জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৫,১৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৫
ইফা সিড়ি দিয়ে নামার সময় গোমড়ামুখোর সামনে পড়ে যায়। ইফার সাহস হয়না ছেলেটার চোখের দিকে তাকানোর। শরীরের হালকা কাঁপুনি টের পাচ্ছে সে। গোমড়ামুখো তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, “এইসময় এখানে কি করছেন?” ইফা হকচকিয়ে উঠল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে, কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে ‘কিছুনা’ বলে ছুটে পালিয়ে এল। গোমড়ামুখো ই আলফি জানার পর থেকে ইফার ভিতরে এক ভয়ানক তান্ডব চলছে। একের পর এক প্রশ্ন মস্তিষ্কে হামলে পড়ছে। সে যদি আলফি হয় তবে এখানে কেন? রেহজান কি সত্যি’ই মারা গেছে? রেহজানের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি আলফি! এমন অনেক প্রশ্ন তাকে চারদিক ধুম্রজাল থেকে চেপে ধরেছে।
ইফা দীর্ঘসময় নিয়ে ছোট্ট চায়ের কাপে চুমুক দিল। জাইমা আড়চোখে ইফার দিকে তাকিয়ে আছে, ইফার এমন গম্ভীর চেহারা আগে কখনো’ই দেখেনি। জাইমা কোনো প্রশ্ন করার আগে ইফা জিজ্ঞেস করল, “ডায়েরী টা কি অনেক পুরোনো?” জাইমা নিচের ঠোঁট দাতে কামড় দিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “মনে হয়না। তবে এই ডায়েরী বা বই যাই বলিস, এটা অবস্থা এত খারাপ যে মনে হচ্ছে খুব পুরোনো।”
ইফা হঠাৎ করে জাইমার হাত চেপে ধরে বলল, “আচ্ছা তোর কি মনে হয়, রেহজান কি বেঁচে থাকতে পারে?” ইফার এমন উদ্ভুত প্রশ্নে জাইমার কপালে ভাঁজ পড়ল। নিজের কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে পারলনা সে।
–” কি হয়েছে তোর? এমন অদ্ভুত সব প্রশ্ন কেন করছিস?”
— বলনা তুই, রেহজান কি বেঁচে থাকতে পারে? এতদিনে আলফি আদৌ তার শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে?
— এটা একটা কাল্পনিক রহস্যময় গল্প। অতএব, আমার অনুমানে এর কোনো পরিবর্তন ঘটবেনা কিংবা বাস্তব ও হবেনা। তবুও আমার ভাবনায় আসে, রেহজান হয়ত সত্যি মারা গেছে। তারপর আলফি তার শোকে স্তব্ধ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। একদিন হয়ত সেই গল্পের মোড় ঘুরে গেছে, আলফির জীবনে নতুন কেউ এসেছে।
ইফার চোখ দু’টো চকচক করে উঠল। তার মন এখন অনেকটা হালকা। জমে থাকা এত প্রশ্নের ভারে তার শ্বাস নেওয়া’ই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাসায় ফিরে তিনতলায় একবার উঁকি মারে সে। চোখাচোখি হয় গোমড়ামুখোর সাথে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে। সবকিছুতে সে অজানা ভালোলাগা খুঁজে পাচ্ছে।
দরজায় টোকা পড়ায় চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে ছেলেটা। ইফাকে বড় একটা বক্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চেহারায় বিস্ময়ের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে।
— “আপনি এখানে?” ইফা একগাল হেসে বলল, “দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবেন নাকি ভিতরেও আসতে বলবেন?”
