জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৭,১৮

0
1280

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৭,১৮
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৭

ইফা বিষন্ন মনে হাঁটুতে মুখ রেখে বসে জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখছে। পাশে জাইমা চিন্তিত চেহারায় মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ভেঙ্গে জাইমা বলল, ” আমি ঠিক ই ধরেছি আলফি আলফি করে তোর মাথাটা গেছে। একটা নেইমপ্লেট লকেটের ভিত্তিতে শাহরকে তুই আলফি ভেবে বসে আছিস। আবার এখন বলছিস শাহর আলফি নয়, তুই সত্যি রেহজানের আলফিকে দেখেছিস। আমি তোর কথার কিছুই বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা দুনিয়াতে কি আলফি একজন ই?” ইফা কপালে ভাঁজ ফেলে চুপ করে আছে। নেইমপ্লেট লকেটের উপর ভিত্তি করে সে শাহরকে আলফি ভেবে নিয়েছে এটা ঠিক। কারণ, তখন তার মাথায় কেবল জ্বীনবর আলফির চিন্তা ঘুরছিল। তাই সে কিছু না ভেবে বোকার মত শাহরকে জ্বীন আলফি ভেবে নিয়েছিল। এটা তার মাথায় আসেনি, আলফি কেবল একটা গল্পের চরিত্র। বাস্তবে এমন কিছু হতে পারেনি। ইফা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতে থাকল, তার সাময়িক আবেগী চিন্তা জাইমার কথাতে কেটে যেতে পারত যদি সে নিজের চোখে কাল আলফিকে না দেখত। আলফি যদি গল্পের চরিত্র হয়ে থাকে তবে কাল রাতে দেখা আগন্তুকের সাথে বর্ণনার মিল কি করে থাকতে পারে? শাহরের রুমে সে কি করে আসল? আর আলফির অস্তিত্ব না থাকলে শাহরের কাছে আলফি নেইমপ্লেট লকেট কেন? কিছু একটা তো রহস্য আছে। যেটা ওকে খুজে বের করতে হবে।
শাহর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের বারান্দায় দাঁড়ানো ইফাকে দেখছে। ইফা খুব ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্রের তদারকি করছে। শাহরের মনে হচ্ছে ইফা তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। ২-৩দিন ধরে ইফা উপরতলায় আসেনি, আগে তার সাথে যা টুকটাক কথা হত তাও হচ্ছেনা। ইফার পাগলামী-আবেগ গুলোতে তার বিরক্তি আসতনা, বরং মুগ্ধ হত। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইফার চোখ পড়ে শাহরের দিকে। চোখাচোখি হওয়ামাত্র শাহর মুচকি হেসে হাত নাড়ায়। ইফা মূহুর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকে ইফা খেয়াল করে আশফাক সাহেব খুব যত্ন সহকারে কনের জন্য আনা জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে রাখছেন। ইফা দেখে ডাক ছাড়লেন। ইফা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। আজ সন্ধ্যায় ঘরোয়াভাবে তার মামা আর নাহার আন্টির বিয়ে হবে। অবশেষে তারা একসাথ হওয়াতে ইফা প্রচন্ড খুশি। আশফাক সাহেব সাজ-সরঞ্জাম ভর্তি থলে ইফার হাতে দিয়ে বললেন, “লিস্টে যা যা দিয়েছিস সব এনেছি। এগুলো তোর আন্টির কাছে পাঠিয়ে দিস।” ইফা হেসে বলল,
” এখনো আন্টি বলব? এবার তো আমার চাচাকে রেহাই দাও। চাচী যদি বাংলাদেশ থেকে জানে আমি এখানে চাচার আরেকটা বউ বানিয়ে ফেলেছি তবে কি হবে বুঝতে পারছো!” আশফাক সাহেব হাসতে হাসতে বলল,
” এতদিন তো আন্টি ই ডেকেছিস!”
