জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০২,০৩

0
2421

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০২,০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

ছাদবাগানের ক্যাকটাসের ঝোপের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। ভয় ও লাগছিল যেহেতু হাতে লাইট নেই, বারান্দায় জ্বালানো বাতির আবছা আলো এসে পড়েছে এদিকে। ঝোপের কাছে যেতেই দেখলাম একজোড়া জ্বলজ্বল করা সবুজ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। তখনি বিড়ালটা মিও করে ডেকে উঠল। একটু আশস্ত হলেও ভাবনায় পড়লাম। এত রাতে কার বিড়াল এই উচু ছাদে লাফিয়ে পড়ল!! পায়ে তরল কিছু স্পর্শ লাগতেই সরে দাড়ালাম। ভালো করে দেখলাম কালো বিড়ালটার পা থেকে রক্ত ঝড়ছে। হয়ত ক্যাকটাসের কাটা পায়ে ফুটেছে। দেখে খারাপ লাগল অনেক। অবুঝ প্রাণীটার বেশ কষ্ট হচ্ছে। প্রাণীপ্রেমি হলেও কালো বিড়াল ধরতে আমার একটু অস্বস্তি হয়, তাও একে টেনে কোলে নিলাম। ভয় ছিল আচড় কাটবে নাকি, সে তেমন কিছু করলনা। ব্যথা কোকড়ে আমার কোলে শক্ত হয়ে বসে রইল।
ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে আসলাম। কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে ফার্স্ট এইড বক্স এনে কাটা তুলে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার এর মধ্যে সে একবারো ডাক দেয়নি, অপলক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কালো হলেও চোখ দুটো বেশ মায়াবী তার। আমি তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— ব্যথা করছে? সে চুপচাপ চোখ বুজে আমার হাতের স্পর্শের আরাম নিচ্ছিল।
উদাসমনে তার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলাম,
— এই অসুস্থ অবস্থায় তোকে রাখতে চাইলেও আমার রাখার সাধ্য নেই। কাকী কোনো প্রাণী পোষা পছন্দ করেনা। সকাল হলেই তোকে বাহিরে ছেড়ে আসব। ভুল করেও কখনো এই বাড়ীতে আসিস না। কাকা দেখলে পা ভেঙ্গে দিবে নতুবা মেরে ফেলে দিয়ে আসবে।
বিড়ালটা আমার দিকে তাকিয়ে একবার মিও ডাক দিল। আমি খাটের নিচ থেকে একটা ছোট্ট চৌকি বের করে ওকে শুইয়ে দিয়ে খাটের কোণায় রেখে শুয়ে পড়লাম।
সকালে কাকীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। ও ঘর থেকে চেচাতে চেচাতে আমার ঘরের দিকে আসছে, কিরে মহারাণী। এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি আপনার?? সারারাত কি চুরি করলি না চোর পাহাড়া দিলি?
ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম। কাকী এদিকে আসছে তাহলে তো বিড়ালটা দেখে ফেলবে। বাসায় বিড়াল ঢুকানোর শাস্তিস্বরুপ আমার আজ সারাদিন ভাত না জুটলেও আফসোস নেই, কিন্তু নিরীহ জীবটা রেহাই পাবেনা। ভেবেই খাট থেকে নামতেই কাকী এসে ঘরে ঢুকল। আমার চুলের মুঠি ধরে বলল, এত করে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিসনা।
আমি ব্যথা পেয়ে বললাম, কাকী, ব্যথা পাচ্ছি। রাতে ঘুম আসতে দেরী হওয়ায় উঠতে দেরী হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি সব কাজ করে দিচ্ছি।
কাকী রাগান্বিতস্বরে বলল, দেরী হল কেন? নাগর জুটাইলি নাকি? ঘাড়ের উপর বসে… হঠাৎ চুপ মেরে আমার চুলের মুঠি ছেড়ে খাটের কোণার দিকে গেল। আমার দুশ্চিন্তা এবার সীমা ছাড়িয়ে গেল, এবার নিশ্চয়ই কাকী বিড়ালটা দেখে ফেলবে।
আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, চৌকিটা এখানে কেন? এটা তো খাটের নিচে ছিল।
উকি মেরে দেখি চৌকিতে বিড়ালটা নেই। মস্তবড় হাফ ছেড়ে বাচলাম। আমতা আমতা করে বললাম, ময়লা হয়ে গেছে তাই ধোয়ার জন্য বের করলাম।
— তাড়াতাড়ি এসে কাজগুলো শেষ কর। আমি যাচ্ছি। বলে কাকী বেরিয়ে গেল।
পুরো রুম ঘুরেও বিড়ালটাকে দেখলামনা। নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিলাম।

দাদীমার ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। কাল ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ছিলাম। তার রেশ এখনো কাটেনি। ওষুধ ও ফুরিয়ে গেছে, ওষুধ ঠিকমত না খেলে আবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় উনার। কাকাকে একবার বলে দেখি যদি কিছু টাকা দেয় ওষুধ নিয়ে আসব।বিকালে কাকাকে বলতেই উনার সোজা উত্তর দিলেন,
— আধমরা বুড়ির জন্য আর এক টাকা ও খরচ করতে পারবনা। টাকা কি গাছে ধরে নাকি? আর তুই তো কিসব করে বেড়াস, টাকা যায় কই?
