জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৯

0
2081

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৯
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

রুমে শুয়ে বালিশে গুজে কাদতে লাগলাম। কি কপাল নিয়ে এই দুনিয়ায় এসেছি! জন্মের পর থেকে শুধু দুঃখ ই পেয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ বোধহয় সব কষ্ট আমার ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন। সবকিছু ভুলে যখন তাসবীনকে ভালোবেসে পানিতে ভাসা খড়কুটোর মত আকড়ে ধরে বাচতে চেয়েছি, সে আমাকে ধোকা দিল। বাবাকে তো পেয়েও হারালাম, আর সাদাফকে বিশ্বাস করে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছি আজ সেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।
কাকে বিশ্বাস করব আমি! আর পারছিনা এভাবে বাচতে। এই জীবন থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো। আল্লাহ তুমি আমাকে এভাবে তিলে তিলে আর কষ্ট দিওনা, এরচেয়ে একেবারে মেরে ফেলো। অসহ্য লাগছে জীবনটা।
হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে উঠে বসলাম। তাসবীন আমার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— কাদছো কেন?
— এমনিতে।
— দেখো ত্বোহা, দুঃখ আল্লাহ তাকেই বেশি দেয় যাকে উনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আর তুমি যদি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করে নিজের জীবন শেষ করতে চাও, তাহলে তোমার চেয়ে বড় বোকা আর নেই।
আমি রেগে গেলাম। একজন শয়তান উপাসকের মুখে আল্লাহর গুনগান ভীষণ বেমানান লাগছে। যে নিজেকেই খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনা, আল্লাহর বিরুদ্ধে চলে তার মুখে আল্লাহর গুনগান বড্ড অহেতুক। রাগান্বিত কন্ঠে বললাম, আপনার বলা শেষ হয়েছে? এবার আসতে পারেন।
— ত্বোহা, এমন করছো কেন?
— আপনাকে চলে যেতে বললামনা, প্লীজ চলে যান।
আপনার মত শয়তানের কোনো সহানুভূতি আমার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমার সাথেই আছেন, আমি যথেষ্ট শক্ত একটা মেয়ে। তাই এত সহজে ভেঙ্গে পড়ে আপনার মিষ্টি কথায় ভুলে যাবনা। আসুন তাহলে।
তাসবীন মনমরা হয়ে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল। আমাকে সহানুভূতি দেখাচ্ছে? কারো সহানুভূতি কিংবা ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই। কাউকে বিশ্বাস করিনা আমি। বলে বেডটেবিলের সবকিছু হাত ছুড়ে ফেলে দিলাম।
তারপর কাদতে কাদতে মেঝেতে বসে পড়লাম। বাবাকে খুব মিস করছি, অন্তত বাবা আমাকে কখনো ঠকাতনা। পাশে থেকে ঠিক কষ্ট ভুলিয়ে দিত। বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রুমেই শুয়ে রইলাম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মরার মত শুয়ে আছি। সাদাফ আমাকে ডাকতে ডাকতে রুমে এল।
এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
— শরীর খারাপ তোমার?
— খারাপ হলে তাতে কি?
— মানে? দুপুরেও খেলেনা, সারাদিন রুমের কোণায় পড়ে রইলে। কি হয়েছে? মন খারাপ? বাবার কথা মনে পড়ছে?
আমি চোখ তুলে সাদাফকে একনজর দেখে নিলাম। এখনো কি নিখুত অভিনয় করে যাচ্ছে আমার সাথে!
প্রমাণ করতে চাইছে সে আমার ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ। কিন্তু আসল সত্যিটা জানার পর এসব দেখে হাসছি। কতই না বোকা ভাবে আমাকে সবাই?
— কি হল ত্বোহা? চুপ করে আছো যে!
— আমাকে একা থাকতে দাও। যাও এখান থেকে।
— তোমার কি হয়েছে না বললে তো যাবনা। ত্বোহা বল না।
আমি আর ওর এসব ন্যাকামি নিতে পারছিনা। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
— আমাকে ঠকালে কেন সাদাফ?
