জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২৪
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মন থেকে তাসবীনের চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলাম। মেনে নিচ্ছিলাম ছেলেটি তাসবীন নয়, আরাফ। সবকিছু সহজ ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছি। যে চলে গেছে সে আর ফেরার নয়। তাসবীন ও আমার কাছে আর কখনো ফিরবেনা।
এখন আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য শয়তানগুলোকে শেষ করা। না পারলে হয়ত ওদের হাতেই আমার মৃত্যু হবে।
আমি জীবন থেকে আর কিছুই আশা করিনা, যা ছিল সব ই হারিয়েছি। নতুন করে আর কিছুই চাইনা।
বিকালে আসর নামায শেষ করার পর মাইসা এসে ডাকল,
— ত্বোহা বুবু, তোমার নামায শেষ?
— হ্যা, কিছু বলবে?
— জ্বীনহুজুর তোমাকে তলব করেছেন। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে চল।
মাইশার কথা শুনে হিজাব জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাদাফ-মাইশা একে অপরের হাত ধরে সামনে সামনে হাটছে। সাদাফের আস্তে আস্তে বলা কথা শুনে মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে গায়ের উপর ঢলে পড়ছে মাইশা, সাদাফের কাধে মুখ লুকাচ্ছে, শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরে সাদাফের কাধের উপর মাইশা তার মাথাটা এলিয়ে দিল। দুজনকে মাশা আল্লাহ খুব সুন্দর মানিয়েছে। দেখতেও খুব ভালোলাগছে ওদের এত মিষ্টি খুনসুটিগুলো।
নিজের ভেতরে কেমন খারাপ লাগা ফিল হচ্ছে। আজ যদি সবকিছু ঠিক থাকত আল্লাহর চাহে আমার আর তাসবীনের বিয়ে হত। সাদাফ-মাইশার মত একটা ছোট্ট সংসার হত, সেখানেও এমন দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি হত। নিজের করা ভুলের জন্য সব হারিয়েছি, সারাজীবন এটার মাশুল দিতে হবে আমাকে। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল।
ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে জমে থাকা পানি কখন যে নাকের ডগায় গড়িয়ে পড়ল টের পেলামনা। তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হলাম।
পথে বেশ কয়েকজন জ্বীন দেখলাম। মাশা আল্লাহ সবারই কম-বেশি নূরানী চেহারা। কারো হাল্কা খোচা দাড়ি, কারোবা স্বল্প ছাড়া দাড়ি। সাদা জোম্বায় দেখতে অনেক পবিত্র লাগছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাইশা দুষ্টুমি করে বলল, ত্বোহা বুবু, কাউকে পছন্দ হয় নাকি?
— উহু, কেউ ই তাসবীনের মত নয়।
জ্বীনহুজুরের আস্তানায় ঢুকে তাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বসতে বলে মোনাজাত ধরলেন। আমি চারিপাশটা একবার দেখে নিলাম। আরাফকে কোথাও দেখলামনা, হয়ত ও এখানে অনুপস্থিত। ও যত আমার চোখের আড়ালে থাকবে, ততই ভাল।
জ্বীনহুজুর মোনাজাত শেষে আমাদের সামনে এসে বসলাম। গোটাকয়েক খোরমা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
— নাও খাও।
খেজুরগুলো দেখতে অপেক্ষাকৃত সাধারণ খেজুর থেকে বড়, গাঢ় কালো রঙ্গের। মাইশা আমার হাতে দিয়ে বলল,
— খাও বুবু। একটা মুখে দিতেই বুঝলাম এই খেজুরের স্বাদ তুলনাহীন। এমন খেজুর আমি জীবনেও খাইনি।
জ্বীনহুজুর গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন,
— ত্বোহা, তোমার জ্বীনরাজ্য হতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। তোমার খুব শীঘ্রই এই রাজ্য ত্যাগ করা উচিত।
খাওয়া বন্ধ করে বললাম,
— কখন ফিরতে হবে?
আবার কি সেই প্রবেশদ্বার দিয়েই যেতে হবে?
