জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
কিছু বলার আগেই সাদাফ জ্ঞান হারায়। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলামনা। সাদাফের এই অবস্থা কে করল?? মেঝেতে কারো রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সাদাফের রক্ত মাড়িয়ে যাওয়ার কারণে পায়ের ছাপ গুলো স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। ভীষণ জেদ চেপে গেল, যে সাদাফের এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ছাড়বনা। আমি পায়ের ছাপটা অনুসরণ করলাম, পিছু নিয়ে দেখি ছাপগুলো তাসবীনের ওয়াশরুম পর্যন্ত আছে। ওয়াশরুমের ভিতর থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে, ভেতরে কেউ আছে। বুঝতে বাকি রইলনা সাদাফের উপর কে আক্রমণ করেছে। আমি সাদাফের কাছে ফিরে এলাম, ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। নিজে কেমন জানি অসহায় লাগছে। চিৎকার করে মাকে ডাকলাম, মা এসে সাদাফের এই অবস্থা দেখে কান্না জুড়ে দিল। বিলাপ করে বলতে লাগল, কোন জ্বীন আমার সাদাফের এই অবস্থা করে,ছে? আমার ছেলে কার কি ক্ষতি করেছিল!
আমি সব বুঝেও চুপ করে রইলাম। তাসবীন এমনটা করতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। কিন্তু নিজের চোখকে এতবার ভুল বলতে পারছিনা। আচ্ছা তাসবীন এখন কোথায়? এত হট্টগোল শুনে তো ওর আসার কথা। ও কি ওয়াশরুম থেকে এখনো বের হয়নি!
সাদাফের শরীরের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। আল্লাহর রহমতে আঘাত অত গুরুতর হয়নি, আপাতত জ্ঞান ফেরার পর ব্যথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মা কেও বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। নিজের কাছে ও ক্লান্ত লাগছে। চুপচাপ বেরিয়ে তাসবীনের রুমের সামনে এলাম। মেঝের দিকে খেয়াল করে দেখলাম, একটাও পায়ের ছাপ নেই। সব যেন কেউ সুন্দর করে মুছে নিয়েছে। তাসবীনের রুমের দরজাও পুরো খোলা, ভিতরে ঢুকলাম। আজ তাসবীনকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, কেন? কি কারণে? ও এসব করেছে। কি চায় ও?
পুরো রুম খুজে দেখলাম তাসবীন কোথাও নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে ও কোথায় উধাও হল? নাকি সাদাফকে মরার প্ল্যান করে পালিয়ে গেল?
সময় যত যাচ্ছে তত যেন সবকিছু রহস্যময় হয়ে উঠছে। যত সমাধান করতে যাচ্ছি, তত যেন গোলকধাধার অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।
তাসবীনকে অনেক খোজার পর না পেয়ে নিজের রুমে ঘুমাতে চলে এলাম। সাদাফের জন্য খারাপ লাগছে, এমন এক অবস্থা ওর পাশে থাকতেও পারছিনা। কাল সকালে সাদাফকে জিজ্ঞেস করে নেব, ওর উপর আক্রমণ কে করেছিল? আর তাসবীন থেকে সব রহস্যের উত্তর আমি বের করেই ছাড়ব।
সকালে উঠে সাদাফের কাছে গেলাম। ও অনেকটা সুস্থ, তবে চোটের ব্যথা এখনো রয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম,
— তোমার শরীর কেমন এখন?
— হ্যা, ভাল।
— উঠে বসতে পারবে? তোমাকে ওষুধটা খাইয়ে দেই, ব্যথা কমে যাবে। আর একটু স্যুপ এনেছি খেয়ে নিলে ওষুধ দিব।
সাদাফকে সাবধানে উঠে বসালাম। হেলান দেওয়ার জন্য পিছনে একটা বালিশ দিয়ে দিলাম। সামনে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললাম, খেয়ে নাও।
সাদাফ ডান হাত নাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যথার জন্য হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে, তার উপর ব্যান্ডেজ বাধা। তাই ঠিকমত চামচ ধরতে পারছেনা। এই অবস্থা দেখে বললাম,
— আচ্ছা আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি তো পারছোনা।
ও চুপ থেকে সম্মতি দিল। অতি যত্নে ওকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছিলাম। খেতে খেতে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমার চোখে চোখ পড়তেই আড়াল করার চেষ্টা করল।
— সাদাফ!
— হুম।
— তোমার কি বেশী কষ্ট হচ্ছে?
— না তো।
— তাহলে কাদছো কেন?
— কই এমনিতে।
— একটা সত্যি কথা বলবে?
— কি কথা?
— কাল রাতে তোমার উপর কে আক্রমণ করেছিল?
