জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-১৯,২০
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৯
রুস্তম রওনকের কাঁধ শক্ত করে জড়িয়ে বলে, “রওনক এমন কিছু করেনি। সেদিন রেহজানকে আনার জন্য আমি যখন সেই বাসায় গিয়ে পৌঁছাই, তখন রেহজানের রুমে রওনককে অজ্ঞান অবস্থায় পাই। সারাবাড়ী খুঁজেও রেহজানকে কোথাও পাইনি। টেবিলের উপর এই ডায়েরীটা পড়ে ছিল, সেটা পড়ার পর আমি নিজে’ ই হতভম্ব হয়ে যাই। রেহজান যদি মরে গিয়ে থাকে ওর লাশ কোথায়? আর কিভাবে’ ই বা এসব ডায়েরীতে লিখে রেখে যাবে? তাও আমি ভয় পেয়ে যাই। তোমরা ডায়েরী পাওয়ার পর হয়ত এতকিছু ভাববে না সোজা দোষ দিবে রওনককে। তাই আমি রেহজানের হাতের লেখা নকল করে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, আমি স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমার খোঁজ করোনা।” আলফি একটু চুপ থেকে বলল,
-” এই মিথ্যা চিঠির জন্য আমাকে কত মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে ভাইয়া সেটা তুমি জানো। অন্তত সত্যটা বলতে পারতে। আমি জানি, ডায়েরীতে লিখা মৃত্যুর কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সেটা আমি ডায়েরী পড়ার পর পর ই বুঝেছিলাম। মারার যাওয়ার পর সে কিভাবে এসব ডায়েরীতে লিখে যাবে! তাও এতক্ষণ বললাম শুধু সত্যটা জানার জন্য।” রওনক চোখ চকচক করে বলল,
— “তাহলে আমার বোন মরেনি, কিন্তু কোথায় আছে সে?”
ইফা বিস্ময়ের ঘোরলাগা কন্ঠে বলল, “এটা তো একবারো আমার মাথায় আসেনি। ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই আপনাদের এসব বলে ফেলেছি।” শাহর ইফার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “ডায়েরী পড়ার পর ভাইয়া সেটা ধরে ফেলেছিল।”
— “তাহলে এতক্ষণ ডায়েরীর লেখার সূত্র ধরে উনাদের জেরা করছিলেন কেন?”
শাহর ইফার বোকা প্রশ্নে হোচট খায়। তাও নিজে সামলে নিয়ে বলে, “ভাইয়ার সন্দেহ উনারা কিছু জানেন সেটা লুকাচ্ছেন। তাই এভাবে জেরা করে সত্য বের করলেন।”
ইফা অস্ফুটস্বরে বলল, “আলফি শুধু হ্যান্ডসাম ই নয়, ব্রিলিয়ান্ট ও।” আলফি রওনকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
— “সেদিন তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে কিভাবে? তখন রেহজান কোথায় ছিল?”
— “আমি রেহজানের রুমে আসামাত্র দেখি সারাগায়ে চাদরমুড়ানো এক ভয়ানক ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে রেহজানকে দেখলামনা। সেই ব্যক্তির হাতে বেশ বড় বড় নখ ছিল, সে আমাকে আচড়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। আচড় দেওয়ার মূহুর্তে আমি জ্ঞান হারালাম।”
— “এই সত্যগুলো একবছর না লুকিয়ে রাখলে আমি হয়ত এতদিনে রেহজানকে খুঁজে বের করতাম। তোমরা এটা কিভাবে করলে আমার সাথে?”
