জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-২১,২২

0
1272

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-২১,২২
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২১

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রেহজান। চোখ মেলে দেখে মাস্ক পড়া এক আগন্তুক তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ার্ত চোখে ধড়পড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। আগন্তুক তার মুখোমুখি বসে শব্দ করে হাসে। তারপর ফিসফিস কন্ঠে বলে, “আমি আগেই বলেছি পালানোর চেষ্টা করিসনা। ফলাফল খুব খারাপ হবে।” রেহজান আগন্তুকের মুখায়ব থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— “আমাকে এভাবে আটকে রেখে কি কাজ হাসিল করতে চাচ্ছেন?” আগন্তুক হাসে কিন্তু নিঃশব্দে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রেহজানের দিকে ঝুঁকে বলল, “হাসিল করার সময় তো মাত্র ই এলো। তুমি তোমার পরিবারের কাছে যেতে পারবে তবে একশর্তে।” রেহজান কপাল কুচঁকে বলল, “কি শর্ত?” আগন্তুক সরে গিয়ে আগের স্থানে বসে।
আলফি একদৃষ্টিতে রেহজানের দিকে তাকিয়ে আছে। রেহজান কেমন জানি উশখুশ করছে। ইফা আর শাহর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। আলফি রেহজানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এত অস্বস্তিবোধ করছো কেন? একজন হুজুর তোমার সাথে একান্ত কিছু কথা বলে বিয়ের আয়োজন করবেন। রেহজান চমকে উঠে আলফির দিকে তাকায়। ধরা পড়া অপরাধীর মত ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ” হুজুর কিসের জন্য?” আলফি রেহজানের হাত টেনে ছাদে নিয়ে আসে। সজোড়ে এক থাপড় দিয়ে বলে,
— “চালাকি করার চেষ্টা করোনা। তুমি ধরা পড়ে গেছো। নিজের আসল রূপে এসো এক্ষুনি। নতুবা তোমার এমন অবস্থা করব আর নিজের জায়গা ফিরতে পারবেনা।”
মেয়েটি রেহজানের রূপ পরিবর্তন করে নিজের রূপে আসল। আলফি মেয়েটির দিকে একনজর তাকল। শ্বেতবর্ণ গায়ের রং, পরনে ঢোলা জোব্বার ন্যায় বস্ত্র, চোখ দুটো ভিতরের কোটরে ডেবে আছে। আলফির মনে হচ্ছেনা সে আগে কোথাও মেয়েটিকে দেখেছে। মেয়েটিকে প্রশ্ন করে,
— “কে তুমি? রেহজানের রূপ ধরে কেন এসেছো?”
মেয়েটি চোখ তুলে আলফির দিকে তাকায়। তার চোখগুলো যেন জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডলী। আলফির বুঝতে দেরী হলনা মেয়েটি একজন জ্বীন। মেয়েটি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া আসলেই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, তাতে আলফি তাকে সন্দেহ করেছে।
— “আমি এসেছি আপনাকে জ্বীন রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। অনুগ্রহ করে আপনার আসল জগতে ফিরে চলুন।”
আলফির মাথায় রাগ চড়ে যায়। ক্রোধান্বিত গলায় বলল,
— ” রেহজান কোথায়? সত্যিটা যদি না বলো তবে এক্ষুনি আমি তোমাকে মারতে উদ্যত হবো।” মেয়েটি ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। পিছন থেকে ডাক আসে, “আলফি”। আলফি পিছু ফিরে তাকায়। রেহজান তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, রেহজানের মাথার একপাশে ব্যান্ডেজ। আলফি অবাক হয়ে রেহজানের দিকে ভালো করে তাকায়। রেহজানের লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে আছে, পরনে মেয়েটির মত’ই ঢোলা কালো জোব্বা। চেহারায় ভীষণ ক্লান্তির ছাপ। আলফি রেহজানের দিকে এগিয়ে আসে। রেহজান কাতরদৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। আলফির আর ভুল হয়না আসল রেহজানকে চিনতে। এই দৃষ্টি যে তার বড়ই পরিচিত। রেহজানকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আলফি খেয়াল করে মেয়েটি পালাচ্ছে। আলফি পিছু নিতে গেলে রেহজান তার হাত চেপে ধরে আটকায়। আলফি মেয়েটির কথা ভুলে রেহজানের দিকে নজর দিয়ে বলল, ” তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? মাথায় আঘাত পেলে কি করে?” রেহজান নিভু নিভু দৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। তার চোখের সামনের সবকিছু আধার হয়ে আসছে, মাথা হালকা ঘুরছে। রেহজান অবশের মত আলফির বুকে ঢলে পড়ল।

