জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২৫

0
2830

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সারারাত টেনশানে ঘুমাতে পারলামনা, ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগলাম। আরাফ বিছানায় ঘুমাচ্ছে, আমি জানালার ধারে বসে আছি। ছেলেটি তাসবীন নয়, কিন্তু তাসবীনের মতই দেখতে।
জানিনা ওকে দেখলে নিজের ভিতর একটা স্বস্তি অনুভব করি। মনে হয় তাসবীন আমার পাশেই আছে। বারবার ভাবতে চাইনা তাসবীনের কথা। কিন্তু ওকে দেখলেই মনে পড়ে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় ভীষণ নিষ্পাপ লাগছে আরাফকে।
দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম, নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
লক্ষ্য অর্জন করা হয়ে গেলে আমরা যে যার মত ফিরে যাব নিজেদের অবস্থানে। কয়েকদিনের জন্য তাসবীন মনে হয় মায়ায় পড়তে চাইনা। চোখ বুজতেই তাসবীনের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো ভেসে উঠে। কত ভালোই ছিল সময়টা!
সকাল সকাল উঠে চাচীমার সাথে রান্নাঘরে গেলাম সাহায্য করতে। নাস্তা বানাতে বানাতে আরাফ উঠে গেল, ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বলল, তুমি তৈরী ত্বোহা?
আমি বললাম, এক্ষুনি বের হবেন?
— যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই ভাল।
চাচ্চু খবরের কাগজ পড়ছিল। আরাফের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, আজ ই চলে যাবে?
— হ্যা চাচ্চু, কিছু কাজ আছে।
— কাল ই তো এলে, কয়েকটা দিন থেকে যাও।
— ইনশা আল্লাহ অন্য কোনোদিন।
— যাই বলো, এত সকালে তোমাদেরকে ছাড়ছি। বিকালের দিকে যেও। আরাফ না করতে লাগল। অবশেষে চাচ্চুর জোরাজুরিতে বিকাল পর্যন্ত থাকতে রাজি হল।
আমি রুমে ঢুকতেই বলল, আমি আশংকা করছি সারবান আপনাকে খুজতে খুজতে না এখানে চলে আসে।
— ও কি চাচ্চু-চাচীমার ও ক্ষতি করবে?
— সেটার ই ভয় পাচ্ছি। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই স্থান ত্যাগ করতে চাচ্ছি।
— কিন্তু যাব কোথায়? সেই বাড়ীতে ফিরে যাব?
তারা তো আমাদের দেখলেই আক্রমণ করবে আর সেটা প্রতিহত করার মত পর্যাপ্ত শক্তি কি আমাদের আছে?
— আল্লাহ ভরসা।
বিকালবেলা আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। আকাশটা ঘন মেঘে ঢেকে আছে, চারিদিকটা ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঝড়ো বাতাস বয়ছে, চাচ্চুরা এই সময় বের হতে বারণ করল।
কিন্তু আরাফ ভীষণভাবে না করে বেরিয়ে এল। আমিও ভাবলাম একবার বলব, এই দুর্যোগপ্রবণ সময়ে বের হওয়ার দরকার না। কিন্তু এখন আমার কাছে আমার নিজের থেকেও এই নিরীহ মানুষগুলো জান বাচানোটা জরুরী।
চারিদিক কেমন থমথমে হয়ে আছে, আশেপাশে কেউ নেই। জনমানবহীন এলাকা মনে হচ্ছে।
একটু একটু ভয় পেতে লাগলাম। থেমে থেমে জোরেসোরে বজ্রপাত হচ্ছে। আরাফ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগল। ও কোথায় যাচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। একবার আমার দিকে ফিরে বলল,
— আল্লাহকে ডাকুন। উনি ই আমাদের সহায় হবেন।

হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আরাফ দূরে ছিটকে পড়ল। আমি তার কাছে গিয়ে উঠানোর চেষ্টা করে বললাম, কি হয়েছে আপনার? এভাবে ছিটকে পড়লেন কেন?
এমনসময় কেউ যেন আমার হাতটা শক্তকরে চেপে ধরল। ব্যথা পেয়ে পাশ ফিরে দেখতেই দেখি সারবান ভয়ানক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
— এভাবে পালিয়ে বাচতে পারবে ভেবেছো? আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাচাতে পারবেনা। চল, আমার সাথে।
আরাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— উপরে আল্লাহ আছেন, তার কাছে তোদের মত শয়তানরা কিছুই নয়। সারবান চোখ বড়বড় করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাক হয়ে বলল,
— তাসবীন! তুই বেচে গেলি কি করে?
বেচে গিয়েছিস যখন নতুন করে আবার আমাদের হাতে মরবি।
সারবান চোখ বন্ধ করে কিসব বিড়বিড় করে চোখ খুলে আরাফের দিকে আগুনের গোলা ছুড়তে লাগল। আরাফ সরে গিয়ে এইগুলো থেকে বাচার চেষ্টা করছে। আমি এই সুযোগে সারবানের হাতে কামড় দিলাম। সারবান আমার হাত ছেড়ে দিতেই আমি আরাফের হাত ধরে দৌড়াতে লাগলাম।
আরাফ টাল সামলাতে না পেরে বলল,
— দৌড়াচ্ছেন কেন?
— আপনি ওদের সাথে পেরে উঠছেন না। তাই নিজেদের আত্মরক্ষা করতে হলে এখন দৌড়াতে হবে।
— যুদ্ধ করতে এসে পিছু হটলে চলবেনা।
— যুদ্ধ করার জন্য হলেও আগে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে.. কথা শেষ না হতে সামনে তাকিয়ে দেখি শয়তানী মহিলা আর সারবান দাঁড়িয়ে আছে।
শয়তানী মহিলা এসে আমার চুল চেপে ধরে বলল,
— তোকে বাচিয়ে রাখাটাই ভুল হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য না করে তুই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিস? আজ দেখ তোকে দিয়ে কি করে আমরা লক্ষ্য অর্জন করি।
বলে আমাকে সারবানের দিকে ছুড়ে দিল। সারবান টানতে টানতে আমাকে ওইপাশে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। আরাফ এগিয়ে আসতে চাইলে শয়তানী তাকে বাধা দিয়ে বলে,
— আমি তো ভেবেছি তুই মরে গিয়ে জ্বীনভুত হয়ে গেছিস।
কিন্তু তুই তো আমার কাজ বাড়াতে আবার ফিরে এসেছিস। চিন্তা করিস এবার আমি তোকে খুব ভালোভাবে উপরে পাঠাব। যাতে কষ্ট করে আর দুনিয়ায় ফিরতে না হয় তোর।

আরাফ নাকমুখ খিচিয়ে বলল, আমিও একই ভুল বারবার করবনা। নিজের মা ভেবে তোকে বিশ্বাস করে তোর হাতে জ্বীনি তলোয়ার তুলে দিয়েছিলাম। আর তুই শয়তানী বেঈমানি করে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছি। আজ তোদের কে না শেষ করে এই তাসবীন থামবেনা ইনশা আল্লাহ।
— আয় তবে হয়ে যাক যুদ্ধ।
বলে শয়তানী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছি, তাহলে এই আরাফ ই আমার তাসবীন। তাসবীন মরেনি, আমার কাছে ফিরে এসেছি। পরক্ষণেই ভাবলাম শয়তানগুলো যেহেতু ওকে তাসবীন ভেবেছে তাই সে নিজেকে তাসবীন হিসেবে জাহির করছে। যাতে শয়তানগুলো দমে যায়।
শয়তানী মহিলা সারবানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। সারবান তা দেখে মূহুর্তে আমার উপর হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। আমি নিজেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। আমার কাছে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সারবান জোরে আমার গালে থাপড় লাগিয়ে দিল।
সারাগায়ে আচড় দিতে লাগল। শরীর থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে, ব্যথায় আর জ্বলুনিতে কাতরাচ্ছি তাও দমে যাচ্ছিনা। শয়তানটার হাত থেকে বাচার চেষ্টা করছি।
অন্যদিকে আরাফকে শয়তানী আগুনের গোলা এবং ধারালো ছুরি ছুড়ছে। ওর কয়েক জায়গায় লেগেও গেছে, রক্তে ভিজে গেছে ওর পাঞ্জাবির কয়েক অংশ।
জ্বীন হিসেবে আরাফের শক্তি খুব কম হচ্ছে। ঠিকমত পেরে উঠতে পারছেনা, শয়তানীর কোনোরকম ক্ষতি হওয়ার আশংকা নেই।
সারবানেত সাথে আর পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছেনা। আমার জামার কয়েক অংশ ছিড়ে ফেলেছে, ওড়নাটা কোথায় ছুড়ে ফেলেছে কে জানে। নিজেকে কেমন জানি বিবস্ত্র মনে হচ্ছে।
আল্লাহ আপনি আপনার বান্দীকে সাহায্য করুন।

