জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০২,৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্বঃ০২
এত রাতে মানুষের স্বরে কে আর্তনাদ করছে? বাড়িতে আবার চোর ঢুকল না তো! ভেবেই একটা মোটা ডাল কুড়িয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঝোপটা এখনো কিঞ্চিৎ নড়ছে। ডালটা নিয়ে সাবধানে ঝোপের পিছনে এসে দাড়ালাম। অনুজ্জ্বল জ্যোৎসায় দেখলাম একটা প্রতিমূর্তি মাটিতে উবু হয়ে বসে পায়ে হাত বুলাচ্ছে। বোধহয় পায়ে চোট পেয়েছে। এইবার মাথায় ডাল দিয়ে একটা আঘাত করে কুপোকাত করব ভেবে যেই ডাল টা উচিয়ে আঘাত করতে গেলাম, আঘাত করার আগমূহুর্তে প্রতিমূর্তিটা পিছনে না ঘুরেই হাত দিয়ে ডালটা শক্ত করে চেপে ধরল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মূহুর্তে সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ওড়না টেনে হাত বেধে ফেলল গলায় প্যাচ দিয়ে। এমনভাবে ওরনা টা গলায় পেচিয়ে দিল সে একটু শক্ত করে টেনে ধরলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। চোর তো দেখছি ভীষণ চালু। তাও দমে যাওয়া চলবেনা, তাই আমি হাতের বাধন খোলার চেষ্টা করলাম। সে আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, কে আপনি? এভাবে আঘাত করতে এসেছিলেন কেন? আমি চেচিয়ে চেচিয়ে বললাম,
— অন্যের বাড়ীতে চুরি করতে আসবেন আর আপনাকে আদর করবে। ছেড়ে দিন বলছি, সাহস থাকলে মুখোমুখি লড়াই করুন। পিছন থেকে আঘাত করে ভীতুর পরিচয় দিবেন না। ছিচকে চোর কোথাকার!
— আস্তে কথা বলুন, জোরে কথা বললে কিন্তু বেঘোরে মারা পড়বেন। আমি একটু জোরে টেনে ধরলে আপনি শেষ। অতএব, আওয়াজ নিচে।
দমে গেলাম আমি। একি সত্যি সত্যি আমাকে মারার চিন্তা করছে নাকি?
— চোরের আবার বড় গলা। এত সাহস কি করে হয় একটা মেয়েকে এভাবে হ্যারেজ করার। একে তো চুরি করতে এসেছেন, তার উপর আমার সাথে দেমাগ দেখাচ্ছেন। একবার হাত ছেড়ে দেখুন, নিজের নাম ভুলিয়ে দিব।
— আপনাকে কে বলল আমি চোর? আর রাত-বিরাতে এভাবে ঢিল ছুড়ে আঘাত করছেন সেটা কেমন ভদ্রতা। না জেনে আবার চোর ভেবে এসেছেন আঘাত করতে। বেশ সাহস তো আপনার।
— আপনি কত ভদ্র ছেলে! রাত-বিরাতে অন্যের বাড়ীতে ঘুরঘুর করেন। একটা অবলা মেয়েকে নির্যাতন করছেন। এখনো বলছি ছেড়ে দিন নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
— আপনাকে বললাম না আস্তে কথা বলুন। এইবারের মত ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে এসব কাজ আর করবেন না। বলে এক টানে প্যাচ ছাড়িয়ে দিল। ছাড়ানোর সাথে সাথে আমি মাটি থেকে ডাল তুলে যেই ছেলেটাকে আঘাত করতে যাব দেখি আশেপাশে কেউ ই নেই। একনিমিষে পালাল কি করে! এত বড় অপরাধ করেও বেচে গেল। একবার হাতে পাই, তখন দেখে নিব। নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে ওড়না তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকে পড়লাম।