— কাকা, মাস তো শেষ হয়নি। তাই টিউওশনির টাকা এখন পাবনা।
যা ছিল কিছুদিন আগে দাদীকে ডাক্তার দেখানোর পিছনে শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমায় ৫০০টাকা ধার দাও। কথা দিচ্ছি, টাকা হাতে পেলে তোমায় দিয়ে দিব।
— যা ভাগ তো, এখন আমার কাছে এক পয়সা ও নেই।
মন খারাপ করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম এমনসময় কাকার ছেলে ১১বছর বয়সী মুজাম্মেল ঢুকে তার নতুন জামা কিনে দেওয়ার বায়না ধরল। কাকাও এখনি কিনে দিবে বলে বেরিয়ে গেল তার সাথে।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিউশনির জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতেই ভীষণ বাতাস শুরু হল। অদ্ভুত লাগল এতক্ষণ কড়কড়ে রোদ ছিল, হঠাৎ এত ঝড়ো বাতাস কোথা এল? ধুলো সব চোখে ঢুকছে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা।
টাল সামলাতে না পেরে চোখ হাত দিয়ে ঢেকে পিছু নামছি। ভুলেই গেছিলাম উচু রাস্তার কিনারায় বিরাট জঙ্গলে পানিভর্তি গভীর খাদ। পিছু নামতেই নুড়িপাথরের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ভয় পেয়ে গেলাম, আমি তো এখন সোজা গভীর খাদে পড়ে যাব। যে নির্জন রাস্তা কেউ আসতে আসতে আমার লাশ ভেসে উঠবে।
হঠাৎ একটা ঠান্ডা বলিষ্ঠ হাত আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল, পড়তে গিয়ে পড়লাম না। চোখে ধুলো যাওয়ায় পুরোপুরি চোখ খুলতে পারছিলামনা। হালকা মেলে দেখলাম কালকের ছেলেটা আমার হাত ধরে আছে। চোখ জ্বলছে তাই আবার হাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম, আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? ছাড়ুন বলছি।
এত সাহস কেন আপনার? অচেনা একটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন?
ছেলেটা শান্তকন্ঠে বলল, ছেড়ে দিব?
— তো কি ধরে রাখবেন? ছাড়ুন বলছি।
উনি আলগা ভাবে ছাড়তেই পড়ে যাওয়ার অবস্থা হল। বুঝলাম যে উনি এখন হাত ছাড়লেই আমি সোজা গিয়ে খাদে পড়ব। উনি আবার শক্ত করে ধরে বলল, পুরোপুরি ছেড়ে দিব?
— নাহ, নাহ। আমাকে উঠান প্লীজ।
উনি আরেকটু টেনে রাস্তার নিরাপদ কিনারায় নিয়ে আসল। আমি হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে চোখ ডলতে লাগলাম। এখনো জ্বলছে আর খচখচ করছে।
উনি বলল, আপনি ঠিক আছেন তো? চোখে কি হয়েছে আপনার?
— ঝড়ো বাতাসে চোখে ধুলো ঢুকে গেছে তাকাতে পারছিনা। খচখচ করছে অনেক।
বিনয়ীকন্ঠে বলল, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
— লাগবেনা। আপনি কি করবেন এতে?
