জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২৬ শেষ

1
3622

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২৬ শেষ
লেখিকাঃ শান্ত্বনা

আরাফের কি হল জানিনা! হঠাৎ করে আমাকে শক্ত করে
জড়িয়ে ধরল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ততক্ষণে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। রেগে গিয়ে বললাম,
কি করছেন কি? বেগানা নারীকে স্পর্শ করা হারাম জানেননা!
আরাফ মাথা নিচু করে রইল। এইসময় সাদাফ-মাইশা আর
জ্বীনহুজুর এসে হাজির। জ্বীনহুজুর বললেন,
— অভিনন্দন তোমাদেরকে শয়তানের বিপক্ষে জয়ী হওয়ার জন্য। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— সবি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছে।
— এইবার তোমাকে আমি কিছু সত্য বলতে চাই ত্বোহা।
— কি সত্য জ্বীনহুজুর?
— তোমার আসল পরিচয়। জানো তুমি কার সন্তান?
— আমি আমার বাবার পরিচয় জানতে পেরেছি অনেকপরে। একটু আগে কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলছিল, জ্বীনকন্যার মেয়ে। এটা বুঝলামনা।
— এটা সত্য, তুমি জ্বীনকন্যা সিমরানের মেয়ে
এবং জ্বীন মেহরাবের নাতনী।
— এসব কি বলছেন আপনি?
— হুম, জ্বীন মেহরাবের ২টি যমজ ছেলেমেয়ে ছিল- মুহিব এবং সিমরান। তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়েছে মানুষের সাথে। মুহিবের সন্তান তাসবীন এবং সিমরানের সন্তান
তুমি।
— আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমিও একজন জ্বীন হতাম। কিন্তু আমি একজন সাধারণ মানুষ। তাসবীন আর আমি যদি জ্বীনের বংশধর হয়ে থাকি ও জ্বীন হলে আমি কেন সাধারণ মেয়ে?
— মুহিব এবং সিমরান শয়তান তান্ত্রিককে শেষ করার পর রাজ্যের ভার গ্রহণ না করে সব শক্তি ত্যাগ করে সাধারণ জ্বীনরুপে দুনিয়ায় ফিরে এসেছিল তাসবীনের মা ওয়াফাহ আর তোর বাবা তাওহীদের সাথে বাকিটা জীবন সুখে কাটানোর জন্য। সিমরান সব শক্তি ত্যাগ করার পর তুই হয়েছিস তাই তুই সাধারণ মানুষ্যমেয়ে রুপেই জন্ম নিয়েছিস।
মুহিব শয়তানের আস্তানায় বন্দি থাকাকালীন ওয়াফাহর গর্ভে তাসবীন এসেছিল। মুহিবের সব জ্বীনিশক্তি তাসবীন ধারণ করেছিল।
— তাহলে আমি আমার মা-বাবা থেকে আলাদা হলাম কেন? এতবছর বাবাকে পেলেও মাকে পাইনি। তাসবীনের মা-বাবার কথাও শুনিনি কখনো। ওর মা তো ছিল এই শয়তানী।
— তাহলে তোকে পুরো ঘটনাটাই বলি। তখন তাসবীনের বয়স ৪-৫ বছর ছিল আর তোর ৩-৪ হবে হয়ত। কথা ছিল তাসবীন হবে জ্বীনরাজ্যের উত্তরাধিকারী, ২১বছর বয়সে সে রাজ্য পরিচালনার ভার নিবে। এই খবর বদজ্বীনের সর্দারনী জানতে পারে তাসবীনকে তার আয়ত্বে নিয়ে আসার প্ল্যান করে। সেদিন ছিল ঘোর বৃষ্টির রাত, বাহিরে প্রচন্ড তুফান হচ্ছিল। তোদের মা-বাবা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথা দেওয়া-নেওয়া চলছিল বড় হলে তোদের বিয়ে দিবে। আরেকটি কাহিনী রচিত হবে জ্বীন-মানুষের বিয়ে। সেই রাতে শয়তানী তার দলবল নিয়ে তোদের উপর আক্রমণ করে। মুহিব আর ওয়াফাহ বাধা দিতে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়, ওদের শরীরের সব রগ ছিড়ে দেওয়া হয়।
তাসবীনকে পাওয়ার পর ওরা তোকে আর তোর মা-বাবার প্রাণ নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। তোর মা-বাবা তোকে আড়কোলে করে বেরিয়ে পালাতে থাকে। ওদের হাত থেকে বাচার জন্য গাড়িতে উঠে। তোর বাবা একহাতে তোকে শক্ত করে আগলে রেখে অন্যহাত দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।শয়তানী ওদের পিছু ধাওয়া করে মূহুর্তে বিভৎস রুপ নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। তোর বাবা ভয় ব্রেক করতে গেলে গাড়ি উলটো গড়িয়ে পড়ে যায়। আল্লাহর কুদরতে তোর বাবা গাড়ির দরজা ভেঙ্গে পড়ে যায় রাস্তায়। মোটা গাছের সাথে প্রচন্ড আঘাত পায় মাথায়। ততক্ষণে গাড়ি বিস্ফোরণ হয়ে তোর মা সেখানেই মারা যায়। সেইদৃশ্য দেখতে দেখতে তোর বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তুই বাবার পাশে বসে কাদছিলি, ততক্ষণে খবর পেয়ে আমি সেখানে যাই আর তোকে শয়তানীর চোখ ফাকি দিয়ে নিয়ে আসি।

