জ্বীনবর ২,পর্বঃ ০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সাথে সাথে নিচে বেকে থাকা রডটা ধরে ফেললাম। দোতলা বাসা হলে অনেকটা উচু মাটি থেকে, নিচে আবার পাকা বারান্দা। এখান থেকে মাথা ফাটবে কিংবা হাত-পা দুটোই ভাঙ্গবে। রডটা খুব হালকা, কতক্ষণ ঝুলে থাকতে পারব জানিনাহ। চিৎকার করলেও কেউ শুনবেনা, আর শুনে যদি আসেও অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে। এত রাতে ছাদে আসার জন্য কৈফিয়ত কম দিতে হবেনা, পড়লাম উভয় সংকটে। ইস! এখন যদি এখান থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলে দিত কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, রডটা আরেকটু নেবে গেল। ভয় পেয়ে ওইটা আরো শক্ত করে ধরলাম। মানুষগুলো এমনিই, যারা বলে মরে যাব, মরে যাব। তারাও মৃত্যুর সন্নিকটে এসে বাচার জন্য আকুল চেষ্টা করে।আর ঝুলে থাকতে পারছিনা, হাতগুলো অবশ হয়ে এসেছে। নিজে থেকে উঠতে পারব এমন কোনো উপায় দেখলামনা। হাতটা আস্তে আস্তে রড ছেড়ে দিচ্ছে, শত চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারছিনা। আল্লাহ এভাবে মরতে চাইনাহ আমি, তুমি বাচাও আমাকে। হঠাৎ দেখি একটা লম্বা হাত কেউ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই চাদরে মুখ ঢেকে রাখা লোকটা। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, হাতটা ধরে উঠে আসুন। নতুবা পড়ে যাবেন।
বুঝতে পারছিনা কি করব, এমনিতেই ঝুলে আছি পড়পড় অবস্থা, তাতে নাকি উনার হেল্প নিব। নিজের ইগোতে লাগছে ব্যাপারটা।
উনি আমি হাত ধরার অপেক্ষা করলেননা, নিজের হাতটাকে আরেকটু লম্বা করে আমার এক হাত ধরলেন। উনার ছোয়ায় পুরো শরীরটা যেন কেপে উঠল। যেমন কোমল হাত, তেমনি ঠান্ডা। টেনে ছাদের উপর উঠিয়ে নিলেন। আমি গা ঝেড়ে উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি আশে পাশে নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেলেন ই বা কেন? এইবারও ধন্যবাদ দেওয়া হলনা। আমি আর ছাদে দাড়ালামনা, অনেকটা পালিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। শরীরের প্রতিটা পশম এখনো খাড়া হয়ে আছে, অনুভূতিটা অদ্ভুত। ছোটবেলা থেকে মাদ্রাসা আর বাবার নিয়মে চলতাম বলে কখনো কোনো ছেলের সাথে মেশা হয়নি, ছোয়াছুয়ি তো দূরের কথা।
আজ কি প্রথম তার ছোয়া পেয়ে এমন অনুভূতি হচ্ছে নাকি কেবল তার ঠান্ডা হাতের জন্য। সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনাহ। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই উঠতে কষ্ট হচ্ছিল, পুরো শরীরে হালকা ব্যথা। কপালে হাত দিতেই বুঝলাম জ্বর হয়েছে, মাথাটাও ঘুরাচ্ছিল। বিছানায় ই পড়ে রইলাম, সীমা-ফুপি মাথায় পানি দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন তাও কমলোনা।
ফুপি ওষুধ খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, আজ বিকালে ভাবলাম তোকে আর সীমাকে নিয়ে একটু বের হব, তুই তো দেখি জ্বর বাধিয়ে রেখেছিস।
— কোথায় যেতে ফুপি?
— কাল-পরশু সীমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, তাদের আপ্যায়ন করার জন্য কিছু জিনিস পত্র লাগবে আর কিছু কেনাকাটা তো করতে হবে। কিন্তু তোকে এই অবস্থায় একা রেখে এসব কি করে আনতে যাই!
