জ্বীনবর ৫,পর্বঃ০২,০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০২
পুকুরঘাটে বসে মাছগুলোকে খাবার দিচ্ছিলাম। মাছ গুলো হালকা মাথা তুলে ঠুকরে ঠুকরে ভাসমান খাবারগুলো খাচ্ছিল। আমি কিছুটা চিন্তিত, হঠাৎ মাছের সংখ্যা কম মনে হচ্ছে।
এমনটা মাঝে মাঝে ই হয়। ভাবনা-চিন্তা করেও যখন কূল পাইনা, হাল ছেড়ে দেই। আমাদের বাসাটা কিছুটা পুরোনো ধাচের, চারপাশে বিশাল দেয়াল দিয়ে বাউন্ডারী করা। বাবা-ই সব করে গিয়েছিলেন। একতলা বাড়ীর উপরে ছাদ, আর সামনে কিছুটা খোলা জায়গা, তার অন্যপাশে ছোট ডোবার মত পুকুর খুড়েছি। পুকুরটায় পদ্মফুল লাগিয়ে মাছ ছেড়ে দিয়েছি, আর বাসার সামনের ফাকা অংশে কিছু সবজি-ফুলের গাছ লাগিয়েছি।
এসবের তদারকি আমি ই করি। বোনের এদিকে নজর নেই বললেই চলে, মন ভাল থাকলে একটু ঘুরে ঘুরে দেখে যায় এই যা। বাহিরের কেউ আসেওনা যে মাছ চুরি করবে, বোনকে অজানা কারণেই এলাকার ছেলেগুলো ভয় পায়, এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় ঘেষে না পর্যন্ত।
হঠাৎ করেই এত মাছ উধাও হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত। বোনকে একবার বলে দেখব, অবশ্য এর আগেও বলেছি। ও ওতোটা গুরুত্ব দেয়নি, বলেছিল হয়ত মরে গেছে বা হাস খেয়ে ফেলেছে। ওকে বুঝাতেই পারিনি মাছ মরে গেলে তো ভেসে উঠব আর এই বাড়ীতে হাস ই বা আসবে কোথা থাকে।
যাক গে, আবার যদি একই ঘটনা ঘটে তবে আর মাছ ই রাখবনা।
বুড়িমা লাঠিতে ভর দিয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তুমি আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসলে কেন? তোমার হাপানির টান টা বেড়েছে। একটু বিশ্রাম নাও।
এদিকের কাজ আমি সামলে নিব।
বুড়িমা একটু টান নিয়ে বললেন, আফরাহ কোথায়?
— দেখলাম বের হল। বোধহয় কোনো কাজে গেছে।
তোমার কি কিছু প্রয়োজন?
— আমার ওষুধগুলো ফুরিয়ে গেছে। এখন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আফরাহকে বলবি ফেরার সময় নিয়ে আসতে।
— তুমি আগে বলোনি কেন?
আচ্ছা আমি বোনকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। তুমি যাও তো, একটু বিশ্রাম নাও।
বুড়িমাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বোনকে কয়েকবার কল দিলাম। বারবার ই বলছে, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
সন্ধে হয়ে এল, এতক্ষণ বোন বাহিরে কি করছে। সময়মত ওষুধ না খাওয়াতে পারলে বুড়িমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। ফোনটা রেখে বুড়িমার ঘরে গেলাম।
চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে, আমাকে দেখে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারছেনা।
আমি বুড়িমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
— খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?
