জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০৪,৫,৬

0
2304

জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০৪,৫,৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

১২টা অবধি আড্ডা দিলাম দীঘির পাড়ে। মন খারাপ কিছুটা কাটল, সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরলাম। মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরছে, “সত্যিই কি জ্বীন বলতে কিছু আছে?” মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মা ই জানতে পারে, মা তো আবার ধর্ম মেনে চলেন। আমি সবসময় ছন্নছাড়া, এসবে মন নেই। তার মানে এই নয় যে, বিশ্বাস করিনাহ। কিন্তু জ্বীন বা অলৌকিক কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। হাতে গাছের একটা ভাঙা ডাল নিয়ে দুলাতে দুলাতে গান গাইছিলাম আর হাটছিলাম আপন মনে। হঠাৎ দেখলাম এক বৃদ্ধ আমার সামনে আস্তে আস্তে পা ফেলে হাটছেন। অনেকটা লম্বা, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন খানিকটা। যাক পাত্তা দিলামনা, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। জানিনা বাসায় আজ কেমন যুদ্ধ শুরু হবে! দ্রুত পা চালিয়ে বৃদ্ধকে পিছনে ফেলে হাটতে লাগল। উনি যেভাবে আস্তে হেটে চলেছেন, আমি উনাকে সাইড দিয়ে হাটলে বাসায় ফিরতে ঘন্টাখানেক লেগে যাবে।
একটু পিছনে ফেলে আসার পর একটা “আউচ” শব্দ শুনলাম। সাথে অনেকগুলো কাশির আওয়াজ। ফিরে দেখি বৃদ্ধলোকটা মাটিতে পড়ে আছেন পায়ে হাত দিয়ে আর অনবরত কাশছেন। দ্রুত তার কাছে এগিয়ে গেলাম, সম্ভবত পা মচকে গেছে। তাকে সবিনয়ে বললাম, দাদু আপনার কি পা মচকে গেছে?
উনি হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার নূরানী মুখ, মুখভর্তি সাদা দাড়ি। দেখেই কেমন জানি একটা ভক্তি কাজ করছে।উনি আমাকে অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে দাদু?
— আমি এই এলাকার মেয়ে। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম আপনি পড়ে আছেন। তাই এগিয়ে আসলাম। আপনি কে দাদু? এতরাতে কোথায় যাচ্ছেন? পায়ে কি বেশি চোট পেয়েছেন?
— একটু পানি খাওয়াবেন দাদু?
— হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি বরং আমার হাত ধরে উঠে গাছের নিচের বেঞ্চিতে বসুন।আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি।
উনি কেমন জানি ইতস্তত বোধ করলেন আমার হাত ধরতে। আমিই তাকে কাধে ভর দিয়ে উঠিয়ে অদূরে একটা বেঞ্চিতে বসালাম। আশেপাশে তাকালাম, এখানে তো কোনো টিউবওয়েল ই নেই। কিছুটা হেটে এসে দেখলাম পাড়ার দোকানী দোকান বন্ধ করতে ব্যস্ত। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
— কাকু, একটা পানির বোতল দাও।
— এখন তো দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।
— আহা, এখন আবার খুলে আমাকে দাও। বন্ধ করেছো চলে তো যাওনি।
— আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। তুই এত রাতে এখানে কি করিস? যা বাড়িতে যা। আজ এমনিতেও দোকানের হিসাব মিলাতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে। তোর কাকিমা চোটপাট শুরু করবে। যা বাড়ি যা।
আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে, দোকানীর হাত থেকে একটানে চাবিটা কেড়ে নিয়ে দোকান খুলে পানির বোতল নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। উনি অবাক হয়ে বলল,
— এটা কি করলি? চাবিটা তার হাতে দিয়ে বললাম,
— গুন্ডামি। ভালোই ভালোই চাইলাম, দিলানা। আর কোনো উপায় ছিলনা।
যাচ্ছি আমি।
— দাম দিবে কে? তোর বাপ।
রাগে চোখ দুটো জ্বলে উঠল। ফিরে এসে তার কলার চেপে ধরে উরাধুরা কয়েকটা কিল-ঘুষি দিয়ে বললাম, ওই শালা বাপ টানিস কেন? পাড়ার চিপায় ঢুকে যে শ্যামলী খালার সাথে লুচ্চামি করিস অইটা কি তোর বাপে শিখায়। তোর বউরে দেখামু অইসব। শালা কুত্তাহ, তোর টাকা কাল দিয়ে দিব।
সাথে তোর বউকে লুচ্চামিগিরির প্রমাণ দিব। শুয়োর একটা।
মনের ঝাল মিটিয়ে পিটাইতে পারলামনা, বৃদ্ধের কথা মনে পড়ল। নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।
— ভবিষ্যতে ওয়াফাহকে কিছু বলার আগে ভেবে নিবি শালা।
— মাফ করে দে ভুল হয়ে গেছে মা।
— রাখ তোর মাফ, যা ভাগ। কাল তোর টাকা মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে যাব লুইচ্চা।

