জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১১,১২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
এমন সাতপাচ চিন্তাভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। এই বাড়ীতে আসার পর দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছে। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা এত মধুর হয় জানা ছিলনা। বিকালবেলা বাবাকে নিয়ে হাটতে বের হলাম। বাবা হাটতে হাটতে বলল, জানিস মা, অনেকদিন পর বাসা থেকে বের হলাম। খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস সব যে কত ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবনা।
— এবার থেকে প্রতিদিন আমার সাথে তুমি বের হবে।
— সত্যি বলছিস?
লোকটার চকচক করতে থাকা চোখের দিকে বললাম, হ্যা বাবা। সত্যি বলছি, তবে একটা শর্তে কোনো অনিয়ম করা যাবেনা। রোজ রুটিনমত খাবার-ওষুধ খেতে হবে।
লোকটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, সব শুনব রে মা। শুধু তুই তোর বাবার কাছে থাকিস। ভাগ্যটা ভীষণ অদ্ভুত। এমন এক জায়গায় এনে দাড় করিয়েছে যেখানে দুটো মানুষের প্রাপ্তির হিসাব সমান। হঠাৎ করে লোকটা বুকে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়ল। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বাবা তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো!
বাবা বিছানায় শুয়ে আছে আর আমি আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ডাক্তার এসে একবার চেকআপ করে গেল। উনাকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করতে বারণ করে গেল, শরীর এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি উনার।
চুপচাপ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন জানি একটা মায়া কাজ করছে তার প্রতি। আংকেলটা ডাক্তার কে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে বলল,
— আমার মনে হয় ভাইয়ার একটু বিশ্রাম দরকার।
চল, আমরা তাকে একটু রিলেক্সে ঘুমাতে দেই।
আমি আরেকবার বাবার দিকে তাকালাম। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন, এখন তাকে একা রাখা উচিত। উঠে চলে এলাম, লামিয়াকে খোজার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলাম।
তখন কিছু টুকরো কথা কানে ভেসে আসে। আন্টিটা লামিয়াকে বলছে,
— এত আদিক্ষেতার কি আছে বুঝিনা! এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেবাযত্নে সুস্থ ও হয়েছে কোথায় চলে যাবে। তা না করে ঘাড়ের উপর চেপে বসেছে।
— উফফ মা। ত্বোহা কি নিজের ইচ্ছেতে এই বাড়ীতে আছে নাকি জেঠুর শরীর খারাপ বলেই তো!
— চুপ থাক। এইরকম মেয়েদেরকে আমার ভালোই চেনা আছে। সুযোগ পেলেই হল, বড়লোকের বাড়ী দেখেছে ওমনি লোভে চেপে বসেছে।
আর কি ত্বোহা ত্বোহা করছিস? এই মেয়ে মোটেও ত্বোহা নয়। আমার তো মনে হয় এই কোনো ডাকাতনী। তক্কে তক্কে আছে বড় দাঁও মারার আশায়।
— চুপ করো তো মা।
— উচিৎ কথা বললেই তোদের সহ্য হয়না। সেদিন ও আর বেশী দূরে নেই যেদিন বুঝবি আমার কথা কতটা সত্য।
যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ।
আল্লাহ সব নির্বোধ আমার কপালেই জুটিয়েছে।
এক মূহুর্ত আর ওখানে দাড়ালামনা। ছুটে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বালিশ জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম। কথাগুলো কাটার মত আমার গায়ে বিধছে। আমার তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই, কখনো কারো ক্ষতিও চাইনি তাহলে আমাকে সবাই কেন এত খারাপ ভাবে!
আমি বাবাকে না ঠকাতে চেয়েছি আর না এই বাড়ীতে থাকতে চেয়েছি! তাও কেন এত বাজে মন্তব্য শুনতে হচ্ছে।
পুরুষকন্ঠটি বলে উঠল,
— এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে চলে? আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এভাবেই ধের্য্যের পরীক্ষা নেন। সেটাকে ভয় পেয়ে পথ চলা বন্ধ করে দিলে আল্লাহ নারাজ হবেননা।
আমি তক্ষুনি উঠে বসে চোখ মুছে বললাম,
— কে? ঘরের অন্ধকার কোণা থেকে আওয়াজ এল।
— আমি।
— আপনি আবার কেন এসেছেন? কে আপনি?
কেন আমাকে এভাবে জ্বালাতন করছেন বলুন তো!
— শান্ত হন আপনি। এভাবে ভাঙ্গা রের্কডার মত চেচাবেন না তো।
— আমি ভাঙ্গা রেকর্ডার?? বাজে কথা বন্ধ করে বলুন কে আপনি? এখানে কি চান?
— সত্যি বললে ভয় পাবেন না তো!
— না পাবনা। বলুন আপনি।
— আমি একজন জ্বীন। আমার নাম সাদাফ।
শুনে আমার কেমন জানি হাতপা কাপতে লাগল। আমার কাছে জ্বীন কেন এল? তাসবীন কি এবার আমাকে মারতে জ্বীন পাঠাল? কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
— আপনি জ্বীন তাহলে আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? কেন এসেছেন?
