জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০৪,০৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
কথাগুলো শুনে নিজেকে অনেকটা হালকা লাগল। তার কথামত নিয়মিত নামায পড়ার চেষ্টা করলাম। অনেকটা শান্তি লাগে এখন। কয়েকদিন ধরে বিড়ালটার দেখা পাচ্ছিনা, কোথায় যে উধাও হল।
মাঝরাতে হঠাৎ দেখি আমার ঘরটা কালো ধোয়ায় ভরে যাচ্ছে। কেমন জানি দমবন্ধ করা গরম বাতাসের অস্তিত্ব পাচ্ছি। বেডের পাশে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পটা বার বার অন-অফ হচ্ছে। উঠতে চাইলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ আমার হাত-পা দুটো শক্ত করে বেধে রেখে বুকের উপর মস্ত পাথর দিয়ে রেখেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম উঠার কিন্তু নড়ার একটুও শক্তি পাচ্ছিনা। এরমধ্যে আমার রুমের দরজাটা হুট করে খুলে গেল, আবছা অন্ধকারে কেউ একজন ঢুকল। হুডি পরা কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তার চেহারাটা স্পষ্ট নয়। চিৎকার করলাম, আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ ই বের হচ্ছেনা। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে। সেই প্রতিবিম্বটা আমার পাশে এসে বসতেই ল্যাম্পটা অফ হয়ে গেল। ভয়ে আমার হার্ট দ্রুত পাম্প করছে, মনে হচ্ছে এ আমার কোনো ক্ষতি করে বসবে। তার একটা বলিষ্ঠ হাত আমার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে আমার গাল ছুয়ে দিল। হাতটা এতই ঠান্ডা ছিল যে আমার গাল অবশ হয়ে যাচ্ছিল।
হাত সরিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। ফিসফিস করে কয়েকটা কথা বলল যার কিছুই আমি বুঝলামনা। আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি আমি।
চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছি আর হাপাচ্ছি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সবকিছু ঠিক আছে, রুমের দরজা বন্ধ আর ল্যাম্পটা ও জ্বলছে। তবে আমি কি এতক্ষণ বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম??
হাত-পা ঝিমঝিম করছে উঠতে পারছিনা, বহুকষ্টে হাত দিয়ে গালটা স্পর্শ করলাম। বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে, কিছুটা অবশ মনে হচ্ছে। স্বপ্ন ই যদি দেখে থাকি তবে এমন ফিল হচ্ছে কেন? আমার রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। কোনোমতে উঠে দরজা খুললাম। দাদীমা এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর? চিৎকার করছিস কেন?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চিৎকার শুনলে কি করে? অবাক হওয়ার কারণ হচ্ছে, দাদীমার রুম আমার রুম থেকে দূরে। এই বাসার অধিকাংশ রুম থেকে বাহিরে শব্দ যায়না। আমার রুমটাও তেমন, বাহিরে থেকে ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যায়। দাদীমা আমার মাথায়-গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই শুনেছি। পানি খাবি?
আমার অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, হুম। দাদীমা টেবিল থেকে পানির জগ নিতে গেলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম দেয়ালে দাদীমার ছায়া পড়ছেনা, পড়ছে একটা ঘন কালো অদ্ভুত প্রতিবিম্বের ছায়া। ভয় পেলেও কিছু বললামনা, দাদীমা আমার কাছে আসলে আমি বললাম,
— আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমি এখন ঘুমাই?