” তখন উনি সিঙ্গেল ছিল।” ইফার এমন রসিকতায় আশফাক সাহেব মুখ চেপে হেসে ভাবে মেয়েটা এখনো বাচ্চাদের মত কথা বলে। সন্ধ্যার পর বিয়ের সমস্ত কাজ শেষ হয়। অতিথি হিসেবে যারা এসেছে ইফা তাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। শাহর বসে একমনে ব্যস্ত ইফাকে দেখছে। আশফাক সাহেবের বিয়েতে শাহরও আমন্ত্রিত। ইফা শাহরের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেনা। তার এই লাপাত্তা ভাব শাহর মেনে নিতে পারছেনা, সে চাচ্ছে ইফা তার সাথে কথা বলুক। ইফার পাগলামীগুলো সে প্রচন্ড মিস করছে। ইফার সাথে একটু কথা বলার জন্য শাহর উঠে দাঁড়াল। কিন্তু একবারের জন্যও ইফাকে ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছেনা। সে হতাশ হয়ে ফিরে এল। সব কাজ শেষ করে বর-কনেকে রুমে পাঠিয়ে ইফা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার অনেক ক্লান্ত লাগছে, চোখে ঘুম ঘুম ভাব। বাহিরে হালকা বাতাস দেখে চোখ বুজে রিলেক্স হওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কেউ তার হাত টেনে উঠোনে নামিয়ে আনে। ইফা আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে দেখে শাহর তার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?” শাহর ইফার কাছাকাছি এগিয়ে এসে বলল, “আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন? উত্তর দিতে দেরী করেছি বলে? জানতে চাও উত্তরটা!” ইফা শাহরের দিকে একপলক তাকায়। ছেলেটার চাহনীতে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইফা নিজেই শাহরের মুখোমুখি হতে চেয়েছিল কিছু প্রশ্ন নিয়ে। মামার বিয়ে থাকায় সবকিছুর পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু সে ভাবতে পারেনি শাহর তাতে এতটা উতলা হয়ে নিজেই ছুটে আসবে। ইফা দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দেয়,
— “আমি সেই উত্তর জানার প্রয়োজনবোধ করছিনা। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করতে চাই। যার উত্তর আমার জানা আবশ্যক। সেসব আমি আপনাকে পরে জিজ্ঞেস করব। তার আগে একটা ব্যাপার আপনাকে ক্লিয়ার করা দরকার। এতদিন আমি যেসব পাগলামী-বেহায়াপনা করে আপনাকে বিরক্ত করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি আপনাকে আলফি ভেবে এত দুর্বলতা দেখিয়েছিলাম। যা করেছি সব ছিল আলফির জন্য। ” এইটুকু বলে ইফা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শাহর অন্ধকারে পাথরের মত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইফা শাহরের ঘরের দরজায় নক করে একবার চারপাশে তাকাল। এই রাতের বেলা সে এখানে এসেছে কেবল শাহরের কাছ থেকে অজানা উত্তর গুলো জানতে। দরজা খুলতেই ইফা ভিতরে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। ফিরে তাকিয়ে দেখে সেই রাতের সুদর্শন আগন্তুক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যাকে সে আসল আলফি ভেবেছে। ঘরের ঝলমলে আলোতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইফা হতভম্ব হয়ে ভালো করে তার দিকে তাকায়। সে কিছুতে’ই ভুল দেখছেনা। কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি কি সত্যিই আলফি?”
ছেলেটা একটু অবাক হয়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি আলফি। কিন্তু তুমি আমাকে কিভাবে চিনো?” ইফা আবেগে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল, “সেসব পরে বলব। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি জ্বীন? জ্বীন আলফি যার সাথে রেহজানের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।”
— “হ্যাঁ। তুমি রেহজান সম্পর্কেও জানো?”
