জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৩,১৪

0
1450

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৩,১৪
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৩

সকালের কাঁচা রোদ চোখে পড়তে’ই চোখ মেলে উঠে বসল ইফা। চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, সে ছাদের এক কোণায় বসে আছে। কাল রাতের ঘটনা মনে পড়তে’ই বা’গালে টনটন ব্যথা অনুভব করল। ধীরে ধীরে উঠে ছাদের দরজার কাছে আসে। দরজা কাল রাতের মত ভেজানো আছে। কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে ইফা! নিষ্প্রভ দেহে ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে নীচতলায় এল। উকি দিয়ে দেখল তার মামা এখনো ঘুমাচ্ছে। রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে গেল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাড়াল। হলদে ফর্সা বা’গাল টকটকে লাল হয়ে আছে। চুলগুলো বেশ এলোমেলো, জামার গলা ভিজে আছে। বেশ জোরে ঘষে লিপস্টিক উঠানোর ফলে ঠোটগুলো হালকা ফুলে লাল হয়ে গেছে। ইফা ড্রেস চেঞ্জ করে মিষ্টি রঙ্গের কামিজ পড়েছে। চুলে হাত দিয়ে জট খুলতে খুলতে বারান্দায় এসে দাড়াল। সূর্য তখন পূর্বের দিকে আকাশে তার আলোর ছটা ছড়িয়ে দিয়েছে। ইফার মন বেশ ভার। তার মোটেও কাল রাতের ঘটনাকে স্বপ্ন মনে হচ্ছেনা। এসব যে বাস্তবে ঘটেছে বা’গালের লাল আভা তার প্রমাণ। কিন্তু অকারণে এত জোরে থাপড় কেন দিল! ভেবে’ই ফ্যালফ্যাল কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ইফার। এমন নির্দয় জ্বীনের জন্য সে এত কষ্ট করেছে! নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। যদি ওই ব্যাটা এখন তার সামনে আসত, সে বুঝিয়ে দিত ইফার মাইরের পাওয়ার। চুল কোনোরকম পেচিয়ে ঘরে ঢুকার সময় দেখল গোমড়ামুখো তিনতলা’র বারান্দায় ঝুঁকে দাড়িয়ে আছে। অন্যসময় হলে হয়ত কৌতূহল দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলত কিন্তু এখন সে নীরবে প্রস্থান করল। আর সেটা ছেলেটার চোখ এড়ালনা। সারাদিনটা ইফা রুমের এককোণে বসে কাটিয়ে দিল। কেবল চড় খাওয়াতে তার মন ভার তা নয়, সে ভাবতে পারেনি জ্বীন’রা এত নির্দয় হতে পারে। জ্বীনবর পাওয়ার ইচ্ছে তার চড় খাওয়ার পর ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এসব নিয়ে ভবিষ্যতে আর না ভাবার বড়সড় প্রতিজ্ঞা করেছে। মন একটু হালকা হতে’ই সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তখন গোমড়ামুখো বাহিরে থেকে এসে গেইট আটকাচ্ছে। ইফার দিকে চোখ পড়ামাত্র উপহাসের হাসি দিয়ে বলল, ‘কেমন হল জ্বীনের উপর এক্সপেরিমেন্ট?’ ইফা মনে মনে অবাক হলেও সেটা চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘জ্বীন তো বিজ্ঞানের কোনো বিষয়-বস্তু নয় তার উপর এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে!” পুনরায় চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কিভাবে জানলেন?” ‘মাঝরাতে আমার বারান্দার সামনে দিয়ে অত সেজেগুজে ছাদে উঠলে বরং না জানা ই অস্বাভাবিক।’ ছেলেটা আর কথা বাড়ালনা। শিস দিতে দিতে উপরের দিকে চলে গেল। ইফা চোখ ছোট ছোট তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘ছেলেটার মতি-গতি ভালো ঠেকছেনা।’
“সব জ্বীনরা আলফির মত হয়না কেন? হলে একজনকে আমি সিউর বিয়ে করে নিতাম। তার পিঠে চড়ে পুরো দুনিয়া চষে বেড়াতাম।” ইফার কথা শুনে জাইমার হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। ইফা ভ্রু কুঁচকে জাইমার দিকে তাকাল, জাইমা কোনোরকম হাসি চেপে বলল,
— ” জ্বীনকে তুই পঙখীরাজ ঘোড়া পেয়েছিস?” ইফা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ওর সামান্য ইচ্ছে’র কথা শুনে জাইমা যেভাবে উপহাস করল, কাল রাতের ঘটনা শুনলে তো ইজ্জত রাখবেনা। তাই ইফা সেসব কথা মালুম চেপে গেল। জাইমাকে নিয়ে ছাদে উঠার সময় গোমড়ামুখোর মুখোমুখি হয় ইফা। জাইমা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
— কে এই সুর্দশন যুবক? ইফা ঠিক যে ভয় পেয়েছিল তাই হল। ছেলেটা জাইমার সামনে কালকের ঘটনার ঝুলি খুলে দিল। ‘এক্সপেরিমেন্ট করে জ্বীনের দেখা পেয়েছিলেন?’ কথাটা শুনে জাইমা ইফাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই জ্বীনের এক্সপেরিমেন্ট করেছিলি? আমাকে তো একবারো বললিনা।’ গোমড়ামুখো এইটুকু বলে ক্ষান্ত হলনা, ইফার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘ আপনার বা’গাল এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেউ মেরেছে নাকি?’