প্রায় দৌড়ে সেই জায়গাটায় ফিরে এলাম। বৃদ্ধ পায়ে হাত দিয়ে হালকা টিপছেন, এখনো কেশে চলেছেন। কাছে গিয়ে পানির বোতলের ঢাকনা খুলে দিয়ে বললাম,
— নাও দাদু, পানি খেয়ে নাও। কাশিটা কমে যাবে।
লোকটা কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে বোতল নিয়ে পানি খেল। খাওয়া শেষে শুকরিয়া বলে আমার জন্য দোয়া করল। তারপর উঠে দাড়াতে চাইল, কিন্তু পারলনা। আমি দেখে বললাম, দাদু তোমার পা কি মচকে গেছে?
— হ্যাঁ, দাদু। সেটাই মনে হচ্ছে।
— আচ্ছা তুমি বেঞ্চিতে বসো। আমি পাটা টেনে দিচ্ছি, দেখবে ১মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে। পায়ে পরপর টান দিলাম। নাড়াচড়া করে দিলাম।
— দাদু, এখন ঠিক আছে? উনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— হ্যা, দাদু। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, আজ যা করলে তার জন্য আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আমি আসি।
— কোথায় যাবেন আপনি? এই এলাকায় কি নতুন আপনি? আমাকে বলুন কোথায় যাবেন আমি আপনাকে পৌছে দিচ্ছি। এই পা নিয়ে একা একা যেতে পারবেন তো!
— হ্যাঁ, দাদু পারব। আপনাকে এমনিতেও অনেক ব্যস্ত করলাম।
— এসব বলে লজ্জা দিবেননা। চলুন না, আপনাকে পৌছে দেই।
— চলেন দাদু।
হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় যাবেন দাদু?
উনি কিছু বলার আগেই পিছন থেকে কেউ দাদাভাই বলে ডাক দিল।আমরা পিছনে তাকাতেই দেখি সেই চাদর পরা ছেলেটা ছুটে এল।
এসে বৃদ্ধের শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, দাদাভাই তুমি এখানে কেন?
আমার দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার দাদুর সাথে কি করেন? আমি শান্তমুখে বললাম,
— কিছুই না। উনাকে ঠিকানায় পৌছে দিতে যাচ্ছিলাম।
— ধন্যবাদ। দাদাভাই চলো, এই গুন্ডি মেয়ের সাথে আর কথা বলবানা।
— অইই কে গুন্ডি? আমার তো জানা ছিলনা দাদু একজন ছিচকে চোরের দাদাভাই হয়। উনাকে দেখে মনে হয় নি।
— আপনি কিন্তু আপনার ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
— সেটা আপনি আগেই ছাড়িয়ে গেছেন। কেমন মানুষ আপনি? একজন অসুস্থ বৃদ্ধকে এত রাতে একা একা ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়ে কোন বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলেন? অপদার্থ একটা।
— শুনুন আমি কি করব না করব, সেটা আপনার মত গুন্ডির থেকে নাই বা শিখলাম। এত রাতে আপনি বাহিরে কোন চোর পাহারা দিচ্ছেন?
— আমি তো একটা চোরকেই চিনি। সেটা আপনি।
— যান বাড়ি যান। এত রাতে একা মেয়ে ঘুরছেন।
— হুহ, দাদু ভালো থাকবেন। আসি। বলে পা ছুয়ে সালাম করলাম।
দাদু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ঝগড়া দেখছিলেন।
আমাকে চলে আস্তে দেখে ছেলেটাকে বলল, যা না ওকে এগিয়ে দিয়ে আয়। একা একটা অবলা মেয়ে।