একটু অপেক্ষা করো, বোন ঠিক ওষুধ নিয়ে আসবে।
বলতে বলতে মাগরিবের আযান পড়ে গেল। বুড়িমার হাত ধরতেই খেয়াল করলাম হাত দুটো বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে।
মূহুর্তেই বুকের ভিতরটা ধপ করে উঠল। বার বার বুকে টান দিচ্ছে বুড়িমা, এই মূহুর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা।
এক্ষুনি যদি কিছু করতে না পারি বুড়িমাকে হয়ত বাচাতেই পারবনা। দেরী না করে প্রেস্ক্রিপশন টা বের করে আমার রুমে ঢুকে পার্সটা নিয়ে বের হলাম।
খুব কাছেও যে বাজার, তা নয়। ১০-১৫ মিনিট হেটে গেলে তবেই বাজারের শেষ দোকানটার কাছে পৌছানো যাবে।
হাতে সময় খুব কম, তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছি।
বুড়িমা সারাবাড়ীতে একা, তাড়াতাড়ি না যেতে পারলে কোনো অঘটন নিশ্চিত ঘটবে।
মাগরিবের সময় তাই রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। আমাদের এলাকায় নাকি জ্বিনের উৎপাত অনেক, তাই লোকজন সন্ধ্যের পর খুব একটা বের হয়না।
বের হলেও এই রাস্তার দিকে আসেনা, এই রাস্তায় শেষ মাথায় বিরাট বটগাছ তার অনেক বছরের জীর্ণ ঐশ্বর্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচলিত, এর প্রতিটি দুলায়মান শিকড়ে একটা করে জ্বীন আছে।
শর্টকাটে বাজারে পৌছাতে চাইলে এই বটগাছ পার করেই আমাকে যেতে হবে। কখনো সন্ধ্যে বেলা এদিকে আসিনি, তাই কিছুটা ভয় ও করছে। আল্লাহর নাম নিয়ে পা চালাতে চালাতে বটগাছের কাছে এসে পড়ি। চেষ্টা করছি, গাছের দিকে যাতে চোখ না যায়। কিন্তু কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে এর উচু ডাল থেকে কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে, ফিসফিস করে কিছু বলছে।
মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে নির্বিঘ্নে গাছটা পার হয়ে বাজারে ঢুকলাম। প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে ফেরার সময় দোকানদার কাকু বলল, সাবধানে যাস মা।
এই পথটা কিন্তু ভালনা। আমি কি তোকে এগিয়ে দিব?
— না কাকু। বোন জানলে আবার রাগ করবে।
আমি যেতে পারব।
— তোর বোনের ভয়ে তো কিছু করা যায়না। আচ্ছা যা তাহলে।
ওষুধগুলো নিয়ে আবার হাটা দিলাম। বোন কেন জানি পছন্দ করেনা এলাকার কোনো লোক আমাদের সাথে অহেতুক কথা বলুক, সাহায্য করুক। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে বলে, তাও আমি কথা বলি-মিশি। ওরাও আমাকে খুব ভালোবাসে।
শুধু বোনের জন্য কথা বাড়ায় না বেশী একটা। এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছি, কখন যে বটগাছ টার সামনে চলে এসেছে খেয়াল ই করিনি।
হঠাৎ বিদঘুটে একটা হাসির আওয়াজে আমার সম্বিৎ ফিরে এল। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব গাঢ় কালো ছায়া গাছের ঝুলানো শিকড়ে দোল খাচ্ছে।
ভয়ে আতকে উঠলাম। চেচালাম, কে ওখানে?
সাথে সাথে কিছু একটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। পড়ে গিয়ে সাথে সাথে উঠার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার হাত-পা অবশ হয়ে আছে।
একচুল নড়তেই পারছিনা। ছায়াটা উড়ে এসে আমার সামনে দাড়াল, তারপর আবার বিদঘুটে হাসির শব্দ।
আমাকে এত জোরে একটা থাপড় দিল যে আমার মাথাটা টনটন করে ব্যথা করে উঠল, চোখে অন্ধকার দেখছিলাম।
দোয়া পড়ব এমন কোনো শক্তি পাচ্ছিনা।
আবার বিদঘুটে হাসি দিয়ে ছায়াটা আমার চুল চেপে ধরে সামনে টেনে হিচড়ে কোথায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। পায়ের জুতোটা খুলে ছায়াটার মুখ বরাবর ধরতেই সেটা এক লাফে সরে গেল। আমি যেন কিছুটা জোর ফিরে পেলাম, আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলাম।
ছায়াটা একটা আত্মচিৎকার করে গাছের উপরে উঠে গেল। আর দৃষ্টিগোচর হলনা।
মাটি থেকে ওষুধের প্যাকেট টা উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে এলাম। পুরোটা রাস্তায় একবারের জন্য ও দোয়া-কালাম পড়া বন্ধ করিনি।
ঘরে ঢুকতেই বোনের সামনে পড়ে গেলাম। ও আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। মোম জ্বালিয়ে আগুন ছোয়াল। তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
— কোথায় গিয়েছিলি?