— আমি কেবল আপনাকে সঙ্গ দিতে এসেছি। ভয় পাবেন না, আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতির আশংকা নেই। নির্ভয়ে থাকুন।
— আমার চাইনা কারো সঙ্গ। আপনি এখন আসতে পারেন। ভবিষ্যতে আমার আশেপাশে ঘেষার চেষ্টা করবেননা। আমি জ্বীন-টীন কাউকে বিশ্বাস করিনা।
— কিন্তু…
— দয়া করে আমাকে একা ছেড়ে দিন। চলে যান এখান থেকে। এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলাম। রুমটার বাতাস এখন অনেকটা হালকা লাগছে। বোধহয় জ্বীনটা চলে গেছে। তাসবীন শয়তানটার কথা মনে পড়তেই মাথার মধ্যে রাগটা ভীষণ চড়া দিয়ে উঠেছিল। কাউকে বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার। হবে ই বা কেন? তাসবীন ও আমার সামনে এমন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে এসেছিল আমাকে সঙ্গ দিতে। অনেক ভালোলাগা জন্মে গেছিল তার প্রতি, খানিকটা দূর্বলতা আর অগাধ বিশ্বাস জয় করে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে এরা কেন আমাকে আঘাত করতে আসে? আল্লাহ কি আমার কপালে ভালো কিছু কখনোই লিখে রাখেননি!
লামিয়া দরজায় কড়া নেড়ে ডাকল, ত্বোহা। দরজা অফ করে রেখেছিস কেন? চোখমুখ মুছে দরজা খুললাম।
— ডাকছিস যে?
— জেঠু উঠে গেছে। তোকে ডাকছে।
বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, কিরে ত্বোহা মা! তোর মুখটা এত শুকনো কেন?
— কই তেমন কিছুনা।
— শুন মা, জীবনে কোনোকিছুর সাথে আপোস করবিনা।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখবি। সবাইকে একরকম ভেবে ভুল করিসনা। বাবার কথাগুলো শুনে কেমন জানি খারাপ লাগতে শুরু করল। সাদাফ যদি তাসবীনের কেউ না হয়, তাহলে আমার এমন আচরণ করাটা খুব অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার! বিশ্বাসটা যে হারিয়ে ফেলেছি।
নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়।
লামিয়া পিছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরল। মূহুর্তে ভাবলাম হয়ত সাদাফ এসেছে। অস্ফুটস্বরে বললাম,
— আপনি এসেছেন? ও চোখ ছেড়ে আমার পাশে বসে বলল, কার কথা বললি?
— উহু কারো না। এত রাতে তুই ছাদে কেন?
— ঘুম আসছিলনা। তোর রুমে গিয়ে দেখি তুই নেই। তাই ছাদেই চলে আসলাম আড্ডা দিতে।
— ভালোই হল। একা একা বসে ছিলাম।
— আচ্ছা তুই সবসময় এত কি ভাবিস বল তো? বিএফ এর কথা নাকি?
— আরেহ না, আমার ওইসব নেই।
— বলিস কি! সত্যিই নেই?
তাহলে কাউকে পছন্দ করিস নিশ্চয়ই!
প্রতিউত্তরে চুপ করে রইলাম। পছন্দ তো একজন কে করেছিলাম, কিন্তু সে তার যোগ্য ছিলনা।
— তাও নাহ।
— এত বেরসিক তুই! না আছে বিএফ আর না আছে পছন্দের কেউ!
— উমম, তবে একটা উইশ আছে।
— কি উইশ?
— একটা জ্বীনকে বিয়ে করব। লামিয়া আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। একটু চমকে উঠে বলল, মজা করিস?
— মজা কেন করব? দাদীমা যখন আমাকে জ্বীনের ভয় দেখাত, তখন আমার কেন জানি উইশ হত আমার এক্লটা জ্বীনবর হবে।
— দূর, এসব আবার হয় নাকি?
— কেন হবেনা? দাদীমা আমাকে বলেছে জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়।
— আচ্ছা ম্যাম, আপনি জ্বীন পাবেন কোথায়?
উঠে দাঁড়িয়ে হাত ছোড়াছুড়ি করে বললাম, বনে-বাদাড়ে, পাহাড়-জঙ্গলে যেখানে তাহার হদিস পাই। বলে দুজন মিলে হাসতে লাগলাম। এমনসময় চোখ পড়ল মাধবীলতা গাছের পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে দেরী হল না এটা সাদাফ।
এখন যে করে হোক লামিয়াকে সরাতে হবে এখান থেকে। নতুবা, উনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।
— লামিয়া, অনেক রাত হয়েছে। চল, ঘুমাবি।
— তুইও চল।
— আমি একটু পরে যাব।
— সমস্যা নেই, তোর সাথেই নামব। আমার তো এখন ঘুম পাচ্ছেনা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। এভাবে তো ওকে তাড়ানো সম্ভব না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সন্দেহ করবে।
হঠাৎ চিলেকোঠার ছাদে জোরে ঢিল মারার শব্দ হল। এমন শব্দে লামিয়া ভয় পেয়ে গেল। আমার হাত টেনে বলল,
— শুন এত রাতে আমার ছাদে থেকে কাজ নেই। চল নিচে চলে যাই। আমার ভয় করছে।
— ভয় করছে কেন?