— “আপনি এখানে কিভাবে এলেন? জনাব শাহরের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
— ” তুমি ঠিক ই জানো আমি একজন জ্বীন। শাহর সম্পর্কে আমার ছোটভাইয়ের মত। ওর সাথে আমার পরিচয়ের খুব বেশীদিন হয়নি। ছয় মাসখানেক আগে ওকে এক দুর্ঘটনা থেকে আমি বাচিয়েছিলাম, তারপর থেকে মাঝে মাঝে ওর সাথে দেখা করতে আসি। তার কারণেই আজ আমি এখানে। ও আমার ব্যাপারে সবকিছু জানে তাই আমাকে আড়াল করে রাখার জন্য তোমার সামনেও না জানার ভান করেছে।”
ইফা আলফিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আপনি জানেন আমি আপনার জন্য কতটা পাগল। এতদিন শাহরকে আলফি ভেবে অনেক পাগলামী করেছি।” আলফি ইফার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি আমার ব্যাপারে কিভাবে জানো? আর কিভাবে ই বা বুঝতে পারলে আমি আলফি।” ইফা ঢোক গিলে বলতে শুরু করে,
— “আমি একটা পুরোনো বইয়ে আপনার আর রেহজানের ভালোবাসার কাহিনী পড়েছি। রেহজানের মারা যাওয়ার কাহিনী পড়ে আপনার জন্য ভীষণ খারাপ লেগেছে। তারপর থেকে আমার মনে আপনাকে নিয়ে অনেক চিন্তা আসে। আমি আপনার মত একজন জ্বীনবর চেয়েছি, এমন আলফিকে ভালোবাসতে চেয়েছি।”
আলফি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিসের বই? কত পুরোনো?”
— “কত পুরোনো তা জানিনা। তবে বইয়ের অবস্থা দেখে মনে হল বছর দশেক হতে পারে। বইটা আমার বান্ধবী তার দাদুর লাইব্রেরিতে পেয়েছে।”
— “আমার আর রেহজানের ঘটনাটা বছরখানেক আগের। সেটা বইয়ে আসবে কিভাবে?”
— “ঠিক বই হবেনা, এটা ডায়েরী। রেহজানের ডায়েরী হয়ত, সবকিছু তার নিজের কথায় লেখা। আচ্ছা রেহজান কি সত্যিই মারা গেছে?”
আলফি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “রেহজান মারা গেছে?”
ইফা আলফি বিস্ময়মাখা চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে জানেন না?”
আলফি অসারশূন্য হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। শাহর আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল, আলফির এই অবস্থা সে বেরিয়ে এসে আলফিকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে ভাই?” ইফা আলফির অবস্থা দেখে এটা ভেবে অবাক হয়, রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে আলফি কিছুই জানেনা। সে ঢোক গিলে বলে, ” তাহলে রেহজান কোথায়? উনি কি বেঁচে আছেন?” আলফি একটু চুপ থেকে বলে,
” আমাকে ওই বইটি এনে দিতে পারবে?” ইফা দাত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে। তারপর দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়।
শাহর আলফির দিকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাই রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি জানেন না?” আলফি একনিঃশ্বাসে পুরো পানি শেষ করে না সূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। শাহর আর কোনো প্রশ্ন করার আগে আলফি বলে, “আমি একটু একা থাকতে চাই।”
ইফা নিজের রুমে এসে বইয়ের তাক চেক করে, সেখানে ডায়েরীটা নেই। পুরো রুম চেক করেও বইটা পায়না। জাইমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, জাইমা উত্তরে বলে, “কয়েকদিন আগে ই তো তুই বইটা আমার থেকে নিয়ে গেলি!” ইফা হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ভাবতে থাকে, সে ২দিন আগেও বইটা বইয়ের তাকে দেখেছিল। তাহলে সেটা গেল কোথায়? বইটা না দিতে পারলে তো সে আলফির কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে। আলফি যদি রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে না ই জেনে থাকে তবে রেহজান কোথায়?
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-১৮
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

শাহর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও ইফাকে ফিরতে না দেখে হতাশ হয়ে আলফির দিকে তাকাল। আলফি দুই হাত ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। তার মাথার দুই পাশের রগ ফুলে আছে, কপালে সামান্য ভাঁজ। শাহর হালকা গলা ঝেড়ে বলল, “তোমার কি মনে হয় ইফার কাছে রেহজানের ডায়েরী থাকতে পারে?” আলফি মাথা না তুলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রেহজানের ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল। কিন্তু ওর ডায়েরী ইফার কাছে থাকতে পারে এটা আমার ভাবনার বাহিরে। ইফার সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবে?”