ইফা দাঁত কটমট করতে করতে নিচে নেমে আসে। ছেলেটার কথা শুনে জাইমা ইফা বেশ ভালোভাবে চেপে ধরল। অগত্যা ইফা জাইমাকে সব আদ্যপাদন্ত খুলে বলল। জাইমা দুঃখীভাব নিয়ে বলল, ‘বলেছিলাম এসব করতে যাসনা। এখন কেউ জানলে কি বলবে- জ্বীনের হাতে থাপড় খেয়ে ইফা অজ্ঞান।’ ইফার বেশ রাগ হচ্ছে। মন হালকা করার জন্য জাইমাকে নিজের বাসায় ডাকাটা’ই ভুল হয়েছে। ওর মান-সম্মান সব ডুবল। এখন জাইমার সামনে জ্বীনের কথা উঠলে সে এসব বলে লজ্জা দিবে। ইফা কঠিন চেহারায় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তিনতলা’র বারান্দার দিকে তাকায়। কাপ হাতে গোমড়ামুখো বোকামত হাসি দিয়ে ওর তাকিয়ে হাত নাড়ায়। মনে মনে বলে, ‘এবার যদি মেয়েটা ক্ষান্ত হয়!’

ইফার বা’গালের দিকে লক্ষ্য করলেন আশফাক সাহেব। কিছুটা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ গালে কি হয়েছে?’ ইফা অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয়, ‘জ্বীনের বাচ্চা জ্বীন মেরেছে।’ পরক্ষণে হুশে এসে বলল, ‘বৃষ্টিতে মশা বেড়েছে মামা। ঘুমের ঘোরে মশা মারতে গিয়ে এই অবস্থা।’ মামা হো হো করে হেসে বলল, ‘মশাকে এত জোরে মারলে পোস্টমর্ডেম করার জন্য তার বডি স্ট্রাকচার ও পাওয়া যাবেনা।’ ইফার খুব বিরক্ত লাগছে। চারিদিকের সবাই যেন ওকে নিয়ে তামাশায় মেতেছে। এর মাশুল তো দিতে হবে ওই ব্যাটাকে। সারাদিনে অনেকবার করা প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে রাতে আবার গেল ছাদে। সাথে পাড়ার বাচ্চাদের থেকে ধার করা দু-তিনটা ক্রিকেট ব্যাট ও নিয়েছে। ছাদে দাড়িয়ে ব্যাট ঘুরাতে ঘুরাতে ভাবল, ‘আজ সব ছক্কা মারবে।’ ছাদের দরজায় দুই হাত বন্ধনী করে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে ছেলেটা। দৃষ্টি ইফার দিকে নিবদ্ধ। তার ঠোট হালকা ডানদিকে প্রসারিত। ইফা বিড়বিড় করতে করতে দু হাতে দুইটা ব্যাট নিয়ে ছাদে এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে দাড়িয়ে হাত-পা ছুড়ছে। ছেলেটা দুইদিকে দুইবার মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, “এই মেয়ে সহজে দমে যাওয়ার নয়।” ইফা এই সময় গোমড়ামুখোকে ছাদে দেখে ভয়ে কিছুটা দমে গেল। ছেলেটা ব্যাটের দিকে দৃষ্টি নিপাত করে বলল, ” জ্বীনের সাথে ক্রিকেট খেলতে এসেছেন? বল এনেছেন তো?”
— আপনি এখানে কি করেন?
— আপনার সহযোগী ব্যাটম্যান হতে এসেছেন। দৌড়ে দৌড়ে রান নিব। জ্বীন এখনো আসেনি? খেলা কখন শুরু করবেন? ইফা চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, ‘মজা করেন? আমি ব্যাট দিয়ে খেলতে নয় মারতে এসেছি বজ্জাতটাকে। আসুক আজকে সামনে।’
— অনেক শক্তি আপনার। ভয় পাবেননা?