পানি পরে খাব বলে শুয়ে ঘুমানোর ভান করলাম। দাদীমারুপী জিনিসটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়লাম, দাদীমা আমার মাথায় হাত ছোয়াতে এসে অস্বস্তিবোধ করলেন। চুপচাপ বাহিরে থেকে দরজা নক করে চলে গেলেন। শোয়া থেক্ব উঠে বসলাম। বুঝতে পারছিনা আমার সাথে এসব কি হচ্ছে? কেউ কি সত্যিই আমার উপর নজর রাখার চেষ্টা করছে? করলে সে কে? ভয়ের চোটে সারারাত আর ঘুম হলনা।
সকালে উঠেই দাদীমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুমি কি কাল রাতে আমার ঘরে এসেছিলে? দাদীমা মাথা নাড়িয়ে বলল, নারে আপু। কাল ওষুধ খাওয়ার পর খুব ঘুম পেয়েছিল, সারারাতে আর জাগিনি।
সারাদিন আমার মাথায় এসব ঘুরপাক খেতে লাগল। দাদীমাকে বলতে গিয়েও বললামনা, অযথা চিন্তা করে শরীর খারাপ করবে। মনটা উদাসীন লাগছিল তাই আজ আর টিউশনি করাতে গেলামনা। সারাসন্ধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম। দাদীমা এসে বলল,
— কিরে মুসকান, তোর কি মন খারাপ?
— না দাদীমা।
— তুই চুল ছেড়ে এই সন্ধ্যেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি চুল বেধে নে।
আমি চুলে খোপা করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, বাধতে হবে কেন? না বাধলে কি হয়?
দাদীমা ফিসফিস করে বললেন, তেনাদের নজর পড়ে। এটা ভালোনা বুঝলি।
–তেনারা কারা?
— বোকা মেয়ে। তোকে এখন ভেঙ্গে বলতে হবে? জ্বীন-ভূত এর নজর পড়ে, আছর করলে আর ছাড়েনা।
আমি জোরে জোরে হেসে হেসে বললাম, নজর পড়লে তো ভাল। তোমার নাতনীর একটা গতি হত। এত পাত্র খোজাখুজি করতে হতনা।
— বোকা মেয়ে বলে কি! ওরে জ্বীন আর মানুষের কখনো বিয়ে হয়! ওরা শুধু মানুষের ক্ষতিই করে।
— কেন হয়না?
— ওরা তো ভালো মানুষদের মত অত ভালনা। অন্যের ক্ষতি করাই এদের স্বভাব। আর দেখতেও নাকি ভয়ংকর। তাদের কিভাবে মানুষ বিয়ে করবে বল!
— ভাবার বিষয়।
— অত ভাবতে হবেনা। তোর বিয়ে আমার একটা লাল টুকটুকে রআজপুত্রের সাথেই দিব। যে আমার নাতনীটাকে ভালোবেসে আগলে রাখবে।
— আদৌ পাও কিনা দেখো নাহলে আমি জ্বীন ই বিয়ে করব।
— মেয়ের অলক্ষী কথাবার্তা সব। এসব বলবিনা আর।
চল নিচে চল। তেল দিয়ে তোর চুল বেধে দিব।
— তুমি যাও, আমি আসছি।
— আবার!
— আসছি তো। সুন্দর বাতাস টা আরেকটু গায়ে লাগুক।
— বাতাসের সাথে ও কিন্তু এরা আছর করে বলে দিলাম।
— বুড়ি আর ভয় লাগাইওনা তো। যাও তুমি, আমি খানিকবাদে আসছি।
ছোটবেলা থেকে নানি-দাদীর থেকে ভয়ানক গল্প শুনে দাদীমার এসব ই ধারণা হয়েছে। আমারো হয়নি তা বলবনা কিন্তু কৌতুহল আছে তাদের প্রতি। আসলেই কি তারা দেখতে ভয়ংকর কিংবা তাদের বিয়ে করা যায়না??
