জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০৬,৭

0
2185

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ০৬,৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

দাদীমা বার বার চোখ মুছতে মুছতে ঠোটের ফাটা অংশের রক্ত পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে। আমি একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। শরীরের কষ্ট টা না মনের ভিতরে একরাশ যন্ত্রণা আমাকে বেশি জ্বালাচ্ছে। ভাবছি কাকীমা হঠাৎ আমাকে ডাইনী বলল কেন? আমি কালোজাদু করি এসব ই বা ভাবছে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাদীমার দিকে তাকিয়ে বললাম, কাকীমা আমাকে এসব বলল কেন দাদী?
— কাল রাতে যখন আর বৃষ্টি আইলনা আমরা বাড়ি ফিরে আসছিলাম। আইসা শুনি লোকটার ঘর থেকে চাপা গোঙ্গানীর আওয়াজ আসতাছে। তড়িঘড়ি করে বউ, তোর কাকা আর আমি ওর ঘরে গেছিলাম। দরজা ভাঙ্গতে হইসিল, ভাঙ্গার পর দেখি তারে দেয়াল ঘেসাইয়া কেউ উপরে উঠাইয়া রাখছে। শরীরের অনেক জায়গায় গভীরভাবে কাটা, অইখানে আবার লবণ-মরিচ লাগানো। আমি দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলাম। একটু পরে ওই লোক ফ্লোরে পড়ে গেছে। জ্ঞান ফেরার পর বলে তুই নাকি ওরে মারার চেষ্টা করে তোর নাগরকে নিয়ে পালাইসোস।
অবাক হয়ে এসব শুনলাম। এগুলো কি করে সম্ভব? দাদীমা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কই ছিলি সারারাত? আমি জানি তুই এসব করতে পারিসনা, তাই দাদীমার কাছে সত্যি কথা বল।
কাদতে কাদতে দাদীমাকে ওই লোকের সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে দাদীমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— তুই এতকিছু সহ্য করে এখানে কেন পড়ে আছিস হতভাগী? পালাতে পারিসনা। যা পালিয়ে যা এখান থেকে। আর কোনোদিন ও এইমুখো হবিনা।
— এটা সম্ভব না দাদীমা। তোমাকে ফেলে আমি কিভাবে যাবো বলো? তুমি ছাড়া আমার কে আছে? আর যদি যেতে হয় তোমাকে নিয়েই যাব, এই জাহান্নামে তোমাকে একা ফেলে আমি কখনোই যেতে পারবনা। খুব তাড়াতাড়ি আমি একটা মাথা গোজার ব্যবস্থা করব তারপর তোমাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।
— প্রত্যেকদিন তোর সাথে বউয়ের খারাপ আচরণ আমার সহ্য হচ্ছেনা রে। ওরা তোকে তিলে তিলেই মেরে ফেলবে। তুই আমার জন্য ভাবিসনা। এখান থেকে পালা মুসকান।
আমি আর কয়দিন বাচব বল!
— এসব একদম বলবানা বুড়ি। চিন্তা করোনা তুমি, আমাকে একটু সময় দাও। আমি তোমাকে নিয়েই এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাব।
রাতে কাকা এসে সাফ জানিয়ে দিল, উনি আমাকে তার কাকীর ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবেন। এখানে আমার কোনো আপত্তি ই খাটবেনা। যদি আপত্তি থাকে, তবে যেন এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই। জঘন্য মানসিকতাসম্পন্ন চল্লিশার্ধ বয়স্ক লোককে আমি কিছুতেই বিয়ে করবনা সাহস করে জানিয়ে দিলাম কাকাকে। কাকীমা আমাকে মারার জন্য মোটা চেলাকাঠ নিয়ে তেড়ে এলেন। দাদীমা বাধা দিতে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, পুরো ফ্লোর দাদীমার রক্তে ভেসে যায়। কাকা, কাকীমা ঘটনার আকস্মিকতায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কাকার পায়ে ধরে বললাম,
— দাদীমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো কাকা। এভাবে পড়ে থাকলে আমার দাদীমা যে আর বাচবেনা। আমি তোমার সব কথা শুনতে রাজি।
কাকা ভয়ে ভয়ে বলে, এখন হাসপাতালে নিলে পুলিশ কেসে আমি ফেসে যাব। কিছু হয়নি মার, মাথা একটু ফেটে গেছে। তুই ব্যান্ডেজ করে দে। অবস্থা বেশী খারাপ হলে আমি নাহয় ডাক্তার ডেকে দিব।
কাকা ডাক্তার নিয়ে এল। উনি সেলাই করে ব্যান্ডেজ বেধে দিলেন কিন্তু দাদীমার জ্ঞান ফেরলনা। নামাযে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দাদীমার সুস্থতা চাইলাম।
শেষরাতে দাদীমার জ্ঞান ফিরল। আমার হাত ধরে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু সে সুযোগ আর তার হলনা। অবশ হয়ে গেল চোখের মনি। আমার দাদীমা আমাকে ছেড়ে সত্যিই অন্য জগতে চলে গেছে। আমার চোখে তখন পানি এলনা, পাথরের মত অবশ হয়ে বসে রইলাম দাদীমার হাতটি ধরে। দাদীমাকে যখন দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল, চোখের পানি আর বাধ মানল না। বাচ্চাদের মত দাদীমার কবর আকড়ে ধরে কাদলাম।