সাদাফ বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়ত বুঝতে পেরেছে আমি কি বলতে চাচ্ছি! কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যেতে উদ্ধত হল। আমি ওর হাত টেনে বললাম, উত্তর না দিয়ে তুমি কোথাও পালাতে পারবেনা। আমাকে সঠিক উত্তরটা দাও।
সাদাফ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি কাউকে ঠকাইনি। বরং নিজেকে ঠকিয়েছি আর বারবার ঠকেছি।
— তুমি কি অস্বীকার করতে পারো মাইশার সাথে তোমার অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক নেই?
ও মাথা নিচু করে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। খানিকক্ষণ পর শান্তশিষ্ট অনুতপ্ত মুখের খোলস ছিড়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
— তুমিও কি অস্বীকার করতে পারো তাসবীন ভাইয়ার সাথে তোমার এমনি অবৈধ ভালোবাসা ছিলনা!
আমার টা যদি অবৈধ হয় তবে তোমারটাও অবৈধ ছিল।
এখনো তুমি ওর প্রতি দুর্বল, ওকে নিয়ে ভাবো। এটা কি অস্বীকার করতে পারবে! তোমার নিজের চরিত্র ই নোংরা, তুমি আমায় নিয়ে কোন সাহসে মন্তব্য করো?
আমি সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতগুলো কথা কঠিনভাবে জঘন্য ইঙ্গিতে বলতে ওর একটুও বাধলনা। এই ওর আসল রুপ!!
এসব বলে সাদাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে লাগলাম। কানে সাদাফের কথাগুলো অনবরত বেজে যাচ্ছে।হাটতে হাটতে বাসার অদূরে বড় খাদের কিনারায় চলে এলাম। আর একপা এগোলেই বড় খাদের অতলে তলিয়ে যাব। বেচে থাকাটা বৃথা মনে হচ্ছে। তাই নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেওয়ার চিন্তা করছি।
এমনসময় কেউ আমাকে টেনে নিয়ে আসল। আমি অবাক হয়ে বললাম, মা আপনি!
— কি করতে যাচ্ছিলি? আরেকটু হলে তো বেঘোরে মারা পড়তি। তোর কি হয়েছে মাকে বল।
— মা আমি বার বার ঠকে যাচ্ছি। আর পারছিনা এভাবে বাচতে। মা চুপ করে শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমার কাছে হয়ত আর কিছু লুকানো উচিত হবেনা। তোমাকে সব সত্য বলার উপযুক্ত সময় এসে গেছে।
— কিসের সত্য মা?
— আমি নিজেও জানি, তাসবীন একজন শয়তান উপাসক জ্বীন। অনেকবার চেষ্টা করেও ওকে এই পথ থেকে ফেরাতে পারিনি। ও সবার ক্ষতি করতে ব্যস্ত। তুমক যে সাদাফকে ভুল বুঝছো তার পিছনেও তাসবীন দায়ী। ও সাদাফের রুপ ধরে এসব করছে, আর তুমি সাদাফকে ভুল বুঝে যাচ্ছো।
আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তার মানে, সাদাফের কোনো দোষ নেই। যা হচ্ছে সব তাসবীনের প্ল্যানেই হচ্ছে। ও এভাবে আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।
মা চোখ মুছে বলল, নিজের চোখের সামনে দুই সন্তানের এমন ভবিষ্যত দেখেও কিছু করতে পারছিনা। হতভাগী মা আমি। এভাবে চলতে থাকলে তাসবীনের হাতে পুরো জ্বীনসাম্রাজ্য চলে আসবে। ও সেই চেষ্টা করছে আর অনেকটা সফলের পথেও।
— এসব বন্ধ করার কি কোনো উপায় নেই মা?
— আছে। সেটা হল তাসবীনের মৃত্যু।
আমি আতকে উঠলাম। তারপর আবার বললাম,
— এসব কি বলছেন মা?
— হ্যা, এটাই সত্য। ও শয়তানের সন্তুষ্টি লাভ করে ফেলেছে, এখন যদি ওকে থামানো না হয় তবে ও পুরো পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে। এক্ষুনি ওকে না আটকালে না জানি ও কত লোকের সর্বনাশ করবে।
— তাই বলে ওকে মেরে ফেলে!