খুব রাগ হচ্ছে। একটুও শান্তি পাচ্ছিনা, ব্যাটাকে ধরে ইচ্ছেমত পিটুনী দিতে পারতাম শান্তি লাগত। অন্ধকারে চেহারাটাও দেখিনি যে পরে ধরতে পারব। এত চালু যে এক মূহুর্তে আমাকে কুপোকাত করে ছাড়ল। চোরব্যাটা আপনি যতই চালু হন, আপনার ১২টা আমি বাজিয়ে ছাড়ব। এত বড় সাহস আমাকে বেধে ভয় দেখাল। আজ না হলে কাল তো সে আবার চুরি করতে বের হবে। কোনো না কোনো বাড়িতে তো ঢুকবে, তখন খপ করে ধরে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিব।
সাত-পাচ ভেবে রাগে ফুসতে ফুসতে এ পাশ ও পাশ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন আর চোরটার কথা মনেও ছিলনা সারাদিনের আড্ডাবাজি আর গুন্ডামিতে। পাড়ার পাশের বস্তির কয়েকটা ছন্নছাড়া মেয়ে আমাকে সঙ্গ দেয়, ওদেরকে নিয়ে আমার গ্যাং। সারাদিন টইটই করে রাতে বাসায় ঢুকার সময় চোর ব্যাটার কথা মনে পড়ল। বাসায় না ঢুকে পাড়ার বাড়ীগুলোতে কয়েকবার চক্কর মেরে আসলাম। নাহ চোর ব্যাটার দেখা নেই। হয়ত টের পেয়ে এলাকা ছেড়েই পালিয়েছে। আমার না ওরে টাইট দেওয়া হলনা। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। অনিচ্ছায় ব্যাটাকে এই যাত্রায় ছেড়ে দিলাম।
হঠাৎ মাঝরাতে মায়ের বুকের ব্যথা বেড়ে গেল। বুকের ব্যথায় কাতরাতে লাগল। দিশেহারা হয়ে গেলাম আমি। মায়ের ওষুধের বাক্স ঘেটে দেখলাম ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। অথচ মা আমাকে একবারো বললনা। এত রাতে তো পাড়ার ফার্মেসী ও খোলা পাবনা। তাও গেঞ্জির উপর শার্টটা চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাড়ার বাহিরের ফার্মেসীর উদ্দেশ্যে। প্রায়ই ওইটা অনেক রাত অব্ধি খোলা থাকে। ভাগ্য ভাল হলে আজো খোলা পাব। বেশ দূরে তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলাম। আল্লাহ সহায় হওয়ায় ফার্মেসী খোলা পেলাম, ওষুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাটা লাগালাম। পুরো পাড়া নিস্তব্ধ, সবাই ঘুমে বিভোর। রাস্তায় দুই-একটা কুকুর শুয়ে শুয়ে ঝিমুচ্ছে। আরো জোরে পা চালালাম। খানিকটা পথ আসতেই আমার পথ আটকে ধরল ৫টা ছেলে। এরা তো সেই ছেলেগুলোই যাদের সে ইচ্ছেমত কেলিয়েছিলাম। ৭দিনের মাথায় হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরবে ভাবিনি। এটাও ভাবিনি মাঝরাতে নির্জন রাস্তায় আমাকে একা পেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পথ আগলে দাঁড়াবে। না এখন এদের সাথে লড়াই করা চলবেনা। একে তো হাতে ওষুধের প্যাকেট, ওদিকে মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। তার উপর এই ৫টার সাথে একা পেরে উঠবনা।
শান্ত গলায় বললাম, শুন ভাই, লড়াই করবি ভালো কথা। কিন্তু এখন আমি লড়াই করতে ইচ্ছুক না। লড়াই করার ইচ্ছে হলে কাল পাবলিকের সামনে আসিস। এখন আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। পথ থেকে সরে দাড়া।
তাদের একজন হেসে হেসে বলল, এক্ষুনি লড়াই কর। দেখি তুই কত লড়াই করতে পারিস। আয়, আজ তোর গুন্ডামি ছুটাব। সেদিন কেলিয়ে হস্পিটালে পাঠিয়েছিস না? আজ আমরা তোকে জাহান্নামে পাঠাব। আমি কিছু বলার আগে দুটো ছেলে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল, ওষুধের প্যাকেট টা দূরে ছুড়ে ফেলে দিল।
