জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৫

0
2130

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

উপরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি ঠিক জানিনা সাদাফের রুম কোনটা! এখন সাদাফের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করার আছে? এর মধ্যে সানজানা আমার কাছে আসল। আমার ব্যাগটা নিয়ে বলল, এসো৷ ভাবী তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ সানজানাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ও একটা রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বলল, এটা তোমাদের রুম। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, এটা তো তাসবীনের রুম। যেখানে আমি আগে এসেছিলাম।
— সানজানা এটা তো তোমার তাসবীন ভাইয়ার রুম। এখানে কেন আমরা থাকব?
— খালামণি এই রুমে তোমাদেরকে থাকতে বলেছে।
— সানজানা, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছোনা?
— পারবনা কেন! তুমি তো এর আগে তাসবীন ভাইয়ার সাথে এই বাড়ীতে এসেছিলে।
— তাহলে কথা বললেনা কেন? ওমন না চেনার ভান করেছিলে যে?
— সবাই একটু রাগ করেছিল তোমার উপর। তুমি একা একটা মেয়ে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে, তাসবীন ভাইয়া তোমাকে পাগলের মত খুজেছে জানো। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরে নিয়েছিলাম, তুমি ইচ্ছে করেই পালিয়ে গিয়েছো। সেই থেকেই সবার রাগ তোমার উপর।
এইজন্য ই আমি সবার সামনে চুপ ছিলাম। খালামণির সামনে কিছু বললে রাগ করত হয়ত।
— তাসবীন আমাকে খুজেছে?
— হ্যা, অনেক খুজেছে। তোমাদের এত ভাল বন্ডিং দেখে তো আমরা মনে করেছিলাম তাসবীন ভাইয়া ই হয়ত তোমাকে বিয়ে করবে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।
কিন্তু তুমি তাশবীহ ভাইয়াকে কোথায় পেলে?
এতদিন কোথায় ই বা ছিলে?
— সময় করে সব বলব। তোমার থেকে আমার অনেককিছু জানার আছে। তুমি সময় করে আমার কাছে এসো।
আর এসব ব্যাপারে তোমার তাশবীহ ভাইয়া কিংবা কাউকে কিছু বলোনা। এমনসময় দেখি সাদাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে গেলাম, ও কিছু শুনতে পায় নি তো। এগিয়ে এসে বলল, ত্বোহা।
— হ্যা বলো।
— ভাবী আর ননদের দেখি খুব ভাব হয়ে গেছে। একা একাই গল্প করলে, আমাকে একবারো ডাকলেনা।
আমি যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম। সাদাফকে এই মূহুর্তে সবকিছু খুলে বলা উচিত হবেনা। ও ওর পরিবারকে খুব ভালোবাসে। অনেক কথা ই সে বিশ্বাস করবেনা, উলটো আমাকে ভুল বুঝবেনা।
— ও কিছুনা। তুমি ফ্রেশ হবেনা?
— হ্যা, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। মা আজ আমার পছন্দের খাবার রান্না করছে। আমার তো তর সয়ছেনা। তুমি মায়ের কাছে যাও, টুকটাক সাহায্য করো। দেখবে মা খুব খুশি হবে।
আমি সাদাফের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, কত সরল ছেলেটা। তার ভাই কি করে শয়তান হয় সেটাই ভাবার বিষয়।
— আচ্ছা সাদাফ, তোমার পরিবারের সবাই ই কি জ্বীন?
— হ্যা, তাসবীন আর মা জ্বীন। বাবা ও ছিলেন, কিন্তু তিনি তো অনেক আগেই মারা গেছেন।
তুমি তো জানো, জ্বীনদেরকে মানুষের সাথে মানুষরুপেই বাস করতে হয়। আমরাও সেরকম ই। খালামণিরা আমাদের কেউ হয়না, ওরা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সানজানার বাবা আমার বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। উনি মারা যাওয়ার পর মা ওদেরকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু উনারা জানেনা আমরা জ্বীনবংশ।
অবাক হয়ে চিন্তা করলাম, এত প্যাচ এখানে। এই বাড়ীর লোকগুলোর শিরায় শিরায় রহস্য। কিন্তু তাসবীনের মা আমাকে বলেছিলেন, তাদের বাবা ব্যবসায়ের কাজে বাহিরে আছেন। আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলেন? এর পিছনে কি কারণ থাকতে পারে!
— আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
আমি নিচে যাচ্ছি।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি শ্বাশুড়িমা রান্না করছেন। আমি গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, মা, আমি আপনার সাথে হাত লাগাই?
— তুমি এসেছো? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
ছেলেটা এতদিন পর বাসায় ফিরল তো, তাই ওর পছন্দের রান্না করছিলাম। এর মধ্যে সুযোগ ও পাইনি তোমার সাথে দেখা করে আসব।
— মা, আপনারা সবাই কি সত্যিই জ্বীন?
উনি বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যা মা। আমি জ্বীনবংশের সর্দারনী ছিলাম। এক গন্ডগোলের জন্য জ্বীনরাজ্য ছাড়া হলাম। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে মানুষের দুনিয়ায় আশ্রয় নিলাম।
এখন এই দুই ছেলে ই আমার শেষ সম্বল। আমরা এখানেই ভালো আছি।
— আগেরবার এসেছিলাম তখন আপনি কিংবা তাসবীন কেউ ই বলেননি আপনার আরেক ছেলে আছে।
— বলার সুযোগ পাইনি বোধহয়। আমার এই ছেলেটা অনেক ভ্রমণপ্রিয়। বেশিরভাগ সময় ওর ভালো মার কাছেই থাকে। ওকে নিয়ে ওর বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ওকে জ্বীনরাজ্যের সর্দার বানাবে। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খারাপ জ্বীনদের সাথে ওর লড়াই করতে হয়, বিভিন্ন ভালো জ্বীনের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এইজন্য বেশিরভাগ সময় ও বাহিরে বাহিরে থাকে। তাসবীন ই আমার কাছে থাকে ওর অবর্তমানে। যখন ও ও কাজে থাকে, তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগে একা একা।
— ওহ আচ্ছা।
— তোমাকে আমার ভীষণ ভালোলেগেছিল। ভেবে রেখেছিলাম আমার তাসবীনের বউ করব তোমায়। কিন্তু তুমি যে কোথায় চলে গিয়েছিলে! তাসবীন তোমাকে পাগলের মত খুজেছিল।
একপর্যায়ে ভেবেই নিয়েছিলাম, তুমি হয়ত জেনে গিয়েছো আমরা জ্বীন। তাই পালিয়ে গিয়েছো। একটা আফসোস রয়ে গিয়েছিল যে, হয়ত জ্বীনের সাথে মানুষের কখনোই মিল সম্ভব নয়।
কিন্তু আল্লাহ আমার মনের খায়েশ ঠিকি পূরণ করেছে। আমার আদরের তাশবীহর বউ করে আমার ঘরে পাঠিয়েছে। আল্লাহর কি অসীম কুদরত বলো! পারবে তো মা আমাদের পরিবারটাকে নিজের পরিবার মনে করে আগলে রাখতে? জ্বীন বলে মনে মনে দূরে সরিয়ে রাখবে না তো!
— এসব কি বলছেন মা? আমি সব জেনেশুনেই আপনার ছোটছেলেকে গ্রহণ করেছি। ইনশা আল্লাহ এই পরিবারকে আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব।
— আল্লাহ তোমার ভালো করুক মা।
আমার মনের দ্বিধা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। তাসবীন যদি শয়তানের উপাসনা করে থাকে, তবে মা আর সাদাফ কেন টের পাচ্ছেনা? আর আমাকে মারতে গিয়ে মারলনা, তারপর আবার পাগলের মত খুজল। আসল রহস্যটা কি এখানে!
