জ্বীনবর ৫,পর্বঃ০৪,০৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
ভদ্রলোক কিছু বলতে গেলেন এই সময় বোন এসে বলল,
— এত কিছু জেনে আমাদের ফয়দা কি?
কাজ করতে এসেছি, সেটাই করি। জ্বীনরা মানুষের পাশাপাশি থেকে মানুষের ক্ষতি করে এটাই তো হয়ে আসছে যুগে যুগে।
ভদ্রলোক জোর কন্ঠে বলে উঠলেন,
— সেটার পিছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। জ্বীনেদের প্রতিশোধ প্রচন্ড ভয়ংকর হয়। একবার যদি এরা ঠিক করে প্রতিশোধ নিবে, হাজার বছর পরেও নিয়ে নিবেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— এই বিশাল প্রাসাদের পিছনেও কি কোনো প্রতিশোধের গল্প আছে?
ভদ্রলোক মাথা নাড়ালেন। অস্ফুটস্বরে বললেন,
— হয়তবা।
আমি সঠিক জানিনা, আমার পূর্বপুরুষরা ই ভালো বলতে পারবেন। তবে এইটুকু ই জানি, যে করে হোক এদের দমাতে হবে। নাহলে আমাদের জীবন সংকটাপন্ন এবং প্রাসাদের ইতিকথা শেষ হয়ে যাবে।
ভদ্রলোকের কথাগুলো ভীষণ এলোমেলো লাগছে। বুঝতে পারছি না কিছুই। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, বোন ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আপনি চিন্তা করবেননা। কাল রাতে আমরা ওখানে যাব।
আমরা এখন অনেক ক্লান্ত, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।
একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
— হ্যা অবশ্যই। আপনারা বিশ্রাম নিন, কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন। আসছি আমরা।
ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।
আমি উঠে জানালার পাশে এসে দাড়ালাম। এখান থেকে প্রাসাদের কিছুটা অংশ অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে কিছু বোঝার উপায় নেই।আমি বলে উঠলাম,
— বোন ভদ্রলোকের কথা কেমন জানি গড়মিল লাগল।
বোন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে বলল,
— তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
তোকেও এতকিছু ভাবতে হবেনা। ভালোয় ভালোয় কালকে কাজটা সম্পন্ন করতে পারলেই হল।
ঘুমাতে আয়। আমি আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম। মনের খচখচানি কোনোভাবেই দূর হলোনা।
খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গল আমার। ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিলাম। এখানকার সকালটা ভীষণ মনোরম, পরিবেশটা দেখার জন্য বাহিরে বের হলাম।
চারিদিকে হালকা মৃদু বাতাস বয়ছে, পাখিদের কলরবে মনটা ভরে গেল। হাটতে হাটতে প্রাসাদের সামনে এসে দাড়ালাম। হালকা রোদ পড়ে প্রাসাদটাকে আরো বেশী সুন্দর লাগছে। চারিদিকটা জঙ্গলে ছেয়ে গেছে, অদ্ভুতভাবে এইদিকের পরিবেশ একদম থমথমে। কোনো পাখির ডাক পর্যন্ত নেই।
কি এক অজানা আকর্ষণ আমাকে প্রাসাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সব ভুলে আমি জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। জঙ্গলের মাঝামাঝি আসতেই কিছু একটা আমার পা চেপে ধরল। চমকে উঠে পায়ের দিকে তাকালাম, ভীষণ কিউট একটা বিড়াল আমার পা ধরে আছে।
এত্ত কিউট বিড়াল আমি আগে কখনো দেখিনি, দেখলে ই মায়া কাজ করে। বিড়ালটাকে কোলে নেওয়ার জন্য যেই হাত বাড়ালাম, সে ছুটে জঙ্গলের বাহিরের দিকে দৌড় দিল।
আমিও তার পিছু নিলাম। কখন যে জঙ্গল থেকে বের হয়ে গেলাম বুঝতেই পারলামনা, কিন্তু আশেপাশে কোথাও বিড়ালটাকে দেখলামনা।
বোন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
— একা একা এখানে এসেছিস কেন?
আমি আস্তে করে উত্তর দিলাম, হাটতে হাটতে চলে এসেছি।
— তোকে বার বার নিষেধ করেছিলাম একা একা কোথাও যাবিনা। তাও এলি কেন?
তোকে খুজতে আমাকে এখানে আসতে হল? টেনশান দিয়েই তুই আমাকে মেরে ফেলবি।
— এমনটা আর হবেনা বোন। তুই রাগ করিসনা।
— চল এখান থেকে।
— আচ্ছা।
বোনকে অনুসরণ করে চলে যাচ্ছিলাম, কৌতুহলবশত পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি বিড়ালটা জঙ্গলের মুখে লেজ গুটিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনিতো এখানে এটাকে আমি দেখিনি, পলকে কোথায় থেকে চলে এল!