বাড়িওয়ালার ভাগ্নে রাফি পকেট থেকে একটা বোতল বের করে দেখিয়ে বলল,
— এটা কি জানিস? এসিড। এটা দিয়ে আমি তোর মুখ ঝলসে দিব। তারপর দেখব আমাদের পাড়ার বড় গুন্ডির ছটফটানি। এই ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে তুই বের হবি কি করে রে ওয়াফাহ। তোর গুন্ডামিগিরি কই থাকবে। বলতে বলতে রাফি আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি ভয়ে চোখ বুঝে ফেললাম। আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম মনে মনে। এখন এই অন্ধকার রাস্তায় কেউ আমাকে বাচাতে আসবেনা, আমার আর্তনাদ ও কারো কান অব্ধি পৌছোবেনা।
এই নির্জন রাস্তায় এসিডে ঝলসানো মুখ নিয়ে আমি ছটফট করতে থাকব। আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও। এমনসময় ছেলেগুলো আমার হাত ছেড়ে দিল, বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। এখন নিশ্চয়ই আমার দিকে এসিড ছোড়ে হবে।
কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ও তেমন কিছু না দেখে চোখ মেললাম। মেলে দেখি পশু গুলো আমার থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর ছটফট করছে। আমি আশেপাশে চোখ বুলালাম, কোথাও তো কেউ নেই।
তখনি সামনে চাদর মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, আসুন আমার সাথে, আপনাকে বাসায় পৌছে দেই।
কন্ঠটা চিনতে আমার দেরী হলনা। এই তো সেই চোরের গলা। আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম, আমি আপনার সাথে কেন যাব? আর এদের এই অবস্থা কি আপনি করেছেন।
— বেশি কথা না বলে আসলে আসুন। কিংবা ইচ্ছে হলে ওদের সাথে থাকুন। ওরা আপনাকে আরো একটু আপ্যায়ন করুক।আমি চললাম।
বলে সে দ্রুতপদে হাটা দিল। আমিও দেরী না করে তার পিছু পিছু প্রায় দৌড়তে লাগলাম। এখন যে পরিস্থিতি এখন তার উপর ভরসা না করলেও আমার চলছেনা।
পুরো রাস্তা সে আমার থেকে ৭-৮হাত দুরত্ব রেখে চলল। এত জোরে হাটছে যে আমি দৌড়েও তার পাশাপাশি আসতে পারছিনা। এদিকে মনটা ও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল হাতে যা কয়েকটা টাকা ছিল তার সব দিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনেছি। এখন ওষুধ না পেয়ে যদি মায়ের কিছু হয়ে তাহলে আমি কি করব! শয়তান গুলো যে কোথায় প্যাকেট টা ছুড়ে ফেলেছে। আমার ভীষণ কাদতে ইচ্ছে করছে। লোকটা বাসার সামনে এসে দাড়াল, দরজার সামনে কি একটা রেখে অন্য দিক দিয়ে দ্রুত হেটে বেরিয়ে গেল। একবার পিছন ফিরেও দেখল না আজিব লোকটা। দরজার সামনে এসে দেখলাম প্যাকেট এখানে রেখে গিয়েছে লোকটা।
ঘাড় থেকে কত বড় চিন্তার বোঝা নেমে গেল।
একটু উকি দিয়ে বাহিরে তাকালাম লোকটা ততক্ষণে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় ঢুকে দরজা লক করে দিলাম।
মা উঠে বসে আছে, তাড়াতাড়ি করে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু নিজের ঘুমের দেখা নেই। ছটফট করছি ভিতরে ভিতরে। আজ আমার কি যে হত! সত্যিই আমার মুখ দেখানোর জো থাকতনা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, উনি এমন একজন পাঠিয়ে আমার সহায় হয়েছেন…..