রেহজানের জ্ঞান ফিরে এসেছে, আলফি তাকে ফু দিয়ে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। দেখে ইফা খানিকটা স্বস্তি পায়। আলফি-রেহজানের জুটি দেখে ওর মন জুড়িয়ে যায়। অনেকক্ষণ হল শাহরকে আশে-পাশে দেখতে পাচ্ছেনা সে। কেমন জানি ছটফট লাগছে! ইফা বেশ কয়েকবার শাহরের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে শাহরের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগল। এর মধ্যে কখন যে শাহর তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে টের পেলনা। শাহরের কন্ঠে নিজের নাম শুনে ফিরে তাকায় ইফা। শাহরের চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। যা দেখে ইফার অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। ইফা প্রশ্ন করে, “আপনি ঠিক আছেন তো?” শাহর সম্বিৎ পেয়ে চোখ তুলে ইফার দিকে তাকায়। তারপর ইফাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “হয়ত কথাগুলো বলার আমার আর সুযোগ হবেনা। আমি চেয়েছি সময় নিয়ে এগোতে, কিন্তু মাঝপথে থেমে যেতে হবে ভাবতে পারিনি।” ইফা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শাহর তাকে জড়িয়ে ধরার সাথে তার শরীরের শিরা-উপশিরায় এক ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। হৃদস্পন্দনের শব্দ প্রখর হচ্ছে। এক ভালোলাগার ঘোর তাকে চারিদিক থেকে আবিষ্ট করে আছে। ইফা কম্পিত গলায় বলে, ” আপনার কথা ঠিক বুঝলামনা।”
— “আচ্ছা ইফা আমি আপনার প্রতি এত মুগ্ধ কেন? আপনার চঞ্চলতা, বোকামি, হাসিমুখ আমাকে এত আনন্দ দেয় কেন? আপনাকে ভালো না বাসার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপনি আমাকে আপনার ভালোবাসায় বন্দি করেই ফেললেন।” ইফা কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। সেও তো শাহরকে ভালোবাসে কিন্তু তা মুখ ফুটে বলার মত সাহস তার এখনো হচ্ছেনা। শাহর একটু চুপ থেকে ইফাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা এর উত্তর নাহয় আমার অজানা থাক। আপনাকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছি এটা’ই আমার প্রশান্তি।” ইফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাহর ঘরে ঢুকে যায়।

