জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০১

0
3817

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজের যত্নে লাগানো গাছের ফুলগুলো দেখছিলাম। পড়ন্ত বিকালে র রোদে কত সুন্দর দেখাচ্ছে তাদের! আল্লাহর সৃষ্টি কতই না অপরুপ সুন্দর। সাত-পাঁচ ভেবে উদাসীন হতেই নিচের ঘর থেকে দাদীমার ডাক এল।
“মুসকান, ও মুসকান। কই গেলি আপু?”
কানে আসতেই দেরী না করে নিচের ঘরে চলে গেলাম। এসে দেখি দাদীমা অনবরত কাশছে। তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পানি নিয়ে এসে তার হাতে দিলাম। দাদীমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
— এখন একটু ভালোলাগছে দাদী?
দাদীমা একটু মুচকি হেসে কপালে একটা চুমু একে দিল। তারপর বলল,
— লক্ষী আপু আমার। তোর টিউশনিতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছেনা?
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ। আচ্ছা আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
দাদীমা আমার হাত চেপে বলল, কিছু খেয়ে যাবিনা? আসতে আসতে সেই সন্ধ্যে গড়াবে। চুপ থেকে বললাম,
— ওখানে নাস্তা দেয় দাদী। সেটা খাই তো।
দাদীমা হয়ত কিছু আচ করতে পেরেছে। উঠে গিয়ে তার মাটির ব্যাংক খুচিয়ে খুচিয়ে ২০টাকা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, তাও কিছু খেয়ে নিস।
আমি মাথা নিচু করে টাকাটা নিলাম। এই অবধি আমার জন্য দাদীমার শখের ব্যাংক থেকে যে কত টাকা খুচিয়ে বের করতে হয়েছে তার হিসেব হয়ত তার নিজেরও জানা নেই। না ও করতে পারিনা, করলেই ওমনি পাজি বুড়ো কেদে দেয়।
বোরকাটা গায়ে জড়িয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ডেকে নিতেই কাকি এসে হাজির।
— কই যাওয়া হচ্ছে মহারাণীর?
— টিউশনিতে।
— কাজ ফাকি দেওয়ার জন্য তো প্রতিদিন ই যাওয়া হয় জানি। ঢেং ঢেং করে যে বের হচ্ছিস, দুপুরের এটো বাসনপত্র ধুয়েছিস? উঠোন কুড়িয়ে মুরগীগুলোকে খাইয়েছিস?
— সব করেছি। ভুলে যাইনি কিছু। এখন আমি আসি?
কাকি আর কিছু বললনা, মুখ ভেঙ্গচিয়ে নিজের কাজে চলে গেল।
রোজকার অপমান, হাজারো খোটা-ভেঙ্গচি এখন গায়ে সয়ে গেছে। অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে থাকলে যা হয়!
বাড়ি থেকে ২০মিনিটের দূরত্বে ৩টে টিউশনি করাই। তার টাকায় আমার হাতখরচ আর দাদীমার টুকটাক ওষুধপত্র হয়ে যায়। দাদাভাই যতদিন বেচে ছিলেন এত চিন্তা করতে হয়নি, হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করিয়েছেন।
তখন নিজেকে সংসারের বোঝা মনে হতনা, পরিবারের একজন ই ভাবতাম।
কিছুমাস আগে দাদাভাই গত হয়েছেন, তখন থেকেই কাকির কাছে আমি একপ্রকার বোঝা। মা-বাপ মরা মেয়ের একমাত্র সহায় এই দাদীমা ই।
সারাদিন গাধার মত খেটেও কাকির মন পাইনা, দাদীমাও আমার জন্য কম কথা শুনেননা।