কপালে একটা জ্বীনবর জুটলে মন্দ হতনা।
ভাবতে ভাবতে নিচে থেকে আবার দাদীমার ডাক। দেরী না করে নিচে চলে এলাম।
সন্ধ্যেবেলা খবর এল পাশের পাড়ার দাদীমার সই সালেহা দাদী মারা গেছেন। দাদীমা আর বাসার সবাই সেখানে চলে গেল। আমার শরীর খারাপ থাকায় দাদীমা ই আমাকে সাথে নিয়ে গেলনা। শোয়া থেকে উঠে ছাদে এসে বসলাম। বাহিরে খুব ঝড়ো বাতাস হচ্ছে, হয়ত খুব জোরে বৃষ্টি হবে। মাঝে মাঝে জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ কাকীমা আর দাদী সেখান থেকে ফিরতে পারবেনা। এদিকে শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে, শরীর কাপুনি দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা আর। এমনসময় সিগারেট পোড়ানোর গন্ধ নাকে আসল। পিছনে তাকিয়ে দেখি কাকীমার ভাই ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। উনাকে দেখে আমি পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে গেলে উনি শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। উনি আমাকে ছাদের কোণার দিকে ছুড়ে মারলেন। সিগারেট ফেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি হাত জোড় করে বললাম,
— কাকা, আমি তো আপনার মেয়ের মত।
আমার সাথে এমন অন্যায় করবেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে যেতে দিন। উনি আমার থুতনি চেপে ধরে বললেন, এতদিন এই সুযোগটার ই অপেক্ষায় ছিলাম। আজ বলছিস ছেড়ে দিব। আচ্ছা ছেড়ে দিব আগে আমার কাজ হাসিল করি।
কান্নাভরা আকুতি মিনতি যখন মাঠে মারা গেল, তখন পাশ থেকে একটা ফুলের টব নিয়ে তার কপাল লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম। আমার কপালটা এতই খারাপ যে, সেটা উনার কপালে লাগার আগে উনি সরে গেলেন। তার ক্ষোভ আরো দ্বিগুণ হল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলেন। মনে হচ্ছিল, আমি আর নিজেকে বাচাতে পারবনা। পশুটার লালসার কাছে হেরে যাব। ভাবতে ভাবতে তার কবজি বরাবর জোরে কামড় বসালাম। ব্যথা পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। উঠে পালাতে যাব এমনসময় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল যে জায়গায় আবার বসে পড়লাম। লোকটা এসে আমার তলপেট বরাবর জোরে লাথি মারল। ব্যথায় সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম। এবার আমার চুলের মুঠি জোরে চেপে ধরে বলল, তোকে আজ তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে ধর্ষণ করব। আমাকে কামড় দেয়া, চল আমার সাথে নিচে। তোর শরীর কেটে আজ লবণ-মরিচ লাগাব।
শরীরটা এতই খারাপ হয়ে গেছে যে উঠে দাড়াতে পারছিনা। উনি আমাকে চুল ধরে টেনে-হেচড়ে নিচে নিয়ে গেলেন। রুমে বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে লবণ-মরিচ আর ছুরি আনতে গেলেন।
ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। আজ কি শেষ রক্ষা হবেনা আমার!!
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৪
পর্বঃ০৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
বদ্ধরুমে বসে আল্লাহকে স্মরণ করা ছাড়া কোনো উপায় ই রইলনা। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখি রুমের জানালার কার্ণিশটা ভাঙ্গা। আল্লাহ সহায় থাকলে কোনোমতে এখান দিয়ে বের হওয়া যেতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম। একটু চিপা থাকায় বের হতে কষ্ট হল, অনেক কষ্টে বের হলাম। হাতের বাহুতে খুব ব্যথা করছে। হাত দিয়ে দেখি ভাঙ্গা কার্ণিশের একটুকরো কাচ গেথে আছে এবং অনেক রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। কাচ বের করতে গিয়ে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। দেরী না করে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। অনেকটা দৌড়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি শয়তানটা আমার পিছু নিয়েছে। আমি আর একটুও এগোতে পারছিলামনা, শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। উপায় না দেখে সামনের জঙ্গলের ভাঙ্গাচোরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। মুখ চেপে বাড়িটার দরজার পিছনে বসে রইলাম। শুকনা পাতার উপর কারো হাটার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দটা আস্তে আস্তে আমার কাছাকাছি চলে আসছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম, আর বুঝি রক্ষা নেই। হুট করে দরজায় কারো ধাক্কা খাওয়ার শব্দ আসল। মেঝেতে আবছা ছায়া পড়ছে, আমার বেশিক্ষণ ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। চোখ প্রচুর জ্বলছে, মাথাটা ভার ভার লাগছে। আস্তে আস্তে আমার সবকিছু যেন অবশ হয়ে আসল। সব ঝাপসা হতে হতে চোখ বুজে গেল।
আস্তে আস্তে চোখ মেললাম। একটা পুরোনো ভাঙ্গাচোরা ঘরে শুয়ে আছি আমি, চারপাশে কয়েকটা হারিকেন জ্বলছে। অনুভব করলাম, আমি কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই ছেলেটা বলল,
— ভয় পাবেননা। আমার কোলে মাথা রেখে আছেন আপনি। উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দুর্বলতার কারণে সেটা পারলামনা। ক্ষীণকন্ঠে বললাম,
— আপনি এখানে কেন? আর আমি ই বা কোথায়?