শাহর, ইফা, রেহজান, আলফি আর রেহজানের বোন-দুলাভাই সবাই একত্রে গোল হয়ে বসে আছে। রেহজানের মুখে সবকিছু জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রেহজানের ডানহাত মুঠোয় নিয়ে রওনক মাথা নিচু করে নিশ্চুপে কাঁদছে। রেহজান হালকা ধমকের সুরে বলল,
— “ফ্যালফ্যাল কাঁদার অভ্যাস পরিবর্তন কর। আমি এখনো বেচে আছি।” রওনক বকা শুনেও কান্না থামায় না। রেহজান আলফির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যখন নতুন বাসায় উঠি তখন ই খেয়াল করেছি কোনো এক আগন্তুক রাতে সেই বাসায় প্রবেশ করে। তাকে কাছ থেকে দেখতে গেলে সে আমার হাতে থুতু ছিটায় তাতে আমার হাতে ফোস্কা পড়ে যায়। বিয়ের দিন জানতে পারি সেই আগন্তুক আপুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া খারাপ জ্বীন। সে নানাভাবে আপুর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, পেটের বাচ্চা নষ্ট করতে চাইছে। সেই আগন্তুক আমাকে সেদিন মারতে ধেয়ে আসে আর আমার ডায়েরীতে আপুর কথা উল্লেখ করা। যাতে সবাই আপুকে দোষী সাব্যস্ত করে তাড়িয়ে দেয় আর জ্বীন তাকে নিজের দখলে নিয়ে আসতে পারে।” রেহজানের কথা শুনে রুস্তম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেই জ্বীন তোমাকে বন্দি করেছিল?” রেহজান ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— ” নাহ, সে আমাকে মারতে চেয়েছিল। তার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে আলফির জন্মদাত্রী মা। তিনি ই আমাকে বন্দি করে রাখেন। উনার ধারণা ছিল, আমাকে না পেয়ে আলফি তাদের কাছে ফিরে যাবে আর তারা নিজের পছন্দের জ্বীনজাতির কাউকে পুত্রবধূ বানাবেন। তাতে যখন কাজ হলনা, উনি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করলেন আলফিকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার।” এইটুকু বলে শাহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমিও তো তোমার ভাইকে ফিরিয়ে নিতেই এসেছো তাইনা?” শাহর এই প্রশ্নের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে মাথা নিচু করে বলল,
— “আম্মা আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি জানতামনা আপনি তার হাতে বন্দি। ভাইয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম আমি। পরে আপনার সাথে ভাইয়ার এত মহাব্বত দেখে আমি বিমুগ্ধ হয়েছি। আম্মাকে অনুরোধ করেছি উনি যেন এই প্রচেষ্টা বন্ধ করেন।”
— “আপনি যখন নাকোচ করেন তখন তিনি আমার বেশে একজন জ্বীন মেয়েকে পাঠান। উনি ভেবেছেন, তাকে দিয়ে জ্বীনরাজ্যে ফেরত আনবেন আলফিকে। কিন্তু যখন সেও ব্যর্থ হয় উনি বাধ্য হয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন আলফি বুঝাতে।” আলফি রাগান্বিত চেহারায় রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কিছুতেই যাবনা। এদেরকে আমার আম্মা-আব্বা ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে। আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কিসের এত আক্ষেপ তাদের? ৫বছর বয়সে যারা আমাকে একা ফেলে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি।”
রেহজান শান্ত কন্ঠে বলে, “আপনাকে তো ফিরে যেতেই হবে। আপনি যদি না ফিরে চান এটা ভেবে আমি আপনাকে গ্রহণ করব। তবে ভুল! এতকিছুর পর আপনাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, আমার অনুরোধ আপনি আপনার আম্মা-আব্বার কাছে নিজের স্থানে ফিরে যান।”
রেহজানের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি আলফি। তার আর কিছু বলার থাকলনা। চোখের পানি আড়াল করে শাহরের উদ্দেশ্যে বলল, “রাতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও।”

শাহর ইফার হাত শক্ত করে ধরে জল ছলছল করা চোখে বলল, “আমি আমার ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আপনি ভালো থাকবেন। আর কখনো হয়ত আমাদের দেখা হবেনা, তবে সবসময় আপনাকে ভালোবাসব।” ইফা খুব ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, চাইলেও যেন সে কিছু বলতে পারছেনা। শাহর ইফার কপালে হালকা করে ঠোট ছোয়াল। অনিচ্ছাকৃত মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ হাফেজ।”
আলফি রেহজানের পাশে এসে দাঁড়াল। রেহজান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আলফি নিচুকন্ঠে বলল, “আমার জন্য তুমি অনেককিছু সহ্য করেছো তার জন্য আমি সত্যই দুঃখিত। আশা করি আমি ফিরে যাওয়ার পর তোমাকে আর কোনো খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে হবেনা। ভালো থেকো।” রেহজান চুপ করে রইল। আলফি একপলক রেহজানের দিকে তাকিয়ে ওকে একটানে বুকের কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। রেহজান ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায় সামান্য হাত ছুড়ল। আলফি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, ” এটা’ই শেষবার।” রেহজান চুপ করে আলফির বুকে পড়ে রইল। শাহরের ডাক শুনে আলফি রেহজান কে ছেড়ে দিয়ে অন্ধকার বারান্দায় মিলিয়ে গেল। একবারের জন্য ও ফিরে তাকালনা। রেহজান শুকনোমুখে অপলক সেইদিকে চেয়ে রইল।
.
(চলবে)

জ্বীনবর (সিজন-৬)
পর্ব-২২
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

রওনক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একবার রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান গম্ভীর মুখে চা খেতে ব্যস্ত। ওর চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই তার মনে কি চলছে! অভিব্যক্তি সবসময়ের মত চুপচাপ আর স্পষ্টবাদী। রওনকের আলফির কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে। নিজের জ্বীন আসক্তির জন্য কতজন ভোগান্তিতে পড়েছে! রেহজান এমনটা কেন করল ভেবে পাচ্ছেনা রওনক। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করার মত সাহস হচ্ছেনা। নীরবতা ভেঙ্গে রওনক সংশয়পূর্ণ অভিব্যক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “তোর কি আলফির জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে?”