সারাদিন ঘরের এককোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কাকীমা এসে চেচিয়ে চেচিয়ে বলল,
— ডাইনী, নিজের দাদীমারেও খাইসোস। এখন এখানে বসে ন্যাকামী দেখাস, যা উঠে সব কাজ কর। আমি না শোনার ভান করে আগের মতই বসে রইলাম। কাকী ক্ষেপে গিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরতে এলে উনার হাত খামচে ধরে বাধা দিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বললাম,
— এতদিন তোমাদের সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম। কেন জানো? আমার দাদীমার দিকে তাকিয়ে, অন্তত তাকে তোমরা ভাল রাখবে বলে। আর তোমরা তাকেই মেরে ফেললে। তোমাদের কাউকে আমি ছাড়বনা।
কাকীমা চুপসে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাত ১০টায় কাকা, কাকীমা আর তার ভাই মিলে আমার রুমে ঢুকল। আমাকে ইচ্ছেমত মেরে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করল। আমার পুরো গায়ে ঘুরে ঘুরে কেরাসিন ছিটাল। আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মূহুর্তে হঠাৎ ঘরে দমকা হাওয়া ঢুকতে লাগল। সেই সাথে ভয়ানক ভয়ানক শব্দ। দেয়াল ফুটো হয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল। জানালা দিয়ে কে যেন কাটা মাথা, উপড়ে ফেলা চোখ ছুড়ে মারতে শুরু করল। এসব দেখে আমার খুব ভয় হচ্ছিল। দৌড়ে দরজার বাহিরে চলে এলাম। কাকা-কাকীমারাও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। তারাও বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে ছুটে গেল। কিন্তু আমি বের হওয়ার সাথে সাথে দরজা আটকে গেল, কাকীমারা ভেতরেই আটকা পড়ে রইল।
দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুলছেই না। হঠাৎ দেখি একটা বিভৎস কাটা মাথা লাফাতে লাফাতে আমার ঘাড়ের কাছে উঠে বসল। চিৎকার করে ওটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। ওইটা আমার পায়ের কাছে পড়ে ভয়ানক হাসি দিল। দরজার ফাক দিয়ে নাড়িভুড়ি, রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়তে লাগল,আর ভেতর থেকে আত্মচিৎকার যেন কেউ কারো টুটি ছিড়ে ফেলছে। ভয়ে আর এক মূহুর্ত ও দাড়ালামনা। বাসা থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে এলাম।
আকস্মিকভাবে মুহুর্তেই পুরো বাড়িতে ভয়ানক বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে গেল। চোখের সামনে ছাই হয়ে গেল কাকা-কাকীমাসহ পুরো বাড়ীটা।