— বুড়িমার ওষুধ আনতে বাজারে গিয়েছিলাম।
— বটতলা দিয়ে গিয়েছিলি?
— হুম।
— তোকে আমি বারণ করেছিলাম না আমাকে না বলে তুই বাড়ীর বাহিরে বের হবিনা।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার চুপ দিয়ে বোন আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, বলেছিলাম কিনা?
— হ্যা।
— তাহলে??
— বুড়িমার অবস্থা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারত। তোকে অনেকবার কল দিয়েছিলাম, কিছুইতেই সংযোগ পাচ্ছিলামনা।
— তোকে কতদিন বারণ করেছি। অন্যের কথা ভাবা বন্ধ করে নিজের চিন্তা কর।
এর কিছু হলে আমাদের কি! বয়স হয়েছে একসময় তো মরবেই। এটা নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কি দরকার।
— বোন!! এভাবে বলিসনা। বুড়িমা কতগুলো বছর ধরে আমাদেরকে আগলে রেখেছে, নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে এখন তার প্রতি আমাদের ও কিছু দায়িত্ব আছে।
বোন উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল, নিজেকে শান্ত করে বলল,
— সব বুঝতে পারছি। কিন্তু এই সময় বের হয়ে তোর কি অবস্থা হয়েছে দেখ। খারাপ কিছু ও তো হতে পারত।
আমি বুড়িমার ওষুধ এনেছি, আমার এটা মাথায় ছিল।
খাইয়ে দিয়েছি, উনি ঘুমাচ্ছে এখন।
কিন্তু তুই তোর অবস্থা দেখ! পুরো শরীরে মাটি লেগে আছে, ঠোটের কোণা বেয়ে রক্ত ঝড়ছে।
যাহ, ফ্রেশ হয়ে আমার কাছে আয়।
আমি ব্যান্ডেজ করে দিব।
— আচ্ছা।
— শোন, আর কখনো এভাবে বের হবিনা।
কোনো পরিস্থিতিতেই না।
— ঠিক আছে।
আফরাহ ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। কপালে ঘামের সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠল, ক্ষণেই হাতের পিঠ দিয়ে তা মুছে নিল সে।
আমি সোজা বুড়িমার ঘরে ঢুকলাম। গভীর ঘমে আচ্ছন্ন বুড়িমা। তার গায়ের উপর কাথা টেনে দিয়ে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
অনেকক্ষণ ধরে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টিতে। ঠোটের কোণে কালশিটে বর্ণ ধারণ করে আছে, গালটায় কিছু টা ব্যথা অনুভব করছি।
সেই ভয়াবহ মূহুর্তের কথা মনে পড়লে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কখনো এমন ভাবে কারো সাথে আমার লড়াই করতে হয়নি, আজ আত্মরক্ষার জন্য করতে হল।
কিন্তু ছায়াটা কিসের? আমাকে কেন আঘাত করতে চেয়েছিল? তখন মনে হচ্ছিল ছায়াটা কি একটা ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। অবশ্য সেটা নিতান্ত আমার ধারণা।
ঠিক বুঝতে পারছিনা এটাকে কি সাধারণ ঘটনা ধরে নিব নাকি কারো প্রতিশোধ ধরে নিব??
হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাত পড়তেই চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে দেখি বোন ব্যান্ডেজ-ওষুধের সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— ভয় পেলি?
— হ্যা কিছুটা। বোন আমাকে বসিয়ে আস্তে আস্তে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলল, এত ভয় পেলে জ্বীনের মুখোমুখি হবি কি করে?
— মুখোমুখি হব মানে!
— এই কাজ আর কতদিন আমি একা করব! এইবার তোকেও এতে সামিল হতে হবে যে।
এখন থেকে আয়ত্ব করতে শিখ।
— আচ্ছা বোন, তুই কি বলতে পারিস আক্রমণ টা আমার উপর কেন হয়েছিল?