— মা বলে, আমাদের ছাদের পাশের আমগাছে নাকি ভুত আছে। এই তাকাস না ওইদিকে। চল না, নিচে চলে যাই।
— আচ্ছা চল।
আমি শুধু ওর পিছু পিছু দরজা অবধি গেলাম। এইটুকু গিয়ে ও আমাকে রেখে “ওরে বাবারে” বলে এমন ভৌ-দৌড় দিল যে আর পিছনে তাকালনা। আমি ওর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। তারপর মাধবী গাছের দিকে তাকিয়ে উনাকে খুজতে লাগলাম। ততক্ষণে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে খুজছেন?
— মোটেও নাহ।
— আচ্ছা তাহলে চলে যাচ্ছি।
— শুনুন, কালকের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আসলে
একটু মন খারাপ ছিল।
— আমি কিছু মনে করিনি।
কথা বলতে বলতে বেঞ্চিতে এসে বসলাম। উনি আমার থেকে অনেকটা দূরে বসলেন। খারাপ লাগল, কেন জানি মনে মনে চাচ্ছিলাম উনি আমার পাশে বসুক।
— আচ্ছা জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়?
উনি একটু চমকে উঠে বলল, হ্যা, কেন হয়না! ভালোবাসা আর বন্ধন পবিত্র হলে এসব কোনো বিষয় নয়। অবশ্য আমি কখনো হতে দেখিনি। শুনেছি এমনটা নাকি হয়!
আগেও হয়েছে বহুবার। শুনে মনে একটু আশা জাগল। কারণ, আমার যে ভীষণ ইচ্ছে একটা জ্বীনবর পাওয়ার।
— আপনি আমাকে আপনার চেহারা দেখাননা কেন?
— সময় হলে দেখবেন। আমরা জ্বীনেরা আবার বৈধতা ছাড়া চেহারা দেখাইনাহ।
— কিসের বৈধতা?
— সেটা নাহয় পরেই জানবেন।
হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি ব্যথা শুরু করল, চোখ দুটো ও জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। আমার খুব অল্পতে জ্বর বাধে। এসব তোয়াক্কা না করে ভরসন্ধ্যেবেলা শাওয়ার নিয়েছিলাম, চুলের পানিও নেইনি ঠিকমত। তার ফল বোধহয় এই অকালজ্বর।
উনি আস্তে করে বলল, শরীর খারাপ লাগছে?
আমি কিছু বলতে পারলামনা। উনি আলতো করে আমার কপালে হাত ছুয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আপনার তো জ্বর এসেছে। আমি আস্তে হুম করলাম। উনি তার কোল পেতে দিয়ে বলল, আমার কোলে মাথা রাখুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
কি এক ঘোরের মধ্যে উনার কোলে মাথা রাখলাম। উনি আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে তার ঠান্ডা হাত আমার কপালে বার বার ছুয়ে দিলেন। ভীষণ ভালোলাগছিল। মনে হচ্ছিল, সারাজীবন এভাবেই উনি আমার চুলে বিলি কেটে দিক।
কিন্তু অজানা এক আতঙ্ক আমাকে জড়িয়ে ধরল। তাসবীনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি উনার মধ্যে। উনিও আমাকে ওর মত ঠকাবেন না তো? আস্তে করে বললাম,
— সবাই আমার সাথে কেন এমন করে?
— ভালো মানুষের সাথে দুনিয়ায় সবসময় খারাপের ই দেখা হয়। তাই বলে ভালো মানুষটা খারাপ হয়ে যায়না। আল্লাহ সবাইকে একই মানসিকতা দিতে সৃষ্টি করেননি। অতএব, উনার উপর ভরসা রাখুন। বিপদে-আপদে উনার শরণাপন্ন হন। আর হ্যা, নিয়মিত নামায পড়বেন। মনের সব কথা মোনাজাতে আল্লাহকে বলবেন, দেখবেন কষ্ট কমে গেছে। নিজেকে হালকা লাগছে।
উনার কথাগুলো খুব ভালোলাগছে শুনতে। এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি, নামাযের ব্যাপারেও আলসেমি করেছি।
রাত জেগে নানান গল্প করলাম। সবি আমার ভালোলাগা, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে।
এভাবে সারারাত গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের ই পেলামনা।
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৪
পর্বঃ১২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি নিজের বিছানায় ঘুমাচ্ছি। ভেবে চমকে উঠলাম, আমি তো ছাদে ছিলাম উনার সাথে। এখানে আসলাম কখন? এটা নিশ্চয়ই উনার কাজ। শরীর এখন অনেকটা চাঙ্গা লাগছে।
ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা বিছানা থেকে নিচে পড়ে আছে। আতকে উঠে ছুটে গেলাম বাবার কাছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আছে বাবার। পালস ও পাচ্ছিনা ঠিকমত। জোরে জোরে চাচ্চুকে ডাকতে শুরু করলাম।
ডাক্তার বাবাকে দেখছে, আমি এককোণায় দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে কাদছি। মানুষটা দুদিন আগেও কত চঞ্চল,হাসি-খুশি ছিল, এখন কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।
ডাক্তার চাচ্চুর সাথে কিসব বলে চলে গেল। বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিল। আমি কাছে গিয়ে বাবার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
— তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো? বাবা টেনে টেনে বলল,
— নারে মা, তুই আমার কাছে আছিস। আমি এখন ঠিক ই আছি।
— কথা বলোনা বাবা। চুপ করে শুয়ে রেস্ট নাও।
কয়েকদিন ধরে তোমার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে।
— সেটা তো বুঝতে পারিরে মা। এখন আমার একটাই চিন্তা, আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে যাওয়ার আগে তোর বিয়েটা যাতে ঠিক মত দিয়ে যেতে পারি।
— এসব বিয়ে-টিয়ে কিছু দিতে হবেনা। আমার বাবা খুব তাড়াতাড়ি আবার সুস্থ হয়ে যাবে।
— বাবা হিসেবে তো কখনো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। এখন যদি বিয়েটা না দিতে পারি, আমি তো মরেও শান্তি পাবনা। বাবাকে এইটুকু অন্তত করতে দে।
চাচ্চু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এখনি বিয়ে ধরার কি আছে ভাইয়া? আগে তুমি সুস্থ হও। তারপর সেসব দেখা যাবে। এতবছর পর ত্বোহামণিকে কাছে পেয়েছো এখনি তাড়াতে হবে বুঝি!