বিকট শব্দে কারো হাসির আওয়াজে আমার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। আমি ভয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। চারপাশে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু কাউকেই দেখছিনা। মনে হচ্ছে আমি কোনো নিস্তব্ধ গোরস্তানে আছি। সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
বুঝতে পারছিনা কি করব! পায়ের সাথে কি একটা বেধে হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মাথা তুলে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কেউ একজন আমার সামনে এসে দাড়াল। তাকিয়ে দেখি লম্বামতন কোনো পুরুষ, মুখের সামনে হুডির ক্যাপ তোলা, অন্ধকারাছন্ন চেহারা। ঠিক যেমনটা সেদিন আমি স্বপ্নে দেখেছি। আমতা আমতা করে বললেন,
— কে আপনি? সে কিছু না বলে আমার দিকে এক পা করে এগোতে লাগল। আমার পিছু হটতে থাকলাম। সে আমার সামনে বসে আমার হাতটা চেপে ধরল শক্ত করে। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
— আহ! ছাড়ুন। আমার ভীষণ ব্যথা লাগছে।
কে আপনি? ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে উঠে উলটো দিকে দৌড়াতে লাগলাম।

দৌড়ে কিছুটা দূরে এসে সামনে সেই লোকটাকে আবার দেখতে পাই। যেইদিকেই যাচ্ছি সেখানে লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কি হচ্ছে আমার সাথে এগুলো!!
“আপনি এভাবে আমার পিছু নিচ্ছেন কেন? কে আপনি?
কি চাচ্ছেন বলুন?”
“আমাকে মেরে ফেলতে চান? তাহলে এক্ষুনি মেরে ফেলুন।”
লোকটা আমার মুখের সামনে মুখ আনল। তার প্রচন্ড ঠান্ডা নিঃশ্বাস টা আমার মুখ অবশ করে ফেলছে। সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখলাম কেউ নেই আমার সামনে। চারপাশটা ভালো করে দেখলাম লোকটা উধাও। রাস্তায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
এমনসময় কেউ আমার কাধের উপর হাত রাখল। ভয়ে আতকে উঠলাম। সে লোকটা আবার এসেছে!! এবার কি সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে।
পিছনে ফিরে দেখি সে চোরব্যাটা দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে-আতঙ্কে নাকি স্বস্তিতে জানিনা আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। উনি আমার এমন অবস্থা দেখে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— কি হয়েছে আপনার? আবার ভয় পেয়েছেন? আমি আছি তো ভয় পাবেননা।
উনার এমন শান্ত্বনাতে আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে গেল। উনাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠলাম। সেই সাথে শুরু হয়ে গেল হেচকি উঠা।
উনি বারবার বলতে লাগলেন,
— কান্না থামান। কি হয়েছে বলুন?
আমি হেচকির জন্য কথা ই বলতে পারছিনা। উনি জোরে একটা ধমক দিয়ে বললেন, কান্না থামাতে বলেছিনা আপনাকে। আমি একদম চুপ মেরে গেলাম।
উনি আবার নরমকন্ঠে বললেন,
— দুঃখিত, আপনার হেচকি থামানোর জন্য ভয় লাগতে ধমক দিয়েছি। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, কি হয়েছে বলুন?
— আমার একমাত্র আপনজন দাদীমা মারা গেছেন। আমার আর কেউ রইলনা।
— বোকা মেয়ে। যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছে। কাদবেননা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
.
(চলবে)