মাথা হ্যাং হয়ে গেছে এসব ভেবে। মাথা ঠান্ডা করার জন্য গোসল করে নিলাম। চুল মুছতে মুছতে ব্যালকুনিতে পায়চারী করছিলাম। এমনসময় কারো গলা ঝাড়ার আওয়াজ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালাম। তাসবীন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভিতরে আসতে পারি?
আমি মাথায় ঘোমটা টেনে বললাম, আপনি এখানে?
— আপনার সাথে কথা বলতে এলাম।
— কিন্তু আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। পরে কথা বলি ভাইয়া?
— হঠাৎ মাথা ধরল কেন? আমি কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিব? মূহুর্তে বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি আমার ভাসুর। আপনাকে আমি আর আমার স্বামী বড় ভাই হিসেবেই সম্মান করি। অতএব, এমন কিছু বলবেন না কিংবা করবেননা যাতে আমাদের চোখে আপনি ছোট হয়ে যান।
তাসবীনের চোখ কেমন ছলছল করছিল। আমার কথায় হয়ত বড় আঘাত পেয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— দুঃখিত, অযাচিত কথা বলে ফেললাম।
আসলে আগে করেছিলাম তো। তাই আর কি..
আর এক মূহুর্ত ও উনি দাড়ালনা। দ্রুত বেরিয়ে গেল। মনে হল উনি নিজের চোখের পানি আড়াল করতে চাইল।
সবকিছু কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে। সেই আগের মত মোলায়েম স্বাভাবিক আচরণ যা দেখে তার প্রতি আম মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখন নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই তাসবীন ই সেরাতে আমাকে মারতে এসেছিল!

রাতে শ্বাশুড়িমা আমার ঘরে এলেন। দরজায় কড়া নেড়ে বললেন, বউমা, আসব?
আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে মাথায় কাপড় টেনে বললাম, আসুন মা। অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল!
— তোমারো তো সুবিধা-অসুবিধা থাকতে পারে তাইনা। যাই হোক, তোমার জন্য কিছু শাড়ি আর গয়না এনেছিলাম। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা!
— আপনি ভালোবেসে দিয়েছেন, অপছন্দ হতে পারে! মায়ের সব ই পছন্দের হয়।
— লক্ষী বউমা আমার।
তাশবীহ এখনো ফিরেনি?
— বলল তো তাসবীন ভাইয়ার সাথে বের হচ্ছে। কিছু কেনাকাটা করবে নিজের জন্য।
— তাহলে নিশ্চিন্ত থাকো। তাসবীন ওকে নিজের চেয়েও বেশী ভালোবাসে। দুইভাই যখন একসাথে থাকে, আমি খুব নিশ্চিন্ত থাকি। কারণ জানি তাসবীন নিজের সবটুকু দিয়ে হলেও ভাইকে আগলে রাখবে।
মনে মনে ভাবলাম, তাসবীন কি সত্যিই এমন নাকি এসব তার মুখোশ মাত্র!
— বউমা।
— হ্যা মা, বলুন।
— তোমার কাছে একটা অনুরোধ ছিল।
— কি অনুরোধ মা?
— যতটা বুঝেছি তোমাদের মধ্যে এখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেদের মত সময় কাটানোর সুযোগ পাওনি তুমি।
— হুম।
— অনুরোধ হল এটাই, তাশবীহ জ্বীনরাজ্যের সর্দার না হওয়া অব্ধি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক করোনা।
— কেন মা?
— তাহলে এতদিন ধরে ওর অর্জিত সমস্ত শক্তি সব বিনষ্ট হয়ে যাবে। ওর বাবার স্বপ্ন আর পুরণ হবেনা। আমি এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দিতে চাইনি, কিন্তু আল্লাহর হুকুমে হয়ে গেছে। যখন তুমি বাড়ীতে এলে, ভাবলাম হয়ত আমাদের আশা-ভরসা সব শেষ। পরে তাশবীহ থেকে জানলাম তোমাদের সম্পর্কটা এতদিন স্বাভাবিক ছিলনা।
এখন তুমি আমার অনুরোধ টা রাখো।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, আচ্ছা মা। আপনি যা চান তা হবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here