ঘরে তোর আংকেল বা পুরুষ মানুষ নেই যে সে এসব করবে। না করলেও তো চলছেনা।
— তোমরা যাওনা ফুপি। আমি একা থাকতে পারব, আর বিছানায় শুয়ে ই তো থাকব। সমস্যা হবেনা, তুমি অইসব সেরে আসো সীমাকে নিয়ে।
— তুই বলছিস? সীমা আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু….
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, কিচ্ছু হবেনা তো। এয় চিন্তা করিসনা, তোরা যাহ।
— সীমা চল আমরা বরং যাই। আর স্বপ্না তো আছেই ওর সাথে থাকবে।
স্বপ্না শুনে মুখ গোমড়া করে ফেলল। কেদে কেদে বলল, তোমরা সবসময় আমার সাথে এমন করো! আমাকে রেখে যেতে খুব ভালোলাগে তাইনা। যাবনা আমি কখনো। কেদে-অভিমান করে এমন অবস্থা করেছিল সে, আমিই জোর করে ফুপিকে বুঝিয়ে ওকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলাম। তারা বের হতে হতে মাগরিবের আযান পড়ে গেল, বিদায় দিয়ে সদরদরজা বন্ধ করে রুমে চলে আসলাম। শরীরটা বড্ড দূর্বল লাগছে, ব্ল্যাককফি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শরীরে তেমন বল পাচ্ছিনা যে নিজে সিড়ি বেয়ে নেমে কফি বানাব।
অগত্যা শুয়ে রইলাম বিছানায়। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, ছেলেটা কি আমার উপর সত্যি অভিমান করেছে সেদিন এভাবে বলায়। নিশ্চয়ই করেছে নাহলে কাল একদন্ড না দাঁড়িয়ে চলে গেল কেন! আমার আসলে এভাবে বলা উচিত নয়নি, সত্যিকার অর্থে আমার কারো সঙ্গ দরকার। কিন্তু জ্বীন বলে আমি তাকে মেনে নিতে পারছিলামনা। মানব ই বা কি করে, সেটা পরিবেশ কিংবা সমাজের নিয়মের বিরুদ্ধ। আমি আসলেই ঠিক করিনি, উনি তো কেবল সঙ্গ দিতে চেয়েছিলেন ক্ষতি করা তো তার উদ্দেশ্য ছিলনা। আর যে সমাজের ভয়ে আমি উনাকে দূরে সরাচ্ছি, তাদেরকে না বললেই তো হয়।
ব্যাপারটা শুধু আমার মাঝে থাকল, জ্বীনের সঙ্গ পাওয়ার মত ভাগ্য কয়জনের ই বা হয়। উনি বলেছিলেন মন থেকে স্মরণ করলেই তিনি আসবেন।
মনে মনে তাকে কয়েকবার স্মরণ করলাম।
ঠিক তখনি লোডশেডিং হল, এতক্ষণ পরে আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আমি যে পুরো বাড়ীতে একা এখন খুব খারাপভাবে উপলব্ধি করছি। হাতড়ে ফোনটার ফ্ল্যাশ অন করে অন্যদিক ঘুরিয়ে রেখে দিলাম। শোয়া থেকে উঠে বসামাত্রই নাকে ব্ল্যাককফির ঘ্রাণ লাগল। মাথাটা ঘুরিয়ে দেখি বেডটেবিলে কফির মগ রাখা আছে, তা থেকে ধোয়া উঠছে। মগটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, এটা কি উনার কাজ?
এমনসময় ওপাশ থেকে তার গলার স্বর ভেসে এল।
— কফিটা কেমন হল? আমি চুমুক দিয়ে বললাম, আপনি বানিয়েছেন?
উনি উত্তর না দিয়ে বললেন, জ্বর কমেছে?