শাহর মাথা ঝাকিয়ে বলল, “যতটা জেনেছি ও বাংলাদেশী। মা-বাবার মৃত্যুর পর লাহোরে মামার কাছে চলে এসেছে, তাও প্রায় ২বছর আগে। ও একটু বেশী চঞ্চলা আর আবেগপ্রবণ। আর আমার মনে হয়না ও মিথ্যা বলছে।”
ইফা ঘরজুড়ে অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে। নাহার আন্টি ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইফাকে এমন অস্থির হতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,
–” কি হয়েছে তোমার?” ইফা চেয়ারে বসে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ” আমার একটা জরুরী ডায়েরী পাচ্ছিনা। কাল এটা সর্বশেষ বইয়ের তাকে দেখেছিলাম।” নাহার একমূহুর্ত কিছু একটা ভেবে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ইফার দিকে হাতের ডায়েরী বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা খুজছিলে?” ইফা ডায়েরীটা একটানে নিয়ে নিল, এতক্ষণে যেন ও প্রাণ ফিরে পেল। উৎফুল্লস্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “এটা তোমার কাছে কি করে এল?”
— “তোমার মামা ডায়েরীর অবস্থা খারাপ দেখে ফেলে দিয়েছিল। আমার আবার এসব পড়ার শখ আছে। তাই তুলে রেখেছিলাম। দেখো সব ঠিক আছে নাকি? দু-একটা পাতা নাও থাকতে পারে।”
কথাটা শুনে ইফার টেনশান লাগল। তাড়াতাড়ি ডায়েরীর সব পাতা একবার দেখে নিল। সবগুলো’ই আছে কিন্তু লাস্ট পাতা নেই যেখানে রেহজানকে মেরে ফেলার ঘটনা লিখা ছিল। ইফা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এবার কি হবে? নাহারের দিকে ফিরে তাকিয়ে করল, “একটা পাতা মিসিং। ওইটা কোথায় গেল?”
— “তোমার মামা যখন ফেলেছিল সবগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। আমি যা পেয়েছি তাই নিয়ে রেখেছি।” ইফা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে,
— “কোথায় ফেলেছে মামা?”
— “ছাদের কর্ণারে যে পানি জমানোর ট্রাংক আছে সেখানে।”
ইফা একমূহুর্ত দেরী না করে ছাদের দিকে দৌড় দিল। তিনতলায় আসতে’ই শাহর পথ আটকে বলল, “তুমি ডায়েরীটা পেয়েছো?” ইফা তাড়াহুড়োয় শাহরকে সরিয়ে ছুটে যেতে যেতে বলল, “আমি এসে বলছি।”
ইফা ছাদের ট্রাংকের চারপাশ আর ভিতরে খুঁজল। সেখানে ডায়েরীর পাতার চিহ্নমাত্র নেই। হতাশ হয়ে নিচে নেমে এল। শাহর আর আলফি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইফা তাদের মুখোমুখি হতে’ই আলফি প্রশ্ন করে, “পেয়েছো?” ইফা কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরী এগিয়ে দিয়ে বলল, “শেষ পাতা হারিয়ে গেছে যেখানে রেহজানের মৃত্যুর ঘটনা লেখা ছিল।” আলফি ডায়েরী হাতে নিয়ে শাহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসছি।” ইফা আলফির হাত ধরে কান্না কান্না চেহারায় বলল, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেননা?” আলফি ইফার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই মূহুর্তে নয়, ডায়েরী পড়ার পর বলতে পারব। নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণ করতে হলে শেষ পাতা ও খুঁজে বের করতে হবে তোমায়।”
ইফা কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে আসে। বিড়বিড় করতে থাকে, আলফি এত কঠিন কেন? এই আলফিকে তো সে নিজের জ্বীনবর হিসেবে চায়নি। একটাবার ও হেসে কথা বললনা তার সাথে। কষ্টে তার বুকটা চিরে যাচ্ছে। মামার ডাকে চোখ মুছে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায় ইফা। আশফাক সাহেব ঘুমানোর আগে ইফার হাতে বানানো চা না খেলে শান্তি পাননা। তাই ইফা আগে রান্নাঘরে ঢুকে আগে চা বানিয়ে নেয়। তারপর চা হাতে মামার স্টাডি রুমে ঢুকে। আশফাক সাহেব কাজ বন্ধ করে ইফার হাত থেকে চা নিয়ে খেতে থাকেন। ইফা ধপ করে চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। তার মনভার এখনো কাটেনি। শুকনো মুখে বলে,
— “কাজ রেখে কয়েকটা দিন মামীকে তো সময় দিতে পারো।” আশফাক সাহেব হেসে উঠে বলেন,
— “এক বউ পেয়ে আরেক বউকে কিভাবে ছেড়ে দিই বল! ভালো থাকতে চাইলে দু’টোকে ই সামাল দিতে হবে।”
আশফাক সাহেব আবার চা খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। ইফা চা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল। হঠাৎ টেবিলের দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে উঠল। টেবিল থেকে ডায়েরীর পাতা নিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করল,
— “এটা তোমার কাছে ছিল?”
