জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৪

0
2110

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৪
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

দরজা লক করে এসে শুয়ে রইলাম। অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এতকিছুর মধ্যে আল্লাহর অসীম কুদরতে নিজের বাবাকে ফিরে পেয়েছি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। অতীত জেনে আর কি হবে! আপন বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সব পেয়েছি, নতুন একটা জীবন পেয়েছি আর ভীষণ ভালো স্বামী।
প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরও উনি সামান্যতম খারাপ ব্যবহার কিংবা যত্নের ত্রুটি করেননি। আর আমি সাদাফের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। তার সাথেই অকারণে খারাপ ব্যবহার করেছি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল। সাদাফ যা করেছে, তার জন্য নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দায় থাকবে। কিন্তু আমি জেনেবুঝে যা করছি, তার জন্য আমার ও কম দায় থাকবেনা। একজন নির্দোষ মানুষকে অকারণেই কষ্ট দিচ্ছি।
নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সাদাফকে ভুলে এখন উনার সাথে আমার নতুন জীবন শুরু করা উচিত। নিজেকে আর বিবেকের কাছে ছোট করতে চাইনা।
দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম। পুরো বাড়ী তন্নতন্ন করে উনাকে খুজলাম। কিন্তু কোথাও পেলামনা। উনি কি তাহলে আমার উপর রাগ করে চলে গেছেন? হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। লামিয়া আমাকে এমন অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ নাকি?
— উহু, তোর দুলাভাই কি চলে গেছে?
— নাহ তো। উনাকে তো একটু আগে ছাদের দিকে যেতে দেখলাম। এত করে বললাম সারাদিন কিছু খাননি, কিছু একটা খেয়ে নিন। কিছুতেই খেতে রাজী হলনা। একটা কথা তুইও সারাদিন কিছু না খেয়ে আছিস। স্বামী হয়ে তোকে ফেলে কি করে খাবেন উনি!
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। যা তুই উনাকে ডেকে নিয়ে আয়। দুজন একসাথে খাবি। তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছিস।
আমি দুহাত দিয়ে চোখ মুছে ছাদের দিকে ছুটে গেলাম। আজ আকাশটা চাদের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় ভরে আছে। অনেক সুন্দর বাতাস বয়ছে, ছাদবাগানে বোধহয় বেলীফুল ফুটেছে। চারিদিক বেলী ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। ছাদের ঝাড়বাতিগুলো আজ জ্বালানো হয়নি, তাই আবছা অন্ধকার। ছাদে উঠে উনাকে খুজতে লাগলাম এদিক সেদিক। হঠাৎ চোখ পড়ল রেলিং ঘেষে দাঁড়ানো প্রতিবিম্বটা। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমি আপনাকে সারাবাড়ী খুজে বেড়াচ্ছি। আসলে আমি ভীষণ দুঃখিত। বুঝতেই পারছেন, বাবার মৃত্যু যেকোনো মেয়ের কাছেই ভয়ংকর শোকাবহ। এভাবে বাবা হারিয়ে মানসিকভাবে একটু ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাই নিজের অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।
এতকথা বলে একটু চুপ রইলাম। উনি ফিরেও তাকাচ্ছেননা, কিছু বলছেন না।
— আপনি কি বেশী রাগ করেছেন?
— ত্বোহা! কন্ঠটা শুনে গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। উনার কন্ঠটা অন্যরকম লাগছে কেন? আর উনি তো আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকেননা। তবে এটা কি উনি নয়?
— কে?
— চিনতে পারছোনা? আমি সাদাফ। বিস্মিত হলাম কিন্তু বুঝতে না দিয়ে বললাম,
— ওহ! কি মনে করে এখানে এসেছেন? দেখতে আমার বিয়ে হয়েছে কিনা? নাকি আমি আপনাকে না পাওয়ার শোকে মরেছি কিনা?
— ত্বোহা, সবসময় কেন মন দিয়ে চিন্তা করো?
— এখন মন দিয়ে কিছুই চিন্তা করিনা, সব বিবেক দিয়ে চিন্তা করি। আর আপনি এসবের কি বুঝবেন? বিশ্বাসঘাতকতা করে কোন মুখে আবার আমার সামনে এসে দাড়িয়েছেন বলুন তো! দেখতে চান, কতটা ভালো আছি?
আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনার মতো বেঈমানের থেকে অনেকগুণ ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছি। আল্লাহ ঠিকসময় আমাকে সবার আসল রুপটা দেখিয়ে দিয়েছে।
— তাহলে আমাকে আর চাওনা?
— চাওয়ার সময় যখন পাইনি, এখন আর চাইনা। চলে যেতে পারেন এখান থেকে। আপনাকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, আর কখনো সামনে না আসলে খুশি হব।
— কিন্তু আমাকে তো তোমার সামনে বার বার আসতে হবে।
— মানে!
হঠাৎ করে ছাদের সব ঝাড়বাতিগুলো জ্বলে উঠলে। সাদাফ আমার দিকে ফিরে জ্যাকেটের হুড সরিয়ে ফেলল। অবাক হয়ে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। তাও আমতা আমতা করে বললাম,
— আপনি!
— হুম, তোমার বিয়ে করা স্বামী।
— এসবের মানে কি!
— মানে খুজছো বোকা মেয়ে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বিয়ে করব। আর আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়েছি সে যেভাবেই হোক।