— সেসব বলব আপনাকে। আগে বলুন শরীর এখন কেমন?
একটু ভালো লাগছে?
আগের চেয়ে শরীরটা একটু ভালো লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব অনেকটাই কমে গেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে বুঝতে পারলাম।
— জ্বী অনেকটাই ভাল।
উনি আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আপনার হাতের বাহুতে কাচ ঢুকল কি করে?
উনার কথা শুনে হাতের দিকে তাকালাম। সেখানে ব্যান্ডেজ করা। উনি আমার চুপ থাকা দেখে বললেন,
— কাচ বের করে আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। অনেক রক্ত গেছে আপনার হাত থেকে, তাছাড়া খুব জ্বর ও ছিল। এখন অনেক দুর্বল লাগবে। চোখ বুজে একটু শুয়ে থাকুন।
— আপনি এখানে কেন? আমি কোথায়?
— আপনি ভাঙ্গাচোরা বাড়িটাতেই আছেন। আমি এখানে এসেছিলাম মন টা ভালো করতে, আসলে একাকী পরিবেশ,এক ঝাক জোনাক, ঝি ঝি পোকার ডাক খুব ভালো লাগে তাই বসে এসব উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ কাউকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি আপনি অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছেন।
আমি তো প্রায়ই এখানে আসি। তাই নিজের সুবিধার জন্য কয়েকটা হারিকেন, বিছানা আরো প্রয়োজনীয় জিনিস এনে রাখি। তার জন্যই আপনার সেবা করতে পারলাম। চোখ বড় বড় করে তার কথা শুনছিলাম। সিরিয়াসলি? এমন একটা গা ছমছম করা জায়গা কারো ভালো লাগতে পারে? ছেলেটার কি মাথায় সমস্যা আছে নাকি! দিনের বেলায় ও কেউ এই বাড়ির আশে পাশে ঘেষতে চায়না। ভয় লাগছিল একটু একটু, মিনতিমাখা কন্ঠে বললাম,
— আমি বাড়ি যাব।
— এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কিভাবে যাবেন? পারবেন তো?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওই নরপশুটার কুৎসিত হাসিমাখা মুখটা। আতকে উঠে উনার শার্ট খামচে ধরলাম। বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলাম, না আমি আর ওখানে যাবনা। আমাকে মেরে ফেলবে। বলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলাম তার কোলে জড়োসড়ো হয়ে। উনি আমাকে থামানোর চেষ্টা করে বললেন,
— কি হয়েছে আপনার? শুনুন ভয় পাবেননা। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবনা। আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম এই শরীর এখন না যাওয়াই ভাল। যদি আপনি চান তবে আমি বাহিরে গিয়ে বসছি আপনি একটু রেস্ট নিন। সকালেই আপনাকে আমি বাড়ি পৌছে দিব।
বলে উনি উঠে যেতে উদ্ধত হলেন। আমি উনাকে শক্ত করে চেপে ধরে আরো জোরে জোরে কেদে বললাম,
— প্লীজ যাবেননা। আমার ভয় করছে।
— ভয় পাবেননা। আপনি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় আমার খুব স্বস্তি ফিল হচ্ছিল। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ভয়টা যেন কেটে গেছে, অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল। বাচ্চাদের মত উনার শার্টের নিচের অংশ চেপে ধরেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
কিন্তু ঘুম আমার পুরোপুরি আসছিলনা। একটু পর পর ভেঙ্গে যাচ্ছিল আতঙ্কে। যতবার ভাঙ্গছিল ততবার উনার কোলে আরো জড়োসড়ো হয়ে হচ্ছিলাম। আবার জ্বর এসেছিল, জ্বরের ঘোরে উনার হাত আমার গালের কাছে চেপে ধরেছিলাম। উনি একটুও বিরক্ত হননি উলটো আমার এমন অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। আমি জ্বরের ঘোরে বলে ফেললাম, আমি আর পারছিনা এভাবে থাকতে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আম্মু আব্বু আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাবে?