(চলবে)
জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
ছেলেটা কে যত খারাপ ভেবেছি সে ততটাও খারাপ নয়। অন্তত ধন্যবাদটুকু তার প্রাপ্য। দূর আমি আবার ওই ব্যাটার ভাল-খারাপ ভাবতে বসলাম কেন? চোর তো চোরই। মানবতার খাতিরে আমাকে বাচিয়েছে বিনিময়ে আমি সেই রাতের রাগ উঠিয়ে নিলাম। সবি মাইনাসে মাইনাসে কাটা। সারারাত আর ঘুমালাম না, মায়ের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলালাম।
ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা অনেকটাই সেরে গেছে। বিকেলের দিকে ক্লাব থেকে হকিস্টিক কয়েকটা নিয়ে পাড়ার মোড়ে আসলাম। আজ অই কুত্তাগুলোকে উপরের টিকেট কাটাব, খুব লড়াই করার শখ হয়েছিল না! কাল রাতের সব সুদে আসলে এখন ফেরত দিব। হকিস্টিক নিয়ে ওই ছেলেগুলোর আড্ডাখানার দিকে যাচ্ছিলাম। পিছন থেকে মীনা ডেকে বলল, কিরে, কই যাস? তোর হাতে হকিস্টিক কেন? কেলাতে যাচ্ছিস আমাদেরকে ডাকলি না!
— মোড়ের দোকানে যাচ্ছি। হ্যা কেলাতেই যাচ্ছি।
— অইখানে কাকে কেলাবি?
— রাফি আর তার চেলাগুলারে। আজ সবগুলার হাত-পা ভাঙ্গব।
— হাত-পা ভাঙ্গা পোলাপাইনের আর কি হাত-পা ভাঙ্গবি?
— আগের বারের মাইর ঠিক জায়গায় পড়েনি। সপ্তাহ না ঘুরতেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে। আজ আবার ১মাসের জন্য পাঠাব।
— তুই জানিস না? হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পর ওরা আবার কেলানি খেয়েছে। এখন সবগুলো আবার হাসপাতালেই গেছে। কারো হাত ভেঙেছে৷ কারো পা, আর রাফির মাথা ফেটেছে। তার নাকি মুখ বেকে গেছে, ঠিকমত কথা বলতে পারছেনা। মাত্রই তো করিম চাচার দোকান থেকে খবর পেলাম।
আমি অবাক হয়ে চুপ করে রইলাম। এত সিরিয়াস অবস্থা ওদের!
— কিরে চুপ করে আছিস যে? তুই আবার ওদের উপর ক্ষেপে গেলি কেন?
— না তেমন কিছুনা। চল হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসি খবর সত্য কিনা! আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা।
— ঠিক আছে, চল।
হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম যা শুনেছি সবি সত্যি। ওদের চোখে ভয় দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে বেচারাদের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। অথচ আমিই ওদেরকে কিছু করিনি। গভীর ভাবনায় পড়ল চোর ব্যাটা এদের কিছুসময়ের মধ্যে এমন কেলিয়েছে যে সবগুলো ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মীনাকে বিদায় দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরছি।সাধারণত এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরিনা, মায়ের শরীরটা খারাপ তাই। নামাজের টাইম তাই আশেপাশে মানুষ কম, কিছুক্ষণ হাটার পর মনে হল কেউ আমাকে ফলো করছে। পাত্তা না দিয়ে নিজের মত আবার শিস বাজাতে বাজাতে হাটতে লাগলাম। কিন্তু আবার মনে হল কেউ আমার পিছনে পিছনে আসছে, আমি পিছনে তাকাতেই সরে পড়ছে। একটা ছেলে উল্টাদিকে তাকিয়ে রাস্তার একপাশ ওপাশ তাকিয়ে কিছু একটা খুজছে। শার্টের পকেট থেকে কাটার বের করে গাছের আড়াল থেকে পিছন থেকে ছেলেটার গলায় কাটার চেপে ধরলাম। ছেলে ভয়ে চুপ করে সোজা দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কাটার আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
— কিরে, তোর ঘরে মা-বোন নাই? এভাবে রাস্তায় মেয়েদেরকে ফলো করিস।
— আপনাকে দেখে মেয়ে মনে হয়নি।
— অই ব্যাটা, আমি মেয়ে না ছেলে সেটা দিয়ে তোর কি দরকার! ফলো করছিলি কেন? এখন এক পোচ টেনে উপরে পাঠিয়ে দেই?