— সন্ধ্যের আগেই। শুনো, এই জ্বীনরাজ্যে প্রবেশ করা যতটা কঠিন, ফিরে যাওয়া ততটাই সোজা।
তুমি প্রস্তুতি নাও, এখান থেকে ফিরে তোমাকে শয়তানদের মুখোমুখি হতে হবে। লড়াই করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে।
আশা করছি, এই জ্বীনরাজ্যের সম্পদ জ্বীনি তলোয়ার তুমি সহীহ হেফাজতে ফিরিয়ে দিতে পারবে ইনশা আল্লাহ।
— আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। আপনি শুধু দোয়া করবেন।
— অবশ্যই। ফটকের বাহিরে আরাফ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও তোমাকে এখান থেকে তোমার জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সহায়ক সঙ্গী হিসেবে থাকবে।
শয়তান দের শেষ করে তবে থেমো।
জ্বীনহুজুরের পায়ে ধরে সালাম করে বেরিয়ে আসলাম। সাদাফ-মাইশা আমাকে জ্বীনরাজ্যের প্রধান ফটক অবধি এগিয়ে দিল। যাওয়ার সময় মাইশা জড়িয়ে ধরে বলল,
— নিজের খেয়াল রেখো এবং বিজয়ী হও দোয়া করি।
সাদাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— জানিনা আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে কিনা। সবসময় দোয়া করি ভালো থাকো। আর আমি যা করেছি তার জন্য অবশ্যই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
তবে তোমার সাথে জ্বীনদের যে সম্পর্ক হয়েছে, তা আজীবন অটুট থাকবে ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।
ফি-আমানিল্লাহ।
আমি তাদেরকে বিদায় জানিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে আরাফের পাশে বসলাম। অকারণে বার বার চোখ থেকে পানি পড়ছে আর আমি বার বার মুছে নিচ্ছি। গাড়ি চলতে শুরু করার পর আরাফ আমার দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— যে যুদ্ধে আপনি নেমেছেন, সেখানে জেতার জন্য এমন হাজারো মায়া আপনাকে ত্যাগ করতে হবে। হোক সেটা আপনজনের কিংবা নিজের জীবনের।
অতএব, এখান থেকে নিজেকে শক্ত করুন।
আয়নাজগত থেকে আরাফের হাত ধরে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। ভাবনামত বাবার বাসায় এলাম। চাচ্চু-চাচীমা আমাদের দেখে রীতিমত অবাক। জিজ্ঞেস করল,
— এতদিন পর এখানে?
— চাচ্চু আমরা কিছুদিন এখানে থাকতে এসেছি। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমরা থাকতে পারি?
চাচ্চু একটু চুপ থেকে বলল, হুম পারিস। তোর ই তো বাড়ি এটা। কিন্তু ও কে? জামাই কোথায়?
আমি চুপ করে আরাফের দিকে তাকালাম। আরাফ সালাম দিয়ে বলল, আমি ই আপনাদের জামাই।
চাচ্চু কপাল কুচকে বলল, তুমি তো সে নও, যার সাথে ত্বোহার বিয়ে হয়েছে।
আমি মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এমনি কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হব। এখন চাচ্চুকে কি বলব? কিভাবে ম্যানেজ করব? আরাফ হেসে বলল,
— জ্বী আমি সে নই।
আসলে আপনারা যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, তার এই বিয়েতে মত ছিলনা। সে তার পছন্দের মানুষের সাথে চলে গেছে ত্বোহাকে ফেলে।
তখন আমি ত্বোহাকে বিয়ে করি। আমি তো এখানে থাকিনা, বাহিরে থাকি। ত্বোহাকেও ওখানে নিয়ে যেতে চাইছি।
বাসায় তো এসব নিয়ে ঝামেলা চলছে তাই বাহিরে যাওয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে একটু সময় দরকার। আর আমি এই কয়েকটা দিনের জন্য ওকে ওখানে রাখতে চাচ্ছিলামনা।
— তুমি সেই ছেলেটার কে হও?
— ভাই। আত্মীয় সম্পর্কের।
— আচ্ছা যা হওয়ার হয়ে গেছে।
তোমরা চাইলে থাকতে পারো, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
আমি আরাফের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অনায়াসে কতগুলো মিথ্যে উনি বলে ফেললেন। অবশ্য এ ছাড়া কি ই বা করার ছিল।
— আল্লাহ ভরসা।
তারপর অনেকটা পথ চুপ করে রইলাম। একসময় নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, এই ঘোড়ার গাড়ী কি আমাদেরকে বাড়ী অবধি পৌছে দেবে?
— নাহ, এটা কেবল আয়নাজগত পর্যন্ত ই যাবে।
বাকিটা ক্ষমতা ব্যবহার করেই যেতে হবে।
— সরাসরি কি বাড়ীতেই যাব?
— সরাসরি শয়তানদের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবেনা।
এর জন্য আমাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
তার জন্য প্রথমে একটা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
এখন আপনি বলুন, এমন কোন স্থানে যাওয়া যায়?
আমি চুপ করে ভাবতে লাগল। এখন যাব কোথায়? ওই বাড়ী ছাড়া তো এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। হঠাৎ স্মরণে আসল নিজের বাবার বাড়ীর কথা।
অবশ্য সেখানে ঠাই হবে কিনা জানিনা! এখন তো বাবা নেই যে নিজের মেয়ে রাখবেন। তাও একবার গিয়ে দেখি যদি ২-১দিনের জন্য আশ্রয় পাই।
— আমার বাবার বাড়ীতে চলুন।
ভাগ্য ভালো থাকলে সেখানে আশ্রয় পেতে পারি।
আরাফের হাত ধরে আয়না জগত থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাবনামত বাবার বাড়িতে চলে এলাম দুজনে। চাচ্চু আর চাচীমা আমাদের দেখে রীতিমত অবাক।
চাচ্চু জিজ্ঞেস করলেন,
— এতদিন পর তুই এখানে?