কাদতে কাদতে সাদাফের গায়ে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক। এতগুলো দিন আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। একটাবার বললে কি হত যে আপনি সাদাফ!
— তাহলে তো জানতে পারতামনা ত্বোহা আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।
অভিমানের স্বরে বললাম, উহু ভালোবাসিনা। এমন মানুষগুলো ভালোবাসা যায়না।
— ভেবে বলছো তো?
— নাহ।
— লাল টুকটুকে বউ আমার। বলে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, আমি আমার জ্বীনবর পেয়ে গেছি। সাদাফ নিজের হাতে আমাকে খাইতে দিল। তারপর আমার কোলে তার মাথাটা এলিয়ে দিল, আমি তার চোখে-মুখে-চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সারারাত গল্প করলাম। রাতটা স্বপ্নের মত কেটে গেল।
আল্লাহ এতদিনে আমার ডাক শুনেছেন, সব কষ্ট-দুঃখ দূর করে দিয়ে সুন্দর একটা জীবন দিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে সাদাফ আমাদের ব্যাগ গোছাতে লাগল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিগো, ব্যাগ গোছাচ্ছো যে? আমরা কোথায় যাব?
— আমার লাল টুকটুকে বউটার আরেকটা শ্বশুড়বাড়ি আছে। সেখানে যাব, মাকে দেখাবনা তার ছেলের বউ দেখতে কেমন হয়েছে!
— আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
— যেতে যেতে সব বলব। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও তো। ভেবে নিলাম, ও যেহেতু জ্বীন। ওর নিজস্ব কোনো পরিবার আছে। আর সে পরিবারের কাছেই আমাকে নিচ্ছে।
কিন্তু কথা হল, তাহলে এরা কে?
আস্তে আস্তে সব জিজ্ঞেস করে নিব ভেবে রেডি হয়ে গেলাম। মা, নানুমণি আর সাহারা থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। অবাক ব্যাপার, কেউ একবারো জিজ্ঞেস করলনা আমরা কোথায় যাচ্ছি! তাহলে তারাও কি জানে সাদাফ জ্বীন। গাড়িতে উঠে সাদাফের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমাকে ব্যাপারটা খুলে বলো তো।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
— রিলেক্স। সব বলব।
আসলে ওরা আমার রক্তের কেউ ই নয়। আমার পালিত মা বলতে পারো, আমার মা যখন ছোটবেলায় জ্বীনরাজ্যের কাজে ব্যস্ত ছিল তখন মায়ের বিশ্বস্ত মানুষ্য বোন ই আমাকে লালনপালন করেছেন। তবে উনি ছাড়া আর কেউ ই জানেনা আমি জ্বীন।
— তাহলে তুমি তোমার আসল মায়ের কাছে কেন থাকোনা?
— মা তো জ্বীনরাজ্যের কাজেই ব্যস্ত থাকেন প্রায়সময়। আর আমার উপর আদেশ আছে আমাকে জ্বীনরাজ্য পরিচালনা করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তাই মায়ের আদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়।
এসব তুমি বুঝবেনা। তুমি এখন জ্বীন পরিবারের একজন সদস্য। পরিবারটাকে নিজের ভেবে আগলে রেখো, এইটুকুই তোমার কাছে চাওয়া।
আর মাকে কখনো কষ্ট দিওনা। মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, দেখবে তোমাকেও অনেক ভালোবাসবে।
ভাবনায় পড়ে গেলাম। সাদাফের মা কি সত্যি আমাকে মেনে নিবে তার ছেলের বউ হিসাবে? মানুষ বলস অবজ্ঞা করবে না তো।
গাড়ি এসে বাড়ীর সামনে থামল। গাড়ী থেকে নেমে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল এই বাড়ীতে আমি আগেও এসেছি। আবছা আবছা ভাবে মনে পড়ছে। সাদাফ আমাকে ডেকে বলল, কি দেখছো? এটাই আমার আসল বাড়ী।
চলো ভেতরে চল। সবার সাথে দেখা করবে।
চুপচাপ ওকে অনুসরণ করে বাড়ীতে ঢুকলাম। ঢুকেই সাদাফ তার মাকে জড়িয়ে ধরল। শ্বাশুড়িমাকে দেখে আমার চক্ষুচড়ক। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— উনি তোমার মা?
— হ্যা, সালাম করো। মা, এই হচ্ছে তোমার বউমা। না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। জানি তুমি রাগ করবেনা।
উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, তাসবীনের মা কি করে সাদাফের মা হয়? তবে কি ওরা… ভাবতে ভাবতে তাসবীন চলে এল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
পরে আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সাদাফের সাথে কোলাকুলি করল।
সাদাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ হচ্ছে আহনাফ তাসবীন। আমার বড় ভাই। আমার পুরো নাম সাদাফ তাশবীহ। নামের মত সব কিছুই মিল আমাদের।
আমি তো ভাইয়ার কলিজা টুকরা।
খালামণি আর মিষ্টি দুটো বোন ও আছে আমার। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে এরা আমাকে চিনেই না। আজ ই প্রথম দেখছে।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সব কেমন জানি গুলিয়ে যাচ্ছে। সাদাফ যদি তাসবীনের ভাই হয় তবে কি সাদাফ ও একজন শয়তান? তাসবীন শয়তান হলে ও জ্বীন পরিবারের সদস্য হয় কি করে! আর আমাকে মারতে চাওয়ার পিছনে ওর উদ্দেশ্য ই বা কি থাকতে পারে।
সবটা কেমন জানি এলোমেলো লাগছে। সব সূত্র মিলাতে হবে আমাকে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলাম। সাদাফ মা-ভাইদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here