শুনে আমার চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝড়তে লাগল। ভাবতে পারছিলামনা এভাবে আমার মাকে মরতে হয়েছে। ভেবেই গায়ে কাটা দিচ্ছিল। জ্বীনহুজুর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,
— তোকে জ্বীনরাজ্যে নিয়ে আসার পর আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। জ্বীনজাতি জানতে পারলে তোকে মেরে পুতে ফেলবে, দুনিয়ায় রাখলে যেকোনোসময় শয়তানীর হাতে তুই শেষ হয়ে যাবি৷ তাই আমি এমন একটা পরিবার খুজছিলাম যেখানে তুই নিরাপদ থাকবি।
ভাগ্যক্রমে এক দম্পতি পেয়ে যাই, যারা হন্য হয়ে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য ছুটছিল। সাধারণ মানুষ সেজে তোকে ওদের হাতে হস্তান্তর করি আর শর্ত রাখি তুই যে তাদের পালিতা মেয়ে। এটা যেন কেউ না জানে এবংকি তুই ও না।
তোর বাবা ঠিক তোকে চিনতে পেরেছিল।
আমি চোখ মুছে নিয়ে বললাম,
— তাসবীনের সাথে যেহেতু আমার বিয়ে ঠিক ছিল তাহলে বাবা আমার অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছিল কেন?
— শয়তানীর প্ররোচনায় বাধ্য হয়ে সাদাফ তোর বাবার কাছে নিজেকে তাসবীন হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। সেই বিশ্বাসে তোর বাবা এই বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
ওনার শেষ ইচ্ছে ছিল সবার মনের আশা পূরণ করা, তোকে তাসবীনের বউ করা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— হতে তো পারলাম না উলটো তাসবীনকে তো হারিয়ে ফেললাম। ওর সাথে কি হয়েছিল? সে কি এসবের বিন্দুমাত্র জানতনা!
— তাসবীনকে সেই শয়তান নিজের ছেলে হিসেবে পালন করতে লাগল। তার উদ্দেশ্য ছিল তাসবীন যখন পরিণত হবে তখন তাকে দিয়ে জ্বীনি তলোয়ার নিয়ে আসবে এবং তাসবীনকে মেরে সারবান কে বানাবে জ্বীনিরাজ্যের রাজকুমার। কিন্তু তাসবীনের যখন ২১বছর তখন তাসবীন জ্বীনরাজ্যের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
কেননা, তাসবীন কখনো এর আগে জ্বীনরাজ্যে যায়নি। সে নিজেকেও জানত না সে একজন জ্বীন। অতএব, ২৫ বছর বয়স ছাড়া সে আর জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে পারবেনা। এরপর শয়তানী তাকে ভালোভাবে তৈরী করে নেয়। মারার পরিকল্পনা ও করে ফেলে, সাদাফকে জ্বীনরাজ্য থেকে নিয়ে আসে পরিকল্পনা সফল করার জন্য।
তাসবীনকে বলে এটা তাসবীনের ছোটভাই। সবটা তো তুমি জানো। তোমার আর সাদাফের বিয়ের কথা শোনার পর তাসবীন ভেঙ্গে পড়েছিল। ও আজীবনের জন্য জ্বীনরাজ্যে ফিরে আসতে চেয়েছিল।
শয়তানী ওকে বুদ্ধি দেয় জ্বীনরাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করে তলোয়ার নিয়ে আসতে। এতে তাসবীনের তোমাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