উনি শুনে বলল, চোখের ধুলো ঝেড়ে দেই?
— লাগবেনা, আপনি আর আমাকে স্পর্শ করবেননা।
— আচ্ছা করবনা।
— ঠিক আছে তাহলে।
উনি পকেট থেকে একখানা শুভ্র রুমাল বের করে পুটলির মত করে বেধে মুখের কাছে ঘন ঘন জোরে ফু দিতে লাগলেন। আমার চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল তাই আবার বন্ধ করে ফেললাম। উনি রুমাল টা চোখের উপর দিতে অনেকটা আরাম লাগল, কয়েকবার করতেই জ্বালাটা কমল। কিন্তু খচখচানি রয়ে গেল।
উনি আমাকে বলল, চোখ বড় বড় করে তাকান আমার দিকে।
— কেন হ্যা? আপনাকে বড় বড় করে দেখার কি আছে?
— উফফফ! এত বকেন কিভাবে? তাকাতে বলছি তাকান। ধমক শুনে বড় বড় করে তাকালাম। উনি কিসব বিড়বিড় করে চোখে কয়েকবার ফু দিয়ে দিলেন। রুমালটা হাতে দিয়ে বললেন, চোখের পানি মুছে নিন।
— ধন্যবাদ আপনাকে।
— জাযাকাল্লাহ।
চোর ব্যাটা এত হুজুর হল কেমনে সেটা ভাবছি! এখন নিশ্চয়ই ভাব জমাতে চাইবে, ছেলেদের তো স্বভাব ই এটা। উনি বলল, আপনি একা যেতে পারবেন?
মনে মনে এটাই সন্দেহ করছিলাম। কড়া করে বলে দিলাম,
— শুনুন, আপনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। এর চেয়ে বেশি মহৎ সাজতে আসবেননা। আর একটা কথা, আমার সাথে মোটেও ভাব জমাতে আসবেন না। দূরে থাকুন। ব্যাটা চোর!
— আপনি সবসময় এত ঝগড়া করেন কেন? আমাকে দেখে মনে হয় আমি চোর!
— জ্বি তেমনি লাগে।
আরো কিছু বলতে যাব দেখি রাস্তা দিয়ে কিছু মানুষ আসছে। এভাবে দাঁড়িয়ে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে খারাপ ভাববে। তাই চুপচাপ সামনে তাকিয়ে হাটা শুরু করলাম, একবারো পিছু ফিরলামনা।
পিছন থেকে শুনলাম উনি বলছেন, অদ্ভুত মেয়ে।

ছাত্রীকে পড়াতে গিয়ে খেয়াল করলাম তার রুমালটা নিয়ে চলে আসলাম। ফেলে দিব ভাবলাম কিন্তু অন্যের জিনিস ফেরত না দিয়ে ফেলে দেওয়াটা বিবেকে বাধলাম। আসার সময় খুজলাম কিন্তু তাকে পাইনি। কিন্তু সবসময় মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, আমার উপর সারাক্ষণ নজর রাখছে। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল।
সন্ধ্যেবেলা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে পড়ল আমার জানালার সামনে একটা কালো প্রতিবিম্ব। ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ায় সেটা নিশ্চুপে সরে গেল। লাইট দিয়ে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে কিছুই দেখতে পেলামনা।
জানালা বন্ধ করার মূহুর্তে বিড়ালের ডাক শুনলাম। জানালা খুলে আবার উকি মারতেই সে এক লাফে আমার রুমে ঢুকে পড়ল। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— কই গিয়েছিলি সকালে? এই পা নিয়ে এখনো লাফালাফি করছিস!