— আমার ডিকশনারীতে ভয় নামক কোনো শব্দ নেই। আজকের পর ওই শালা আমাকে ভয় পাবে। ছেলেটা একটু চুপ রইল। তারপর চিৎকার করে ছাদের দরজার দিকে একদৌড় দিল। ইফা খানিকটা হতভম্ব হয়ে ব্যাট ফেলে চিৎকার দিয়ে নিজেও লাফাতে লাফাতে দৌড়াল। তিনতলার বারান্দায় এসে হাপাতে হাপাতে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে দৌড়ালেন কেন?”
— এক্সারসাইজ করলাম। আপনি কেন দৌড়ালেন? ইফা ছেলেটার কথা শুনে বোকাবনে গেল। ক্রোধান্বিত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে নিচে নেমে গেল।
ইফা চুপিচুপি পা টিপে টিপে গোমড়ামুখোর রুমের সামনে এসে দাড়াল। দরজায় সচরাচরের মত তালা দেওয়া। ইফা বুঝে উঠতে পারেনা, ছেলেটা এত কড়াকড়ি সাবধানতা কেন অবলম্বন করে? ছেলেটার মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। ইফা ঘুরে ছাদের চিলেকোঠার দিকে যায়। ওখানে তিনতলার রুমের একটা ব্যাকআপ জানালা আছে। জানালার কাছে এসে দাড়ায় ইফা। জানালার কাঁচের অবস্থা ভালো নয়। জায়গায় জায়গায় ফেটে আছে। বড় ফাটা জায়গায় চোখ রাখল সে। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই আঁধারের মধ্যে পাশের রুম থেকে সুক্ষ্ম হলদেটে আলো এসে পড়েছে। ইফা আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য চোখ সরিয়ে অন্য ফাটা অংশে রাখবে এমনসময় দেখল সেই আলোতে একটা নারীমূর্তির ছায়া পড়ছে। ইফা আরেকবার দেখার আগে ছায়াটা চোখের পলকে সরে গেল। সে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগল, এতদিন জানত গোমড়ামুখো এই বাসায় একা থাকে। কিন্তু তার সাথে কোনো মেয়ে আছে সেটা সে গোপন রাখল কেন? আর থাকলে মেয়েটা কেন বেরিয়ে আসেনা। অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার। আরেকটু পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আরো গভীরে যেতে হবে।
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-১৪
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

জাইমা আর ইফা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প জুড়েছে। জাইমা গল্প করায় ব্যস্ত থাকলেও বারবার চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরাচ্ছে। তা অবশ্য ইফার চোখ এড়াচ্ছেনা। একসময় কথায় কথায় জাইমা প্রশ্ন করল, ‘ইফা সেই সুদর্শন ছেলেটা কোথায়?’ ইফা বিরক্তিমাখা গলায় বলল, ‘জানিনা।’ জাইমা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, ‘তার নাম?’ ইফা আবার উত্তর দেয়, ‘তাও জানিনা।’ জাইমা ইফার মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল, ‘মাথার উপরে এত সুদর্শন বালক থাকে তার সামান্য খোঁজ রাখিসনা। উপরন্তু নামও জানিসনা। জ্বীন ছেড়ে মানুষের দিকে তো একটু নজর দে।’ ইফা প্যাঁচার মত মুখ করে বলল, ‘আই এম নট ইন্টারেস্টেড!’ জাইমা এবার খোঁচা মেরে বলল, ‘যার উপর ইন্টারেস্ট ছিল তার হাতে চড় খেয়ে অজ্ঞান হলি। তোর তাও সৌভাগ্য অন্তত চড়ের অজুহাতে জ্বীন তো দেখলি।’ ইফার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, দাত-মুখ খিচে মনে মনে গোমড়ামুখো আর বজ্জাত জ্বীনকে বকা দিতে লাগল। এসব অপমান আর নেওয়া যাচ্ছেনা। বজ্জাত জ্বীনকে একটা শিক্ষা দিতে’ই হবে। এমনসময় গোমড়ামুখো বাহিরে থেকে ভিতরে ঢুকে গেইট আটকাল। জাইমা চায়ের কাপ ফেলে ছুটে গেল তার দিকে। ইফা অনিচ্ছাসত্ত্বেও গোমড়ামুখোর দিকে তাকায়। তার ঘমার্ক্ত চেহারায় একরাশ উজ্জ্বলতা আভা দীপ্তিমান। পরনের বেগুনি রঙ্গের শার্ট ভিজে শরীরের সাথে এটে আছে। জেল দিয়ে একসাইড করে রাখা চুল থেকে দু-একটা কপালের