তালুতে জমা হচ্ছে। হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় আসে ওর, আচ্ছা জ্বীনরা তো আগুনের তৈরী! তবে পানি লাগলে কি তাদের কোনো সমস্যা হয়? ওর ঝুলিতে যে জ্বীন সম্পর্কে কত কৌতূহলী প্রশ্ন জমা আছে! যদি কোনো জ্বীন দূর্ভাগ্যক্রমে তার মুখোমুখি হয় তবে প্রশ্নের আঘাতে’ই নিশ্চিত ছিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। ভেবে মুচকি মুচকি হাসে।

অনেকক্ষণ পর ও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখলনা তখন সিদ্ধান্ত নিল বাসার দিকে এক দৌড় দিবে। এক দৌড়ে নিশ্চয়ই খুব বেশী একটা ভিজবেনা। সাধারনভাবে মাথায় দেওয়া শিফনের ওড়নাটা ভালো করে পেচিয়ে নেয়। তারপর ব্যাগটা বুকের কাছে ঝাপটে ধরে দৌড়াতে থাকে সরু রাস্তায়। খানিকটা দৌড়ার পর পা পিছলে রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তাতে পুরো শরীর কাচা কাদায় মাখামাখি। নিজের এই অবস্থা দেখে তার রীতিমত কান্না পেল। উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার পড়ে যায়। একা একা উঠতে পারছেনা। হঠাৎ কারো খিলখিল হাসি শুনে পিছনে ফিরে তাকায় সে, গোমড়ামুখো ছেলেটা ছাতা মাথায় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এটা দেখে তার জোরে জোরে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু চোখ আটকে যায় গোমড়ামুখোটার বামপাশের টোলে। ইফাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি বন্ধ করে বড় ফ্রেমের চশমাটা আরেকটু ঠেলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয়। পিছন থেকে ইফা কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে,
— আমি বাসায় যাব!!!
ছেলেটা ফিরে তাকিয়ে বলল, “তো যান।”
— আমাকে টেনে তুলুন। ছেলেটা হকচকিয়ে উঠে বিরক্তিমাখা চেহারায় হাত বাড়িয়ে দেয়। ইফার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়, নিজে উঠে দাড়িয়ে ছেলেটাকে টান দিয়ে ফেলে দেয়। ছেলেটার হাত থেকে ছাতা ছিটকে অদূরে পড়ে যায়। ছেলেটা কাদামাখা মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে হালকা থরথর করে কেপে উঠছে, চোখ-মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। যতটা সম্ভব হাত দিয়ে নিজেকে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বাচানোর চেষ্টা করছে।

ইফা ছেলেটার এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। দ্রুত ছাতা নিয়ে এসে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দেয়। ছেলেটা ছাতা মাথায় দিয়ে উঠে দাড়িয়ে ইফার দিকে রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়। ইফা চোখ নামিয়ে নেয়, এই দৃষ্টি তাকে ভস্ম করে দিবে মনে হচ্ছে। ছেলেটা গটগট করে হেটে মূহুর্তে চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইফা তার হাটার সাথে তাল মিলাতে সক্ষম হলনা।

ইফা অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে তিনতলায় ছেলেটার ঘরের সামনে আসে। কাপা কাপা হাতে কয়েকবার দরজায় টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা বেরিয়ে আসে। ইফা এক্নজর ছেলেটার দিকে তাকায়। চশমা ছাড়া গোমড়ামুখোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ফর্সা চোখ-মুখ এখনো লাল হয়ে আছে। পরনে হোয়াইট টি-শার্ট আর ব্লু ট্রাওজার। ভেজা হালকা লালচে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
ইফাকে দেখে ছেলেটা বাজখাঁই গলায় বলল, ‘কি চাই?’ ইফা চোখ নামিয়ে অনুশোচনা নিয়ে বলল, ‘তখনকার ঘটনার জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি বৃষ্টিতে আপনার সমস্যা হয়।’ ছেলেটা প্রত্যুত্তরে কিছু বললনা। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ইফার অভিমান হয় বিড়বিড় করে বলে, ‘ চল্লিশ ডাকাতের গুহার দরজা পাইসে উনি। সারাদিন আটকে রাখতে হয়।’ বলে দরজায় একটা কষে লাথি মারে।
ভিতর থেকে বাজখাই গলার আওয়াজ আসে। কালক্ষেপন না করে দৌড়ে নিচে নেমে আসে।

আশফাক সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে চা খাচ্ছেন। তামাম দুনিয়ার এই একটা জিনিসে তিনি খুব মনোযোগী। এই সময় তার সামনে টর্নেডো হয়ে গেলেও তার হুশ হবেনা। ইফার মনে হয়, চা খাওয়ার সময় মামা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেন। ইফা গালে হাত দিয়ে মামার চা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। চা শেষ হওয়ার আগে সে যত কথা ই বলুক মামার হু-হা উত্তর ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবেনা। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায় ইফা, এই এক চাপ চা শেষ করতে মামা ঘন্টাখানেক সময় লাগিয়ে দিবেন। ‘মামা তোমার চায়ে তেলাপোকা পড়েছে’ বলে চায়ের কাপটা হাত থেকে কেড়ে নেয় ইফা। আশফাক সাহেব লাফিয়ে উঠে এগিয়ে আসে, ‘কই দেখি দেখি!’
— দেখতে হবেনা, তেলাপোকা সহ খাবে নাকি? আমি ফেলে দিয়ে আসছি।
— আরেক কাপ নিয়ে আয় তাহলে।
— চায়ের ফ্ল্যাক্স খালি, আবার বানাতে হবে। সন্ধ্যায় খেয়ো।