আমি বুঝতে পারলামনা জ্বর কমেছে কিনা, তবে এখন অনেকটা বেটার ফিল করছি। আমাকে নীরব থাকতে দেখে উনি এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন। আমার খুব ভালোলাগছিল, মনে হল এভাবে যদি উনি হাতটা কপালে রাখেন আমার জ্বর এমনিতেই সেরে যাবে।
হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, ইনশা আল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে আবার অন্ধকার কোণে বসে পড়লেন। আমার খারাপ লাগল, মনে মনে চাচ্ছিলাম উনি আমার পাশে বসুক।
— আপনি অন্ধকারে থাকেন কেন? নিজেকে আমার সামনে প্রকাশ করতে চান না কেন?
— যেদিন বৈধতা পাব সেদিন প্রকাশ করব।
— মানে বুঝলামনা।
— আপনার কি আমার উপর রাগ কমেছে?
— আমি সেদিনের ঘটনার জন্য সত্যিই দুঃখিত। আমার এমন টা করা ঠিক হয়নি, মানসিক ডিপ্রেশন থেকে করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দিবেন।
উনি কিছু বললেননা। একটু নীরব থেকে বললেন, আপনার নামটা খুব সুন্দর। এটা কার নাম জানেন কি?
— না তো, আপনি জানেন?
— হ্যাঁ জানি। এটা সেই মেয়ের নাম, যার সাথে আমাদের জ্বীনবংশের ছেলে মুস্তফার সাথে বিয়ে হয়েছে। তাদের একটা মেয়েও হয়েছিল পরবর্তীতে।
— এটা কি আদৌ সম্ভব?
— কেন সম্ভব নয়?
— একটা মানুষের সাথে একটা জ্বীনের কি করে বিয়ে হতে পারে! যেখানে দুজন ই ভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্টি, সবকিছুই ভিন্ন।
— তাতে কি! এক সৃষ্টিকর্তার ই তো সৃষ্টি। আল্লাহ যদি চান, তবে এটা হওয়া অসম্ভব কিছুনাহ।
— হয়তবা।
অনেকটা সময় গল্প করলাম তার সাথে, সবি আমার পছন্দ-অপছন্দের কথাবার্তা। অনেক ভালোলাগছে এখন, সত্যিই এমন একটা সঙ্গী আমার খুব দরকার ছিল। কথার মাঝে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
— বাসা থেকে পালিয়ে এলেন কেন?
আমি থ মেরে গেলাম, সে কি করে জানল। অবশ্য জানা অসম্ভব কিছুনা। কিন্তু এর উত্তর আমি কি দিব। আমি তো নিজেও জানিনা আমি কেন পালিয়েছি।
আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব?
— হ্যাঁ করুন।
— এইবার থেকে নিয়মিত নামায পড়ুন, দেখবেন মন ভাল থাকবে। এবং আল্লাহ আপনার সহায় থাকবেন।
তার এই কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। ছোট থেকেই আমার এসবে অনীহা ছিল। বাবা হুজুর, কিন্তু তার মেয়ে বেনামাযী এমন কথাও শুনতে হয়েছিল। তাও পাত্তা দিতামনা, একটু বেশিই দুষ্ট ছিলাম। তাই দুষ্টুমিতে মেতে থাকতাম, এসবে কখনো মন দেওয়ার সুযোগ পাইনি। আজ উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যিই এসবে মন দেওয়া উচিত। যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তার শোকর গুজার করা আবশ্যক।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আচ্ছা।
এমন সময় নিচে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেলাম। নিশ্চয়ই ফুপিরা চলে এসেছে। এখন তো উনি চলে যাবেন। করুনমুখে অন্ধকার কোণে তাকালাম।
উনি বললেন, আসি আমি, আপনি নিচে গিয়ে দরজা খুলুন।
আল্লাহ হাফেজ। আমি নিচে নেমে এলাম, শরীরটা ফুরফুরে লাগছে।
ফুপিরা এসে ঢুকল বাসায়, এলাহি কেনাকাটা হয়েছে দেখছি।
(চলবে)