আজও ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেছে। সন্ধ্যে গড়িয়ে যাচ্ছে, ছাত্রদের পরীক্ষা এলে তাদের থেকে বেশী প্যারায় আমি ই থাকি। ছোট ফোনটার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে একা একা হাটছি। পুরো রাস্তাটা এখন নির্জন, লোকবল নেই বললেই চলে। হালকা ভয় ভয় করতে লাগল। ব্যাগ থেকে কেনা বিস্কুটগুলো বের করে খেতে আরম্ভ করলাম যাতে মনোযোগ অন্যদিকে থাকে আর ভয় না পাই।
এমন সময় কে যেন আমার পাশে এত জোরে দৌড় দিল, তার সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার ফোন,ব্যাগ- শেষ সম্বল বিস্কুট ও মাটিতে চিৎপাত। মূহুর্তে চিন্তা করলাম এত জোরে দৌড়াচ্ছে যেহেতু এটা চোর ই হবে। এইবার চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে লাগলাম, চোর! চোর!
একটুপর চোর ব্যক্তিটি ফিরে এসে বললাম, ষাড়ের মত চোর চোর করে চেচাচ্ছেন কেন? চোর কোথায় পেলেন আপনি?
— এত জোরে দৌড়াচ্ছেন, চোর না বলে কি বলব? দেখুন আমার সব ফেলে দিয়েছেন। ব্যক্তিটি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মাটি থেকে ফোন আর ব্যাগ উঠিয়ে আমার হাতে দিল। আমি বিস্কুটগুলোর দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেললাম।
ফোনের ফ্ল্যাশ তার দিকে দিয়ে দেখে নিলাম তাকে। ২০-২১ বয়সী একটা সুন্দর ছেলে। মুখটা একদম লাল টমেটো হয়ে গেছে। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। বললাম, দিলেন তো আমার বিস্কুটগুলো ফেলে। ব্যাটা চোর কোথাকার!!
কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে ছেলেটি বলল, ভদ্রতা জানেন না নাকি! চোখে এভাবে আলো ফেলছেন কেন? আমি তো ইচ্ছে করে ফেলিনি। আমি দুঃখিত এর জন্য।
— আপনার দুঃখিত দিয়ে আমি কি করব?
আমার বিস্কুটগুলা!??
ছেলেটা আমার কাদো কাদো মুখ দেখে অট্টহাসি হাসতে লাগল।
— আপনাকে কি এখন বিস্কুট কিনে দিতে হবে?
— লাগবেনা। ব্যাটা চোর কোথাকার।
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা দ্রুত হেটে চলে এলাম ওখান থেকে।
এটুকু বুঝতে পেরেছি যে ছেলেটা ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাকে আচ্ছামত বকাঝকা করেছে। করুকগে তাতে আমার কি!
ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে দাদীমা উঠোনে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসামাত্র জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, এত দেরী করলি কেন? জানিস না এই বুড়িটার টেনশান হয়??
আমি মুচকি হেসে বললাম, বুড়ো হয়েছো কিন্তু টেনশান করার রোগ টা গেলনা।
কাকী বাহিরে এসে বলল, এত দেরী দেখে আমি তো ভাবলাম কোন ছেলের সাথে পালিয়ে টালিয়ে গিয়েছিস? দাদীমা কিছু বলতে চাইলে বাধা দিলাম।
মুচকি হেসে বললাম, কোনো কাজ পড়ে আছে কাকী??
— কাজের কি শেষ আছে নাকি? সারাদিন আমি খেটে মরি কি সাধে!
রান্নাঘরে তোর জন্য পান্তা রাখা আছে, খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।
দাদীমা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আজ ভালমন্দ রান্না হলেও আমাকে পান্তা খেতে হবে এটা জানা কথা। নিশ্চয়ই দাদীমাকেও আজ দুধভাত দিয়েছি তাই আমার জন্য লুকিয়ে কিছুটা রাখার অবকাশ পাননি। নিজে খাবেনা, আমার জন্য লুকিয়ে রেখে দিবে।
ধরা পড়লে দাদীমার ভালমন্দ খাবার বন্ধ করতে দেরী করবেনা কাকী।

শরীর টলছিলনা এতটা খাটনীর পর। ক্ষুধা ও বেশি লেগেছে তাই অল্প পান্তায় পেট ভরেনি। এই জন্য ঘুম ও আসছেনা। উঠে একটু পায়চারী করার জন্য ছাদে গেলাম।
খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে, হালকা বাতাস ও আছে। রেলিং এর পাশে বসে একদৃষ্টিতে চাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
খুব বোরিং হয়ে গেছে জীবনটা, মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দাদীমার মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা কে মাটিচাপা দেই। কিন্তু যেদিন দাদীমা থাকবেনা সেদিন আমার কি হবে? কে পাশে থাকবে আমার?
ভেবেই কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল ছাদবাগানের গাছ গুলো সশব্দে নড়ে উঠল। মনে হল খুব জোরে কেউ কিছু ছুড়ে মেরেছে। আতকে উঠে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, কে ওখানে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here