ছেলেটা হেসে উঠল। হাসিটা ভীষণ সুন্দর, কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কাছে বান্দরের কিচিরমিচির লাগছে। হাসি থামিয়ে বলল,
— দাদু উনি অবলা নন উনি একটা পাক্কা গুন্ডি। উনি কাউকে ভয় পায়না, উনাকে সবাই ভয় পায়। আশা করি একাই যেতে পারবে। তুমি চলো তো।
ভীষণ রাগে ফুসছি। ব্যাটা দাদু যদি সামনে না থাকত তোরে লবণ মাখিয়ে কাচাই খেতাম। মুখ বেকিয়ে বললাম,
— যান যান, আমি আপনার হেল্প চাইনি। ছিচকে চোরকে আমি নিরাপদ মনে করিনা। দাদু অই ব্যাটাকে বকে দিয়ে বলল,
— এভাবে কথা বলে কেউ? ক্ষমা চাও ওর কাছে। মেয়েটা সত্যি অনেক ভাল।
আমি গর্বে গর্বিত। ব্যাটাকে ভাগে পাওয়া গেছে। মনে মনে হেসে নিলাম।
ব্যাটা সেটা না শুনে বলল,
— দাদাভাই, তুমি চলো তো। আমি পরে বলে নিব। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
— সত্যি তো? ক্ষমা চাইবি তো। উনি মাথা নাড়ালেন।
আমার হাওয়ায় ভরা বেলুন টুস করে ফুটে গেল। ব্যাটা আমাকে পরে কত বলবে জানা আছে। ধোলাই দিতে পারলে শান্তি লাগত।
দাদু আবার আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রস্থান করলেন।
আমি বিরক্তিমুখে আবার হাটতে লাগল। ছেলেটা আবার পিছন থেকে ডেকে বলল, দুঃখিত গুন্ডি। কিছু বলতে যাব তারপর আগেই হাওয়া হয়ে গেল।
ব্যাটা দুঃখিত বলবি তো সুন্দর করে বল আবার গুন্ডি বলার কি দরকার ছিল।
আল্লাহ এর মুখোমুখি আমাকে আর করোনা। দেখলেই কেলাইতে ইচ্ছে করে।

(চলবে)

জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

বাসায় আসতেই মায়ের মুখে বিস্তর হাসি দেখলাম। প্রতিদিনকার মত কোনো বকা-ঝকা নেই। নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। বুঝলাম না কাহিনী কি! সাত রাজার ধন পেল নাকি মা?
মা কি কি সব বলে চলল, আমার তার কথার দিকে একটুও মনোযোগ নেই। আজ বৃদ্ধটার জন্য আমি একটু বেশী করে ফেলেছি। এমনটা আমি কারো জন্য ই করিনা, কিন্তু বৃদ্ধটাকে দেখে মনের মধ্যে কেমন একটা মায়া জাগ্রত হল। নিজের দাদুর কথা মনে পড়ে গেল, দাদুর বয়সী লোকটাকে দেখে হয়ত যা করা উচিত তাই ই করলাম। কিন্তু ভাবতেই পারিনি এমন একটা ভালো মানুষ ওই ছিচকে চোরের দাদু হবে।
ওই ব্যাটার কথা মনে পড়লে মাথা পুরো গরম হয়ে যায়। কথায় কথায় গুন্ডি বলে, আরেহ ব্যাটা আজ যদি গুন্ডামি না করতাম তোর দাদু কেশে কেশে জান্নাতে যেত। ব্যাটা হাড়ে বজ্জাত, আসে আবার ভদ্রতা শিখাতে।
সকালে মা অনেক বড় লিস্ট বানিয়ে বাজারে পাঠালেন, সচরাচর বাজার-সদাই মা ই করেন। আমি গেলে নাকি দোকানীদের সাথে দাম নিয়ে ঝামেলা করি। কিন্তু আজ আমাকেই পাঠিয়ে দিলেন। ওয়ালেটে টাকা নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় লিস্ট? আজ কি বাড়িতে মেহমান আসবে নাকি মা? মা হেসে হেসে বলল,
— হ্যারে মা, তোমার জেঠিমা আসবে।
— বাব্বাহ, তা কেন আসবে এতদিন পর?
— কেন আবার? আসতে পারেনা।
— পারেই তো। ভুড়ি কমে গেলে আবার বাড়ানোর জন্য তো ছুটে আসতেই হবে।
— এসব কি কথাবার্তা! কবে বড়দের সম্মান করতে শিখবি তুই? কম তো বয়স হলোনা তোর। এইবার একটু আদব-কায়দা শিখ।
— এর থেকে আমার গুন্ডামি হাজার গুনে ভাল। আমি বের হচ্ছি।
— দেরী করিসনা, তাড়াতাড়ি ফিরিস। রান্না বসাতে হবে আবার।
— হ্যা বুঝেছি। আসছি।
বাজার করে ফেরার পথে দোকানীর চোখে চোখ পড়ল। বেচারার আমাকে দেখে মুখ শুকিয়ে গেছে, ভালোই টাইট দিয়েছি শালাকে। বউকে বাঘের মত ভয় পায়, অথচ বউয়ের আড়ালে লুইচ্চামির অন্ত নেই। শালার সব পুরুষ ই এক। মুখের উপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বলল, আমার বাপ না আমি দিয়ে গেলাম।
— দরকার ছিলনা তো মা। আমি তো বারণ করেছি তোকে।
— মাইনকা চিপায় গেথে গেলে সবাই একটু আধটু আলগা পিরিত দেখায়। তাই তোমার অই আলগা পিরিতের ধার আমি ধারিনা। ব্যাটা শুয়োর।
বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখি রান্নাঘরের বেড়ার ধারে বসে জেঠিমা খুশিমনে পান চিবুচ্ছে আর এদিক সেদিক পিক ফেলছে। আমি সালাম দিয়ে রান্নাঘরে বাজারগুলো রেখে আবার বাইরে চলে আসলাম। জেঠিমা ডাক দিয়ে বলল,
— কোথায় যাচ্ছিস?
— আরো কিছু কাজ বাকি আছে তো জেঠিমা। অইগুলো সেরে আসতে।
— কোথাও যাওয়া লাগবেনা। এদিকে আয়।
দাতে দাত চেপে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। পানের পিক আমার পায়ের সামনে ফেলে এক আঙ্গুল মুখে পুরে বলল,
— এসব কি পড়েছিস ছেলেদের মত? শার্ট, গেঞ্জি এসব মেয়েরা পড়ে?
— আসলে হয়েছে কি জেঠিমা, বাজারে আজকাল মেয়েদের জামা-কাপড়ের দাম খুব বেশি। তাই সস্তায় ফুটপাতে এইগুলো পেয়েছি, কিনে নিয়েছি। যদি আপনার পছন্দ না হয় আমাকে কিছু ড্রেস কিনে দিতে পারেন। সেগুলোই এইবার থেকে পড়ব। আমার কথা তার পছন্দ হলনা, আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
— সে তো দিব ই। তুই আমার দেবরের একমাত্র মেয়ে, তোকে তো আর ফেলে দিতে পারিনা। মনে মনে হাসলাম, যে জেঠিমা কখনো একটা সুতো কিনে দেয়নি, সে বলছে আমাকে ফেলে দিতে পারেনা।
মাকে ডেকে বলল, সোহানা, আজ আমাদের ওয়াসিফা রান্না করবে। তুই আজ রান্নাঘরে ঢুকিসনা। আমি থ মেরে গেলাম, “বুড়ি বলে কি! আমি রান্না করব!”
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,
— ভাবি, ওয়াফাহ তো রান্না জানেনা। পরে করতে গিয়ে দেখবেন খেতেই পারছেন না। আমিই রান্নাটা করব ভাবি।
— লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েটার কি অবস্থা করেছিস দেখ! এত বড় ঢেঙ্গা মেয়ে হল, তাও বিয়ে হচ্ছেনা। ঘরের কাম-কাজ ও জানেনা। খালি পোলা মানুষের মত জামা কাপড় পড়ে টইটই করে ঘুরতে পারে। তোর কিছু হয়ে গেলে, মেয়েটা কোন চুলোয় যাবে বল তুই।
আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেছি রাগে। কিছু একটা কড়া করে বলতে যাব মা আমাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। চুপ করে রইলাম, জেঠিমা টেনে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। মোড়া টেনে আমার পাশে বসলেন তিনি।
আমি কি রান্না করব, চুলা কিভাবে ধরায় সেটাও তো জানিনা। জেঠিমা সব বলে বলে করালেন, মুরগী কাটতে গিয়ে হাত কেটে রক্ত বের হতে লাগল। উনি দেখে মুখ বেকিয়ে বলল, এমন হাত কত কাটছে আমাদের। এসবে মনোযোগ দিলে চলবেনা। হাত পুড়িয়ে নীরবে চোখ থেকে টপটপ করে পানি ছেড়ে দিলাম।
রান্না শেষে কালিমাখা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালাম। নিজেকে খানিকটা সংসারী মনে হচ্ছে। কিন্তু হাতটা ভীষণ জ্বালা করছে। চোখ বুজে জ্বালা সহ্য করছি নীরবে। টের পেলাম মা হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। চোখ মেলে চাইতেই বুকে টেনে নিয়ে বলল, তোর যখন বড় ঘরে বিয়ে দিব, দেখবি এসব কিছু করতে হবেনা তোকে। রাজরাণী হয়ে থাকবি। আজ বিকালে তোকে দেখতে আসছে, তোর জেঠিমা ই সম্বন্ধটা এনেছে। অনেক বড় ঘরের ছেলে, তোকে ভীষণ সুখে রাখবে। আমি কিছু বললামনা, চুপ করে মায়ের হাসিমুখটা দেখলাম শুধু।
প্রতিবারের মত সঙ সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে এই আর কি! এতেই মা অনেক খুশি হয়ে যান। বিকালে জেঠিমা কালো পাড়ের শাড়ি পরিয়ে দিলেন, কাজল-লিপস্টিক আরো হেন তেন দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। এর আগে কখনো এসব পড়িনি আমি, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। শাড়ি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। মা এসে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, মাশা আল্লাহ। আমার মেয়ের রুপ ফুটেছে। মায়ের কথা শুনে আয়নার দিকে তাকালাম।
সত্যি আজ নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। এমন মনে হচ্ছে, এই এক অন্য ওয়াফাহ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আগের ওয়াফাহকে খোজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃথা।
যথারীতিতে পাত্রপক্ষের সামনে বসলাম। একনজরে পাত্রের দিকে তাকালাম, শকড হয়ে গেলাম। এই তো ছেলে নয়, একটা বয়স্ক ব্যাটা। ইয়া বড় ভুড়ি ব্যাটার, আমার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ওয়াফাহ তুমি কোনটা বেশী ভালো পারো?
— আমি কেলাতে ভীষণ ভাল পারি, একবার যে খায় সারাজন্মেও ভুলে না।
ব্যাটার মুখ কালো হয়ে গেল। পরক্ষণে হেসে বলল,
— কোন রান্নাটা ভালো পারো?
— মুরগীর কলিজার শরবত, গরুর মাংস দিয়ে কচুর লতির হালুয়া।
ব্যাটা শুনে ঢক গিলল। জেঠিমা আমাকে পিছন থেকে গুতা দিল। তারপর লোকটা বলল, আচ্ছা তুমি ভেতরে চলে যাও।
চুপচাপ উঠে চলে এলাম ঠিকি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগলাম। ব্যাটা বলল, ওয়াফাহকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার চার নাম্বার বউ করতে আপত্তি নেই যদি আপনারা রাজি থাকেন।
জেঠিমা খুশী হয়ে বলল, এই তো খুব খুশির কথা। আমরা রাজি।
— তবে আজ উঠি, দিনক্ষণ ঠিক করে আপনাদের জানাব।
মন খারাপ করে রুমে চলে এলাম। দেখি মা অন্যমনস্ক হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, মা, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?? মা চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকাল। জেঠিমা ঘরে ঢুকে বলল,
— রাজি হবেনা কেন? এত বড় ঘরের সম্বন্ধ হাতছাড়া করা যায় নাকি! আর তুই ই বা কোন রাজ্যের রাজকুমারী যে তোর জন্য রাজকুমার আসবে। যা জুটসে তাও তোর জন্য রাজকপাল। মা-মেয়ে মিলে তো বাপটারে খাইসোস, পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডামি করে বেড়াস। এসব জেনে কোন পোলা আইব তোর জন্য।
রেগে গিয়ে বললাম, জেঠিমা, মুখ সামলান আপনার।
মা আমাকে সজোড়ে থাপড় দিলেন। চোখ গরম করে বললেন,
— ভাবি তো ভুল কিছু বলেনি। হয় এই বিয়েটা কর, নাহলে গলায় কলসি বেধে দীঘিতে ঝাপিয়ে মর। তোর কপালে এর চেয়ে ভাল কিছু জুটবে না। এতদিন যা করেছিস, সব মুখ বুজে সহ্য করেছি। আর পারছিনা, এখন মুক্তি দে আমাকে।
আমি থ মেরে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, তারপর ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম।