রেহজান চা’য়ে চুমুক দেওয়া বন্ধ করে সটান হয়ে চুপ করে থাকে। তারপর ঠোট দুটো প্রসারিত করে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল,

— “কষ্ট হবে কেন? আমি তাকে তার নিজস্ব স্থানে পাঠিয়েছি যেখানে তার থাকার কথা। আর সেখানে’ই সে ভালো থাকবে।”

রেহজানের এমন কথায় রওনক অবাক হলনা। সে এমনটা’ ই আশা করেছিল। রেহজান সবসময় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। তার ব্যবহার-আচরণে সে সব নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে ফুটিয়ে তোলে। রওনক ছোট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মনে হচ্ছে রেহজানের ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আর এই কষ্ট অনুভব করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে রওনকের। রেহজান কিভাবে পারছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। রেহজানের জায়গায় সে হলে এতক্ষণে কেদে কেদে অথৈ সমুদ্র বানিয়ে ফেলত, আর সবচেয়ে বড় কথা সে কখনো’ই আলফিকে ফেরত পাঠাত না। রেহজান রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশ্ন করে,
— তোর বাচ্চা শেষমেষ পৃথিবীর আলো দেখতে পারলনা!

রেহজানের কথায় চমকে উঠে রওনক। মৃত বাচ্চার শোক কাটাতে তার বেশ সময় লেগেছিল। অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাকে বাঁচাতে না পারার জন্য নিজেকে দায়ী করে হতাশায় ডুবে ছিল। রুস্তম এইসময় তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছিল, নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। যার কারণে সে আজ এতটা স্বাভাবিক। রেহজান ভেবেছিল তার এই কথায় তার বোন ফ্যাল ফ্যাল করে কেদে বসবে। কিন্তু তার ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে রওনক মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
— “তাই তো সে আবার আমার গর্ভে ফিরে এসেছে। তার মাকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দিচ্ছে, এইবার তার মা তাকে আর হতাশ করবেনা ইনশা আল্লাহ।”

রেহজানের চোখে খুশির ঝলক দেখা গেল। রওনক আবার মা হতে যাচ্ছে, এই মূহুর্তে এই সংবাদ যেন তার বুকে জমে থাকা কষ্টের ভার কমিয়ে দিল। উঠে এসে রওনক কে জড়িয়ে ধরল রেহজান। রওনকের বাচ্চা নষ্ট হওয়ায় সে এক মানসিক অপরাধে ভূগছিল। আজ যেন সে অপরাধের হতাশা তাকে মুক্তি দিল।

ইফা শুকনোমুখে রুটি তাওয়ায় ভাজছে। নাহার পাশে দাঁড়িয়ে বেলে বেলে রুটিগুলো ইফার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। অন্যমনস্ক থাকায় ইফার হাতে একটু ছ্যাঁক লেগে যায়। ইফা টের পেয়ে যন্ত্রণায় আতঁকে উঠে। নাহার তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানি ভর্তি বোলে ইফার হাত চুবিয়ে দেয়। তারপর একটু ধমকসুরে বলে, “এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছো কেন? লাল হয়ে কতটা ফুলে গেছে। ” ইফার চোখে তখন পানি ছলছল করছে। যন্ত্রণায় নাকি কাউকে খুব মনে পড়ায় সেটা নাহার বুঝতে পারলনা। ইফা হাত সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে করতে বলে, “ঠিক হয়ে যাবে।”

নাহার আড়চোখে ইফার দিকে তাকাল। ইফার চোখের পানি গড়িয়ে নাকের ডগায় এসে জমেছে। নাহার এতদিন জানত ইফা এতবড় হয়েও ভ্যা ভ্যা করে কাদে। এখন নিঃশব্দে কাদতে শিখে গেছে। এই কয়েকটা মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে ইফার মাঝে। সারাদিন বকবক করতে থাকা মেয়েটি এখন অপ্রয়োজনে কথা বলে, চঞ্চলতা গুলো ঢাকা পড়ে গেছে তার চুপচাপ থাকার চেষ্টায়। মাঝরাতে প্রায়শ একা একা ছাদে বসে থাকে, তিনতলার বারান্দায় পায়চারি করে।
এত পরিবর্তনেও নাহার মুখ ফুটে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অপেক্ষায় ছিল ইফা কবে নিজে থেকে সবকিছু বলবে। তার কোনো লক্ষণ না দেখে নাহার নিজে থেকে’ই প্রশ্ন করে, ” তোমার কি হয়েছে? ইদানিং তোমার অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি।” ইফা আড়ালে চোখ মুছে একফালি হাসি টেনে বলল, “তেমন কিছুই না মামী।” নাহার বুঝল ইফা বলতে চায়না, তাই সেও আর কোনো প্রশ্ন করলনা।