— নারে ভাই, ও চলে গেলে বেশি কষ্ট আমার ই হবে। কিন্তু আমার ভীষণ ছটফট লাগে। শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে, ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে ত্বোহা মায়ের বিয়েটা দেখার সাধ আমার অপূর্ণ থেকে যাবে।
তাছাড়া, আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই যোগ্য কারো কাছে আমার ত্বোহা মায়ের দায়িত্ব দিয়ে। চাচ্চু একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
— সে ঠিক আছে। তুমি যা চাও তাই হবে।
আমি ত্বোহার জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করি তাহলে।
— হ্যা, শুভ কাজে দেরী করতে চাইনা। কি বলিস ত্বোহা মা!
আমি কিছু বলতে পারলামনা। চোরের মত পালিয়ে চলে এলাম। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিনা। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। আমি আসলে কি চাই সেটা আমিও বুঝতে পারছিনা, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিনা। এখন যদি না করি, তাহলে বাবা কষ্ট পাবে। উনার মেয়ে নাহলেও এতদিন বাবার স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন। চাচ্চুর সাথে কথা বলে দেখি উনি যদি পারেন এই ব্যাপারটা বাদ দিতে। রাতে চাচ্চুর ঘরে ঢুকার সময় শুনতে পেলাম। চাচ্চু বলছে,
— ভাইয়ের মাথায় এখন ভুত চেপেছে ওই রাস্তার মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। চাচীমা বলে উঠল,
— তো তুমি আটকালেই পারো!
— আটকানো কি এত সহজ? আমার তিল তিল করে সাজানো প্ল্যান টাই ভেস্তে দিল মেয়েটা। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ভাইয়ের ব্রেইন টিউমার এর জন্য ভাই এমনিতেই কিছুদিন পর দুনিয়া ছাড়বে। ভেবেছি তারপর মেয়েটাকে বিদায় করে দিয়ে ভাইয়ের সব সম্পত্তি নিজের আয়ত্বে আনব।
এখন যদি মেয়েটাকে বিয়ে দিই, ভাই মরার আগে সম্পত্তি মেয়েটা কিংবা তার স্বামীর নামে উইল করে দিয়ে যাবে। সেটা নাও করলে মেয়েটার স্বামী যদি বেশি চতুর হয়, সে এই সম্পত্তি দাবী করে বসবে। বিয়ে দিলে এই ঝামেলা, বিয়ে না দিলে ভাইয়ের প্যানপ্যানানি। টেনশানে আছি অনেক।
— আমি বলি কি! তুমি এমন একটা ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দাও যে বিয়ের পর মেয়েটাকে নিয়ে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবে। এইদিকে আর পা ও বাড়াবেনা।
— এমন ছেলে পাওয়া কি মুখের কথা!
— খুজে তো দেখতে পারো।
— আচ্ছা দেখি তাহলে। ভাই বড়জোর আর ২-৩সপ্তাহ বাচবে। এর মধ্যে বিয়েটা দিয়ে বিদায় করে দিলে এখানে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে মেয়েটার। ভাই ও উইল করার সময় পাবেনা।
— তুমি ই বেশি বেশি করেছো! কি দরকার ছিল মেয়েটাকে থাকতে বলার? ঝামেলা বয়ে আনার?