— আমরা এখানে কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছি। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমরা কি এখানে থাকতে পারি?
চাচ্চু একটু চুপ থেকে বলল, এটা তো তোরই বাড়ি। কিন্তু ও কে? আর জামাই কোথায়?
আমি চুপ হয়ে আরাফের দিকে তাকালাম। জানতাম এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এখন কি বলব আমি?
আরাফ হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল,
— আমি ই আপনাদের জামাই।
চাচচু গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি তো সেই নও যার সাথে আমরা ত্বোহার বিয়ে দিয়েছিলাম।
— চাচ্চু, আপনারা যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে এই বিয়ে মানতে নারাজ। তাই সে তার পছন্দের মানুষের সাথে চলে গেছে। তখন আমি ত্বোহাকে বিয়ে করি।
আমি তো এখানে থাকিনা, বাহিরে থাকি। ত্বোহাকেও আমার সাথে বাহিরে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু এ সংক্রান্ত কাজে একটু সময় লাগবে। বাসায় ও এসব নিয়ে ঝামেলা চলছে। তাই ওকে আমি ওখানে রাখতে চাচ্ছিনা।
এইজন্য আমরা এখান কিছুদিন থাকতে চাচ্ছিলাম।
— সেই ছেলেটা তোমার কি হয়?
— আত্মীয় সম্পর্কের ভাই।
— তোমরা এখানে থাকতে পারোম আমাদের কোনো আপত্তি নেই। লামিয়া ত্বোহা আর জামাইকে রুমে নিয়ে যা তো। জামাই বাবা, অনেকটা জার্নি করে এসেছো মনে হচ্ছে। একটু রেস্ট নাও। ত্বোহা তুই ও যা, ফ্রেশ হয়ে নে।
আমি মাথা নাড়ালাম। আরাফ রুমে চলে গেল লামিয়ার সাথে। আমি পিছন পিছন ভাবতে ভাবতে আসছিলাম। কি অনায়াসে উনি এতগুলো মিথ্যে বলে ফেললেন। অবশ্য এখন এই ছাড়া কি ই বা করার আছে। মানিয়ে নেওয়া ই জীবনের ধর্ম।
রুমে ঢোকার পর অনেক বেশী ক্লান্ত লাগছিল। গোসল করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। ঘুম আসতে বেশীক্ষণ সময় লাগলনা। একপর্যায়ে ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ আমাকে উপর উবু হয়ে খুব কাছ থেকে আমাকে দেখছে।
মূহুর্তে চোখ খুলে দেখি আরাফ ঝুকে বসে আছে।
অবাক হয়ে বললাম,
— আপনি এভাবে আছেন কেন?
— আপনার খোলা চুলের সাথে আমার ঘড়িটা আটকে গেছে তাই। খোলার চেষ্টা করছি। এইতো খুলে গেছে।
লম্বা চুলগুলো একটু সামলে রাখুন।
মনে মনে স্বস্তি পেলাম যাক খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা। লামিয়া গলা ঝেড়ে বলল, আপনাদের রোমান্স কি শেষ হয়েছে?
আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। আরাফ কিছু না বলে বাহিরে চলে গেল। লামিয়া পাশে বসে বলল,
— খুব তো সুখে আছিস দুলাভাইকে নিয়ে!
আমি কিছু বললামনা।
— কিরে চুপ করে আছিস যে?
— বলার মত কিছু নেই। জীবনের মোড় ঘুরে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে।
— তুই কি আগের জন্য মন খারাপ করছিস? যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয়না। এখন যে আছে তাকে নিয়ে ভাব।
— সবটা জানলে হয়ত এটা বলতিনা।
যাই হোক বাদ দে। চাচ্চু কি রাগ করেছে আমরা আসায়?
— মোটেওনা জানিস তুই চলে যাওয়ার পর মা-বাবা প্রায়ই তোর কথা বলত। তারাও চাইত তুই একবার হলেও আসিস। ওরা তোর সাথে না বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে।
তখনি আরাফ এসে বলল, তৈরী থেকো। কাল ই আমরা বের হব।
— এত তাড়াতাড়ি?
— পরে বলব। আমি বলা ছাড়া এই রুম থেকে বের হয়োনা। বলে বেরিয়ে গেল। কিছুই বুঝলামনা, উনার এমন সর্তকবাণী করার কারণ কি! তবে ওরা টের পেয়ে গেছে আমরা কোথায় আছি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। শয়তানগুলো যদি এখানে আসে চাচ্চুদের কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। সেটা আমি একদমই চাইনা।
.
(চলবে)