এত স্বার্থপর কেন তোমরা, এমন একটা নরকে ফেলে রেখে তোমরা জান্নাতে চলে গেলে??
হঠাৎ টের পেলাম আমার কপালে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। ঝাপসাদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি উনার চোখদুটো ভেজা ভেজা। গাল বেয়ে মুক্তোদানার মত অশ্রু ঝড়ছে।
নিজের অজান্তে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিলাম উনার। জানি না কি হল, উনি আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে বাচ্চাদের মত কাদতে শুরু করলেন। আমি বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কাদছেন কেন?
উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, আপনার ঠান্ডা লাগছে? কাপছেন মনে হচ্ছে।
উনার কথায় এখন নিজের কাপুনি টের পাচ্ছি। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন খুজলেন। আশাহত হয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, চাদরটা কোথায় ফেলে রেখেছি এখন দেখছিনা।
— আপনি এই গরমকালে চাদর নিয়ে চলাফেরা করেন?
উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, আমি পাতালতা জড়ো করে আগুন জ্বালাচ্ছি আপনি তার পাশে বসলে ঠান্ডা কম লাগবে। আলতো করে আমার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখলেন। তারপর আগুন জ্বালালেন, ততক্ষণে আমি চেষ্টা করে একটু উঠে বসলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওড়নাটা পেচিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিন। উনার কথামত তাই করলাম। উনি পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে আবার চেক করলেন। আমার মাথাটা ভার ভার লাগছিল, স্থির হয়ে বসতে পারছিলামনা। তাই উনার কাধে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। উনি বিশেষ কিছু বললেননা, শুধু একবার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
অনুনয়ের স্বরে বললাম, আপনার হাতটা আমার কপালে ধরে রাখবেন?? উনি তাই করলেন এবং বললেন,
— এভাবে জ্বর বাধালেন কি করে?
— কিছু তো করিনি। শুধু সেদিন আইসক্রীম….
শুনুন না, আমায় এখন আইসক্রীম খাওয়াবেন প্লীজ!!
আইসক্রীমের কথা মাথায় আসতেই পাগলামীর ঝোক উঠল। উনি আমার দিকে ভুত দেখার মত তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, কি খাওয়াবেন না??
— এত রাতে আইসক্রীম কোথায় পাব?
আর আপনার তো জ্বর অনেক।
— আপনি জানেন না, জ্বরের সময় যেটা খেতে ইচ্ছে করে সেটা খেতে হয়। নাহলে জ্বর বেড়ে যায়।
উনি বিড়বিড় করে বললেন, এমন কথা কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করল?
— সেটা জেনে কি হবে হুম?
এখন আমাকে আইসক্রীম খাওয়াতে হবে ব্যাস! আর চোর ব্যাটা সব পারে, যেভাবে যত রাত ই হোক ঠিকই চুরি করতে পারে। উনি মুখ গম্ভীর করে বললেন,
— আপনার ভয় লাগবেনা একা থাকতে?
— আইসক্রীমের জন্য এটুকু বিসর্জন করা ই যায়।
— আচ্ছা, আসছি। বলে উনি চলে গেলেন।
কিছুটা সময় পর আমার হুশ আসল আমি পোড়াবাড়ীটা তে একা। ভয় লাগতে শুরু করল অল্প অল্প। উনাকে পাঠিয়ে যে কত বড় ভুল করলাম এখন বুঝতে পারছি। চারপাশের ভাঙ্গা দেয়াল গুলো যেন আমার দিকে ভয়ানক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি একটা জোরে আওয়াজ হল আমি উঠে দিলাম ভৌ-দৌড়। উনাকে এদিকেই আসছিলেন,উনাকে দেখে ঝাপিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমতা আমতা করে বললাম, ভূ–ত।
— কোথায় ভুত?