ছেলেটা আমাকে এক ধাক্কা দিল, আমি কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। সোজা হয়ে দাড়াতেই সে আমার সামনে কাটার নিয়ে দাড়াল। আমি নিজের হাতের দিকে তাকালাম কাটার টা কখন তার হাতে গেল। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢক গিললাম। মুখটা চাদর দিয়ে পেচিয়ে রেখেছে, ছিনতাই কারীদের মত।
— ভাই, আমার কাছে কিছু নেই। ছিনতাই করে কিচ্ছু পাবিনা, শুধু শুধু সময়টা নষ্ট করিসনা।
— কি সমস্যা আপনার? একবার চোর, একবার ছিনতাইকারী বানিয়ে ফেলছেন।
সবসময় এমন গুন্ডামি করেন কেন?
— ওহ আপনি সে চোর ব্যাটা।
কাটারটা একটু এগিয়ে ধরে বলল, ভদ্রভাবে কথা বলুন।
— ভদ্রতা শেখাবেন না আমাকে। আপনি কত ভদ্রতা জানেন সেটাও দেখছে। এই নিয়ে দুইবার আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আমাকে এভাবে ফলো করছেন।
— আপনাকে ফলো করার কিংবা ভয় দেখানোর কোনো ইচ্ছে ই আমার নেই। আপনি অতিরিক্ত বলে ফেলেন তাই ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখি। এই নিন আপনার হাতের আংটিটা। কাল বোধহয় প্যাকেটের ভিতরে ছিল, ওরা ছুড়ে ফেলায় বাইরে পড়ে গেছে। আমি কুড়িয়ে রেখেছিলাম, পরে দিতে ভুলে গেছি।
পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আপনাকে চোখে পড়ল তাই দিতে এলাম।
আংটিটা কাটারের মাথায় গেথে দিয়ে সেটা আমার পকেটে রেখে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। আমি পিছন থেকে ডেকে বলল, আপনি কে?
— সেটা জেনে আপনি কি করবেন? আর যেন আপনার মুখোমুখি না হই আমি সেটাই চাই। এত গুন্ডি মেয়ে!
— অই হ্যালো কি বললেন! দাড়ান বলছি। ছিচকে চোরব্যাটা।
আমার কথা তোয়াক্কা না করে হেটে চলে গেল।
রাগে ফুসতে লাগলাম। নিজেকে একদম সাধু পুরুষ ভাবতে থাকে, আপনার মুখোমুখি যেন আর না হই! আমি কি বলেছি আমার মুখোমুখি হতে? আলগা পিরিত দেখাতে আমার উপকার করতে আসেন। লাগেনা আমার এসব।
মা এসে আমাকে এভাবে বিড়বিড় করতে দেখে বললেন,
— নিজে নিজে কি বিড়বিড় করছিস? আবার কি ঝামেলা করেছিস!
— কিছু করিনি মা।
–তাহলে এমন বিড়বিড় করছিস কেন?