— সেটা আমি কি করে বলব।
এটা তো জানা কথা, বটগাছটায় খারাপ কিছুর অস্তিত্ব আছে। সন্ধ্যেবেলা সেই রাস্তায় কেউ গেলে এসবের সম্মুখীন হয়।
— আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ছায়াটা প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে আমার উপর আক্রমণ করেছে। যেন আমি তার শত্রু।
— এমনটা সবার সাথেই হয়।
এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা, তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি আসছি।
— বোন, তুই আমার সাথে আজ রাতটা ঘুমাবি?
কত দিন একসাথে শুয়ে গল্প করিনা।
— এসবের জন্য আমার কোনো সময় নেই। আমাকে সারারাত এসব কাজে ঘাটাঘাটি করতে হয়। সবার পেটের জোগান দিতে হয়।
বলেই চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, বোন হঠাৎ করে এত রেগে গেল কেন? আমি তো এমন কিছুই বলিনি।
ওর মনোভাব বুঝা আসলেই দায়।
ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম। ভয় হচ্ছে কিছুটা, ছায়াটা কি আদৌ আমার পিছু ছাড়বে।
আজকের জন্য আল্লাহর রহমতে ছাড়া পেলাম, এরপর কি পাব!
(চলবে)
জ্বীনবর ৫
পর্বঃ০৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মাঝরাতে বোন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে জাগায়। ওর চোখে-মুখে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোর কি হয়েছে বোন?
বোন এতটাই হাপাচ্ছে যে কোনো কথা ই বলতে পারছেনা।
আমি উঠে পানির গ্লাস এনে ওর হাতে দিতেই এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি খেয়ে নিল।
আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
– কি হয়েছে বোন? এভাবে হাপাচ্ছিস কেন?
খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস!
ও আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়াল। আমি মুচকি হেসে বললাম, ভয় পাসনা তো, আয় আমার কোলে মাথা রাখ। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড়।
বোন বিনা কথায় আমার কোলে মাথা রাখল, আমি আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ও পুরোটা ঘেমে আছে, ওরনা দিয়ে ওর ঘাম মুছে দিলাম।
আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যখন ছোট্ট ছিলাম, বোনের সে কি বায়না ছিল আমার কাছে। বড় মেয়ে হিসেবে বাবার কাছে আমি একটু বেশী ই আদর পেতাম, তাই বোন যা বাবার কাছ থেকে আদায় করতে পারতনা আমার কাছে এসে বায়না করত।
দুবোনের মধ্যে অনেক ভাব ছিল। আমি ওর ২-১ বছরের বড়, তাই বোনের থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টাই বেশী ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন চলে আসে, কেমন জানি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। মুখ ফুটে কিছু বলতে চায়না, আমিও ওকে কোনো ব্যাপারে জোর করিনা। বোনটাকে খুব বিশ্বাস করি এবং ভালোবাসি।
ওর কোনো আচরণে কষ্ট পেলেও চুপ করে থাকি, পরে নিজে থেকে বুঝতে পেরে আমার সাথে সহজ হয়ে যায়। বাবা একসময় বলেছিল, ওকে দেখে রাখতে। আমি যেন সারাজীবন ওর ছায়া হয়ে আগলে রাখি। কখনো ওকে কষ্ট না দেই, ছেড়ে না দেই।
বাবাকে দেওয়া কথার মর্যাদা আমি এখনো রাখছি, ইনশা’আল্লাহ আজীবন রাখব।
ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান পড়ে গেল। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ছিলাম, আযান শুনে মাথায় ওড়না দিলাম। বোন তখনো আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে খুব আরামে, আস্তে করে ওর মাথাটা বালিশে রেখে উঠে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে নামায সেরে বুড়িমার ঘরে গেলাম। বুড়িমা এখনো ঘুমাচ্ছে, বোধহয় বোন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।
বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম, আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। হয়ত অনেকদিন পর বোনকে নিজের কাছে আগের মত করে পেয়ে।
চা বসাতেই বোন চোখ ডলতে ডলতে রান্নাঘরে চলে এল। আমি দেখে বললাম,
— এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেল?
আরেকটু ঘুমাতি, কাল তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিস।
— ক্ষুধা লেগেছে খুব। তোর এখনো নাস্তা বানানো হয়নি, বুড়িমা কোথায়?