আশফাক সাহেব সেটা শুনে দুঃখী মুখ নিয়ে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে।
— মামা, তুমি জ্বীনে বিশ্বাস করো?
আশফাক সাহেব তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠে বসে কাচুমাচু কন্ঠে বলে, “অবশ্যই।”
ইফা কৌতূহলী কন্ঠে বলে, “তুমি কখনো দেখেছো?”
— দেখিনি, শুনেছি আমার জেঠা দেখেছেন, ইয়া বড় দানবের মত। হাতির মত কান, আগুনের মত চোখ। জোকারের মত নাক, গোপাল ভাড়ের মত ভুড়ি। মাথায় ষাড়ের মত দুখানা শিং। আমার জেঠা যখন মাঝরাতে তাজা মাছ নিয়ে বাজার থেকে তেতুলগাছের নিচ দিয়ে ফিরছিলেন তখন জ্বীনটা তার সামনে দু’পা চেগিয়ে দাড়ায়। বলে কি জানিস, আমাকে মাছ দিয়ে দে নাহলে আমার পায়ের নিচে দিয়ে যা।
জেঠা ছিল খুব বুদ্ধিমান। বলে, মাছ দিয়ে দিব। কিন্তু আগে আমি বাড়ি পৌছাই তারপর। নাহলে গ্যারান্টি কিআপনাকে মাছ দেওয়ার পর আমাকে মারবেন না?
জ্বীনটা রাজি হল। জেঠা বাসায় ফিরে মাছ রেখে খুন্তি গরম করে বাহিরে এসে জ্বীনকে বলে, আপনি চোখ বন্ধ করে হা করুন আমি আপনার মুখে মাছ ঢুকিয়ে দিচ্ছি।
জ্বীন সেটাই করে, খুন্তি ঢুকানোর সাথে সাথে লাফাতে লাফাতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। পরদিন জেঠা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে উঠানে একটা কাক মরে পড়ে আছে। কাকটা আসলে ওই জ্বীন ছিল বুঝলি।
ইফা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। ছোটবেলা থেকে মা-বাবা বান্ধবী সহ ১৪ গুষ্টির কাছে একই গল্প শুনতে শুনতে তার কানে তালা লেগে গেছে। সে আজও বুঝতে পারেনা ঘটনাটা আসলে কার?

‘আলফির মত একটা জ্বীনকে স্বামী হিসেবে পেলে মন্দ হতনা। মানুষের চেয়ে জ্বীনরা বেশী কেয়ারিং। আর আলফি তো কোনোভাবেই রেহজানকে মারতে পারেনা। তার বোন রওনক আগে জ্বীনের জন্য ক্রেজি ছিল, সে কি তবে হিংসা থেকে এমন করেছে? কিন্তু সে নিজের স্বামী নিয়ে তো সুখেই ছিল।’ ইফা বাহিরের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে। হঠাৎ তার মাথায় আসে, এই রাতেরবেলা চুল ছেড়ে ছাদে বসে থাকলে কি জ্বীন দেখা দিবে?
ইফা ধীরপায়ে ছাদের দরজা কাছে দাড়ায়। দরজা ভেজানো দেখে ভাবে আন্টি তাহলে এখনো দরজা আটকায়নি। ছাদে ঢুকে একদম কোণায় গিয়ে বসে। বাসার পাশের মস্ত বড় দেবদারু গাছের অর্ধেক ডালপালা ছাদের এই কোণায় ছড়িয়ে আছে। ইফার পরনে লাল ফতুয়া আর কালো লেগিংস। ঠোটে একটুখানি লাল লিপস্টিক মেখে এসেছে। চুলের খোপা খুলে পিঠের উপর ঘন কালো কোকড়া চুল ছড়িয়ে দিয়েছে।
আজ সে এক্সপেরিমেন্ট করবে এসব করলে আসলেই জ্বীন আসে কিনা!

কোণায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা সহকারে বসে আছে সে। বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া আজ তুলনামূলক ঠান্ডা। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে ইফার শরীর ভয়ে কাটা দিচ্ছে। তবুও সে নামছেনা, আজ একটা ফলাফল দেখে ছাড়বে। হঠাৎ করে ইফার চারপাশ কেমন জানি ভারী লাগছে, আগের চেয়ে বেশী ঠান্ডা অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে সারা ছাদময় কেউ ধীরে ধীরে হেটে বেড়াচ্ছে। তার মাথাটা হালকা ভার লাগছে, শরীর অসারশূন্য হয়ে আসছে। ইফার আর থাকতে ইচ্ছে হলনা। দৌড়ে দরজার কাছে এসে খোলার চেষ্টা করে দেখে দরজা আটকানো। তার ভয় ক্রমশ বাড়ছে। চোখে পড়ল ছাদের কোণা থেকে একটা ভয়ংকর কালো আবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে। ইফার চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কেন জানি করতে পারছেনা। ভয়ে থরথর কাপছে সে, হৃদপিন্ড এত অস্বাভাবিকভাবে লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
অবয়ব টা তার মুখোমুখি এগিয়ে এসে সজোড়ে ইফার বামগালে একটা থাপড় দেয়।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here