— “দুঃখিত। আপনাকে ভিতরে আসতে বলতে পারছিনা।”
ইফার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। আগেও একবার ইফাকে দরজা থেকে বিদায় দিয়েছিল। ছেলেটা কিছুতে’ই কাউকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেয়না। তবে আজ ইফার কাছে কারণ টা পরিষ্কার। পুনরায় ঠোটের হাসি প্রসারিত করে বলল,
— “ব্যাপার না। আজ মেঘলা দিন দেখে খিচুড়ি রান্না করেছিলাম। কিছুটা আপনার জন্য ও নিয়ে এলাম।”
— “ধন্যবাদ। তবে আমার প্রয়োজন নেই। আমি রান্না সেরে ফেলেছি।” “নিলে কোনো সমস্যা দেখছিনা।” বলে ইফা গোমড়ামুখোর হাতে বক্স ধরিয়ে দিয়ে ভৌ-দৌড় দেয়। ছেলেটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বক্স নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ইফার অনুরোধে আশফাক সাহেব ছেলেটিকে একদিন বাসায় দাওয়াত দেন। আশফাক সাহেব ছেলেটিকে এর আগে দু-একবার দেখলেও আলাপ করার সুযোগ পাননি। যতবার দেখা হয়েছে ছেলেটার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। আশফাক সাহেবের অনুরোধ না ফেলতে পেরে ছেলেটি দুপুরে নিচতলায় আসল। ইফা সবে রান্নাবান্না সেরে গোছগাছ করে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষণ আগুনের কাছে থাকায় মুখ ঘর্মাক্ত এবং লালবর্ণ ধারণ করেছে। গোমড়ামুখোর দিকে চোখ পড়ায় অপলক তাকিয়ে রইল সে। আজ আলফিকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। জুম্মাবার বলেই হয়ত পাঞ্জাবী পড়েছে। আকাশী রঙ্গে তাকে অনেক মানিয়েছে। বা হাতে সচরাচর পড়ে থাকা ঘড়ি, চুলে আজ যত্ন করে চিরুনী বুলিয়েছে মনে হচ্ছে। গোমড়ামুখোর সালাম শুনে ধ্যান ভাঙ্গল ইফার। ইফা তটব্যস্ত হয়ে ভিতরে আসার অনুরোধ করল। ছেলেটা নাকোচ করে বলল,
— উনি একসাথে নামাযে যাওয়ার কথা বলেছেন। ডেকে দিন উনাকে, আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।
আশফাক সাহেব আর ছেলেটা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলছে। ইফা অপলক দৃষ্টিতে গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়ে আছে। আশফাক সাহেবের কথায় একটু নড়েচড়ে বসে কৌতূহলসহকারে কান খাড়া করে ইফা। আশফাক সাহেব ছেলেটিকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করেছেন। খাওয়া বন্ধ করে ছেলেটি উত্তর দিল, “আমার নাম সারোফার নেওয়াজ শাহর। বাসা পিন্ডিতে। আম্মা-আব্বা সেখানেই থাকেন। পড়ালেখার এবং কর্মসংস্থানের জন্য লাহোরে আসা।”
আশফাক সাহেব মাথা ঝুকিয়ে বলল, ” খুব ভাল। আসলে ব্যস্ততার কারণে তেমন আলাপ হয়নি। কোনোকিছু প্রয়োজন হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।” ইফা গোমড়ামুখোর দিকে বেশ কয়েকবার আড়চোখে তাকাল। আলফি তার আসল পরিচয় গোপন রেখেছে দেখে সে খুব একটা হতবাক হলনা। রেহজান মারা যাওয়ার পর হয়ত সে নিজেকে আলাদা পরিচয়ে বাচিয়ে রাখতে চাচ্ছে। ইফা মনে মনে আলফিকে আশ্বাস দিল, “আমি আছি আপনার পাশে।”
ইফা বেশ কয়েকটা একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। ডায়েরীতে রেহজানের দেওয়া বর্ণনায় আলফির চোখের রং ধূসর ছিল। সেদিন শাহরের চোখে সরাসরি তাকিয়ে সে ধূসর বর্ণ দেখলনা। জাইমা বই ঘাটতে ঘাটতে ইফাকে বলল,
–” এই বইয়ে হয়ত পড়েছিলাম জ্বীনরা যেকোনো সময় যেকারো রুপ ধারণ করতে পারে। যেকোনো পশু থেকে শুরু করে মানুষ। এরা নিজেদের আসল রুপে মানুষের সাথে মিশেনা। ধারণা করা হয়, এদের আকৃতি কিংবা অন্য কোনো আলাদা বিশেষত্ব থাকার ফলে মানুষ সন্দেহ করতে পারে তাই এরা অন্য কারো রূপে মানুষের কাছাকাছি বাস করে।”
ইফা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। আলফিকে একটু একপ্টু করে সে বুঝতে পারছে, চিনতে শিখছে। তার কাছে আসার চেষ্টা করছে। আলফি কিন্তু তাকে অত পাত্তা দিচ্ছেনা। তাতে ইফা হাল ছাড়ছেনা। একদিন না একদিন আলফিও তাকে বুঝতে পারবে সে এই প্রত্যাশা পোষণ করছে।