— তোমার মত মাথামোটার মাথায় এসব ঢুকবে না। ভাইয়ার উইলে বলা আছে ভাইয়ার সুস্থ মানসিকতায় স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হলেই কেবল তার পরিবার এই সম্পত্তি পাবে। নাহলে এসব এতিমখানায় দান হয়ে যাবে।
ভাইয়ার বন্ধু শালা নচ্ছার উকিলটা বুদ্ধি করে এমন শর্ত দিয়েছিল। নাহলে ভাইকে এতদিন বাচার সুযোগ আমি দিতামনা। ভাইয়ের পাগলামী কমাতেই তো মেয়েটাকে রাখা। যাতে মরে গেলে এটা প্রমাণ ভাইয়া মৃত্যুর আগে সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন ছিল।
কথাগুলো শুনে হঠাৎ নিজের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে, এক বাবাকে হারিয়ে আরেকটা বাবা পেয়েছি। আল্লাহ আমার থেকে তাকেও কেড়ে নিচ্ছে। আর এই মানুষগুলো তার কথা না ভেবে সম্পত্তি হাতানোর চিন্তা করছে। ছিঃ! এ নাকি আপন ভাই।
একজন মৃত্যুপথ যাত্রীর প্রতি এদের একটুও মায়া মমতা নেই। পশুর থেকেও জঘন্য এরা। কেউ একজন আমার পাশে বসে বলল, কাদছেন কেন?
চমকে উঠে পাশ ফিরলাম, সাদাফ বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম,
— আপনি কখন এলেন?
— ৫মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
— বাহ, সময়ের খুব ভালো হিসেব রাখেন।
— সবকিছুর ই রাখি। অন্ধকারে আপনার চোখের প্রতি ফোটা পানির ও। শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম।
উনি আবার বললেন, আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে জানালার দিকে তাকিয়ে কি এত ভাবছেন?
— তেমন কিছুই না।
— খুব আপসেট?
প্রতিউত্তরে চুপ করে রইলাম। ইমোশোনাল মোমেন্টে আমি মিথ্যে বলতে পারিনা। বললেও হাবভাব আর চোখ দেখেই যে কেউ বুঝে যাবে আমি মিথ্যে বলছি।
উনি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,
— আপনার মাথাটা একটু আমার কাধে রাখবেন?
উনার দিকে একবার তাকালাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এই মূহুর্তে যদি কোনো কাধে মাথা এলিয়ে দিতে পারতাম নিজের অশান্ত মনটা একটু শান্ত হত। মাথার ভেতরে চিন্তা নামক পোকাগুলো গিজগিজ বন্ধ হত। চুপচাপ উনার প্রশস্ত কাধে মাথা রাখলাম। সাথে সাথে আমার রুমের জানালাটা খুলে গেল। মিষ্টি বাতাস ঢুকে আমার সবটা ছুয়ে গেল। স্বস্তি লাগছিল তখন। উনি আস্তে করে বললেন,
— ওই যে রুপার থালার মত চাঁদ টা দেখছেন! ওই চাদের অনেক সৌন্দর্য আর জ্যোৎস্না থাকা সত্ত্বেও লোকে বলে তার কলঙ্ক আছে। তার গায়ের সামান্য কালো দাগ তার হাজার গুণ ছাড়িয়ে তাকে কলঙ্কিত আখ্যা দিয়েছে।
মানুষের চরিত্রটাও ঠিক এমন। অনেক ভালো গুণ থাকলেও একটা ছোট ভুল কিংবা খারাপ গুণ বড় ভাবে প্রকাশ হয়। তখন কেউ দেখেনা মানুষটা ভাল না সৎ।
আপনাকে নিয়ে হাজারজন হাজারটা কথা বলবে, কিন্তু আপনি নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। কেননা, আপনাকে আপনার চেয়ে ভালো কেউ চিনেনা। আপনি নিজেই যদি নিজেকে দোষী ভাবেন তবে অন্য মানুষগুলো আপনাকে নির্দোষ কি করে ভাববে বলুন!
আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম। হয়ত উনি ঠিক ই বলছে, বাস্তবিকতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ করে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়। যে মানুষদেরকে কখনো চিনতামনা, জানতামনা তারাই আমার নিজের হয়ে আছে। আমার জন্য যদি তাদের কষ্ট হয় আমি তো নিজেকে দোষী ভাবতে বাধ্য।
— আচ্ছা আপনি এটা বলতে পারবেন মনের সাথে যুদ্ধ করে কি করে জিতে যাওয়া যায়?
উনি মুচকি হেসে বললেন, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে জিততে পারবেন? ভিতরটাও আপনার আর বাহিরটাও আপনার। যুদ্ধে দুইপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি আপনার নিজের ই হবে। তাই মনের সাথে যুদ্ধ না করে বিবেকের আশ্রয় নিন। মনটা আবেগতাড়িত, তার নেওয়া সব সিদ্ধান্ত ই ঠিক হবেনা৷। এইজন্য মনের সাথে যুদ্ধে জিতে যাওয়া কেবল অনর্থ।
কয়েকটা জোনাক পোকা রুমে ঢুকে রুমটাকে আলোকিত করছে। মাঝে মাঝে আমার কপাল-গাল ছুয়ে যাচ্ছে। অজানা ভালোলাগায় আমি বার বার শিহরিত হচ্ছি। হঠাৎ বেফাসে বলে উঠলাম,
— বিয়ে করবেন আমাকে?
উনি একটু চুপ থেকে আমার দিকে ফিরলেন। তার ঠান্ডা দুহাত দিয়ে আমার দুগাল জড়িয়ে ধরে বললেন,
— বিবেক থেকে বলছেন নাকি আবেগ থেকে?
— জানিনা।
— হুম করব।
— কিভাবে?