— আপনি একটা ভয়ংকর আওয়াজ শুনেন নি?
— ওইটা বাদুরের ডাক।
এবার আমি উনাকে ছেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম, লজ্জা লাগছিল এমন ঘটনায়। উনি আইসক্রীমটা আমাকে দিয়ে বললেন, নিন।
— এত রাতে কোথায় থেকে আনলেন?
— জ্বরের রোগী খেতে চেয়েছে, না এনে উপায় আছে।
জ্বরের সময় যেটা খেতে ইচ্ছে করে সেটা খেতে হয়।
আমি লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে দিলাম।
খাওয়া শেষ করে দেখি উনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি নিচুকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
— তাকিয়ে আছেন কেন?
উনি কিছু না বলে আমার কাছে আসলেন, আমার ওড়না এককোণা গুটিয়ে নিয়ে নাকের ডগাটা আলতো করে মুছে দিলেন। তারপর বললেন,
– এভাবে বাচ্চাদের মত আইসক্রীম খায় কেউ?
নাকের ডগায় লাগিয়ে ফেললেন।
— আসলে আমি এতটাই অগোছালো যে এখনো নাকে মুখে আইসক্রীম লাগিয়ে ফেলি।
উনি মুচকি হেসে বললেন, শরীর কেমন এখন? জ্বর আছে কিনা দেখি! হুম অনেকটা কমে গেছে। ঘন্টা দুয়েক বাদে সকাল হয়ে যাবে। একটু ঘুমাবেন?
— আপনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমাব। উনি আমার দিকে তাকাতেই বললাম, আসলে তখন তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যায়।
— আচ্ছা আসুন। আবার উনার কোলে ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখ মেলতেই দেখি উনি হাত দিয়ে আমার মুখের উপর ছায়া তৈরির চেষ্টা করছেন। আমাকে জাগতে দেখে হাত সরিয়ে নিলেন, সাথে সাথে একফালি রোদ এসে আমার চোখে পড়ল। এখন বুঝলাম রোদ যাতে আমার চোখে পড়ে ঘুম না ভাঙ্গে তাই এমন অভিনব খাটাচ্ছিলেন। আমি উঠে বসতেই বলল, চলুন আপনাকে বাসা অবধি দিয়ে আসি।
— আচ্ছা। উনি বাড়ির গেইট পর্যন্ত পৌছে দিয়ে বললেন,
— ফি-আমানিল্লাহ। নিজের খেয়াল রাখবেন।
— আপনিও।
আমি গেইটের ভিতরে ঢুকে বারবার পিছু তাকাচ্ছিলাম। কেমন জানি খারাপ লাগছে বিদায় জানাতে। বাড়িতে ঢুকতেই কাকীমা এসে আমার চুলের মুঠি ধরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন। কাকীর ভাই আর দাদীমা সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। দাদীমা কাদতে কাদতে বললেন,
— বউ আমার মুসকান রে মারিসনা। মাইয়াটার শরীর ভালনা।
কাকীর মারের চোটে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি তাও ছাড়ছেনা। এলোপাথাড়ি লাথি মারছে শরীরে। একটা লাথক আমার বাহুর ক্ষতস্থানে পড়তেই ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। এদিকে আমার ঠোট ফেটে রক্ত পড়ছে।
কাকীমা ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে,
— আমার খাস, আমার পরিস। আর আমার ক্ষতি করতে চাস। ডাইনী কোথাকার। কালোযাদু করে আমার ভাইকে মারার চেষ্টা। কাল সারারাত কোন নাগরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে গেছোস?
মা-বাপ রে খাইছোস এখন আমার পরিবার খাওয়ার জন্য বসে আছিস। তোরে আমি অনেক সহ্য করছি আর না। হয় তুই তাড়াতাড়ি এই বাড়ি থেকে বিদায় হবি নাহলে তোরে আমি ঝেটিয়ে বিদায় করব। নষ্টা মাইয়া। বলে কাকীমা আমার গায়ে থুথু ফেলে ঘরে চলে যায়।
দাদীমা চোখ মুছে আমাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে যায়।
.
(চলবে)