এখনো ঘুমাচ্ছে? তুই একা একা সব করবি, উনি আছেন কি করতে তাহলে! দাড়া আমি যাচ্ছি উনার কাছে।
— বোন, উনি অসুস্থ তুই জানিস ই তো। তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি এক্ষুনি নাস্তা দিচ্ছি তোকে।
বলতে বলতে তাড়াহুড়োয় চা নামাতে গিয়ে কিছুটা গরম চা হাতে পড়ে গেল। মুখ থেকে “আহঃ” শব্দটা বেরিয়ে গেল।
বোন পিছন ফিরে দেখে কাছে ছুটে এসে হাতটা বেসিনের কাছে নিয়ে কল ছেড়ে দিল।
রাগান্বিত হয়ে বলল,
— সব ব্যাপারে তোর মাতব্বরি করতেই হয় তাইনা!
নিজেকে খুব দয়ালু প্রমাণ করতে যাস তাইনা? শিক্ষা হয়না তোর একবারে!
তোকে কে এত তাড়াহুড়ো করতে বলেছে? এখন যে পুড়িয়ে ফেললি দোষ তো আমারই দিবি।
— না বোন। সামান্য লেগেছে, সেরে যাবে।
— আস্তে ধীরে কাজ কর।
— আচ্ছা। তুই যা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
— শোন।
— হ্যা বোন।
— আমাদের কয়েকদিনের জন্য এলাকার বাহিরে যেতে হবে, একটা নতুন কাজের ডাক এসেছে।
সবকিছু নিয়ে তৈরী থাকিস। আমরা বিকেলেই বের হব।
— আমরা তো এর আগে এলাকার বাহিরের কাজ করিনি।
— তো কি হয়েছে? এবার থেকে করব।
আগে লোক আমাদের কাছে আসত, এখন প্রয়োজনে আমরা যাচ্ছি। তোর কি কোনো আপত্তি আছে?
— না আপত্তি থাকবে কেন!
কিন্তু অসুস্থ বুড়িমা একা বাসায় থাকবে কেমন করে?
উনি কি আমাদের সাথে যাবে?
— উনি গিয়ে কি করবে? ঘাড়ে করে ঝামেলা নিয়ে কি কাজ পন্ড করব! উনাকে দেখাশুনার জন্য আমি বিন্দি দাদী আর ওর মেয়ের কাছে রেখে যাচ্ছি।
উনাদের কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছি, আশা করি ঠিকমত দেখাশুনা করবে।
তুই এত কথা না বাড়িয়ে যেটা বললাম, সেটা মাথায় রাখ।
চুপচাপ শুনে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
হাতের সব কাজ সেরে ব্যাগ গুছালাম। বোন বোধহয় গাড়ি ডাকতে গেছে। বাড়ির চাবির গোছা বুড়িমার হাতে দিয়ে বললাম, নিজের খেয়াল রেখো। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ফোন দিয়ে জানিও।
আর আমি প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোজ নিব তোমার।
বুড়িমা দুঃখীমুখ করে বললেন, আগে কখনো এলাকার বাহিরে যাসনি, তার উপর এসব ভয়ানক কাজে যাচ্ছিস। সাবধানে থাকিস। তোদের নিয়ে আমার খুব ভয় হয়।
— আহা, বুড়িমা। চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমার সহায় হবেন। আর বোন তো আছেই। তুমি শুধু নিজের খেয়াল রেখো।
বাহিরে থেকে বোনের ডাক ভেসে আসল। বুড়িমাকে সালাম করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে, বোন দরজা খুলে দিয়ে আমাকে ভেতরে উঠে বসতে বলে।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলতে শুরু করে, এই প্রথম এলাকার বাহিরে যাচ্ছি। যেমন সংকোচ, তেমনি অস্বস্তি অনুভব করছি।
বোনকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? সেটা কত দূরে? কিংবা কতদিন থাকতে হবে?
কিন্তু ও রেগে যাবে সে ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিনা। একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি, বোন ফোন টিপা নিয়ে ব্যস্ত।
প্রকৃতিটা যে আল্লাহ এত সুন্দর করে বানিয়েছেন, যত দেখছি মুগ্ধ হচ্ছি। জানালা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে অনেক বাতাস ঢুকে আমার চোখ-মুখ ছুয়ে গেল, এর অনুভূতিটাই অন্যরকম।
বোন ফোন থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— জানালা খুলেছিস কেন?