রওনক কাপা কাপা কন্ঠে বলল, “তোমার ভাই আমাকে সেদিনের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে নিষেধ করেছিল।”
রুস্তম আলফির কাধে হাত রেখে বলল, “আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোর ভাবীকে বাঁচানোর জন্য আমই মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছি।” আলফি মাঝবয়সী মহিলার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, “এই পরিবারকে আমি নিজের পরিবার ভেবে এসেছি। তোমাকে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মত ভালোবাসি। তুমি চাওনি বলে আমার আসল পিতা-মাতা আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসলেও আমি যাইনি।”
মহিলা আলফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি তোকে কখনো ভালো রাখতে পারিনি। এইসব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।”
আলফি অন্ধকারে চুপচাপ ছাদে বসে আছে। রুস্তম ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আলফির দিকে তাকিয়ে আছে। তার সাহসে কুলাচ্ছেনা আলফির কাছে গিয়ে কথা বলার। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আলফি পিছনে না তাকিয়ে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভাইয়া? এখানে এসে বসো।” আলফির কথায় রুস্তম ভরসা পায়না তাও ধীর পায়ে আলফির পাশে এসে বসে। আলফিকে সে কখনো তার সাথে এত গম্ভীর হয়ে কথা বলতে দেখেনি। হয়ত আজও দেখত না যদি সে মিথ্যা না বলত। রুস্তম সংকোচ নিয়ে বলে, — “তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার। তবুও বলতে চাই, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি একজন দোষী।”
আলফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর একটু চুপ থেকে বলে,
— “ভাইয়া তোমার মনে আছে? যেদিন আমি অজ্ঞান-ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রওনক ভাবীকে নিয়ে বাসায় ফিরে তোমাকে বলেছিলাম ওকে গ্রহণ করো। সবসময় ওকে আগলে রেখো, কোনো বিপদের আঁচ তার উপর পড়তে দিওনা। তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কথা দিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিলে। একবারো তার পরিচয় জিজ্ঞেস করোনি, শুধু বলেছিলে তাকে আমি কোথায় পেয়েছি।”
— “তুই উত্তরে বলেছিলি জ্বীনের কারণে তার এই অবস্থা। পরে রওনকের কাছে জেনেছিলাম ও জ্বীনের প্রতি খুব বেশী কৌতূহলী ছিল। যার ফলাফল একদিন খারাপ জ্বীনের পাল্লায় পড়েছিল। আমি ই নাকি সেদিন ওকে রক্ষা করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার রুপ ধরে তুই ওকে খারাপ জ্বীনের কবল থেকে উদ্ধার করেছিস।”
— ” তুমি কিন্তু এখনো আমাকে দেওয়া সেই কথা রাখছো, তাহলে তুমি আমার চোখে কিভাবে দোষী হবে ভাইয়া?”
রুস্তম উত্তর দিতে পারেনা, তার ভীষণ কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে নিজেকে সামলানোর অদম্য চেষ্টা করে বলল, “আমি চেয়েছিলাম রেহজান সব জেনে ই তোকে গ্রহণ করুক। আমি চাইছিলামনা রওনকের মত কেবল আকৃষ্ট হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিক।”
— ” সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার হয়ে তুমি ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়ায় আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। আমি হয়ত কোনোদিন বলতে পারতামনা।”
— “রেহজানকে খুঁজে বের করবিনা?” আলফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ” জানিনা ও কোথায় আছে? তবে খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।”