সে মিউ মিউ করতে করতে আমার পায়ে গা ঘেষতে লাগল।
আমি কোলে তুলে বললাম, এখানে আর আসিসনা বুঝলি। বেঘোরে মারা পড়বি।
সে চুপটি মেরে আমার কোলে বসে রইল। হঠাৎ কি বুঝে খাটের উপর লাফ দিল আর ওই রুমালটা নিয়ে ইচ্ছেমত পিষাপিষি শুরু করল।
তাড়াতাড়ি উঠে ওর থেকে রুমাল টা কেড়ে নিলাম। রুমালটা কেড়ে নেওয়ায় সে অনবরত মিউ মিউ ডেকে যাচ্ছে। আমি তাকে কোলে করে জানালার বাহিরে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলাম। রুমালটার দিকে তাকিয়ে দেখি ময়লা লেগে আছে। কি থেকে কি হল বুঝলামনা। অন্যের আমানত এভাবে খেয়ানত হতে দেওয়া চরম অপরাধ হবে।
তাই তাড়াতাড়ি এটা ধুতে নিয়ে গেলাম। রুমালটায় খুব মিষ্টি একটা আতরের ঘ্রাণ, ভীষণ মাতাল করা। ভেবেছি ধুয়ে ফেললে হয়ত চলে যাবে, কিন্তু রয়েই গেল। ভালোই লাগছিল ঘ্রাণটা। শুকার সময় খেয়াল করলাম রুমালের এককোণায় আরবিতে ছোট করে কি যেন লেখা আছে। আমি তো পুরোপুরি আরবি পরতে জানিনা, তাই আর পাত্তা দিলামনা। গুছিয়ে ব্যাগে রেখে দিলাম যাতে দেখা হলে চোর টাকে ফেরত দিয়ে দিতে পারি।
.
(চলবে)

জ্বীনবর ৪
পর্বঃ০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

দাদীমার ওষুধ আনার জন্য বাজারে গেলাম। কিন্তু যে ফার্মেসী থেকে নিতাম, সেখানে ওষুধগুলো এবার আসেনি। দোকানী কাকা বলল, এই মাসে আর আমাদের দোকানে ওষুধগুলো আসবেনা। আমি একটু চিন্তিত হয়ে বললাম,
— দাদীমার তো ওষুধ গুলো ছাড়া একদিন ও চলেনা। এখন কি হবে??
— দেড় মাইল দূরে সেবারখোলায় যে বাজারটা বসে ওখানে নতুন বড় ফার্মেসিতে এইগুলো বেশি কালেকশানে থাকে আর কমদামেও পাবি।
— অতদূর গেলে তো ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। আপনি একটু আনিয়ে দিতে পারবেন কাকা?
— আমার তো আজ সময় হবেনা মা। তুই টাকা দিয়ে যা আমি কাল-পরশু আনার ব্যবস্থা করে দিব।
দাদীমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। এমনিতে টিউশনির টাকাটা পেতে দেরী হওয়ায় ওষুধ কিনতে পারছিলামনা। বের হওয়ার সময় দেখলাম খুব খারাপ অবস্থা। ওষুধ পেতে দেরী হলে তো যেকোনো সময় খারাপ কিছু হয়ে যাবে। দাদীমার জন্য এটুকু কষ্ট আমি করতেই পারি।
দেরী না করে তখনিই রওনা দিলাম বাজারটার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম সন্ধ্যের মধ্যে বাসায় ফিরে যাব, কিন্তু এখানে পৌছাতেই সন্ধ্যে নেমে এল। তাড়াতাড়ি ওষুধগুলো কিনে বাসার দিকে রওনা দিলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম গাড়ির জন্য, একটাও গাড়ি ফাকা পাচ্ছিনা। পেলেও কেউ আমার এলাকা অবধি যেতে চাচ্ছেনা, কেউ কেউ এক্সট্রা ভাড়া দাবী করছে। খুব বেশী পরিমাণ টাকাও সাথে আনিনি, যা এনেছিলাম ওষুধ আর দাদীমার জন্য কিছু ফলমূল কেনায় ফুরিয়ে গেছে। যা টাকা আছে তা দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়া যাবে, কিন্তু কোনো বাস ই পাচ্ছিনা। অগত্যা হাটতে থাকলাম মেইন রোড ধরে, কিছুটা হেটে যদি কমে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাই। একে তো আমি একা, অচেনা এলাকা, তার উপর রাত হয়ে গেছে। ভয়টা ক্রমশ আমায় জাপটে ধরেছে।
মনে সাহস নিয়ে রাস্তার ধারে হাটতে লাগলাম। ব্যস্ত হাইওয়ে কিন্তু রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই, রাস্তার বাকে বড়বড় গাছগাছালি। শুনেছি এই রাস্তাটা নাকি ভাল না। দোয়া পড়ে ফু দিলাম বুকে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে, ফোনে চার্জ ও নেই তেমন। এতদূর আসব জানলে চার্জ দিয়ে রাখতাম। আসলেই সময় যখন খারাপ যায় সবকিছুই বেঈমানি করে। কিছুটা হাটার পর বুঝতে পারলাম কেউ আমার পিছন পিছন আসছে। থেমে থেমে কয়েকবার পিছনে ফিরলাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলামনা। এটা কি আমার মনের ভুল নাকি আসলেই কেউ আমাকে অনুসরণ করছে? এই ভেবে আরেকবার পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম কুচকুচে কালো বর্ণের একজন লোক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, হাতে শান বাধানো ছুরিটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝকঝক করছে।