রেহজান আর ইফা ছাদে পাশাপাশি বসে আছে। দুজনের দৃষ্টি’ই আকাশে থাকা এক ফালি চাঁদের দিকে নিবদ্ধ। পিনপতন নীরবতায় দুজনের মনের মধ্যে’ই এক তুমুল হাহাকার চলছে। ইফা তার দৃষ্টি রেহজানের দিকে ফেরাল। চাদের আলোয় বোরকা পরিহিত রেহজানকে আরব দেশের কোনো সুন্দরী মনে হচ্ছে। একসময় এই রেহজানকে সে প্রচুর হিংসে করত, ভাবত রেহজানকে কি কারণে আলফি এত ভালোবাসত। কিন্তু রেহজানের সাথে মিশার পর তার মনে হচ্ছে সে একটা বড় বোন পেয়েছে। যতক্ষণ সে রেহজানের সাথে থাকে, ওর মনখারাপের লেশমাত্র থাকেনা। রেহজান আর তার মধ্যে বোনের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। ইফা ধীরকন্ঠে প্রশ্ন করে, “আপু তুমি আলফি ভাইয়াকে মিস করোনা?”

ইফার প্রশ্নে রেহজান তার দিকে ফিরে তাকায়। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যা ইফা টের পায়না। তারপর মুচকি হেসে বলে,
— “যে সর্বক্ষণ হৃদয়ে থাকে, তাকে কিভাবে মিস করব?”

রেহজানের উত্তরে ইফা মুগ্ধ হয়। চোখ বুজে একবার শাহরের মুখখানি মনে করার চেষ্টা করে। তার কল্পনায় ভেসে উঠে শাহরের গেজ দাতের সুন্দর হাসিমাখা মুখ। ইফা ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিতে নিতে পুনরায় প্রশ্ন করে,

— “তুমি জানো, আলফি ভাইয়া আর কখনো ফিরবেনা। তাও তুমি ফিরে যেতে বললে কেন? উনি নিজেও তো চায়নি তার পরিবারের কাছে ফিরতে। তুমি কি পারতে না তার পাশে থেকে তাকে আগলে ধরে রাখতে! এখন তোমার আফসোস হয়না?”

ইফার কথাগুলো রেহজানের হৃদপিন্ডে ছুরির ন্যায় আঘাত করে। সবাই তার বাহিরের শান্ত রুপ দেখে ভাবে সে আলফিকে ছাড়া ভালোই আছে। তার ভিতরের তুমুল শূন্যতা-হাহাকার কেউ বুঝতে পারেনা। অবশ্য সেও বুঝতে দেয়না। রেহজান ইফার দিকে তাকিয়ে বলল,

— “না। আফসোস তখন হত যদি আমি স্বার্থপরের মত আলফিকে নিজের কাছে রেখে দিতাম। আমার বোন রওনকের কথা না ভেবে নিজের জীবন সাজাতে ব্যস্ত হতাম।” ইফা অবাক হয়ে রেহজানকে দেখে। অস্ফুটস্বরে বলে, “তবে তুমি তোমার বোনের কথা ভেবে আলফিকে ফেরত পাঠিয়েছো?”

রেহজান কষ্টের মধ্যেও মুচকি হাসে। তীর্যক দৃষ্টিতে চারপাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি না বেরুতে দেবার চেষ্টা করে বলল,

— “শুধু আমার বোনের কথা ভেবে নয়, আলফির কথা ভেবেও। তার মা-বাবা আমাকে হুমকি দিয়েছিল তাদের কথামত আলফিকে যদি ফিরে যেতে না বলি তবে আমার আপুর পিছনে সেই খারাপ জ্বীনকে লেলিয়ে দিবে।
আমি তাতে ভাবনায় পড়ে গেল, রাজি হতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। তখন উনারা আমাকে বললেন যদি আলফি একবারের জন্য হলেও জ্বীনরাজ্যে ফিরে না যায় তবে তাদের জাতি তাকে মারতে বাধ্য হবে। অতএব, আমার কিছু করার ছিলনা।”