তাসবীনও সেই ফাদে পা দেয়। এদিকে শয়তানী আর সারবান সন্দেহ করতে থাকে সাদাফ তোমাকে সব বলে দিবে এইজন্য সারবান তাসবীনের রুপ ধরে মাইশাকে নিয়ে আসে। তোমার সামনে তাসবীন সেজে সব কিছু করতে থাকে যাতে তুমি তাসবীনের উপর ক্ষিপ্ত হও এবং ওকে খুন করো। এতে দুইটা কাজ হাসিল হয়- সাদাফকে ব্ল্যাকমেইল করা আর তোমার চোখে তাসবীনকে খারাপ বানানো।
শেষ অবধি ওরা সফল হয় আর তুমি তাসবীনকে খুন করো।
মনে পড়তেই আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকি।
বিড়বিড় করে বলতে থাকি,
— ভুল করেছিলাম তাসবীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে অবিশ্বাস করে মেরে ফেলে। ওকে তো আর কখনো ফিরে পাবনা। এই ভুলটা মাশুল আমাকে সারাজীবন দিতে হবে। বলে কাদতে লাগলাম অনবরত।

জ্বীনহুজুর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— শান্ত হ ত্বোহা। তাসবীন বেচে আছে, আল্লাহর রহমতে সেদিন ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু নিজের সব জ্বীনি শক্তি হারিয়ে সাধারণ জ্বীন হয়ে ছিল।
আমি চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
— কোথায় আমার তাসবীন? বলুন না জ্বীনহুজুর।
জ্বীনহুজুর আরাফকে কাছে ডেকে বললেন,
— ও তোর তাসবীনের দেখতে নয়, ও ই তোর তাসবীন।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাইশা বলতে লাগল, হ্যা বুবু। এই ই আমাদের তাসবীন ভাইয়া। তোমার উপর অভিমান করে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিল। আমাদেরকেও গোপন রাখতে বাধ্য করেছে।
আমি তাসবীনের দিকে এগিয়ে এলাম। ওর ছলছল করা চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— কেন এমন করলে? কত কষ্ট হয়েছে আমার জানো।
বোকা ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে কেদে দিল। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। জ্বীনহুজুর বললেন,
— ত্বোহা একটা কথা বলা বাকি রয়ে গেছে।
আমরা লজ্জা পেয়ে দুজন দুজনকে ছেড়ে দিলাম।
— কি কথা হুজুর?
— ফিসফিস করে কথাগুলা তোর মা বলেছিলেন।
— মা? উনি কি বেচে আছেন?
— তোদের একসাথে দেখার আক্ষেপে তার রুহ রয়ে গেছে দুনিয়ায়। দেখবি তোর মাকে?
— হ্যা জ্বীনহুজুর। ডাকুননা আমার মাকে।
জ্বীনহুজুর চোখ বন্ধ করে বললেন,
— সিমরান বুবু, আমি তোমার ছোটভাই জুহানী তোমাকে একটাবার দেখার জন্য ডাকছি। আজ অন্তত দেখা দাও।
দেখে যাও তোমার আক্ষেপ আমি দূর করতে পেরেছি।
একজন সুদৃশ্য মহিলা দৃশ্যমান হয়ে বললেন,
— আল্লাহ তোমার ভালো করুক ভাই। আয় ত্বোহামা আমার বুকে আয়। মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম।
— পাগলি মা, কাদিসনা। আমার রুহ এখন শান্তি পেল। সুখে থাক মা। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে আমাকে যেতে হবে। ভালো থাকিস, তাসবীন আমার মেয়েটার দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম।
জ্বীনহুজুর তাসবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুই কি জ্বীনরাজ্যের ভার নিবি? জ্বীনি তলোয়ার হাতে নিলেই তুই তোর সব শক্তি ফিরে পাবি।
— আমি আর সেটা চাইনা হুজুর। সাদাফকেই আমি জ্বীনরাজ্যের ভার দিয়ে দিলাম। ইনশাআল্লাহ ও সুনিপুনভাবেই পরিচালনা করবে। কিরে পারবিনা?
সাদাফ তাসবীনকে সালাম করে বলল,
— ইনশাআল্লাহ। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু তুমি কি করবে?
তাসবীন আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল,
— ওর সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিব।
মাইশা হেসে বলল,
— তাহলে হয়ে যাক বিয়ের আয়োজন।