হলুদ হাতগুলো বের করে নোংরা হাসি দিতে দিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এক মূহুর্ত দেরী না করে আমি প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম, লোকটাও আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে।
ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে দৌড়ানো ও সম্ভব হচ্ছেনা, হাপিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। হঠাৎ কারো শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বললাম, প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন। বাজে লোকটা আমার পিছু নিয়েছে। সে এদিক সেদিক কয়েকবার তাকিয়ে বলল,
— ভয় পাবেন না, এখানে কেউ নেই।
— আপনি ভালো করে দেখুন, একটা কালো লোক ছুরি নিয়ে আমার পিছু আসছে।
–সত্যি বলছি কেউ নেই। আপনি শান্ত হন।
উনাকে মূহুর্তে ছেড়ে দিয়ে চারপাশে তাকালাম, আসলেই কেউ নেই। লজ্জায় মুখ নীচু করে বললাম, দুঃখিত, ভয় পেয়ে আপনাকে এতটা উদ্বিগ্ন করলাম।
— ব্যাপার নাহ। কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এত রাতে একা এখানে কি করছেন?
— বাজারে গিয়েছিলাম। আসার সময় কোনো গাড়ি ই পাচ্ছিনা, পাচ্ছিনা তাও নয় কোনো ড্রাইভার ওইদিকে যেতে রাজি হচ্ছেনা।
— একা একটা মেয়েকে বাজারে যেতে হল কেন? প্রতুত্তরে আমি চুপ করে রইলাম।
উনি আমার নিস্তব্ধতা দেখে বলল, আমিও এলাকায় ই যাচ্ছি। চলুন একসাথে যাওয়া যাক। আমি চুপ করে একটু ভেবে নিলাম।
উনি আবার প্রশ্ন করলেন, চোর ব্যাটার সাথে যেতে ভয় করছে?
— স্যরি, আমি আসলে…
— যাওয়া যাক তাহলে?
–আচ্ছা চলুন। হাটতে হাটতে দুজন হালকা কথা বললাম। আমি আমার ব্যাপারে বললে উনি তার ব্যাপারে তেমন কিছুই বললেননা। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম টা তো জানা হলনা।
— চোর ব্যাটা। বলে হালকা হাসতে লাগল। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল উনার হাসিটা দেখতে বেশ ভালোলাগছে।
— আমি কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কিন্তু আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। উনি মুচকি হাসলেন। মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে হাটতে লাগলাম। কেমন মানুষরে বাবা! চুপচাপ থাকে মানলাম তাই বলে এতটা চুপচাপ থাকতে হয়। প্রতিটি কথার উত্তরে হয়ত মুচকি হাসছে নয়ত হুম হা করছে। ঝগড়া করার সময় এই ভাব কোন গাছের ডাব হয়ে যায় সেটাই ভাবছি।
অনেকটা পথ আসার পর একটা অটো রিকশা পেলাম। আমার পাশে জায়গা থাকা সত্ত্বেও উনি আমার মুখোমুখি বসলেন। ব্যাপারটা ভালো লাগল।
সারাপথ কেউ আর কোনো কথা বললামনা। কয়েকবার আড়চোখে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম, তারপর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, এবার তাহলে আসি। আল্লাহ হাফেজ।
— ধন্যবাদ। ভেবেছিলাম এর উত্তর মুচকি হাসি ই হবে। ভুল প্রমাণ করে বললেন,
— ধন্যবাদের চেয়ে জাযাকাল্লাহ বললে বেশি মধুর শোনায়।
আমি জ্বী আচ্ছা বলে গেটের ভিতরে ঢুকে গেলাম। মনে হল একবার পিছন ফিরে তাকাই, তাকিয়ে দেখি ছেলেটা নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন বুঝলামনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম।

দাদীমাকে ফল কেটে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এসব কিছু বলিনি আর, অযথা চিন্তা করবে। কাকীমা এসে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে গেছেন, আজ আর সেসব কানে নিয়ে মন খারাপ করিনি। শোকর আল্লাহর কাছে, আজ বড় একটা বিপদ থেকে বেচে ফিরলাম। শুতে এসে দেখি কালো বিড়ালটা আমার বিছানার উপর বসে আছে। কিভাবে যে আমার রুমে ঢুকল মাথায় ধরলনা। আমাকে দেখে বসা থেকে এমনভাবে দাড়াল যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আজ ওর চোখগুলো ভীষণ জ্বলজ্বল করছিল, কেন কে জানে!
