জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০১

0
3407

জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

জামার গুটানো হাতা খুলে নিচের দিকে নামাতে নামাতে এসে করিম চাচার চা দোকানে বসলাম। চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর খেয়াল করলাম হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে, উঠে জগের পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম ভালো করে। ততক্ষণে চায়ের দোকানে বসে থাকা লোকগুলো আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস শুরু করেছে। জানি আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছে।
চোখেমুখে পানি দিয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। ওরা আবার চুপ হয়ে গেছে, অজানা এক কারণে লোকগুলো আমার সামনে আমার বদনামী কর‍তে পারেনা। চায়ে চুমুক দিতেই দেখলাম পাড়ায় এ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে, ওই পশুগুলোকে ধরে নিয়ে চিকিৎসা করতে। যা কেলানি কেলালাম আজ! চায়ের দোকানের পিচ্চিটা এসে বলল, ওস্তাদ, তোমারে খালা খুজতাছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাইতে কইসে। চায়ের বিল দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম, আজ কপালে শনি আছে সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।
আজো মা অনেক বকবে, বাবার পুরোনো লাঠি দিয়ে দু-এক ঘা লাগিয়ে কিছুক্ষণ বাদে নিজেই ফ্যালফ্যাল করে কাদবে, মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাবে। প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে আমার জন্য। যাই হোক, বাসার সামনে এসে দরজায় নক করতেই দেখি দরজা খোলা। বুকে থু থু দিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম। উদ্দেশ্য আগে নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে লম্বা ঘুম দিব। ততক্ষণে মায়ের মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যাবে।

যেই রুমের দিকে যাচ্ছি, পিছন থেকে মায়ের ডাক, “ওয়াফাহ! এদিকে আয়।”
পর পর কয়েকবার ঢক গিলে মুখটাকে মাছুম বাচ্চার মত করে পিছু ফিরে দেখলাম মা সেই পুরোনো লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু কাছে এসে বললাম, “মা, পরে কথা বলি। আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি, বাহিরে যা গরম। তুমি খেতে দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।”
মা লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, ফ্রেশ তো হবিই। আগে লাঠির কয়েক ঘা খেয়ে নে। বলেই পায়ে লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিল। ব্যথার তেমন কিছুই নেই এই আঘাতে, তাও ভান করে বললাম, “মা আমার লাগছে। এমনিতেও পায়ে ভীষণ চোট পেয়েছি।” সাথে সাথে মা লাঠি ফেলে আমাকে বসিয়ে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, কোথায় চোট পেয়েছিস?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। মায়ের চোখ থেকে মুক্তাদানার মত পানি ঝড়ছে। আমার হাত ধরে হাতে মা কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,
-কেন এসব করিস ওয়াফাহ? জানিস তো তোর মা এসব সহ্য করতে পারেনা। তুই কেন ভুলে যাস তুই একটা মেয়ে। এসব করলে লোকে কি বলবে? তোর তো কখনো বিয়ে হবেনা মা। আমি একা একটা মানুষ কতদিক সামলাব।
তুই ও যদি না বুঝিস, কে বুঝবে বল! আমার সব চিন্তা তো তোকেই ঘিরেই। সবাই তোকে আড়ালে গুন্ডি ডাকে, কত বাজে কথা বলে মা হয়ে আমি এসব সহ্য করব কি করে বল?
-মা, আমি তো নিজের জন্য গুন্ডামি করিনা। আজ পাড়ার ছেলেগুলো শান্তার ওড়না ধরে টানাটানি করছিল, বাজে বাজে কথা বলে স্কুলগামী মেয়েদেরকে উক্ত্যত করছিল এসব অন্যায় আমি কি করে সহ্য করি বলো? তাই ছেলেগুলোকে আমি আর রিতা,মীনা, বৈশাখী মিলে ইচ্ছেমত কেলিয়েছি। দেখলাম তো হসপিটালে পাঠাল। জন্মের শিক্ষা দিয়েছি ওদের আজ।
– তুই জানিস তুই কাকে মেরেছিস? আমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নে ও তার বন্ধুদের। ভয়ে আছি কখন এসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়! তুই আর শান্তি দিবিনা আমায়। রাস্তায় বের হলে সবাই বলে তোকে কবে বিয়ে দিব? বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, যেকোনো একটা ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে।
তুই তো বিয়ে করতেই রাজি হসনা। এইদিকে পাড়ায় গুন্ডামি করে বেড়াস, তোকে বিয়ে করবে কে? বলে মা মুখে আচল চেপে কান্না করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