জ্বীনবর ৪
পর্বঃ০৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

উনার কথা শুনে ছলছল করা চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন? আমি না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
— আপাতত কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। জানিনা কি হবে? আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন?
— আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন কেন? আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
— রেখেছি আর রাখব ইনশাআল্লাহ। একটু চুপ থেকে উনি বললেন, আমার সাথে যাবেন? আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সাথে? কোথায়?
— আমার বাসায়।
— না।
— কেন?
— আমাকে আপনি চিনেননা, জানেননা তাও অনেক সাহায্য করেছেন। এখন আপনার গলগ্রহ হয়ে আপনার বোঝা বাড়াতে চাইনা। আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে।
— আল্লাহ চান বলেই তো আপনাকে এত সাহায্য করছি। উনি আমার মাধ্যমেই আপনার ভালো করতে চাচ্ছেন। আর আপনাকে আমার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবেনা। আপনি যখন নিজের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন, তখন আপনি চলে যেতে পারবেন। আমার মনে বিন্দুমাত্র অসৎ উদ্দেশ্য নেই, আমি কেবল আল্লাহর একজন অসহায় বান্দাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি এবং আল্লাহকে খুশি করতে চাচ্ছি।
এখন আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে বলুন?
আমি উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। এই নিষ্পাপ মুখের পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকবে সেটা আমি ভাবছিনা, ভাবার কারণ ও নেই। ক্ষতি করার মনোভাব থাকলে সেদিন আমাকে একা পেয়েই করতে পারতেন। কিন্তু আমার আর কারো উপর নির্ভরশীল হতে ইচ্ছে করছেনা। এখন আমার কাছে সেই উপায় ও নেই যা দ্বারা আমি নিজেই একা চলতে পারব। তাছাড়া কেউ একজন আমাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমার একটা আশ্রয় প্রয়োজন।
— আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিজের ব্যবস্থা করামাত্রই আপনার ওখান থেকে চলে আসব।
— বেশ তাই হবে। তাহলে যাওয়া যাক।
এরপর উনি আমার সাথে তেমন কথা বলেননি। একসাথে বাসে উঠে বসলাম পাশাপাশি সিটে। বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজের এলাকাটা বিদায় দিচ্ছি। এতদিন ভেবেছি উনি আমার এলাকায় ই থাকেন। কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে উনি বেশ দূরে থাকেন। ইচ্ছে থাকাসত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলামনা উনি এই এলাকায় কেন এসেছিলেন!
আমার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার এলাকায় আমি একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম। আমার বাসা এখানে নয়। বিষম খেলাম, উনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি এটাই ভাবছিলাম।
বাস থামতেই ঘুম ভাঙ্গল। উঠে দেখি উনি আমার কাধে মাথা এলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় উনাকে বেশ কিউট লাগছে দেখতে। জাগাতে মন চাইলনা, কাধ হালকা একটু ঝুকে দিলাম যাতে বাস থামলেও উনার ঘুম না ভাঙ্গে।
জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি সবে ভোর হচ্ছে। আমার অন্যজীবনের সূচনা ও নতুনভাবে হচ্ছে। পরবর্তীতে কি হবে? উনার সাথে যাওয়াটা আদৌ ঠিক হচ্ছে কিনা! এর জন্য আবার নতুন কোনো ঝামেলায় পড়ব কিনা! এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এতকিছু সত্যই আমার জানা নেই শুধু একটাই কথা জানি, একজোড়া বিশ্বস্ত হাত ধরে আমি ভবিষ্যতের সন্ধানে যাচ্ছি। এই হাত যদি বেঈমানি করে, তবে আল্লাহর কাছেই দায় রয়ে যাবে। এমন সাতপাচ ভেবেও নিজের অস্থিরতাকে দমাতে পারছিনা। মন সায় দিলেও মস্তিষ্ক আমাকে ভীত করছে।
সকালে একটা বাসস্টেশনে এসে নামলাম। উনি এরমধ্যে একবার জিজ্ঞেস করলেন, কি খাবেন? আমি ক্ষিধে পায়নি বলে না করে দিলাম। যতক্ষণ অস্থিরতা থাকে ততক্ষণ শান্তিতে কিছুই গিলতে পারবনা।
তারপর রিকশা ঠিক করে রিকশায় উঠলাম । রিকশায় উনি আমার সামনে হাত দিয়ে অন্যপাশের হুড শক্ত করে ধরে বসলেন। কয়েকবার রিকশার প্রচন্ড ঝাঁকুনিতেও উনার হাতের জন্য আমি সেইফ ছিলাম। উনার এমন আচরণে আমার মস্তিষ্ক ও কিছুটা বুঝ মানতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর রিকশা একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে থামল। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, বড়লোকদের বাড়ীর মতই। কিন্তু উনার আচরণে কখনো আচ করতে পারিনি উনি এত বড়লোক বাড়ির ছেলে। যাই হোক, ভয়ে ভয়ে উনার পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়ির ভেতরটা বেশ মনোরম। উনি আমাকে বসতে বলে উপরে চলে গেলেন। ভয় আর অস্থিরতা আবারো ঝেকে বসেছে।
কিছুক্ষণ পর এক মাঝবয়সী সুন্দরী মহিলাকে সাথে নিয়ে নামলেন উনি। আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উনি বেশ হাসিমুখে আমার সাথে কথা বললেন। কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হল আমার আসাটা উনার বিরক্তির কারণ। খুব রহস্যময় লাগছে সবকিছু। একটু পরে আরো একজন মহিলা, আমার সমবয়সী দুইটা মেয়ে আমার সাথে পরিচিত হতে এলেন।
মোটামুটি সবার ব্যবহার আমার একটু ভিন্ন ঠেকলেও ভালোই লাগল। কেউ জিজ্ঞেস করল না, কেন এসেছি? কোথায় থেকে এসেছি? কতদিন থাকব? উনার চোখের ইশারায় আমাকে রিলেক্স থাকতে বললেন। মেয়ে দুজনের মধ্যে একজন আমাকে একটা রুমে নিয়ে আসল। মেয়েটা ভীষণ মিশুক আর বাচাল টাইপ। পুরো বাড়ির মধ্যে ওকেই আমার বেশ মনে ধরল। একটু রিলেক্সে বসতেই উনি এসে বললেন, আপনার তো কিছু খাওয়া হয়নি। আসুন খাবেন সবার সাথে।
চুপচাপ উনাকে ফলো করে খেতে আসলাম। খাওয়ার মধ্যে মহিলাটি বলল, তোমার সাথে তো সবার পরিচয় ই করাইনি। আমি তাসবীনের মা।
ও হল আমার বোন মানে তাসবীনের খালামণি। এ সানজানা আর সানজিদা। এরা দুজন আমার বোনের মেয়ে। তাসবীনের আব্বু এখন বাড়ীতে নেই, আসলে উনার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিব। এই বাড়ীতে থাকতে কোনো অসুবিধা হলে সবার আগে আমি বলবে কেমন।
আমি মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বললাম, আচ্ছা আন্টি।
মনে মনে ভাবলাম, এই তাসবীনটা কে?
নাস্তা শেষ করে সানজানাকে রুমে এনে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তাসবীন কে?