সাদাফ চুপ করে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
— আমি জানিনা ত্বোহা। আমি তাকে দেখিনি, অন্ধকারে আঘাত করেছিল আমাকে।
বুঝতে পারলাম, সাদাফ আমার কাছে স্বীকার করতে চাচ্ছেনা। এইজন্য মিথ্যে বলছে। কেননা, আমি ওর গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনে সাথে সাথে এসে দেখি রুমের আলো জ্বালানো। ও কি তাসবীনকে বাচানো চেষ্টা করছে?
যদি করেও থাকে, তবে কেন? কাল সকালেও তো সাদাফ সামান্য ব্যাপার নিয়ে তাসবীনের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে।
আর আজ এতবড় কাহিনীতেও তার টনক নড়লনা। সাদাফকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, যতবার জিজ্ঞেস করব ও মিথ্যে বলেই এড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে যা জানার সব তাসবীন থেকে জেনে নিব।
আমি তাসবীনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু অবাক ব্যাপার ও সারাদিন বাড়ী ই ফিরলনা। কোথায় আছে সেটাও জানিনা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কিছু বললেননা।
এই ব্যাপারে উনাকে চিন্তিত মনে হলনা অত। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম, মা, তাসবীন ভাইয়া কি কোনো কাজে গিয়েছেন?
— কাজ না ঠিক। ওর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। তাকেই আনতে পাঠিয়েছি। জানো, মেয়েটাকে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। ভাবছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বিয়ে দিয়ে দিব। আমার ঘরটা পরিপূর্ণ হবে। কি বলো?
আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আপনি যা ভাল বুঝেন মা।
তাসবীন বিয়ে করবে ভেবে কেমন জানি একটু খারাপ লাগল। জানিনা কেন আমার এমন ফিল হচ্ছে।
চোখের সামনে এত প্রমাণ পেয়েও আমার মনে হচ্ছে তাসবীন নির্দোষ।
সন্ধ্যার দিকে তাসবীন ফিরল সাথে একটা অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছে চেহারা থেকে নূর ঠিকরে পড়ছে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর একটু হেসে দিয়ে বলল,
— আপনি তাশবীহ ভাইয়ার স্ত্রী তাই তো? আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম। তারপর তাসবীনের দিকে তাকালাম। ওকে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে। হয়ত এই বিয়েতে ওর সায় আছে।
সাদাফের এমন অবস্থা শুনে তাসবীন পাগলের মত ছুটে এল। সাদাফের কপালে চুমু খেয়ে বার বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ডাক্তার ডেকে আনল।
আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি নিখুত অভিনয় জানে তাসবীন! যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য ওর মত ছেলে কখনো খারাপ কাজ করতে পারেনা। তাসবীনকে যে প্রশ্নগুলো করব ভেবে রেখে ছিলাম করতে পারলামনা।
ওকে একটিবারের জন্য ও একা পেলামনা। মেয়েটি আঠার মত সর্বক্ষণ ওর সাথে লেগেই ছিল।
এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি আমার হিংসে লাগল। কেন জানি তাসবীনের পাশে ওকে সহ্য করতে পারছিলামনা। আমি এমন করছি কেন? আমার তো স্বামী-সংসার সবি আছে তাও কেন আমি তাসবীনকে আকড়ে ধরে আছি। আর তার চেয়ে বড় কথা হল তাসবীন একজন শয়তান। যে নিজের স্বার্থে ঘা লাগলে ভাইকে মারতেও দ্বিধাবোধ করেনা।
রাতে মেয়েটি আমার দরজায় কড়া নাড়ল। আমি ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
— মাইশা।
— ওহ, তুমি! এসো ভেতরে এসো।
— দুঃখিত ভাবী, তোমাকে বিরক্ত করতে চলে এলাম।
— আরেহ না। বিরক্ত কেন হবে? তোমার সাথে তো ঠিকমত আলাপ ই হলনা। ভালোই হল, তুমি এলে।
— ভাবী, তুমি আর তাশবীহ একসাথে থাকোনা?
— না, মায়ের নিষেধ আছে।
— উনার শরীর কেমন এখন? রাতে খেয়েছেন?
— আগের থেকে কিছুটা ভালো। না এখনো খাবার নিয়ে যাইনি আমি। ও বোধহয় ঘুমাচ্ছে, একটুপরেই যাব।
— আচ্ছা।
— তুমিও কি কোনো জ্বীন?
মেয়েটা মুচকি হাসল। তারপর একটু থেমে বলল,
— কেবল তুমি মানুষ হয়েও একটা জ্বীনবর পেয়ে গেলে। তুমি কত সৌভাগ্যবতী বলো।
— হয়তোবা।
সাদাফের ওষুধ আর ডিনারের সময় হয়ে গেছে। আমি খাইয়ে দিয়ে আসি।
— ভাবী আমি নিয়ে যাই।
— আরেনা, তুমি কেন নিবে!