(চলবে)

জ্বীনবর ৩,পর্বঃ০৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

বাসা থেকে বেরিয়ে ছুটে দীঘির পাড়ে এসে দাড়ালাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে, গুন্ডি হওয়ার পর কখনোই আমি চোখের পানি ফেলিনি। আজ যেন কান্না আটকানোর চেষ্টা বৃথা। হাটু ভেঙ্গে বসে পড়লাম সেখানে, ইচ্ছেমত চিৎকার করে কাদলাম। কাদলে নাকি হালকা লাগে, কিন্তু আমার নিজেকে আরো ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে, জীবনটা এখানে থেমে গেলেই ভালো হবে। মা আমার কাছে মুক্তি চাচ্ছে, মায়ের কাছেও আমি অসহ্য হয়ে গেছি। মাও আমাকে বুঝলনা, আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছি মা এই বিয়েতে রাজি কিনা! মা যদি একবার মুখ ফুটে বলত আমি কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যেতাম। মা আমার কাছে শুধু মুখ ফুটে মুক্তি ই চাইল। এইটুকু দিতে না পারলে আমি তার কিসের মেয়ে হলাম।
ঠিক করলাম মাকে মুক্তি দিব। এক্ষুনি দীঘিতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করব, আমি সাঁতার জানিনা ঠিকিই মরে যাব।
চোখ মুছে উঠে দাড়ালাম, আস্তে আস্তে দীঘির পাড় থেকে সিড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে নেমে যাচ্ছি। দেখতে দেখতে আমি কোমড়সমান পানিতে নেমে গেলাম, যেই এখন ঝাপ দিব কেউ আমাকে হেচকা টান দিয়ে উপরে তুলে নিল। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু এত শক্ত করে হাত টা ধরে রেখেছে যে হাত অবশ হয়ে আছে। কি ঠান্ডা স্পর্শ! শরীর কেপে উঠল মূহুর্তে। আবছা অন্ধকারে তার মুখপানে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সে কে। কিন্তু ঠাহর করতে পারলামনা। সে মুখ খুলে বলল,
— আত্মহত্যা করা মহাপাপ জানেন না? যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাচার সংগ্রাম করে যায়৷, সেখানে আপনি নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছেন। আল্লাহর প্রদত্ত জিনিসের এভাবে অবহেলা করতে নেই। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত রেখে আল্লাহর কাছে বিপদ কাটানোর জন্য প্রার্থনা করতে হয়।
কন্ঠ শুনে বুঝলাম উনি সেই চোর উপাধি পাওয়া ব্যক্তি। তাও আমি চুপ করে তার সব কথা শুনছি, কিছু বলতে ইচ্ছে করলনা। হঠাৎ অবিবেচকের মত কাজ করে বসলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি লম্বা হওয়ায় আমার মাথাটা কেবল তার বুক অব্ধিই স্পর্শ করল। জড়িয়ে ধরে সশব্দে মন খুলে কান্না করলাম। উনি কিছুক্ষণ চুপটি করে ছিলেন আমাকে কোনোপ্রকার বাধা দিলেননা। বরং কাপা কাপা হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েও দিলেন না। শান্তস্বরে বললেন,
— শান্ত হোন, এভাবে ভেঙ্গে পড়বেননা। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। এই কথা শোনার পর আমার হুশ ফিরল, ইস! আমি এতক্ষণ কি করছিলাম। এভাবে একটা পরপুরুষের বুকে মাথা রেখে কাদছিলাম। কিন্তু নিজের মধ্যে অনুভব করলাম অনেকটা হালকা লাগছে নিজেকে। কষ্ট টা অনেকটা কমে গেছে মনে হচ্ছে, তার বুকের মধ্যে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ এক তৃপ্ত প্রশান্তি আর স্বস্তি আমাকে ঘিরে রেখেছিল। অনুভূতি যেন এমন, আমার সবচেয়ে সুখের আর নিরাপদ জায়গা তার প্রশস্ত বুক।
হঠাৎ দীঘির দিকে কারা যেন টর্চের আলো ছুড়ছিল, উনি সেটা লক্ষ করে আমাকে বিদায় জানিয়ে মূহুর্তে প্রস্থান করলেন। বুঝলামনা উনি কেন এভাবে চলে গেলেন কাউকে আসতে দেখে।
আস্তে আস্তে তার প্রতিমূর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আমি একদৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে বড্ড শূন্য মনে হচ্ছে। এমনসময় টর্চের আলো ফেলে রীতা আর মীনা এগিয়ে এল আমার দিকে। রীতা আমাকে আধভেজা দেখে বলল,
— তুই সত্যিই মরতে যাচ্ছিলি?
আমি নিরুত্তর রইলাম। রীতা আমার নীরবতা দেখে বলল,
— জানিস খালাম্মা পাগলপ্রায় হয়ে গেছে তোর হুট করে উধাও হওয়ার কথা জেনে। ফোন করে আমাদের তোর খোজ করতে বলল, মরতে যাচ্ছিস একবারো ভাবলিনা তুই মরলে খালাম্মার কি হবে? বাচ্চামি কেন করিস বল তো।
শোন, ওয়াফাহ ভাগ্য কে মেনে নে। তোর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। শত চেষ্টা করেও সেটা খন্ডাতে পারবিনা। আর কোনো পাগলামী করিসনা, খালাম্মা কত খুশি তোর বিয়ে নিয়ে। এইটুকু খুশি কি তুই উনাকে দিতে পারিস না? তোকে খালাম্মা সেই ছোট থেকে একা একা এত কষ্ট করে বড় করেছে।
আর আজ তুই তার কথা চিন্তা না করে এত কষ্ট করে বড় করা সত্ত্বা কে শেষ করে দিচ্ছিস। মীনা রীতার সাথে তাল মিলিয়ে শুকনো গলায় বলল,
— রীতা কিছু ভুল বলেনি ওয়াফাহ। তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যা, আর কষ্ট দিসনা খালাম্মাকে।