সামনে চলে এসেছে। গোমড়ামুখো একবারো সরাসরি জাইমার দিকে তাকাচ্ছেনা, মাথা নিচু করে কথা বলছে। দু-একটা কথা হতে’ই ব্যস্ততা দেখিয়ে কেটে পড়ল সে। জাইমা মোহময় দৃষ্টিতে একপলক গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়েই রইল। জাইমার এমন আচরণে ইফা শরীরটা জ্বলে উঠল। তাড়াতাড়ি জাইমাকে একপাশে টেনে এনে জিজ্ঞেস করল, “এর সাথে এত ফুসুরফাসুর কিসের?” জাইমা উৎফুল্লিত হয়ে বলল, ‘দেখেছিস, কত সুন্দর লাগছিল তাকে! এবার বোধহয় আমার একাকিত্বের অবসান ঘটবে।তুই কিন্তু এই ব্যাপারে আমাকে হেল্প করবি।’ ইফা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল, ‘আমার বয়ে গেছে। আমাদের ভাড়াটিয়ার দিকে নজর দিবিনা।’ জাইমা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, ‘এমনভাবে বলছিস যেন তোর জ্বীনবরের দিকে নজর দিচ্ছি। আমার বাবা জ্বীনবরের দরকার নেই, যা দিনকাল পড়েছে ওর মত একটা মানুষবর হলেই যথেষ্ট।’ গোমড়ামুখোর প্রতি জাইমার এমন গদগদ ভাব ইফার বিরক্ত লাগছে। কেন জানি সে চাচ্ছেনা জাইমা ছেলেটাকে নিয়ে এসব বলুক।
আশফাক সাহেব চা শেষ করে বইয়ে মুখ গোঁজামাত্র বাড়ীওয়ালী আন্টি এসে ইফাকে ডাকলেন। ইফা রান্নাঘর থেকে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। আন্টির দিকে তাকিয়ে সে থ হয়ে দাড়িয়ে রইল। আন্টি লেমন কালারের শাড়ি পড়েছে, চুলগুলো খোপা করে চোখে একটু কাজল ও ঘষেছে বোধহয়। তাকে এতটা মাধুর্যময়ী লাগছে যে কেউ দেখলে তাকে বাঙ্গালি মেয়ে ভেবে ভুল করতে বাধ্য। ইফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আন্টি তুমি হঠাৎ শাড়ি পড়েছো?’ আন্টি খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘ কেন দেখতে কি খারাপ লাগছে?’ ইফা দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘একদম না।’ ইফা আশফাক সাহেবের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। উনি হা করে বাড়ীওয়ালীর দিকে একপলকে চেয়ে আছেন। ইফা যা বুঝার বুঝে নিল, তার এখন কেটে পড়াই শ্রেয়। চুপচাপ ছাদের দিকে পা বাড়াল সে। আসলে প্রেম মানুষকে অনেক বদলে দেয়। যেমনটা বদলে দিয়েছিল আলফিকে। উর্দুভাষী হয়েও রেহজানের জন্য শুদ্ধ বাংলায় ভালোবাসি বলা শিখেছিল। আর সারাজীবন লাউন আর স্কার্ট পড়া আন্টি আজ মামার জন্য শাড়ী পড়েছে। শুধু তার জীবনেই প্রেম এলনা। মনে হচ্ছে জ্বীনবর না পাওয়ার শোকে তাকে আজীবন চিরকুমারী ই থাকতে হবে। ছাদের এককোণে গোমড়ামুখোকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে ইফা। তাকে ঘাবড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পিছন থেকে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে ইফা। গোমড়ামুখো তাতে একটুও বিচলিত না হয়ে ইফার হাত বাকিয়ে সামনে টেনে আনল। ইফা কোনোরকম নিজেকে ছাড়িয়ে লাফিয়ে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘জ্বলে গেল রে। ওই ছেলে আপনার মুখে কি আগুন ভরে রেখেছেন? আপনি মানুষ নাকি!’
‘তো আমি কি থাপড় মারা জ্বীন নাকি?’ এমন খোচামার্কা কথা শুনে ইফা রোষানল দৃষ্টিতে গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে আসে। হাতের তালুর দিকে লক্ষ্য করে দেখে সেখানে দুটো ফোস্কা পড়ে গেছে। এমন একটা ঘটনা ও কোথায় জানি দেখেছিল মনে হচ্ছে! কিন্তু সঠিক মনে পড়ছেনা। ওসব নিয়ে ইফা আর মাথা ঘামালনা। ওর এখন দুটো টার্গেট বজ্জাত জ্বীন আর গোমড়ামুখোটাকে আচ্ছামত শায়েস্তা করা।

ফেরার সময় বিষন্ন মুখে আন্টিকে ২য় তলায় উঠতে দেখে ইফা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে আন্টি?’