— নিজের প্রিয়বন্ধুর একটু সেবা করতে সাধ জাগল। নিয়ে যাব?
আমি একটু ভেবে বললাম, আচ্ছা নাও।
ও সাদাফের রুমের দিকে যেতেই আমি লুকিয়ে তাসবীনের রুমে চলে এলাম। এই একটা সুযোগ তাসবীনের সাথে নিরিবিলি একটু কথা বলার।
তাসবীনের দরজায় কড়া নাড়লাম। ও দরজা খুলে আমাকে দেখে কোনো কথা না বলে ভিতরে চলে গেল। আমিও পিছু পিছু ঢুকে বললাম, তাসবীন।
— জ্বি বলুন।
— আপনি মনে হয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
— এড়িয়ে যাব কেন? আপনি তো আমার শত্রু নন।
— ওহ আচ্ছা। কাল কোথায় ছিলেন?
— রাতে মাইশাকে জ্বীনরাজ্য থেকে আনতে গিয়েছিলাম।
— আপনাদের দুজন কে কিন্তু বেশ মানায়।
— ধন্যবাদ।
তাসবীনের কথাগুলো কেমন খাপছাড়া। ও বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাও জিজ্ঞেস করলাম,
— সাদাফের এমন অবস্থা হল কি করে জানতে চাইলেননা যে?
— সাদাফকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও কিছুই বলেনি।
হয়ত মনের দিক থেকে খুব চাপে আছে। সময় দিন, সাপোর্ট দিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি আর কোনো কথা খুজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কি এখন খেয়ে নিবেন?
— মাইশা কোথায়? ও আসুক, একসাথে খাব।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। একদিন আগেও যে চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম, আজ তাতে তার ছিটেফোটা ও নেই।পরক্ষণে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, তাতে আমার কি! সে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, উপযুক্ত কাউকে খুজে নিয়েছে এখানে আমার আপত্তি কিসের। ভালো থাকুক ও।
আমিও সাদাফকে নিয়ে ভালো থাকব।
রাতে খাওয়ার পর সব গুছিয়ে কিচেন থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম তাসবীন সিড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে। এত রাতে ও উপরে যাচ্ছে কেন? উপরে তো মা আর আমার রুম।
মা তো সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাহলে ও যাচ্ছে কার কাছে? চুপি চুপি ওর পিছু নিলাম। মা আর আমার রুম পেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝলাম ও অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে স্টাডি রুমের সামনে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে স্টাডি রুমের দরজা খুলল। এতদিন আমি এই স্টাডি রুমের কথা ভুলে ছিলাম! এখানেই হয়ত সব রহস্যের সমাধান আছে।
কিন্তু তাসবীন এখানে কেন ঢুকল! ও কি গুপ্তঘরে যাওয়ার জন্য এসেছে? আস্তে আস্তে উকি মারলাম দরজার ফাক দিয়ে। যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, তাসবীন গুপ্তঘরে ঢোকার সুইচে চাপ দিল। ভিতরে ঢুকে পড়ার পর দরজা বন্ধ করলনা। হয়ত নিশ্চিন্ত হয়ে ঢুকেছে এখন কেউ এদিকে আসবেনা। দেরী না করে আমিও স্টাডি রুমে ঢুকলাম। বইয়ের তাকের পিছনে বসলাম যেখান থেকে ওকে ভালোভাবে দেখা যায়। ঘাপটি মেরে রইলাম ও কি করে দেখার জন্য।
ও অনেকগুলো মোম জ্বালিয়ে এর মাঝখানে বসে পড়ল। একটা বাটি সামনে রেখে পকেট থেকে ছুরি বের করে হাতে জোরে চেপে ধরল। আমি আতঙ্কিত হয়ে একটু নড়ে বসতেই তাক থেকে দুই-তিনটা বই মেঝেতে পড়ে গেল। তাসবীন সেটা টের পেয়ে উকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল, ততক্ষণে আমি আরেকটু কোণায় গিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম।
ও চোখের ইশারায় গুপ্তঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম ও হয়ত উঠে আসবে, আর আমি ধরা পড়ে যাব। এই অবস্থায় উঠে যাওয়া হয়ত বারণ তাই আসতে না পেরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
এই সুযোগে আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে রুমে এসে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লাম। একটু পরে টের পেলাম কেউ দরজা সরিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি জানি তাসবীন আমাকে সন্দেহ করছে, আর ও আসবে যাচাই করতে।
একটুপর দরজা টেনে দেওয়ার শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম। দিনের আলোর মত সব পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। এইবার শুধু প্রমাণ করার পালা।
.
(চলবে)