জ্বীনবর ২,পর্বঃ ০৪
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সীমার সাথে ছাদে হাটাহাটি আর গল্প করছিলাম। রাত ১১টার বেশি বাজে, দুজনের চোখেই ঘুম নেই। সীমার ঘুম না আসার কারণ ও খুব নার্ভাস ফিল দেখতে আসা নিয়ে, আমি তো মেহরাবের কথা ভেবেই চলেছি। উনি খুব ভালো, নিজের আপন লোক মনে হয় উনাকে। সীমা আমার হাত ঝাকিয়ে বলল,
— আচ্ছা মুশু, ওদের আমাকে পছন্দ হবে তো?
— বোকা মেয়ে কেন হবেনা! এত ভালো একটা মেয়ে তুই, সুন্দরী আর কিউট ও বটে। তুই যে ঘরের বউ হয়ে যাবি, ওরা খুব লাকি হবে।
— আসলে মুশু, ছেলেটাকে আমার খুব বেশীই পছন্দ হয়েছে। ছবি দেখে, উনার সম্পর্কে জেনেই প্রেমে পড়ে গেছি, আমি এমন একজনকেই চাচ্ছিলাম মনে মনে। তাই আম্মা যখন বিয়ের জন্য বলল, আমি আর না করলামনা।
— টেনশান করিসনা তোহ। ইনশাআল্লাহ সব ভালোই ভালোই মিটবে।
— তাই যেন হয় রে
— হবে, জাস্ট রিলেক্স।
— আচ্ছা, মুশু তোর পছন্দের কেউ নেই? তুই কি কারো প্রতি সিরিয়াস!
— না রে সীমা। বাবাকে তো তুই চিনিসনা, উনি কোনো ছেলের সাথে মিশতে দেননা। তবে মনে হচ্ছে মনের মধ্যে একটু ভালোলাগা ঝেকে বসেছে।
— কার জন্য? বিনাদ্বিধায় বলতে পারিস, আমি আম্মাকে দিয়ে মামুর কাছে কথাটা উঠাব। দেখবি আমার বিয়ের পরই তোর ও উনার সাথে বিয়ে হবে।
বিয়ের কথা শুনে সারাশরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল, মনটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল।
আমার তো মেহরাবকে ভালোলাগে, কিন্তু উনি তো জ্বীন। উনার সাথে আমার বিয়ে কি আদৌ সম্ভব? আর বাবা কি করে মেনে নিবে এমন সম্পর্ক।
এসব আমি কি ভাবছি, উনাকে জাস্ট আমার ভালোলাগে। তার মানে এই না যে উনাকে আমি আমার লাইফে চাই কিংবা উনাকে স্বামী হিসাবে পেতে চাই!
আমি ইদানিং এসব ব্যাপার নিয়ে একটু বেশি ভাবছি। ভালোলাগাটা কিছুতেই প্রগাড় হয়ে ভালোবাসায় রুপান্তরিত হতে দেওয়া যাবেনা, মন থেকে বাজে চিন্তাগুলো কে দূর করতে হবে।
কিন্তু চিন্তাগুলো আর দূর হলনা, এর মাঝ থেকে আমার ঘুম ই আমাকে টাটাহ বলে কেটে পড়ল। সীমাকে অনেকক্ষণ আগেই ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছি, আমি কেবল ছাদে রয়ে গেছি। ছাদের পরিবেশটা খারাপ নাহ, মৃদু বাতাস, এক পাশে লাগানো ফুলের গাছে থেকে হালকা ফুলের সুগন্ধ, চিলেকোঠার বারান্দায় লো পাওয়ারের কয়েকটা রঙ্গিন ঝাড়।এই সময় উনি থাকলে মন্দ হতনা, বেশ জমিয়ে গল্প করতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে ছাদে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে নিজের চিন্তাভাবনা গুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলাম।
পাশ থেকে প্রশ্ন, ” কি এত ভাবছেন?”
চোখ খুলে পাশে তাকালাম, উনি শরীরে চাদর মুড়িয়ে আমার থেকে ৩-৪হাত দূরে বসে আছেন। অবাক হয়ে বললাম, “আপনি?”
— ঘুমাবেন না?
— আসছেনাহ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
— জ্বীহ অবশ্যই।
— সত্যি কি জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়, সংসার হয়?
— হ্যাঁ হয়। এমন বহুবার হয়েছে, কিছু ভালবাসা পূর্ণতা পেয়েছে কিছু পায়নি।
শুনে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
অবশ চোখে তার দিকে তাকালাম। জানি না কিছু বুঝতে পারল কিনা! পা দুটো বেঞ্চির উপর উঠিয়ে উচু করে বলল,
— আমার কোলে মাথা রাখুন তো।
আমিও কাঠের পুতুলের মত তার কথামত কোলে মাথা রাখলাম। হয়ত আমিও তার সঙ্গ চাচ্ছিলাম। উনি ধীরে ধীরে চুলে বিলি কেটে দিলেন। খুব আরাম লাগছিল, ঘুমহীন চোখগুলো প্রচন্ড ঘুমে বার বার বন্ধ হয়ে আসছে।
চোখে রোদ পড়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখি সবে সূর্য উঠছে, আমি সেই বেঞ্চিতে শুয়ে আছি। গায়ের উপর পাতলা চাদর, মাথার নিচে বালিশ। কাল রাতের কথা মনে পড়তে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। উঠে গিয়ে বালিশ-চাদর চিলেকোঠার ঘরে রেখে নিচে নেমে ফ্রেশ হলাম।
মনটা আজ ভীষণ ভালো, কি কারণে তা জানা নেই। ঠোটের কোণে হাসি লেগেই আছে। সারাটাদিন খুব ভালোই কাটল আমার।বিকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় ২৫-২৬ বয়সী সুদর্শন, হাল্কা ফর্সা ফরমাল টাইপ ছেলে এসে আমাকে পিছন থেকে ডাকল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “জ্বী বলুন।”
— কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু আপনি কে?