— না আসলে… বন্ধ করে দিব?
— না থাক।
তোকে কিছু কথা বলে রাখি, আশা করি সেগুলো শুনবি আর মেনে চলবি।
এবারে যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেটা খুব ভয়ানক জায়গা। সবকিছু খুব একটা সহজ হবেনা, তার উপর সেখানে রাত হলে হিংস্র প্রাণী এবং চোরাকারবারি দলের লোকেরা ঘুরাঘুরি করে।
অতএব, অনেক সাবধানে থাকতে হবে।
এলাকাটা জ্বীনের বাসস্থান নামেই পরিচিত। সবচেয়ে ভয়ানক আর হিংস্র জ্বীনের বসবাস সেখানে।
— এত ঝুকিপূর্ণ জায়গা জীবনের ঝুকি নিয়ে না গেলে হত না বোন? কি দরকার এসব ঝামেলায় জড়ানোর!
ফিরে গেলে ভাল হয়না! আমার ভয় লাগছে শুনে।
— ক্ষেপেছিস? এতদূর এসে ফিরে যাব।
তুই জানিস কাজটা করতে পারলে কত টাকা পাব আমরা। সে এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাকে তলব করেছে।
— বোন টাকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী।
ওদের কাছে আমরা কিছুই না, যেকোনো সময় যেকোনো ক্ষতি ওরা আমাদের করতে পারে।
চল, বোন আমরা ফিরে যাই।
— তোকে সাথে আনাটাই আমার ভুল হয়েছে।
যা, তুই এখানে নেমে যা। বাস ধরে বাড়ি ফিরে যা, আমি সেখানে যাব ই। তোর যেতে না ইচ্ছে হলে বল, তোকে বাড়ী পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেই।
— না আমি তোর সাথে যাব।
এতবড় বিপদের মুখে তোকে আমি ছেড়ে যেতে পারবনা।
— তাহলে চুপচাপ চল।
এসব নিয়ে অযথা ঘ্যান ঘ্যান করবিনা।
বোনের জেদের কাছে হার মেনে অগত্যা চুপ করে রইলাম। ও যেহেতু একবার যাবে বলেছে, আমি শত বুঝিয়েও ওকে আটকাতে পারবনা।
কিন্তু এত ঝুকি নেওয়াটা সত্য খুব ভয়ের। আল্লাহ ই জানে, কি অঘটন ঘটতে যাচ্ছে।
সন্ধ্যে নামার আগেই সে এলাকায় পৌছে গেলাম, এলাকাটা অনেকটা উপশহর টাইপ। এমন এলাকায় জ্বীনের বসবাস থাকতে পারে ভাবা যায়না। দুইজন লোক এসে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল। বিরাট এক পুরোনো আমলের বাড়ীর পাশের দালানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল।
বাড়ীটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম, এত সুন্দর টেরামাটির ফলক আকা বাড়ী কোথাও আছে বলে জানা নেই। কি নিখুত কারুকার্য এর প্রতিটি দেয়ালে!
বাহিরেটা এত সুন্দর, ভিতরটা না জানি কত সুন্দর। দালানটায় একটা পরিবার থাকে, শুনে যা বুঝলাম এই ভদ্রলোক ই এ পোড়াবাড়ীর মালিক এবং বোনের তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তি।
যাই হোক, রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বোন ক্লান্ত হয়ে এসেই শুয়ে পড়েছে।
নামায পড়ে উঠতেই ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী আমাদের রুমে এলেন খাবার দাবার নিয়ে। ভদ্রলোক আসতেই বোন উঠে ফ্রেশ হতে গেল। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
— আপনাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা তো!
— জ্বী না।
— জানি কাজটা আপনাদের জন্য ঝুকিপূর্ণ তাও আমাদের কিছু করার নেই। সমস্যাটা সমাধান না করলে আমাদের জন্য ই বিপদ।
— কিন্তু সমস্যাটা কি যদি একটু খুলে বলেন?
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার চোখে-মুখে এক অজানা ভয় বিরাজ করছে।
আমি ভিতরে ভিতরে আতঙ্কিত হচ্ছি, কি এমন ব্যাপার যে উনারা সেটা বলতেই এত ভয় পাচ্ছেন।
.
(চলবে)