বউ সেজে ফুলে সাজানো বিছানায় বসে আছি। রুমে কয়েকটা রঙ্গিন ঝাড়বাতি জ্বলছে, খোলা জানালা দিয়ে সুন্দর বাতাস ঢুকছে। বেশ ভালো লাগছে।
একবার আয়নার দিকে উকি মারলাম। ভীষণ সুন্দর লাগছে বউসাজে। টকটকে লালরঙ্গা শাড়ি, হালকা গয়না-সাজ, খোপায় বেলিফুলের মালা এবং হাতভর্তি লাল টুকটুকে মেহেদী। তাসবীন ঠিক যেভাবে বলেছিল সেভাবেই সেজেছি। তার এখনো আসার নাম নেই।
দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠে মাথাটা নীচু করে রইলাম। আড়চোখে তাসবীনের দিকে তাকালাম। লাল পাঞ্জাবিতে রাজপুত্রের মত দেখাচ্ছে তাকে। তাসবীন আমার সামনে বসে থুতনী ধরে মুখটা ধরে বলল, মাশা আল্লাহ, আমার বউটাকে কি মিষ্টি দেখাচ্ছে? আমি লজ্জা পেয়ে তার বুকে মুখ গুজলাম। ও আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— সব অপূর্ণতা আজ পূর্ণতা পেল।
— হুম পেয়েছে তো। আমি আমার জ্বীনবরকে পেয়ে গেছি।
তাসবীন মুক্তোঝরা হাসি হেসে কপালে ঠোটের স্পর্শ দিয়ে বলল, ভালোবাসি বউ আমার।
আমি আরো জড়োসড়ো হয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— ভালোবাসি জ্বীনবরটা।
অবশেষে আমরা এক হলাম। সব বাধা-বিভেদ পেরিয়ে শুরু করলাম জ্বীন-মানুষের ভালোবাসার ছোট্ট সংসার। এভাবেই যেন যুগে যুগে এমন ভালোবাসাগুলো পূর্ণতা পায়।

আপনারা কি শুধু গল্প পড়েই যাবেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন না হুম!
.
(সমাপ্ত)

1 COMMENT

  1. Osadharon golpo likhachen puro mona hocche sotti ? , khub vlo laglo ar apner jnno doya kori apni khub khub khub vlo thakun ar amader jnno avabe story likhun

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here