ইফা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে আশফাক সাহেব একটু বকাঝকা করেছে না বলে কোথায় গিয়েছিল সেই প্রসঙ্গে। ইফা কিছু বলেনি বলে আরো বেশী বকা খেয়েছে। সেসব নিয়ে অবশ্য তার মন খারাপ নয়। তার মন ভার হচ্ছে আলফির কথা ভেবে। রেহজানের মিথ্যা চিঠি পেয়েও আলফি রেহজানকে ভুলে যায়নি, তার উপর রাগ পুষে রাখেনি। এই এক বছর চুপচাপ তার ফেরার অপেক্ষা করেছে। আচ্ছা ভালোবাসা বুঝি এটাই? এতদিন ইফা ভেবেছিল সে আলফিকে ভালোবাসে। এখন মনে হচ্ছে, সে ভালোবাসার মানে টাই জানেনা। শাহর তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইফার দিকে তাকিয়ে আছে। আশফাক সাহেব বকা দেওয়াতে হয়ত তার মন খারাপ। শাহর দ্বিধায় পড়ে একবার যাবে ইফার কাছে! এই চঞ্চলা মেয়েটাকে চুপচাপ স্বভাবে একদম মানাচ্ছেনা, এভাবে দেখে তার বুকেও ফাকা ফাকা লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। মেয়েটার প্রতি তার একটা সুক্ষ্ম টান আছে, যেটা সে প্রায় সময় অনুভব করে। সেরাতে ইফাকে এতজোরে চড় মারতে তার খারাপ লেগেছিল বটে কিন্তু ইফার মাথা থেকে জ্বীনের ভূত নামানোর আর বিকল্প উপায় তার জানা ছিলনা।
যখন জেনেছে ইফা আলফির প্রতি দূর্বল। তখন নিজেকে ভীষণ রিক্তশূন্য লাগছিল। এক তীব্র যন্ত্রণা তাকে প্রতিটি মূহুর্ত কষ্ট দিচ্ছিল যা সইতে না পেরে সে আলফিকে অনুরোধ করেছিল একবার ইফার সাথে এই নিয়ে কথা বলতে। কখন যে আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু করল ইফা টের পেলনা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেলেও তার উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। ভালো লাগছে এভাবে বসে ভিজতে। ভিতরটা হালকা হচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে তাকায় সে। শাহর তার মাথার উপর ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে তার পানে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহরের দৃষ্টি তার বুকে ছোটখাট তোলপাড় সৃষ্ট করল। শাহর ইফার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ইফা কাপতে কাপতে হাত ধরে উঠে দাড়াল। শাহর তার টি-শার্টের নিচের অংশ দিয়ে ইফার মাথা মুছার চেষ্টা করে। তারপর ইফা মাথা তার বুকের কাছে ঠেকিয়ে শার্ট দিয়ে ঢেকে দেয় খানিকটা। ইফা সবকিছু চুপ হয়ে দেখতে থাকে। তার নিজের ও কোথাও জানি ভালোলাগা কাজ করছে।
ঝড়ো হাওয়া চোখ বুজে অনুভব করছে আলফি। রুস্তম সেই কখন তাকে নামতে বলে নেমে গেছে, কিন্তু আলফির নামতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। রেহজানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত তার মস্তিষ্কে কড়া নাড়ছে। আশার সঞ্চার করছে রেহজান নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। এতগুলো দিনের অপেক্ষা বৃথা যাবেনা। বৃষ্টির ফোটা ধীরে ধীরে জোরে পড়া শুরু করেছে। আলফির গায়ের সাদা শার্ট অল্পতে ভিজে গেছে। আলফির টনক নড়েনি, তার মনে হচ্ছে রেহজান এক্ষুনি ফিরে আসবে। পাশ থেকে একটা পরিচিত কন্ঠে চমকে উঠল আলফি। ফিরে তাকিয়ে দেখে রেহজান দাঁড়িয়ে আছে। রেহজান তার গায়ের ওড়না দিয়ে আলফির মাথা ঢেকে দেয়। আলফি বুঝতে পারছেনা এটা কি তার ঘোর নাকি বাস্তব? তার মুখে কোনো কথা সরছেনা। আগের মত একটানে রেহজানকে টেনে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রাখে সে। এক অন্যরকম প্রশান্তি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। বৃষ্টি বাড়ছে, কিন্তু আলফির ফেরার তাড়া নেই। রেহজানকে ছাড়তে তার প্রচন্ড ভয় করছে। ছাড়লেই বুঝি এই ঘোর ভেঙ্গে যাবে!
.
(চলবে)
জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব- ২০
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
খানিকবাদে বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমে এসেছে। আলফি বোজা চোখ খুলে রেহজানের দিকে তাকায়। এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিল সে কল্পনার জগতে ছিল। কিন্তু রেহজানকে এখনো তার বুকে দেখে তার বুকের ভিতরে খুশির মাতোয়ারা বয়ে যায়। সে রেহজানের গাল দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে বলল, ” তুমি সত্যিই ফিরে এসেছো রেহজান?” রেহজান অশ্রুসিক্ত চোখে আলফির দিকে তাকায়। আলফির হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলল, “আমি আপনার কাছে ফিরে এসেছি।” আলফি ব্যাকুলচিত্তে প্রশ্ন করে,
–” এতদিন কোথায় ছিলে? কি হয়েছিল সেদিন রাতে?”