ইফা তিনতলার বারান্দা এসে দাঁড়াল। শাহরের দরজায় তালা ঝুলছে। এই ভরসন্ধ্যায় সে কোথায় গিয়েছে কে জানে! দাত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বারান্দার এই মাথা থেকে ওই মাথা চক্কর দিচ্ছে ইফা। ডায়েরী পড়ার পর থেকে ইফার আলফির প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছিল, রেহজানের করুণ পরিণতিতে আলফির জন্য সে কষ্ট অনুভব করত। মনে মনে শুধু চাইত, আলফির মত জ্বীনবর তার জীবনে আসুক। আল্লাহ যে আলফিকে’ই এনে দিবে সেটা সে কল্পনা ও করতে পারেনি। শাহর ই আলফি জানার পর সেই ক্ষুদ্র ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে। এখন সে মনে প্রাণে চায়, সে আলফির একাকিত্ব ভুলিয়ে নতুন করে আলফির জীবন সাজিয়ে তার সাথে জীবনের বাকিটা পথ হেটে বেড়াতে। আলফিকে মনের কথা বলার জন্য ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। শাহর বারান্দায় এসে ইফাকে দেখে অবাক হলনা। ইদানিং ইফা কোনো না কোনো প্রায়সময় তার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। এই অল্পবয়সী চঞ্চল মেয়ের মাথায় কখন কি চলে সে তা বুঝতে পারেনা। ইফার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “আজও কি লবণ শেষ? কি চাই?”
ইফা মুখ ফসকে অস্ফুট স্বরে বলে ফেলে, “আপনাকে।” পরক্ষণে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “কিছুনা। ছাদে গিয়েছিলাম নামার সময় দেখি আপনি এখনো ফিরেননি। তাই পাহারা দিচ্ছিলাম। আপনি এসে গেছেন এখন আমার ছুটি।” শাহর কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে আসে সে। কেন জানি আলফি সামনে এলে কিছু বলার সাহস পায়না সে।
বাড়ীওয়ালা আন্টির মা মারা যাওয়ায় তাকে সমবেদনা জানাতে তার কাছে গিয়ে বসল ইফা। এই মানুষটার জন্য সে কষ্ট অনুভব করে। দুনিয়ায় একদম একা হয়ে গেছেন উনি। মামা যদি এইসময় তাকে সঙ্গ দিত তবে হয়ত তার একাকিত্ব একটু কমত। আশফাক সাহেব রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বারান্দার অন্ধকার তার ভালোই লাগছে। মনের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। এমনসময় ইফা চায়ের কাপ নিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।
— “মামা একটা কথা বলব।” আশফাক সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে মাথা ঝাকায়। ইফা সাহস করে বলল,
— “তুমি জানো, আন্টি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। এতবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও তোমার অপেক্ষা করে। সব জেনেও তুমি কেন তাকে বারবার নাকোচ করছো? আমার বিশ্বাস আন্টির মত কেউ তোমাকে ভালো রাখতে পারবেনা। আশফাক সাহেব মুচকি হাসেন। ইফার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
— ” ভালোবাসা কারো জন্য একবার হারিয়ে গেলে সেটা অন্যের প্রতি সহজে আসেনা। একজনের জন্য গড়া আসনে অন্য কাউকে বসানো অনেক কঠিন ব্যাপার। বড় হলে বুঝবি।” ইফা একটু গম্ভীর হয়ে যায়, পরক্ষণে বলেঃ
— “অতীত আকঁড়ে ধরে নিজেকে কষ্ট দেওয়া মানে সেই মানুষটাকেও কষ্ট দেওয়া। তার জায়গা হয়ত কাউকে দেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু কাউকে পাশে রাখা তো অন্যায় হতে পারেনা। হারিয়ে ফেলা কারো জন্য জীবন থামিয়ে রাখা নিতান্ত বোকামো।”
ইফা নিশ্চুপে রুমে ফিরে এল। তার ও মনে চলছে অনিশ্চয়তার ঝড়। আলফি মামার মত কারণ দেখিয়ে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে না তো? রেহজানের জায়গা আর কাউকে দিতে পারবে না বলেই কি এখনো সে ইফা পাত্তা দিচ্ছেনা? সব বুঝেও এইজন্য চুপ করে আছে? ইফার বুক ফুঁড়ে আংশকামিশ্রিত অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
.