— জানিনা। বড্ড অভিমান হল আমার। সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। উনি মুচকি হেসে আমাকে উনার বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। পরম শান্তিতে আমি চোখ বুজে অবশের মত তার বুকের সাথে লেগে রইলাম। হ্যা, হয়ত এটাই আমার পরম শান্তির আশ্রয়। এটাই আমাকে ভালো রাখবে।
আল্লাহ আমাকে বুঝার মত ঠিক সময় তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বাবা পাত্র আর বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলেছেন। মাত্র ২দিন পর ই আমার বিয়ে। তোড়জোড় আয়োজন চলছে, আমার অসুস্থ বাবাটা নিজে তদারকি করে বিয়ের সব আয়োজন করছেন। তার হাসিমুখটা দেখে শত কষ্টের মাঝেও স্বর্গীয় প্রশান্তি পাচ্ছি। এটাই হয়ত স্নেহের টান। যেখানে রক্তের মিল না থাকলেও ভালোবাসা একই থাকে।
কয়েকবার নিজের অমতের কথা বলতে গিয়েও বাবার স্বস্তিভরা মুখটা দেখে দরজা থেকেই ফিরে এসেছি। এই রৌদ্রজ্জ্বল মুখটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিতে বুকের গভীর থেকে বাধা পাচ্ছি। চুপচাপ নিয়তির খেলা দেখে যাচ্ছি। চোখের সামনে কল্পনা করছি, আমার অমতের কথা শুনে বাবার বিষন্নতায় ছেড়ে যাওয়া অসুস্থ মুখটা।
বিবেক যেন বার বার বলে উঠছে, এই মানুষটাকে তুই কষ্ট দিতে পারিসনা। তোর মুখপানে চেয়েই মানুষটা বেচে আছে এখনো। শেষ সম্বল যদি বেঈমানি করে উনি যে আর ভালোভাবে শেষ কয়টা দিন বাচতে পারবেনা।
তুই নিজেও আমৃত্যু অবধি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবিনা। সাদাফের কথামত মনের সাথে যুদ্ধে নামিনি, বিবেকের কথা ই মেনে নিয়েছি।
সেদিনের পর ৩-৪দিন সাদাফ আর আমার কাছে আসেননি। আসতে পারেননি নাকি আসতে চাননি সেটা আমি জানিনা। শুধু এইটুকু বিশ্বাস করে আছি উনি ঠিক সময় আমার সামনে হাজির হবেন আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করবেন।
এদিকে সময় যেন তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে। সে আমাকে একটু ফুসরত দিচ্ছেনা বিশ্বাসের জোর রাখার। প্রতিনিয়ত একটু একটু আশার আলো ক্ষীণ হচ্ছে।
লামিয়ার কথায় আমার হুশ ফিরল। আমাকে আয়নার সামনে এনে বসিয়ে বলল, দেখ নিজেকে। কেমন লাগছে তোকে? একপলকে আয়নায় পড়া নিজের অপরিচিত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিয়ের সাজ মেয়ের বহু আকাঙখিত সাজ। টকটকে লাল বেনারসী, ভারী গয়না, লালরঙ্গা মেহেদী আকা হাতে রাশি রাশি চুড়ি, চোখে-মুখে আলাদা সাজ, খুব যত্নে করা খোপায় অনেক লাল গোলাপের ঢল, টিকলি আর ঝাপড়ার উপর টেনে দেওয়া মসলিনের গর্জিয়াস ওড়না এসব মিলিয়ে সত্যি বউ বউ লাগছে। লামিয়া টিটকারী মেরে বলল,
— বউ সাজে যে তোকে এত সুন্দর লাগবে ভাবিনি। দুলাভাই না আজ ট্যারা হয়ে যায়। বলে হাসতে লাগল।
আমি ঠোট প্রশস্ত করে উপহাসের হাসিটা হাসলাম। বিয়ের কোনো আয়োজন ই আমার ভিতরটা স্পর্শ করছেনা।
এমনসময় বাবা আমার ঘরে এলেন। অপলক আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
— আমার মেয়েটাকে সত্যি আজ রাজরাণীর মত দেখাচ্ছে। তোকে ছোটবেলায় বলেছিলামনা রাজরাণীর মত করে বিয়ে দিব। আমি আমার কথা রেখেছি।
ত্বোহা!
— জ্বী বাবা।
— আমাকে কখনো ভুলে যাবিনা তো মা?
— বাবাকে কেউ ভুলতে পারে বলো! কখনোই ভুলবনা তোমায়।
— আমি মরে গেলে?
আমি টলমল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
— আমার থেকে আর কত লুকাবি বলো? আমি যে দুনিয়ায় কয়েকদিনের অতিথি এটা আমার অজানা নয়।
আমি শক্ত করে বাবাকে জাপটে ধরলাম,
— এসব কথা বলতে বারণ করেছিনা? কেন বলো এসব! আমার বাবাকে আমি কোথাও যেতে দিবনা।
— পাগলি মেয়ে আমার। বলে আমার কপালে একটা চুমু খেল। আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে বলল,
— আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি তোর নামে দিয়ে গেলাম।
আমার আর কোনো দায় নেই, এবার নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
আর ছেলেটা খুব ভাল বুঝলি। তোকে ভীষণ সুখে রাখবে।
বলে পাঞ্জাবির হাতায় ঝাপসা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
লামিয়া আমার মুখটা ছুয়ে বলল, কি হয়েছে তোর? মনমরা দেখাচ্ছে কেন? চলে যাবি বলে কষ্ট হচ্ছে!