রেহজান উত্তরে নিস্তব্ধ থাকে। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, –” সময় হলে আমি নিজে থেকে সব বলব। এখন এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেননা।” আলফি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে। এখন নিচে চলো, সবাইকে বলি তুমি ফিরে এসেছো।” আলফি রেহজানের হাত টেনে নিচে নামতে উদ্ধত হলে রেহজান যেতে চায়না। আলফি কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রেহজান?” রেহজান স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমাকে দু’টো দিন সময় দিতে পারবেন?” আলফি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিসের জন্য?”
— “আমাকে দু’টো দিন অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন? আমি এখন কারো মুখোমুখি হতে চাচ্ছিনা। একটু সময় প্রয়োজন। আপনার সাথে কোথাও একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাই।”
রেহজানের এমন প্রস্তাবে আলফি অবাক হলেও কিছুটা খুশি হয়। কতগুলো দিন সে রেহজানের অপেক্ষা কাটিয়েছে, এখন সত্যিই তাদের নিজস্ব কিছু সময় কাটানো প্রয়োজন। রেহজান যেহেতু চায়নি তাই আলফি রেহজানের ফেরার কথা কাউকে বলেনি। পরেরদিন ভোর হতেই চুপিচুপি রেহজানকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।
ইফা একমনে ছাদের কোণের দেবদারু গাছের দিকে চেয়ে আছে। হালকা বাতাসে দেবদারু গাছের পাতাগুলো নড়ছে, সেটার দিকে তাকিয়ে ইফা গভীরচিন্তায় মগ্ন। কালরাতের ঘটনা তার হৃদয়ের অক্ষপটে বারবার ভাসমান হচ্ছে। কাল শাহরের বুকে মাথা রেখে সে যে প্রশান্তি অনুভব করেছিল সেটা আগে কখনো পায়নি। ইফা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাসে এতদিন আলফির জন্য করা পাগলামী, আবেগের আফসোসমিশ্রিত ছিল। নিচতলায় নেমে ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ইফা। গেইটের কাছে আলফিকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠে সে। আলফির পিছন থেকে শাহর বেরিয়ে ইফার দিকে এগিয়ে আসে।
— “ইফা তোমার মামা কোথায়?” ইফা বিস্মিত গলায় বলে,
— “বাসায় আছে। এই সকালবেলা আলফি এখানে কেন?”
— “জানতে পারবে। তুমি মামাকে ডেকে নিয়ে এসো।”
ইফার চাসহ ট্রে নিয়ে সামনের ঘরে এসে দাঁড়ায়। এখানে আশফাক সাহেব, শাহর, আলফি আর এক অপরিচিত মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি নিকাব পড়া তাই ইফা তার মুখশ্রী দেখতে পাচ্ছেনা। ভ্রু কুঁচকে একবার মেয়েটির দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করে। আশফাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বলেন, ” নাহারের মা মারা যাওয়ার পর থেকে ২য় তলা খালি ই পড়ে আছে। অবশ্য আমাদের কিছু ফার্নিচার আছে। সেটা ভাড়া দিতে কোনো অসুবিধা নেই। তা আপনারা শুধু দুজন’ই থাকবেন?” আলফি চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, “জ্বি। আমি আর আমার স্ত্রী কিছুদিনের জন্য ২য় তলা ভাড়া নিতে চাচ্ছি। পুরো মাসের এডভান্সড পেমেন্ট করতে আপত্তি নেই।” আশফাক সাহেব হেসে বললেন,
–” সমস্যা নেই। কবে থেকে উঠবে?”