আমি হাটতে হাটতে চুপচাপ ওদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু মাথায় শুধু একটা কথা ই গেথে আছে, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।” সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ভাগ্যকে মেনে নিব। দেখি আল্লাহ আমার ভাগ্যে আর কত পরিমাণ দুঃখ লিখে রেখেন। বাসায় ঢুকামাত্র মা এসে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন, আমি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
— মা তুমি যা চাও, তাই হবে। আমি এই বিয়ে করতে রাজি।
মা হকচকিয়ে উঠে চোখ মুছে আমার মুখ দুহাতে স্পর্শ করে বললেন,
— তুই সত্যিই রাজি?
— হ্যাঁ মা।
— ভাবী দেখেছো, আমার মেয়ে রাজরাণী হতে রাজি। রাজার ঘরে যাওয়ার জন্য রাজি। বলেছিলাম না, আমার মেয়ে আমার কথা ফেলবেনা। আমি আমার ওয়াফাহ কে সুশিক্ষা দিয়েছি।
আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। সেই কখন থেকে আধভেজা শাড়ি পরে আছি, ড্রায়ার থেকে একটা সেলোয়ার-কামিজ নামিয়ে নিলাম। অনেকদিন পর এগুলো পরার জন্য নামিয়েছি। মা কত বলত পড়ার জন, শখ করে দু-একটা সেলাই করে রাখত। কিন্তু তার ঠাই হত ড্রায়ারের এক কোণে অযত্নে। আজ কেন জানি পড়তে ইচ্ছে করছে।শাড়ি খুলতে গিয়ে টের পেলাম আমার শরীরে ভীষণ মনকাড়া সুন্দর একটা সুভাস। যেটা ওই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরার সময় পেয়েছিলাম। তবে কি তার শরীরের গন্ধ এখন আমার শরীরে লেপ্টে গেছে! ভীষণ ভালো লাগছে সুভাসটা। এতক্ষণ যে শুন্যতা আমার মধ্যে বিরাজ করছিল এখন যেন তা পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। খুব সাবধানে শাড়িটা খুললাম, যাতে সুভাসটা আমার শরীর থেকে হারিয়ে না যায়। খাটে চিত হয়ে শুয়ে জানালার দিকে মুখ করে ভাবছিলাম,
“আজ কেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে এমন একটা অবিবেচকের মত কাজ করে বসলাম, তাও একটা ছিচকে চোরের সাথে। লজ্জায় মরে যাচ্ছি এখন।”

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখলাম কিছু মহিলা আমাদের বাড়ীতে ভীড় করে আছেন। উঠোনে মাটি কেটে ইট দিয়ে চুলো বানানো হয়েছে, তাতে বড় বড় ডেকচিতে পোলাও, মুরগী রান্না হচ্ছে। কয়েকটা লোক বাশ-কাপড় দিয়ে ছোটখাট স্টেজ বানাতে ব্যস্ত। কিছু বুঝতে না পেরে মাকে খুজতে লাগলাম এই ঘর, ও ঘর। সবখানেই পাড়ার মহিলা আর কিছু অপরিচিত মহিলার ভীড়। কিছুক্ষণ খোজার পর মাকে দেখলাম জেঠিমা আর কিছু মহিলার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।
মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই রীতা হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে আসল।
আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম,
— এসব কি হচ্ছে রীতা?
— তোর বিয়ের আয়োজন। আজ দুপুরেই তোর বিয়ে হবে।
— কি বলছিস? কোনো আগাম খবর না দিয়েই বিয়ে।
— তোর জেঠিমা আর মা মিলেই ঠিক করেছে। তুই কাল হ্যা বলেছিস তাই তারা আর দেরী করতে চায়নি। খালাম্মার ভয় তোর যদি আবার মত বদলে যায়, তাই সকাল না হতেই তোর বিয়ের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছেন।
আমি চুপ করে রইলাম। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম, “নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য ই করেন।”
রীতা আমাকে জড়িয়ে কেদে ফেলল। খানিকটা কেদে বলল,
— তুই আমাদেরকে ভুলে যাবি না তো ওয়াফাহ? এর উত্তর আমার সত্যিই জানা নেই, কারণ আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আমি তাও রীতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— আমি যেখানেই থাকি, তোদের কখনোই ভুলবনা।
এমনসময় অপরিচিত মহিলাগুলো আমাকে টেনে নিয়ে হলুদ মাখানো আর মেহেন্দী পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাজিয়ে-গুজিয়ে নিতে নিতে বাহির থেকে শুনলাম, বর এসে গেছে। সবাই আমাকে রেখে বাহিরে চলে গেল।
আয়নার দিকে একনজর তাকাল। বেশ লাগছে আজকের ওয়াফাহকে বউবেশে। লাল শাড়ি, হালকা মেক-আপ, গাঢ় লিপস্টিক আর ভারী গয়নায় নিজের নিজে বধু নয় জোকার মনে হচ্ছে। যাকে নিয়ে কিছুক্ষণ পর সারাজীবনের জন্য শোতে খেলা দেখানো হবে।