— মা হয়ে এটা আমার কাছেও ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু বুকে পাথর বেধে এই কথাগুলো আমাকে বলতে হচ্ছে। নিজের কোল ঠিক রাখার জন্য, অন্য মায়েদের কোল আমি ফাকা করে দিতে পারিনা।
আমি চুপ করে রইলাম। মা একটু থেমে আবার বলতে লাগল, তাসবীনকে মারার কাজটা একমাত্র তুমিই করতে পারবে।

আমি আতকে উঠে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা আমার এমন এক্সপ্রেশন দেখে কাদো কাদো মুখ করে বলল,
— তোমাকেই এই কাজটা করতে হবে।
তাসবীন যাকে বেশি পছন্দ করে, যার প্রতি প্রচন্ড রকমের দূর্বল একমাত্র সে ই তাসবীনকে হত্যা করতে পারবে।
— এই কাজ আমি করতে পারবনা মা।
— তুমি কি চাও না আমার ছেলেটা শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পাক? নাকি চাও আরো অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হোক! আমি ওর মা হয়ে চরম কষ্টটা মাথা পেতে নিচ্ছি।
তুমি কেন পারবেনা?
ত্বোহা মা, এখন সব তোমার কাছে। যা করতে চাও, তাই করো। ভালো-মন্দ বুঝে নাও।
আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। তাসবীন এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আমি এটা মানতে পারছিনা। যাকে একবারের জন্য হলেও ভালোবেসেছি তাকে নিজের হাতে কি করে মারব!
কিন্তু ওকে না মারলে পুরো দুনিয়ায় ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে।
ভাবতে ভাবতে দেখি তাসবীন আমাদের খুজতে খুজতে এখানে চলে এসেছে। মা বলল,
— ঘাবড়িয়োনা। এই সুযোগ ওকে শেষ করে শয়তানী থেকে মুক্তি দেওয়ার। বলে আমার হাতে একখানা ছোরা তুলে দিলেন। আমি ওইটা হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
তাসবীন আমাদের কাছে এসে বলল,
— তোমরা এখানে কেন?
আমি তো খুজে খুজে হয়রান। মা-ত্বোহা চল একসাথে খাব। আজ আমি তোমার পছন্দের সব রান্না করেছি মা। আমার কান্না পাচ্ছে, এই তাসবীনকে মোটেও আমার শয়তান মনে হচ্ছেনা। মা ফিসফিস করে কাদো কাদো স্বরে বলল,
— আর কোনো উপায় নেই আমাদের হাতে। এক্ষুনি ওকে মারতে হবে। আজ শয়তান ওকে বর দিবে বলে কথা দিয়েছে। একবার যদি ও বর পেয়ে যায় তবে আর কিচ্ছু করার থাকবেনা। আমার হাত কাপছে ভীষণভাবে। এটা কখনোই পারবনা আমি। তাসবীন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কত কথা বলে ফেলছে। ভীষণ মায়া লাগছে।
— তাসবীন।
— হ্যাঁ।
— আমি তোমাকে খুন করতে যাচ্ছি।
ও বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কান্না করতে করতে বললাম, ক্ষমা করে দিও আমায়।
বলে ছুরিটা ওর পেট বরাবর ধরলাম। তাসবীন একবার আমার দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকাতে লাগল।
— কেন খুন করবে আমায়?
— এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।
তাসবীনের চোখ ছলছল করছে। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কাদছি। আমি পারছিনা ছুরি দিয়ে ওকে আঘাত করতে। ভীষণভাবে হাত কাপছে আমার।
এমনসময় মা আমার হাত ধরে জোরে ছুরিটা তাসবীনের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তাসবীন পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, আমি পাথরের মত অবশ হয়ে এই দৃশ্য দেখছি। কেন জানি চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তাসবীন ছলছল চোখে মাকে বলে,
— মা, দোয়া করো। আল্লাহ যেন আমাকে এর উত্তম প্রতিদান দেন। কথা শেষ না করতেই মা তাসবীনকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেয়।
তারপর চিৎকার করে কাদতে কাদতে বলে, আল্লাহ তুমি আমাকে কি পরীক্ষা ফেললে! আমার ছেলেটাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।
আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছি, তাসবীনের রক্ত এখনো আমার হাতে লেগে আছে। কাপতে কাপতে অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে যাবে।
আমারো কি মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে???
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here