— সেটা তো জানতে পারবেন। যতটা আশা করেছিলাম আপনি তার থেকে বেশি সুন্দরী এবং স্মার্ট। আচ্ছা আপনার চেহারাটা এত মায়াবী কেন? চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর, একদম টানা টানা।
— স্যরি, আপনি এসব কি বলছেন? কে আপনি? বিনা অনুমতিতে কারো রুমে প্রবেশ কর উচিত নয় আপনার জানা নেই?
ছেলেটা সোজা আমার হাত ধরে নিচে নিয়ে এল। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, উনি এত শক্ত করে ধরে রেখেছেন যে ছাড়াতে পারলামনা।
নিচের ড্রয়িংরুমে ফুপি, আরো দুজন মহিলাসহ একজন বয়স্ক লোক এবং ২জন প্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলে ও ছিলেন। আমাকে এভাবে আনতে দেখে উনারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটি বয়স্ক মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— মা আমার পাত্রী পছন্দ হয়েছে।
— তুই কাকে পছন্দ করেছিস?
— কেন যাকে তোমরা পছন্দ করে রেখেছো। তোমরা বিয়ে ঠিক করে ফেলো মা।
ততক্ষণে সীমা শাড়ি পড়ে নিচে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনা বুঝার ট্রাই করল।আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
–ভাইয়া আপনার ভুল হচ্ছে।
— মানে বুঝলামনা। ছেলেটির মা সীমাকে দেখিয়ে বললেন,
— আমরা তোর জন্য সীমাকে পছন্দ করেছিলাম। এই হচ্ছে সীমা, তোমার হবু বউ।
ছেলেটি একপলক সিমাকে দেখে নিল।
ছেলেটির মা সীমাকে পাশে এনে বসিয়ে বলল, তুমি কোথায় ছিলে মা?
— আমি দক্ষিণের শেষ রুমে ছিলাম। উনি ভুল করে এর আগের রুমে ঢুকে পড়েছেন।
— হ্যা সেজন্যই এই মেয়েটিকে সে তুমি ভেবে ভুল করেছে।আমি চমকে দিব বলে তোমার ছবি ওকে দেখাইনি।
তাহলে ভাবী বিয়ের তারিখ টা ঠিক করে ফেলি।ভাইজান তো সামনের মাসে আসছেন তাইনা।
ছেলেটি থামিয়ে দিয়ে বলল,
— মা একটু অপেক্ষা করো। আমি উনাকে বিয়ে করতে পারবনা, আমার এই মেয়েটিকেই পছন্দ হয়েছে। আর আমি উনাকেই বিয়ে করব।
আমি অবাক হয়ে সীমার দিকে তাকালাম। ওর চোখে পানি টলমল করছিল।
আমি কিছু বলার আগেই ফুপি বলল, বাবা, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি ওকে কি করে বিয়ে করবে? ও আমার ভাইয়ের মেয়ে, ওর স্বামী ওকে বেড়ানোর জন্য কিছুদিন এখানে রেখে গেছে।
ছেলেটি আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল,
— বিবাহিত মেয়ের নাকে নাকফুল, হাতে চুড়ি কোথায়? আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন। এত কিছু বুঝিনা, পরশুদিন আমি এসে ওকে বিয়ে করে নিয়ে যাব। মা চলো এখন।
সবাই চলে গেল। সীমা সেখানে এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে কাদতে কাদতে রুমে চলে গেল। ফুপি রেগে আমাকে বলল,
শান্তি হয়েছে তোর? এটাই তো চেয়েছিলি নিশ্চয়ই। আপন মানুষ বলে তোকে ঘরে ঠাই দিলাম, এত ভালোবাসলাম। তুই তার এমন প্রতিদান দিলি? আমার মেয়ের জীবনটাই শেষ করে দিলি। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম আমি, ভাবিনি একদিন তুই আমাকেই ছোবল মারবি? শেষে কিনা ভাইয়ের অসম্পূর্ণ প্রতিশোধ তুই নিতে এসেছিস! ছিঃ এত নীচ তোরা।
ফুপি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। চোখের পানি সীমার ঘরের দিকে গেলাম আমি। কয়েকবার দরজা ধাক্কালাম, কিন্তু সীমা দরজা খুলল না।
হয়ত ও আমাকে ভুল বুঝে বসে আছে ফুপির মত। এত অলক্ষী কেন আমি! গুটি গুটি পায়ে পায়ে ছাদে এসে থ মেরে বসে রইলাম। নিঃশব্দে ফুপির কথাগুলো ভেবে কাদছি, আমি তো এখানে আসতে চাইনি। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এমনসময় টের পেলাম, মেহরাব আমার পাশে বসে আছে, নীচুকন্ঠে
জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আপনার?
.
(চলবে)