(চলবে)
জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-১৬
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
শেষবারের মত ইফা আয়নার দিকে একনজর তাকাল। অনেকদিন পর আজ যত্ন করে সেজেছে। ওড়না দিয়ে সামান্য ঘোমটা মাথায় চড়িয়ে ছাদে এসে দাঁড়ায়। শাহর ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। ইফা তার দিকে এগিয়ে আসে। শাহর একপলক ইফার দিকে তাকায়। কালো ড্রেসে ইফাকে বেশ পরিপাটি এবং সুন্দর লাগছে। প্রতিদিনের চঞ্চল মেয়েটাকে অনেক শান্ত দেখাচ্ছে। ইফা চোখ বুজে একবার বড় নিঃশ্বাস নিল। তারপর শাহরের খুব কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ আমি জানি আপনার একটা ভয়ানক কালো অতীত আছে। যার শোক আপনি এখনো বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ ইফা একটু থেমে শাহরের গালে আলতো করে হাত রেখে আবার বলা শুরু করল,
” আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার খারাপ সময় থেকে আপনাকে বের হতে সাহায্য করতে চাই, আজীবন সবরকম পরিস্থিতিতে আপনার পাশে থাকতে চাই। অনুগ্রহ করে কোনো অযুহাতে আমাকে ফিরিয়ে দিবেননা।” এক নিঃশ্বাসে পুরোটা বলে ইফা দৌড়ে পালিয়ে গেল। শাহর হতভম্ব হয়ে পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে আছে। তার ঘোর এখনো কাটছেনা, এসব কি বলে গেল ইফা! শাহর চিন্তিত হয়ে নিচে নেমে এল।
ইফা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু আগে ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর মূহুর্তের কথা ভাবছে। অবশেষে সে তার মনের কথা বলতে পেরেছে। তার অটুট বিশ্বাস আলফি তার ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিবে। আলফি কে আর কোনো রকম কষ্ট পেতে দিবেনা সে, ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় আগলে রাখবে। এবার রেহজানের শোক নিশ্চয়ই কেটে যাবে। বাড়ীওয়ালা আন্টি কে এইসময় নিচতলায় দেখে ইফা অবাক হল। বেশ কয়েকদিন ধরে উনি কারো সাথে কথা বলছেন না আর খুব একটা বের ও হচ্ছেননা। ইফা এগিয়ে এসে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন আছো আন্টি?” শুষ্ক চেহারায় হাসি ফুটিয়ে আন্টি জবাব দিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মামার হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠানোর কারণ কি?” ইফা নিস্তব্ধ হয়ে ভাবনায় পড়ল। মামা কি তবে কালরাতে তার বলা কথার মর্মার্থ বুঝে আন্টিকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ইফা বিস্তর হাসি দিয়ে আন্টিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। আশফাক সাহেব কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ইফা’দেরকে দেখে কাজ বন্ধ করে এগিয়ে আসলেন। ইফার সামনে উনি কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছেন দেখে ইফা বের হয়ে আসে। ইফা চলে যাওয়ার পর আশফাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন, “শক্ত থাকতে শিখো। এভাবে গুটিয়ে নিজেকে রেখে ভালো থাকা যায়না নাহার।” নাহার অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “আমি ঠিক আছে। আমাকে ডাকার কারণ কি?” আশফাক সাহেব কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। তারপর জড়তা নিয়ে বললেন, “কাল রাতে ইফার সাথে তোমাকে নিয়ে কথা হয়েছিল। সে চায় আমি তোমাকে গ্রহণ করি।” নাহার সম্ভিত ফিরে পেয়ে চোখ তুলে বলল,