— ” তোর ঘরে একটা পুরোনো ডায়েরী দেখেছিলাম। ওটার অবস্থা খারাপ দেখে ফেলে দিয়েছিলাম ছাদের ট্রাংকে। শেষ পাতা ইন্টারেস্টিং লাগল তাই এনে রেখেছিলাম।”
ইফা খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “এত জায়গা থাকতে ছাদের ট্রাংকে কেন ফেললে? আর শেষ পাতায় কি এমন পেলে?”
— ” তোর মামীর একটা বদঅভ্যাস আছে পুরোনো ডায়েরী পেলে তার পড়ার শখ জাগে। তখন আর এটার অবস্থা বা কার সেটা দেখবেনা তাই ওইখানে ফেলেছি।
আর শেষ পাতা পড়ে দেখলাম মেয়েটাকে তার বোন মেরে ফেলেছে। যেটা আমার ঠিক বিশ্বাস হলনা। কারণ, প্রথম দুই পৃষ্ঠা যখন পড়েছিলাম তখন তার বোনকে আমার নিতান্ত সহজ-সরল আর আবেগী মনে হয়েছিল।”
— “উপর থেকে কি মানুষ চেনা যায় মামা? ভালো মানুষের মুখোশ তো যে কেউ পড়ে থাকতে পারে।”
— “মুখোশ সবাই পড়ে থাকতে পারে কিন্তু সহজ-সরল থাকার ভং সবাই ধরতে পারেনা। আর একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা কিভাবে কয়েকবার ছুরি দিয়ে জোরে পোঁচ মারতে পারে যেখানে সে সামান্য টেবিল সরাতে সক্ষম নয়!”
ইফা গালে হাত দিয়ে চট করে ভেবে নেয়, “তবে কি রওনক তার বোনকে মারেনি? কিন্তু এই শেষ পাতা আমি আলফিকে দিবনা। সে আমার অনুভূতিগুলোর কোনো মূল্য দিচ্ছেনা, খুব কঠিন হয়ে আমার সাথে কথা বলছে।” আশফাক সাহেব ইফাকে চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। সে যখন বুঝতে পারবে তাদের এক হওয়া হলনা তখন সে কেমন উন্মাদনায় মাতাল হবে! আমি হয়ত আগের অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি কিন্তু সে কি আদৌ পারবে ওই মেয়েটির স্থান অন্য কাউকে দিতে?” মামার কথায় চমকে উঠে ইফা। তার ভিতরটা এক হাহাকার শূন্যতায় ছেয়ে যায়। এই মূহুর্তে নিজেকে তার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, যেন সে ই আলফি আর রেহজানকে আলাদা করে দিচ্ছে। সারারাত ইফা একফোঁটা ঘুমাতে পারলনা। কখন সে আলফিকে শেষ পাতা দিতে পারবে সেই তাড়নায় ছটফট করছে।

আলফি ইফার দেওয়া পাতায় একবার চোখ বুলায়। পুরোটা পড়ার পর তার ভিতরে ভয়ংকর সাইক্লোন চলছে তাতে ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে রওনক ভাবীর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। রেহজান যেদিন সে হারিয়েছিল তখন অন্তত এই ভরসায় ছিল রেহজান ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু আজ কেন জানি সেই ভরসা মিলিয়ে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে হুংকার আসছে, “রেহজান মারা গেছে। সে আর কখনো ফিরে আসবেনা।” আলফি কঠিন স্বরে বলল, “সবকিছুর জবাব ভাবীকে দিতে হবে।” আলফি দৌড়ে নিচে নেমে গেল। ইফা শাহরের দিকে চেয়ে বলল, “উনি কোথায় গেলেন? উনার মানসিক অবস্থা ভালো মনে হচ্ছেনা। চলুন, আমরাও উনার পিছু নিই।”
শাহর বাসা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আলফির নাগাল পায়। তার কাঁধে হাত জড়িয়ে বলে, “ভাইয়া আমরাও তোমার সাথে যাব।”