— “আজ থেকেই।” আশফাক সাহেব ভ্রু কুচকে একবার আলফির দিকে তাকালেন। তার মনে হচ্ছে, এরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেছে। এই কাজটিকে তিনি কখনো’ই সমর্থন করেননি। কিন্তু প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে একটা আফসোস কাজ করেছিল কেন তখন তিনি এই সিদ্ধান্ত নেননি! ইফা আলফির কথায় অবাক হয়ে পুনরায় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, “এক রাতে আলফি বিয়ে করে ফেলল! রেহজানকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব হল?” মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বারবার ঘুরে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে ইফা। মেয়েটি পাথরের মত নিশ্চুপ বসে আছে। আলফি ২য় তলার চাবি নিয়ে মেয়েটির হাত ধরে উপরতলায় চলে যায়। ইফা হা করে সেটা তাকিয়ে দেখে। শাহর বেরিয়ে আসামাত্র তার হাত চেপে ধরে বলল, ” আলফি একরাতের মধ্যে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল! আর বিয়ে করলেও নিজের বাসা ছেড়ে এখানে কেন উঠল?” শাহর মুচকি হেসে বলল,
— “সব জানতে পারবে। আগে নবদম্পতিকে সংসার গুছিয়ে নিতে দাও, তখন গিয়ে আলাপ করে জেনে এসো।”
শাহর এভাবে কথা এড়িয়ে যাওয়ায় ইফার অভিমান হয়। শাহর সবকিছু জেনেও তাকে কেন বলতে চাচ্ছেনা! সাত-পাঁচ ভেবে ইফা ২য় তলার দিকে পা বাড়ায়। এসে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। ইফার অভিমান আরো বাড়ে, কেন জানি তার এখন হিংসে হচ্ছে। মুখ ভেঙ্গচিয়ে মনে মনে বলে, –” আসা মাত্র রোমান্স শুরু করতে হয় নাকি!”
রেহজান নিকাব খুলে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। অনেকদিন পর সে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। আলফি একপলক রেহজানের দিকে তাকায়। আগের থেকে কিছুটা শুকিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। চেহারা দেখে অনেক মায়া হচ্ছে তার। রেহজান চট করে উঠে বসে বলল, “আমার জন্য কিছু শাড়ি-কুর্তি নিয়ে আসবেন। কাল রাতে কার না কার কুর্তি নিয়ে এসেছেন তাও ওড়না-সেলোয়ার ছাড়া।” আলফি লজ্জায় মাথা চুলকায়। রুম থেকে বেরিয়ে এসে শাহরের ঘরে দিকে যায়। সকাল থেকে দুজনের কিছু খাওয়া হয়নি তার উপর একেবারে ফাকা হাতে বাসায় উঠেছে। কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে আনবে। শাহর আর আলফিকে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যেতে দেখে ইফা ভ্রু কুচকে তাকায়। এই সুযোগে একবার আলফির বউকে দেখে আসাটা মন্দ মনে হয়না তার।
২য় তলায় এসে দরজায় কড়া নাড়ে ইফা। রেহজান চোখ পিটপিট করে দরজার দিকে তাকায়। আলফি সবেমাত্র বেরিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়। তবে কি নিচতলার কেউ এসেছে? দরজা খোলা রেহজানের কাছে এখন সেইফ মনে হলনা। সে নিচুগলায় হাক ছাড়ে,
— “মাফ করবেন, বাসায় কেউ নেই।” ইফা কথাটা শুনে হতাশ হয়ে নিচে নেমে আসে। পরক্ষণে ভাবে, তাকে কি বোকা বানাল হল! বাসায় কেউ না থাকলে হাক ছাড়ল কে? আর তাকে ভিক্ষুক ধরে নিয়েছে নাকি?” নিজের বোকামির কারণে নিজের উপর রাগ হল তার। এখনো মাথায় একটু বুদ্ধি হলনা।