রীতা আর মীনা এসে বাহিরে স্টেজে নিয়ে বসাল আমাকে। আমি জীবন্ত লাশের মত চুপচাপ সব করে যাচ্ছি, সবটা আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিলাম। কিচ্ছুক্ষণ পর ই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। এমনসময় হট্টগোল লেগে গেল, বয়স্ক ব্যাটা বেকে বসল আমাকে বিয়ে করবেনা। মা রীতিমত কান্না শুরু করলেন, বারবার শুধু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন “কেন, বিয়ে করতে চাইছে না আমাকে?”
এমন সময় রাফি আর তার চেলাগুলো মায়ের সামনে এসে ফোনে একটা কিছু দেখিয়ে বলল, “আপনার মেয়ে যে নষ্টা, চরিত্রহীনা তাই। বিয়ের আগে রাতবিরাতে পরপুরুষের সাথে ঘেষাঘেষি করে দীঘির পাড়ে। মুখে বললে তো বিশ্বাস করবেন না তাই একদম ফকফকা ছবি তুলে এনেছি। ওয়াফাহর নাগরকে চিনিনি ঠিকিই কিন্তু ছেলে টা আমাদের এলাকার কেউ নয়। আপনার মেয়ে বাহিরে থেকে পরপুরুষ এনে এসব করে পাড়ার বদনাম করে।
এতদিন তো জানতাম আপনার মেয়ে গুন্ডি, এখন জানলাম সে শুধু গুন্ডি নয় একটা বেশ্যা ও বটে।”
আমার প্রচুর রাগ হচ্ছে, এরা আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগাচ্ছে। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বয়স্ক লোকটা মাকে বলল,
— আপনার চরিত্রহীনা মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবনা। এই সবাই চলো। বড়বউ ওই মেয়ের গা থেকে আমার দেওয়া সব গয়না খুলে আনো।
মা তার সামনে হাত জোর করে বলল,
— আমার মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করবেন না। এই বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে ওর আর সহজে বিয়ে হবেনা। বদনাম রটে যাবে আমার মেয়ের। বিশ্বাস করুন, আমার মেয়ে এসব কাজ করতে পারেনা।
লোকটা মাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেলেন। আমি রাগে ফুলে উঠে দাড়ালাম গায়ের সব গয়না খুলে লোকটার গায়ে ছুড়ে মারলাম। রান্নাঘর থেকে দা বের করে তাকে দেখিয়ে বলল, শালা শুয়োর এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হ।নাহলে একটা কোপ ও মাটিতে পড়বেনা।

সবগুলাও হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। রাফির গলা বরাবর দা ধরে বললাম,
— তোদের লজ্জা করেনি আমার নামে মিথ্যা বদনাম রটাতে! আজ তোকে খুন ই করে ফেলব আমি। মা এসে আমার গাল বরাবর পরপর দু-তিনটে থাপড় দিয়ে বলল,
— তোকে এখন বিয়ে করবে কে পোড়াকপালী? গুন্ডামি দেখাস তাইনা, ছবিতে তো ভুল কিছু নেই। তুই সত্যিই একটা পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছিস্ম এতটা নিচে নেমে গেছিস তুই। এতটা খারাপ আমার মেয়ে আমি ভাবতে পারছিনা। অভাগী তোকে এবার বিয়ে করবে কে?
আমি দা ফেলে দিয়ে চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে কাদতে লাগলাম। ভীড় সরিয়ে সেই দোকানী যাকে পানির বোতলের কাহিনী নিয়ে কেলিয়েছিলাম মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— আমি করব ওয়াফাহকে বিয়ে, সব জেনেশুনে স্বেচ্ছায়।
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here