আন্টি চোখ তুলে ইফার দিকে তাকায়। আন্টির চোখে সযত্নে দেওয়া কাজল লেপ্টে আছে। বাড়ীওয়ালা আন্টি ধরাগলায় বলল, ‘কি আর হবে? প্রতিবারের মত এবারো রিজেক্ট হলাম।’ বলে মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ইফার বেশ খারাপ লাগছে। সে বুঝে উঠতে পারেনি আন্টিকে মেনে নিতে মামার এত অসম্মতি কেন? সে ভালো করেই জানে মামাকে আন্টির মত কেউ এত ভালোবাসতে পারবেনা। এই ব্যাপারটা নিয়ে একসময় আশফাক সাহেবের সাথে খোলাখুলি কথা বলার সিধান্ত নেয় ইফা।

চারদিক মাগরিবের আযানের ধ্বনিতে কলরব। ইফা পা টিপেটিপে তিনতলার বারান্দায় উঠে আসে। সর্তক শিকারীর মত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। দরজার তালার দিকে একবার তাকিয়ে ওড়নার আড়াল থেকে একগোছা চাবি বের করে। এই চাবিগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে এই তলার ডুপ্লিকেট চাবি। সে নিশ্চিত জানেনা কোনটা! তবে বাড়ীওয়ালা আন্টিকে বলতে শুনেছে। চাবির গোছা হাতে নিয়ে আরেকবার নিচের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সবাই রুমে ঢুকে গেছে। মামা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য বাজারে গেছে। আন্টি হয়ত নামায পড়ছে আর তার মা প্যারালাইসিস রোগী। গোমড়ামুখোটাকে একটু আগে কাধের ব্যাগ নিয়ে কোথাও বের হতে দেখল। গত দুইদিন এই সুযোগটার’ই অপেক্ষা করছিল ইফা। একটার পর একটা চাবি দিয়ে তালা খোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। অবশেষে একটা চাবি দিয়ে তালা খুলতে সক্ষম হল সে। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সাথে থাকা টর্চ জ্বালায়। এই ঘরে সে আগে কখনো আসেনি। গোমড়ামুখো কাউকে ভদ্রতার খাতিরেও ঢুকতে দেয়না। সামনে রুমের সবকিছু নিপুণ হাতে গোছানো। কেউ দেখে বলবেনা এটা একটা ব্যাচেলর ছেলের বাসা। ইফা পুরো রুমের কোণায় কোণায় খুজল। এখানে কেউ নেই দেখে ভিতরের রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। এই রুমে বেডরুম, আয়না আর পড়ার টেবিল। এটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে। ইফা ধীরে ধীরে পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে। রান্নাঘরেও একবার উকি মারে। আবার ভিতরের রুমে ফিরে এসে পড়ার টেবিলের কাছে দাড়াল। এখানে কিছু কাগজ আর বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই ঘরে গোমড়ামুখো ছাড়া আর কেউ থাকেনা তাহলে সেদিন যে নারীমূর্তি ছায়া দেখেছিল সেটা কার! তবে কি সে ভুল দেখেছে! এসব ভেবে ইফা হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ইফার কোমড়ের সাথে ধাক্কা লেগে টেবিল থেকে কিছু কাগজ পড়ে যায়। ইফা কোমড়ে হাত বুলাতে বুলাতে মেঝেতে থেকে সেগুলো কুড়িয়ে নিতে যায়। কাগজ গুছিয়ে নেওয়ার সময় একটা নেইমপ্লেট লকেট তার হাতে পড়ে। নামটা উর্দুতে লেখা। ইফা উচ্চারণ করে পড়ল, “আলফি!”
আলফি নাম পড়েই তার চোখ কপালে উঠে গেল, বুকের ভেতর টা কেমন ধড়াস করে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে। ইফা নিজে নিজে ভাবে সে কি ঠিক দেখছে? হাতে একটা চিমটি কেটে লকেটের দিকে তাকায়। সে ঠিক’ই দেখছে। এটা আলফি নেমপ্লেট লকেট। লকেট টা কি তবে গোমড়ামুখোর? গোমড়ামুখো আলফি নয় তো? এসব প্রশ্ন মাথায় আসতে’ই ইফা হকচকিয়ে উঠে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here