রেহজান আলফির আনা কয়েকটা শাড়ি থেকে বেছে মেরুন রঙ্গের শাড়ি পড়েছে। লম্বা চুলগুলো নিচু করে খোপা করেছে। আলফি অপলক রেহজানের দিকে তাকিয়ে আছে। কতদিন পর এই হাসি-খুশি রেহজানকে দেখছে সে। রেহজানের দু-একটা চুল ছাড়া পেয়ে মুখের সামনে চলে এসেছে। তাতেই তাকে বেশ অপূর্ব দেখাচ্ছে। রেহজান আলফির পাঞ্জাবীর বোতাম নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “চলুন বাহিরে থেকে বেড়িয়ে আসি।” আলফি মনে মনে অনেক খুশি, রেহজানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত তার স্বর্গীয় মনে হচ্ছে। এমনসময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আলফি দরজা খুলে। ইফা শাহরের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শাহর প্রাণপণে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ইফা আলফিকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। আলফি গাঢ় সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে তাতে তাকে নুরানী লাগছে। আলফি ভ্রু কুচকে বলল,
— “এই সন্ধ্যাবেলা তোমরা এখানে?” শাহর অসহায়দৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। ইফা রুমের ভিতরে চারিদিকে একবার দৃষ্টি ঘুরায়। তারপর বলে উঠে,
— “আপনি নাকি রেহজানের জন্য অপেক্ষা করছেন? তাকে ভালোবাসেন! তাহলে এক রাতের মধ্যে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিলেন কিভাবে?” ইফার উচ্চচিৎকার শুনে রেহজান বেরিয়ে আসে। অবাকদৃষ্টিতে ইফা’দের দিকে তাকায়। আলফি মুখ চেপে হেসে বলল, ” আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছি সেটা তোমায় কে বলল?” ইফা কিছু বলার আগে তার চোখ পড়ে রেহজানের দিকে। মায়াবী চেহারার একটা শাড়ি পড়া মেয়ে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। কোনো সাজ-গোজ ছাড়াই মেয়েটাকে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে।
— “আপনি জানেন না উনার একটা বিয়ে করা বউ আছে?”
রেহজান চিন্তিত হয়ে আলফির দিকে তাকায়। আলফি রেহজানের কাধ জড়িয়ে কাছে টেনে ইফার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও ই রেহজান।” ইফা চমকে উঠে আবার রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান ফিরে এসেছে এটা তার বিশ্বাস ই হচ্ছেনা। আলফি পুনরায় বলল,
— “রেহজান ফিরে এসেছে। এর বেশী আর কিছু জানতে চেয়োনা এখন। আমরা বের হচ্ছি, তোমরা যাবে আমাদের সাথে?” শাহর আপত্তি করতে নিলেও ইফা সায় দিল। রেহজানকে দেখে ইফার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। আলফি আর রেহজান হাত ধরাধরি করে বসে চা খাওয়ার দৃশ্য দেখে ইফা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।৷ আলফির প্রতি তার ভালোবাসা না থাকলেও ভালোলাগা ছিল। সেই ভালোলাগা থেকে তার খানিকটা খারাপ লাগছে। তার ও ইচ্ছে হচ্ছে কাউকে নিয়ে এভাবে বসে চা খেতে। এমনসময় শাহর ইফাকে একটানে নিজের দিকে টেনে নেয়। তারপর ধমকের সুরে বলল,
— “একটু কেয়ারফুলি থাকবানা, এক্ষুনি বাইকের সাথে ধাক্কা খেতে।” ইফার কানে শাহরের কথা ঢুকছেনা, সে এক আবেশদৃষ্টিতে শাহরের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, শাহরের কাছে আসলে তার এমন প্রশান্তি কাজ করে কেন? আশেপাশের সবকিছু ভুলে যায়! এটা কি ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা? রেহজান আলফির সাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আলফি আমাকে এই মূহুর্তে বিয়ে করতে পারবেন?” রেহজানের কথায় হোচট খায় আলফি। এমন একটা প্রস্তাব তার কল্পনার বাহিরে ছিল। রেহজানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকায় আলফি। সামনে কমিউনিটি সেন্টার, সেখানে বিয়ের আয়োজন চলছে। রেহজানের সামনে এসে দাঁড়ায় আলফি, তারপর দুহাত দিয়ে গাল জড়িয়ে ধরে বলল,
“অবশ্যই, চলো।” রেহজান অবাকদৃষ্টিতে আলফিকে অনুসরণ করতে থাকে।
.
(চলবে)