— তেমন কিছুনা। তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
— হ্যা ঠিক আছে। শোননা, তোর জন্য একটা পাত্রের খোজ পেয়েছি। শুনলাম দেখতে খুব ভালো, অনেক ভালো ফ্যামিলি। বউকে একদম রাজরানী করে রাখবে। আমি তো শুনেই হ্যা করে দিয়েছি। এবার ওরা সময় করে তোকে দেখতে আসবে, পছন্দ হলে সোজা বিয়ে।
— উফফ! মা, তুমি আবার আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছো। রোজ রোজ সঙ সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে আমার ভাল্লাগেনা। বিয়ে হবেনা আমার বুঝলে।
— এসব বলিস কেন? আমার মেয়েটার কোন দিক থেকে কম আছে। দেখিস, এবার তোর বিয়েটা হয়ে যাবেন
— মা প্লীজ বিয়ে নিয়ে কোনো প্যারা দিওনা। আমার বিয়ে-শাদি করার কোনো ইচ্ছে নেই। এমন আছি, ভালোই আছি।
— থাক তুই এমন, যা খুশি কর। পোড়াকপাল আমার, এই কপালে সুখ দেখব না।
বলে মা উঠে চলে গেল।
মায়ের মন খারাপ দেখে আমারো ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার! মাকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি, আর আমার এসব জেনে আমাকে কে ই বা বিয়ে করবে। মন খারাপ করে জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এমনসময় ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছেনা, তাও রিসিভ করলাম। রীতা কল দিয়েছে।
— হ্যালো ওয়াফাহ।
— হ্যা বল।
— কই তুই?
— বাসায় আছি, কেন?
— আয় দীঘির পাড়ে, গল্প করি।
— আমার ভাল্লাগছেনা।
— আমরা সবাই আছি, তুই ও আয়৷ ভাললাগবে।
— আচ্ছা আসছি। বলে ফোন রেখে দিলাম। একবার মায়ের রুমে উকি দিলাম।চুপচাপ সেলাইন মেশিনে আওয়াজ তুলে কাজ করছেন। মনটা সত্যিই খারাপ আমার। একটু ঘুরে আসলে ভালো হবে এই আশায় বেরিয়ে পড়লাম।
দীঘির পাড়ে আসতেই দেখে সবগুলো এক তালে সিগারেট ফুকছে। ওদের পাশে গিয়ে বসলাম।রীতা বলল,
— কিরে, কেমন আছিস?
— ভাল, তুই আজ কোথায় ছিলি?
— অহ, আর বলিস না। আমার দাদীকে নাকি জ্বীনে ধরেছে। তাই দেখতে গেলাম।
— জ্বীনে ধরেছে মানে? এসব কিছু আছে নাকি আবার! বলেই খিকখিক করে হেসে লুটিয়ে পড়ল।
— মজা করিসনা, সত্যি ই জ্বীন আছে।
— আচ্ছা? তোহ জ্বীনবাবুকে বলিস আমার সাথে দেখা করতে।আমি ওকে বিয়ে করব। বলে আবার হাসতে লাগলাম।
— তুই বিশ্বাস করছিসনা, যে দিন সামনে এসে পড়বে সেদিন বুঝবি ঠেলা।
— কিসের ঠেলা আর? আমি বিয়ের জন্য পাত্র পেয়ে যাব আসলে।
— ওয়াফাহ, মজার ব্যাপার নাহ এটা। জ্বীনেরা সত্যিই আছে, মানুষদের নাকি এরা ক্ষতি করে অনেক। আবার ভাল ও করে। তুই আবার হাসছিস, দূর তোকে এসব বলে লাভ নেই।
আমি হাসি থামিয়ে চুপ করে রইলাম। সত্যি যদি তেমন কিছু থাকত, তবে আমি চাইতাম এমন একটা জ্বীন আমার জীবনে আসুক। আমার জীবনটা পালটে দিক। মানুষগুলো কে দেখতে দেখতে ঘৃণা ধরে গেছে। এদের কাছে মনের কোনো মূল্য ই নেই।
দূর! আমিও আবার পাগলের প্রলাপ বকছি। এমন আবার কখনও হয় নাকি? এসব মানুষের মনের কল্পনা মাত্র। কল্পনা করলে আছে, না করলে নেই। এসব ভেবে আকাশ-পাতাল ভাবনা নাই বা ভাবলাম।
.
(চলবে)