“আর আপনি?” “আমিও চাই তোমাকে গ্রহণ করতে। কিন্তু আমার অতীতে আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম, তাকে না পেয়ে আজ আমি যাযাবরের মত জীবনযাপন করছি। এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরেও তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমি যদি তোমাকে গ্রহণ করি, আমার মনে এখনো অন্য কেউ আছে জানার পরে কষ্ট পাবে। তোমার পক্ষে মেনে নেওয়া হয়ত সহজ হবেনা। তাই আমি এতদিন তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
— “ভালোবাসার মানুষের সবকিছুকে সম্মান করতে হয়। সেই হিসেবে আমি আপনার ভালোবাসাকেও সম্মান করি। আপনি তার জায়গা কখনো নিতে চাইবনা। যদি এইটুকু চেয়েছি আপনার পাশে থাকতে, স্ত্রীকে হিসেবে সামান্য হলেও আপনার ভালবাসা পেতে।”
— “তুমিও ইফার মত ই কথা বলছো। ইফা নাহয় বাচ্চা মানুষ, আবেগ দিয়ে কথা বলে। সবকিছু বোঝার সাধ্য নেই।”
— “ইফা কি বলেছে জানিনা। আমি আমার মনের কথাটা বললাম। আমার আপনার অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।”
ইফা আড়াল থেকে এইটুকু শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। তার মবে চিন্তা এল, আলফিও কি রেহজানকে কখনো ভুলতে পারবেনা? সবটুকু দিয়ে তাকে ভালোবাসতে পারবেনা? ইফাকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাহিরে বসে থাকতে দেখে নাহার তার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমার জন্য যা করেছো তার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ আমি।” ইফা হাটুতে গুজে রাখা মাথা তুলে বলল, “অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলাম তোমাকে।” নাহার হেসে বলল,
–“আমি তা মনে করিনা। তোমার মামা হয়ত নিজে থেকে তাকে ভুলতে চাইছেননা, তাকে আকড়ে ধরেছিলেন। যখন আমাকে উনি পাশে পাবেন তখন আমার ভালোবাসা পেয়ে উনি এটা বোধ করবেন এই পরিবর্তন উনার আরো আগে প্রয়োজন ছিল। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে আমি একদিন ঠিক উনার মন জয় করতে সক্ষম হব।”
আন্টির কথায় ইফা অনুপ্রেরণা খুজে পায়। তার নিজের ও মনে হতে থাকে, সেও পারবে একদিন আলফির মনে জায়গা করে নিতে।
শাহর দরজা খুলে বাহিরে এসে দেখে ইফা দাঁড়িয়ে আছে। শাহর ইফার দিকে এগিয়ে আসা মাত্রই ইফা মূহুর্তে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শাহরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
— আমি জানি একদিন আপনিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করে নিবেন। সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবেন। শাহর ইফাকে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এসব কি তোমার স্বল্পমেয়াদী আবেগ?”