আমি চুপ করে রইলাম। আমার মধ্যে কি চলছে সেটা কারো বোঝার সাধ্য নেই। চাচ্চু আর বাবা কাজী নিয়ে রুমে আসলেন। আমি এখনো অবধি সাদাফের জন্য অপেক্ষা করে আছি। শেষ আশা ও এক্ষুনি আসবে। এদিকে কাজী তাড়া দিচ্ছে কবুল বলার জন্য। আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম, মুখটা শুকনো হয়ে গেছে। বাবা বললেন,
— মা তোর কি এই বিয়েতে মত নেই?
কি বলব আমি বুঝে উঠতে পারছিনা। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি সে তো নেই। আর বিয়ে ভেঙ্গে কি হবে! মানুষটাও কত আশা করে আমার বিয়ে দিচ্ছে, তাকে কষ্ট দিলে আল্লাহ ও যে আমাকে ক্ষমা করবেননা।
চাচ্চু বলল, ও হয়ত বলতে লজ্জা পাচ্ছে। মা তোর এই বিয়েতে সম্মতি আছে? হ্যা বললেই চলবে।
নিজের ভেতরটাকে শক্ত করে বলেই ফেললাম, হুম।
মোনাজাত শেষ করে সবাই বেরিয়ে গেল। জানালার কার্ণিশ ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে এখন পানি পড়েনা, হয়ত সব অশ্রু শুকিয়ে গেছে। সাদাফ তার কথা রাখেনি, সেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আর কাউকে বিশ্বাস করবনা কখনো।
লামিয়া এসে বলল, তোর বরটাকে হেব্বি দেখতে। আমি তো ফিদা হয়ে গেলাম। আমি মুচকি হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। সে যেমন ই হোক, আমার কোনো আর্কষণ নেই। দায় সারাতে বিয়েটা করেছি, তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো পুরুষকেই আমি আমার পাশে মানতে পারছিনা।
বিদায়বেলা বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি এই অবস্থায় বাবাকে রেখে যেতে চাইলামনা। চাচ্চুকে মিনতি করলাম উনাদের যেন বুঝিয়ে বলে আজকের রাতটা আমি বাবার কাছে থাকতে চাই। বাবার পাশে বসে বসে ঢুলছি। অনেকটা সময় চেষ্টা করে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে লামিয়া এসে একবার ডেকে বলল, আমি জেঠুর পাশ্র আছি, তুই দুলাভাইয়ের কাছে যা। এখনো অবধি কেউ কারো মুখটা দেখিসনি। আমি এক কথায় বলে দিয়েছি,
— এখন বাবাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। অনেক বুঝিয়ে যখন কাজ হলনা, লামিয়া চলে গেল।
ডেকে বললাম, উনাকে বলিস ঘুমিয়ে পড়তে। আমি আজ বাবার কাছে থাকব।
দুই-তিন দিন ঘুম হয়নি তার উপর সারাদিন বিয়ের এত ধকল চোখ ঘুমে ফেটে যাচ্ছে। বাবা জেগে উঠলে যদি কিছু লাগে এইজন্য ঘুমাচ্ছি ও না। বসে বসে চোখ বুজে ঢুলছি।
এমনসময় টের পেলাম ঘরে কেউ ঢুকল। ঘুমের জন্য চোখ মেলতে পারছিলামনা, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
মিষ্টি পুরুষকন্ঠে কেউ আমাকে সালাম দিল। চোখ মেলে দেখতে চাইলাম সে কে! কিন্তু মেলে রাখতে পারছিনা।
— আপনার তো অনেক ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ুন।
বাবার কাছে আমি থাকি। কথা দিচ্ছি সর্বোচ্চ খেয়াল রাখব।
বুঝতে দেরী হলনা উনি আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী।
— ধন্যবাদ, তার প্রয়োজন নেই।
আমি আছি এখানে। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আর যদি বসতে হয় বসুন।
— আপনার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমি যাচ্ছি, বাবার দিকে খেয়াল রাখবেন। আর নিজের দিকেও।
মানুষটা কে এভাবে কতদিন এড়িয়ে যেতে পারব জানা নেই। কাল আমাকে এখানে রাখবেও না, আবার এক দমকা হাওয়ায় অন্য জায়গায় ছিটকে পড়ব।
সকালে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবার শরীর একটু ভালো এখন। চাচ্চু তাড়া দিচ্ছে তৈরী হওয়ার জন্য, আমরা একটুবাদেই বের হব। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। বাবার পা ছুয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরলাম,
— নিজের খেয়াল রেখো। সময়ে সময়ে আমাকে আমাকে খবর জানিও। শরীর বেশি খারাপ লাগলে আমি চলে আসব।
— পাগলি মেয়ে আমার।
এখন বাবাকে নিয়ে এত ভাবিসনা, নতুন একটা সংসারে যাচ্ছিস। সবাইকে ভালো রাখিস। বলে কপালে একটা চুমু একে দিলেন। উইলটা নিয়ে বাবার চোখ এড়িয়ে চাচ্চুর কাছে গেলাম। চাচীও ছিল সেখানে। চাচা-চাচীকে সালাম দিয়ে চাচ্চুর হাতে উইল টা দিয়ে বললাম,
— এগুলো আমার লাগবেনা।
অধিকারের ভিত্তিতে এসব তোমার পাওনা। আমার বাবাটার খেয়াল রেখো শুধু। চাচ্চু আর চাচীমা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়ত ভাবেনি এমন কিছু আমি করতে পারি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম।
বরপক্ষের লোকজন কম। শুধু বরের বোন এসেছে সাথে।
বোন পিছনে বসে আমাকে তার ভাইয়ের সাথে বসিয়ে দিল।
খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার। জেদ করে তাকাচ্ছিও না উনার দিকে। কিন্তু বুঝতে পারছি উনি ঘন ঘন আমার দিকে তাকাচ্ছেন। রাগ করে বলে ফেললাম,
— এতবার তাকানোর কি আছে?