শয়তানী লাফিয়ে এসে আরাফের বুকে কষে কয়েকটা লাথি মারল। আরাফ মূহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শয়তানী ইচ্ছেমত আরাফকে আঘাত করতে লাগল। ওদের শেষ করার সব রাস্তা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। সারবানকে ধাক্কা দিয়ে উঠে আসতেই ও পিছন থেকে আমার চুল চেপে ধরল।
আরাফকে ডাকছিলাম বারবার তাও ও নড়ছেনা।
মনে মনে একটা ভাবনা চলে আসল আরাফ কি মারা গেছে?
শয়তানী জ্বীনি তলোয়ার হাতে নিল, আরাফকে মারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলল, দোহাই লাগে তোমরা উনাকে মেরোনা। এতটা নিষ্ঠুর হয়োনা।
ও তো তোমাদের জাতি। মারলে আমাকে মারো।
— বাহ, তোর তো দেখছি জ্বীনদের জন্য খুব দরদ। চাপ নিসনা, তোকেও ওর সাথে উপরে পাঠাব।
তুই শুধু আমাদেরকে বাচ্চাটা এনে দে। যদি আমার কথা মত কাজ করিস তবে আমি ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবব।
আমি ছলছল চোখে আরাফের দিকে তাকালাম। আমার জন্য এই নিরীহ জ্বীনটা কেন মরবে?
এদেরকে শেষ করা অসম্ভব ই তাই ওদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু কে যেন আমার কানে কানে বলছে, হার মানিসনা ত্বোহা। তুই প্রমাণ করে দে তুইও জ্বীনকন্যার যোগ্য মেয়ে।
আমি অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলাম। কে বলল এই কথা নাকি আমার মনের ভুল?
এমনসময় শয়তানী হোচট খেল, তলোয়ারটা তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিলাম। সারবানকে কনুই দিয়ে জোরে এক ঘুষি দিয়ে ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সারবান আমার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে আমি তলোয়ার উচিয়ে বলি,
— ভুলে যেওনা জ্বীনরাজ্যের সর্বশক্তিমান তলোয়ার আমার হাতে। কাছে আসলে কেউ বাচবেনা।
অনেক সহ্য করেছি তোদের শয়তানী। প্ল্যান প্ল্যান করে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলি, আমার তাসবীনকেও মেরে দিলি। আজ দেখব তোদের গড শয়তান আমার হাত থেকে তোদের কিভাবে বাচায়!
বলে এগিয়ে এসে সারবানকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলাম। অদ্ভুত ভাবে ওর কিছুই হলনা। চিন্তায় পড়ে গেলাম এই তলোয়ার কি নকল? ওরা আসল তলোয়ার সরিয়ে রেখেছে?
শয়তানী উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল
— বোকা মেয়ে, এই তলোয়ারের ব্যবহার যদি এত সহজ ই হত আমাকে আর তোর আশায় থাকতে হতনা। এই মূহুর্তেই জ্বীনরাজ্য আর পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয় থাকত। তোরা একবারো ভাবিসনি, তলোয়ার তো আমি পেয়ে গেছি তারপরও কেন জ্বীনরাজ্য কবজা করিনি! বেকার বেকার এত প্ল্যান করে এই তলোয়ার হাতালাম কিন্তু ব্যবহার ই করতে পারলামনা।
তলোয়ার কাজ না করলে আমি এদের শেষ করব কি করে? কানের কাছে সেই একই ফিসফিসানি, তলোয়ারে তাজা রক্ত মাখিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে আঘাত কর। ইনশাআল্লাহ শয়তান শেষ হবে।
আমার শরীরের রক্ত মাখিয়ে আল্লাহর কালাম পড়ে সারবানের দিকে ছুড়ে মারলাম। সাথে সাথে ঘড় থেকে ওর মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে লাফাতে লাগল। শয়তানী ভয় পেয়ে উলটো দিকে ছুটে পালাতে লাগল। আমিও তলোয়ার হাতে নিয়ে পিছু নিলাম। দূর থেকে ছুড়ে মারতেই ওর মাথাটাও আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সাথে সাথে তলোয়ার আবার আমার হাতে চলে এল। আরাফের কাছে গিয়ে ওর জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু উঠতে পারছেনা। তলোয়ারটা আল্লাহর নাম নিয়ে ওর গায়ে ছুয়ে দিলাম। সব ক্ষত মুছে গিয়ে ও সুস্থ হয়ে উঠে দাড়াল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here