ইফা এবার রেহজানের কষ্ট টা বুঝতে পারে। তার প্রচন্ড মায়া হয়৷ ভাবে, এই মেয়েটার সহ্যশক্তি এত বেশী কেন? ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে কিন্তু বাহিরে ভীষণ শান্ত। রেহজান নিজেকে সামলে নিয়ে ইফাকে প্রশ্ন করে,
— “তুই তো চাইলেই শাহরকে আটকে রাখতে পারতি? আটকালি না কেন? সে যদি জানত তুইও তাকে ভালোবাসিস তবে সে সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে তোর কাছে থাকত।”
— ” আমি তখন পর্যন্ত সংশয়ে ছিলাম। আর সে কেন বুঝতে পারলনা বলো তো! এখন আমার বড্ড আফসোস হয়, কেন তখন বলিনি। আসলে তার প্রতি অনুভূতিগুলো যথেষ্ট শক্ত ছিলনা। স্বল্পকালীন আবেগ ভেবে দ্বিধায় ছিলাম।”
রেহজান মুচকি হাসে, তারপর ইফার হাতে হাত রেখে বলল,
— “উপস্থিতি যখন বুঝাতে অক্ষম, অনুপস্থিতি দ্বিগুন পোড়াতে মোক্ষম।” ইফা চট করে বলল, “এটা তোমাকে আলফি ভাইয়া বলেছিল তাইনা?”

রেহজানকে উত্তর দেয়না, গম্ভীর হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
ইফা রেহজানের কাধে মুখ রেখে হতাশায় আপ্লুত কন্ঠে প্রশ্ন করে, “আপু ওরা কি আর কখনো আমাদের কাছে ফিরবেনা?”
রেহজান আরো গম্ভীর হয়ে যায়। ধরাগলায় বলে
— “হয়ত ফিরবেনা। খানিকটা আমাদের উপর অভিমানে নতুবা ফেরার আর উপায় নেই বলে।”
ইফার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গালে বেয়ে পড়ে। রেহজান টের পায়, কিন্তু বাধা দেয়না। সে না কাঁদতে পারুক, ইফা তো পারে। কান্না করলে তার কষ্ট খানিকটা হালকা হবে। কিন্তু নিজের অপ্রকাশিত কষ্ট কখনো হালকা হওয়ার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, “একটু আবেগী হলে মন্দ হতনা। অন্তত কষ্টগুলো কিছুটা কমত।”

ইফা একটুপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়। নিজের প্রতি কিছুটা রাগ হয়, কিছুতেই নিজের ইমোশোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। অথচ তার পাশে বসা মানুষটা হাজার কষ্ট বুকে চেপে রেখে কেমন শান্ত! সবকিছু আড়াল করে হাসে। ইফা পরিবেশ সহজ করার জন্য প্রশ্ন করে, “আপু চা খাবে?”
রেহজান নাসূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,
— “খুব তাড়াতাড়ি হয়ত আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব। নিজের দিকে খেয়াল রাখতে ভুলিসনা যেনো।”
ইফা আচমকিত হয়। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— “ফিরবে কেন?”
— “মা-বাবা চাচ্ছেন আমি যাতে ফিরে যাই তাই।”
— “উনারা যদি তোমার বিয়ে দিয়ে দেয় তখন কি করবে?”
রেহজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে একটু চুপ থেকে বলল, “জানিনা। তবে আজীবন একজনকে’ই ভালোবেসে যাব।”
ইফা রেহজানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে কান্না কান্না ভাব নিয়ে বলে, “আপু আমরা কি ওদের ফিরিয়ে আনতে পারিনা? জ্বীনরাজ্যে যেতে পারবনা?”
রেহজান ইফার মাথায় হাত রেখে বলল, “এসব আমাদের কল্পনার-ও বাহিরে… এক কথায় অসাধ্য। আমি আজ আসি, বাংলাদেশ যাওয়ার আগে একবার এসে দেখা করে যাব। নিজের খেয়াল রেখো।”
রেহজান ছাদ থেকে নেমে যায়। ইফা একা বসে থাকে আর তাকিয়ে থাকে দেবদারু গাছের দোলাদুল্যমান শাখার দিকে। ঝড়ো হাওয়ার মতো তীব্র বেগে হু হু করে চাপিয়ে রাখা কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ম্লান মুখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “শাহর আপনি কি আর কোনোদিনও আমার কাছে ফিরবেননা?”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here