ঠিকমত ড্রাইভিংটা করুন। দেখার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে।
উনি বলে ফেললেন,
— আগে জানতাম কাদলে মেয়েদেরকে শাকচুন্নির মত লাগে। আপনাকে কাদলে বেশ ভালোই লাগে, ইচ্ছে করে আরো কয়েকটা চিমটি দিয়ে কাদাই।
উনার কথা শুনে এত রাগের মধ্যে আরো কেরাসিন পড়ল। রাগীচোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, কাদলে বলেছি রাগলে সুন্দর লাগে বলিনি।
আমি চুপচাপ বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লামিয়া একটুও মিথ্যে বলেনি আসলেই ছেলেটা সুদর্শন, লম্বা আর বাকপটু। একটা মেয়েকে আর্কষিত করার জন্য যা যা থাকা দরকার সব ই আছে। কিন্তু আমার মনটা সাদাফের কাছেই পড়ে আছে। ও আমাকে ঠকিয়েছে জেনেও ওর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।
গাড়ি থামলে বরের বোন আমাকে সবিনয়ে গাড়ি থেকে নামায়। বাড়ীটার দিকে তাকালাম সত্যিই বাবা তার মেয়েকে রাজরাণী সাজিয়ে রাজপ্রাসাদেই পাঠিয়েছেন।
পিছন থেকে উনি ডাকলেন, এই যে আমার লাল টুকটুকে বউ এত বড় ব্যাগ নিয়ে এসেছেন, আমি তো এর লোড নিতে পারছিনা। আসুন হাতে হাত লাগান।
আমি ভেঙ্গচি কেটে বললাম, মাংসল শরীরটা কি শুধু মেয়ে পটানোর জন্য বানিয়েছেন? একটু কাজে লাগান এখন।
— ও আমি তো ভুলেই গেছি এক আটার বস্তা আরেক আটার বস্তা কিভাবে নিবে! আচ্ছা সমস্যা নেই, আমি একাই পারব।
সাহারা তুই তোর ভাবীকে ভিতরে নিয়ে যা।
— আমি আটার বস্তা? আমাকে কোন দিক দিয়ে আপনার আটার বস্তা মনে হয়? নিজে কি জানেন সেটা! লইট্টা শুটকি কোথাকার।
সাহারা হাসতে হাসতে বলে উঠল, ভাইয়া আসতে না আসতে ভাবীর পিছনে লাগা শুরু করলে? তুমি আর বড় হবানা।
সাহারা আমাকে নিয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকল। বাড়ির পরিবেশটা কেমন থমথমে। বোঝা ই যাচ্ছে মানুষজন বেশী নেই। একটু পরে দুইজন মহিলা নেমে আসল। একজন আমার নানীশ্বাশুড়ী আর একজন আমার শ্বাশুড়ী। ভীষণ মিশুক তারা। নানীশ্বাশুড়ী আমাকে গলায় ছোট হার পড়িয়ে দিয়ে বললেন, বাহ, পরীর মত নাতবউ পেয়েছি আমি।
উনি পিছন থেকে টিপ্পনী কেটে বললেন,
— দেখ আমার ক্রেডিট!! তোমার নাতী জ্বীনের মত সুন্দর বলেই তার মত পরী হয়েছে। জ্বীন শব্দটা শুনে ভিতরটা কেমন ফুলে-ফেপে উঠল রাগে। এই শব্দটা কি হাসিঠাট্টার বিষয়! নিজেকে শান্ত রেখে উপরে চলে এলাম।
সাহারা একটা মনোরম সুন্দর রুমে ঢুকিয়ে বলল, এটা ভাইয়ার রুম। আজ থেকে এটা তোমাদের রুম। তুমি এখন শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিছু লাগলে ডেকো।
আমি মাথা নেড়ে দরজা ভেজিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এতক্ষণের খারাপ লাগা টা ক্রমশ বাড়ছে। আমার স্বপ্নগুলো কেন সবসময় এভাবে ভেঙ্গে যায়! আল্লাহর কি ইচ্ছে সেটা আমি জানিনা, য়বে এই জীবনের সাথে আমাকে মানিয়ে চলতে হবে।
.
(চলবে)