ইফা, শাহর আর আলফি একটা আভিজাত্য বাসায় ঢুকল। বাসাটা ফয়সালাবাদে, লাহোর থেকে ১২০ কি.মি দূরে। আলফি বাসায় ঢুকামাত্র একজন মাঝবয়সী মহিলা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। মহিলার ডাকে বাসার বাকিরাও বেরিয়ে এল। ইফা আর শাহর বাসার ভিতরে ঢুকে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকাল। আলফি মাঝবয়সী মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আম্মা আমি ভাবীর সাথে কথা বলতে এসেছি। তাকে একবার ডাকো।” কাউকে ডাকতে হলনা, প্রায় সাথে সাথে একজন শাড়ী পরা শ্যামলা বর্ণের মেয়ে আর প্রায় পাকিস্তানীদের মত দেখতে একজন ছেলে উপর থেকে নেমে এল। ইফা মনে মনে আন্দাজ করে নিল এরাই রেহজানের দুলাভাই আর ভাবী। আলফি রওনকের দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, — “সেদিন রেহজানের সাথে কি করেছিলে তুমি?” কথাটা বলামাত্র রওনকের হাসিমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে উপস্থিত সবার দিকে একনজর তাকিয়ে আলফির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
— “আমি কি করেছি মানে?” রেহজানের দুলাভাই কিছু বলতে চাইলে আলফি বাধা দিয়ে বলল, ” আমি আর ভাবী কথা বলছি। বলতে দাও, মাঝখানে এসোনা ভাইয়া।”
আলফির কথায় তার ভাই রুস্তম মাঝবয়সী মহিলার কাছে এসে বলল, “আম্মা আলফি রওনককে এসব কি বলছে?” মহিলা শান্তগলায় বলল, ” ওদেরকে কথা বলতে দাও।”
আলফি হাতের ডায়েরীটা উচিয়ে ধরে পুনরায় রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ডায়েরী রেহজানের। তার সাথে সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনা এখানে লেখা আছে। স্পষ্ট লিখা আছে রওনক ভাবী সেইরাতে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে।” রওনকসহ উপস্থিত সবাই আতঁকে উঠল আলফির কথায়। ইফা শাহরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ” উনাকে দেখে কেউ বলবেনা উনি কাউকে খুন করতে পারে।” শাহর ইফার হাত ধরে বলল, ” চুপ থাকুন।” ইফা তার শক্ত করে ধরা হাতের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল।
রওনক অবাক হয়ে বলক, “আমি নিজের বোনকে কিভাবে মারব? এসব রেহজান কেন লিখবে।”
— ” তাহলে ডায়েরীতে যা লিখা আছে তা মিথ্যা?”
— “আমি জানিনা। আমি আমার বোনকে মারিনি, এটা কিভাবে সম্ভব? আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। আমি জানিনা ও কোথায় আছে?”
— “সেদিন শুধু তোমরা দুজন ই বাসায় ছিলে। তাহলে রেহজান কোথায় সেটা তোমার থেকে ভাল কে জানবে?”
— “আমি সত্যিই জানিনা ভাই। সেদিন ও কোথায় চলে গিয়েছে তার ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।” এইটুকু বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রওনক। ইফার ভীষণ মায়া লাগছে মেয়েটার জন্য। তার নিজেরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রওনক রেহজানকে হত্যা করেনি। কিন্তু ডায়েরীর লেখা সত্য তো ফেলে দেওয়া যায়না। আলফি আর কিছু বলার আগে রুস্তম হুংকার ছাড়ে, “ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিসনা। ও সত্যিই কিছু জানেনা। আমি জানি সব, আর আমি ই করেছি।” আলফি সহ প্রত্যেকে অবিশ্বাসী চোখে রুস্তমের দিকে তাকায়। আলফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— “কি জানো তুমি ভাইয়া?”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here