প্রতিদিনের মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। ছেলেটার উপর আমার রাগ একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। সারাটা রাস্তায় আমাকে এত ভাব দেখাল, যেন একজন মহান লোক উনি। ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে ভাবলাম, ওহহো, তার রুমালটা তো ফেরত দেওয়া হয়নি। এর ঘ্রাণটা এত মিষ্টি যে এটা পাশে নিয়ে না ঘুমালে শান্তি পাইনা।
পরেরদিন সকালে কাকার মুখে শুনি, হাইওয়ের পাশে একটা লোকের বিভৎস লাশ পাওয়া গেছে। যার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছে, প্রতিটা আঙ্গুল ধারালো ছুরি দিয়ে ছিড়ে ফেলা হয়েছে। বুক থেকে টেনে কলিজাটা আধা বের করা। লোকটা নাকি সিরিয়াস কিলার। রাতে পথে অসহায় মেয়ে বা শিশু দেখলে ধর্ষণ করে, ডাকাতিও করে। শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল, কাল রাতে এই হাইওয়ে দিয়ে আমরা ফিরেছিলাম। আরো বিবরণ জেনে অবাক হলাম, এই লোকটাই সে যে কিনা আমার পিছু নিয়েছিল। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। নিজেকে এটা বলে শান্ত্বনা দিলাম, আল্লাহ তাকে তার উপযুক্ত কর্মফল দিয়েছেন। এখানে আমার সাথে কোনো যোগসুত্র নেই।
দুইদিন ধরে নিজের কাছে কেমন জানি অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। বিড়ালটা কেমন জানি অস্বাভাবিক আচরণ করে, যেন মনে হয় এটি কোনো সাধারণ বিড়াল নয়। যেমনঃ গভীর রাতে আমার রুমে ঢুকে পড়া, চোখ দুটি ভীষণ জ্বলজ্বল করা। তাও অত সিরিয়াস কিছু না দেখে অত পাত্তা দিলামনা।
কাকীর ভাই কিছুদিনের জন্য এখানে বেড়াতে এসেছেন। উনার আচরণ আমার খুব বাজে লাগে। যখন-তখন গায়ে হাত দেওয়া, আমার রুমে হুট করে ঢুকে পড়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি-কথাবার্তা। ব্যাপারটা আমি কাউকে বলিনি, জানি এসব বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা, যতটা পারি নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।
এর মাঝে ছেলেটার সাথে আরেকদিন দেখা হল। আমি ভাব দেখিয়ে কথা বলিনি।
উনি নিজে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার রুমালটা আপনার কাছে তাইনা?
কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম, হ্যা কেন?
— ফেরত দিবেননা?
— জ্বি নাহ। এটা এখন থেকে আমার।
— চোরের জিনিস রাখতে ভাললাগবে? চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম। উনি হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে বললেন, এখন অন্তত ঝগড়া করবেন না ।
— আপনি আমাকে ঝগড়ুটে প্রমাণ করতে চাইছেন?
— উহু। আপনি তো লক্ষী মেয়ে। লক্ষীর মেয়ের মত ৫ওয়াক্ত নামায পড়বেন আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখবেন।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here