সানজানা কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম, হাসছো কেন এভাবে??
সে বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, যার সাথে এই বাড়ীতে এসেছো তার নাম জানোনা। ভাইয়ার নাম ই তো আহনাফ তাসবীন। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। উনি তো আমাকে কখনো উনার নাম ই বলেননি। জানব কি করে উনার নাম তাসবীন। সানজানা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
— কি ভাবছো?
— নাহ কিছু না তো।
— আমার ভাইয়াটা কিন্তু অনেক ভালো একটা মানুষ। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারেনা, আর আমাদের সব্বাইকে খুব ভালোবাসে।
— উনি আসলেই অনেক ভাল। কিন্তু উনি এখন কোথায়?
— ভাইয়া? সে তো এখন মনে হয় স্টাডিরুমে। একটু ফাক-ফোকর পেলেই টেবিলভর্তি বই নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে তো আমাকেও বলে তার সাথে পড়ার জন্য।
আমি তো বাবা তখন পালিয়ে বাচি।
মনে মনে উনাকে কেন জানি খুজছিলাম। শুনে একটু স্বস্তি লাগল। একটুপর উনি এসে এসে জিজ্ঞেস করে, কি লাগবে কিনা? ঠিক আছি কিনা। খুব ভালোই লাগছিল তার কেয়ারিংগুলো। কিন্তু এতগুলো ভালো থাকার মাঝে হঠাৎ আমার সাথে এমন কিছু একটা হবে আমি ভাবতে পারিনি। হয়তবা কল্পনা ও করিনি কখনো।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here