ইফা শাহর গলা জড়িয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল, “নাহ, দীর্ঘমেয়াদী ভালোবাসা। আমাকে বিশ্বাস করুন।” শাহর কপাল কুঁচকে বলল, “আমি ভেবে দেখব। রাত-বিরাতে এভাবে এসোনা। এটা ভালো দেখায়না। বাসায় ফিরে যাও, অপেক্ষা করো। পজিটিভ উত্তর হলে অবশ্যই তোমাকে মুখোমুখি জানাব আর যদি নেগেটিভ হয়….” ইফা শাহরের মুখ চেপে ধরে, “এই কথা আর যেন না শুনি।” শাহর চুপ থেকে বলল, “এখন বাসায় ফিরে যাও।” ইফা আরেকবার শাহরকে জড়িয়ে ধরে সিড়ি দিয়ে নেমে আসে।
সন্ধ্যাবেলা শাহরের ঘরের দরজা এভাবে হাট করে খোলা দেখে ইফা অবাক যায়। শাহর তো কখনো ভুলেও এভাবে দরজা খোলা রেখে বাহিরে যায়না। শাহরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ইফা ভিতরে প্রবেশ করে। পুরো বাসায় কারো সাড়াশব্দ নেই। শাহরের বেডরুম থেকে খুট খুট আওয়াজ আসতে শুনে ইফা সেদিকে এগিয়ে যায়। অন্ধকারে খাটের এককোণায় কাউকে বসে থাকতে দেখে ইফা হাতড়ে সুইচ খুজে আলো জ্বালায়। ওপাশের মানুষটাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে। অতি সুদর্শন একটা ছেলে হাতের উপর মুখ রেখে বসে আছে। পরনে ধূসর বর্ণের টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সামনে পড়ে আছে। ফর্সা হলেও মায়াবী চেহারার অধিকারী। চোখগুলো ধূসর বর্ণের। সেই চোখে ইফার দিকে খানিকটা বিব্রত হয়ে চেয়ে আছে। ইফার চোখ পড়ল তার গলায় থাকা লকেটের দিকে। এইটা তো সেই নেইমপ্লেট লকেট। ইফা নিশ্চিত হল এটা আলফির আসল রুপ। হুবহু তার বইয়ে পড়া বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।
পিছন থেকে শাহরের ডাকে ঘুরে তাকায় ইফা। তার চোখে-মুখে এখনো বিস্ফোরিত অবাকতা। শাহর ইফাকে তার দিকে টেনে এনে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কি করছো?”
–” আলফি তুমি ওখানে বসেছিলে না!” বলে ঘুরে তাকায় ইফা। খাটের কোণে কেউ নেই। শাহর ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, “আমি তো এখানে। আর আলফি কাকে ডাকছো?”
ইফা শাহরের টি-শার্ট টেনে কাছে নিয়ে এসে বলে,
–” তোমার আসল রূপ দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত। আমার এখনো ঘোর কাটছেনা। বারবার তোমার ধূসর চোখের মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছি। ওই রূপে আবার এসোনা, মনে ভরে একটু দেখি।”
— “এসব কি বলছো ইফা? ইফা ধমকের সুরে বলে,
— ” আমি সব জানি আলফি। তুমি একজন জ্বীন, তোমার ব্যাপারে সব আমার জানা। এখন আর আড়ালে থেকোনা।”
— “আমি শাহর কোনো জ্বীন নই। আমাকে আলফি বলে ভুল করছো। আর আলফি কে? তোমার কি হয়েছে?”
ইফা নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি জ্বীন নও?”
— “জ্বীন নিয়ে ভাবতে ভাবতে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জলজ্যান্ত আমাকে জ্বীন বানিয়ে দিচ্ছো। তুমি কি আমার সাথে মজা করছো ইফা?”
ইফা ধাক্কা দিয়ে শাহর সরিয়ে দেয়। তারপর রুমের চারিদিকে একবার তাকিয়ে আলফিকে খুজতে থাকে। শাহর ইফার কাছে এগিয়ে আসতে চাইলে ইফা বাধা দিয়ে দেয় আর দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। শাহর অসহায় দৃষ্টিতে ইফার চলে যাওয়া দেখে। ইফার এমন অদ্ভুত আচরণের মানে সে বুঝতে পারছেনা।
.
(চলবে)