নিজের রুমে এসে দরজা লক করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জানালার ফাকে আসা ক্ষীণ চাদের আলোর দিকে ভাবতে লাগলাম, আসলেই মা বড্ড কষ্ট দিই আমি। আমি ওয়াসিফা, মা আদর করে ওয়াফাহ ডাকে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি, তারপর থেকে মা ই আমার মা-বাবা সব। মায়ের আদরে বাবাকে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু ভুলতে পারিনা, বাবার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো, বাবার আপসহীন অন্যায় না মানা আদর্শগুলো মনে পড়ে।
আমিও বাবার মত অন্যায় সহ্য করতে পারিনা, তাই প্রতিবাদ করতে করতে সবার কাছে এখন গুন্ডি নামেই পরিচিত হয়ে গেছি। মা আমাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে। এখন টেইলারি কাজ করেই সংসার চালান। আর আমি পাড়ায় ছেলেদের মত টইটই করে ঘুরি। আমার মা ছাড়া কেউ নেই, মায়ের ও আমি ছাড়া কেউ নাই। তাই অত শাসন করতে পারেনা, একটু করেই ফ্যালফ্যাল করে কেদে দেয়। এখন তার মাথায় আমার বিয়ের ভুত চেপেছে, যে করেই হোক বিয়ে দিবেই আমাকে।
কিন্তু কোনো পাত্রপক্ষ ই আমার এসব স্বভাব-চরিত্র শুনে ঘরের বউ করে তুলতে চায়না। পরে জানাবে বলে কেটে পড়ে, আমি এসব দেখে হাসি। জেনে গেছি, ওরা আর এ মুখো হবেনা। পাশের বাসার ভাবি-চাচীগুলো দেখে মজা লুটে, সহানুভূতির নামে মাকে খোচা মেরে দিয়ে যায়।
দরজায় কড়া নেড়ে উঠল। বুঝতে পেরেছি মা খাবার নিয়ে এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে চুপচাপ মন খারাপের ভান ধরে খাটে এসে বসে পড়লাম। মা ফ্যাকাশে মুখে আমার পাশে বসে ভাত মাখাতে লাগলেন।
খানিকটা মেখে নেওয়ার পর নীরবতা ভেঙ্গে বলল, যতই বকি তোকে, তুই ভাল করেই জানিস আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তোকে কষ্ট দিয়ে আমিই কষ্ট পাই।
তোকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে একফোটা পানিও নামেনা। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই তোকে বহুকষ্টে বড় করেছি। এত কষ্ট করে পড়ালেখা করালাম, কোন শিক্ষক তোকে অন্যায়ভাবে মেরেছে বলে সেটাও ছেড়ে দিলি।
এখন একটু সংসারের কাজকর্মে মন দিবি কিন্তু তা না করে ছেলে সেজে পাড়ায় গুন্ডামি করিস।
আর কত জ্বালাবি আমায় বল? শান্তিতে মরতে তো দিবি।
শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে, কেদেই দিলাম। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা মা, তোকে একটা ভাল ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি মরেও শান্তি।
-এসব কথা বলবানা তুমি। কোথাও যাবানা আমাকে ছেড়ে।
– থেকে তোর এসব নিন্দে শুনব? সবাই আমার মেয়েকে গুন্ডি বলবে সেটা মেনে নিব?
আমি মাকে ছেড়ে চোখ মুছে নিয়ে বললাম, আমি আর এসব করবনা। বিয়ে করে নিব কিন্তু তাও ছেড়ে যাওয়ার কথা বলোনা। আমার যে আর কেউ নেই না তুমি ছাড়া।
মা আমার কপালে চুমু খেয়ে ভাতের নলা আমার মুখে পুরে দিয়ে বলল, আমার লক্ষী মেয়ে।আর রাগ করে থাকিসনা মা, নে খেয়ে নে।
আমি প্লেট থেকে নলা উঠিয়ে মাকে খাইয়ে দিলাম। মা আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমি পরমশান্তিতে চোখ বুজলাম, অনুভব করলাম মায়ের চোখের পানি টপটপ করে ঝড়ছে। প্রতিবারের মত আবারো প্রতিজ্ঞা করে বসলাম, মাকে আর কষ্ট দিবনা, গুন্ডামি ছেড়ে লক্ষী হয়ে যাব।
হয়তো প্রতিবারের মত এইবার ও প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলব। তাও খানিকের শান্তির জন্য প্রতিজ্ঞা করা।

আমি যে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গুন্ডামি করি তা নয়, নিজেকে রক্ষা করার জন্য ও। গুন্ডামি না করলে এই জানোয়ার রুপি মানুষগুলো সেই কবে আমাকে আর আমার মাকে ছিড়ে খেত। সবাই শুধু বাহিরের রুপ দেখেই আমাকে খারাপ বলে, মায়ের কাছে এসে নালিশ বসায়।
আল্লাহ যে কবে আমাকে বুঝার মত একটা মানুষ পাঠাবে।
ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে দেখি মা গভীর ঘুমে মগ্ন। যেদিন আমাকে শাসন করে সেদিন মাকে জড়িয়েই ঘুমাই। মা ই এসে পাশে শুয়ে পড়ে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন গুলো পুনরাবৃত্তি করে।
শুয়ে থাকতে আর ভাল্লাগছেনা। উঠে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। বাহিরে অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না, দাওয়ার উপর বসে চোখ বুজে রইলাম।
দাওয়ার পাশে কতকগুলো ইটের টুকরো ছিল। আনমনে সেগুলো এইদিক সেদিক ছুড়তে লাগলাম। হঠাৎ চাপা স্বরে একটা আর্তনাদ, সাথে সাথে পাশের ঝোপটা সজোড়ে নড়ে উঠল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম…….
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here