সন্ধ্যে নামতেই বোন গোছগাছ করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। আমি গালে হাত দিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছি। আজ অমাবস্যা কিনা জানা নেই।
তবে চারিদিকটা ঘোর অন্ধকারে ঢেকে আছে। অজানা আতঙ্কে বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। বার বার বুলি আওড়াচ্ছি, আল্লাহ আপনি আমাদের সহায় হন।
আল্লাহর নাম নিয়ে দুইবোন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ীটার উদ্দেশ্যে। জঙ্গলটাতে ঢুকতেই এক গা ছমছম অনূভুতি বিরাজ করতে লাগল।
মনে হচ্ছে আমাদের আশে পাশে কেউ আছে, আমাদের উপর নজর রাখছে। জঙ্গল পেরিয়ে প্রাসাদের কাছাকাছি আসতেই দেখি বিশাল দরজা টা হাট করে খোলা, যেন কেউ আমরা আসব জেনে এভাবে খুলে রেখেছে।
বোন টর্চের আলো এদিক সেদিক মেরে চারিদিকটা ভাল কপ্রে দেখে নিচ্ছে। ছাদের দিকের দালানে আলো পড়তেই একদল বাদুর শব্দ করে উড়ে গেল।
জঙ্গলটাতে আর অন্য কোনো প্রাণী চোখে পড়লনা। বোন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকে ভালোকরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বাহিরের দিকটার চেয়ে ভিতরের দিকটা বেশী সুন্দর, নিখুত কারুকার্য ছোয়ানো প্রতিটা দেয়াল। যদিও কোথাও কোথাও চুন সবং আস্তর খসে পড়েছে। কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল ঝুলে আছে, এত্ত পরিমাণ ধুলোয় পরিপূর্ণ চারিদিক যে বার বার কাশি হচ্ছে আমাদের।
হঠাৎ করে দরজাটা সশব্দে নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। উপরের দালান থেকে চাপা কান্নার স্বর, আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। এত কোলাহলের মধ্যেও কিছু একটার সুক্ষ্ম আওয়াজ আমার কাবে আসল। উপরের দিকে একবার তাকিয়ে বোনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজেও সরে পড়লাম। সাথে সাথে মাথার উপরে ঝুলে থাকা মাঝারি ঝাড়বাতি বরাবর নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেল।
বোন এই ঘটনাতে ভিমড়ি খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বামদিকের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
— বোন এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
বোন কোনো উত্তর দিলনা। উপরে উঠতেই একটা কালো ছায়া আমাদের সামনে এসে দাড়াল। বোন সেটা দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার টাল সামলাতে না পেরে পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে যেতে নিল। আমি সাথে সাথে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলাম, ধরতে গিয়ে আমার হাতের টর্চটা নিচে পড়ে বোধহয় ভেঙ্গে গেছে।
দুবোন অন্ধকারের মাঝে ডুবে গেলাম। বোনের টর্চটা যে কোথায় পড়ে গেছে! হাত টেনে বোনকে উপরে তুললাম। এই সময় মনে হল আমাদের চারপাশটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে অন্যদিকে ফেলে দিল।
ধাক্কা খেয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেলাম।
অন্ধকারে নিজেকে একটা অসহায় কীটের মত মনে হচ্ছে। আমার চারপাশে অনেকগুলো ছায়ার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি।
ঘাড়ের উপর পড়া আগুনের মত তপ্ত নিঃশ্বাস যেন আমাকে ঝলসে দিচ্ছে।
সরে পড়তে গিয়ে কিছু একটার সাথে পা বেধে মেঝেতে পড়ে গেলাম। সাথে সাথে ভারী কিছু আমার কপাল বরাবর পড়ল। চারপাশটা কেমন ঘোলা ঘোলা লাগল, হয়ত এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব আমি।
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৫
পর্বঃ০৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
জানিনা কতক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরল, ফেরার পর নিজেকে এক মুক্ত পরিবেশে আবিষ্কার করলাম। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকালাম, আমি পোড়াবাড়ীর ছাদের উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে আধ-শোয়া অবস্থায় পড়ে আছি।
ভেবেই পেলাম না আমি এখানে কি করে এলাম!
আর বোন কোথায়, বোনের কোনো ক্ষতি হলনা তো। উঠতে যাব, চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। চারিদিকটা এত অন্ধকার নামার পথটা কোনদিকে সেটাও ঠাহর করতে পারলামনা।
অসহায়ের মত আগের জায়গায় বসে পড়লাম। মাথার এক পাশটা এখনো ব্যথা করছে, বোনের কথা ভেবে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল।
কয়েকবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বোনকে ডাকলাম। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অসহায়ের মত হাটুতে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলাম।
কারো পায়ের ধীর শব্দ শুনে আমার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে গেল। মাথা তুলে সামনে তাকালাম, মনে হল একটা অবয়ব আমার সামনে মূর্তিমান। অন্ধকারে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
— কে আপনি??
একটা সুমধুর পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল,
— আসসালামু আলাইকুম।
গভীর রাতের অন্ধকারে এমন নির্জন বাড়ীতে পুরুষের কন্ঠ পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। আমার সাথে যা ঘটল তা থেকে বুঝলাম এখানে কোনো মানুষের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব।
তবে কি এই লোকটি কোনো চোরাকারবারি দলের সদস্য? নিজেকে আত্মগোপন করতে এই বাড়ীতে লুকিয়ে আছে।
ভয়-আতঙ্ক মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
— কে আপনি? এখানে কি করে এলেন?
নিজের আসল পরিচয় দিন।
— সর্বপ্রথম সালামের উত্তর নিতে হয়।
মনে মনে ভাবছি, সালামের উত্তর নিব কি করে? ভয়েই আমার কাপুনি উঠে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— ওয়ালাইকুম আসসালাম।
— আপনার শরীর এখন কেমন?
— আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
— অবশ্যই দিব। তবে আগে আপনি আমার উত্তর দিন।
— আমার শরীর এখন ঠিক আছে।
শুধু বুঝতে পারছিনা আমি এখানে কি করে এলাম!
— শান্ত হোন। আপনি জানতেন না এই বাড়ীটা ভীষণ বিপদজনক?
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
— তাও আসলেন কেন? নিজের জীবনের মায়া নেই বুঝি!
আল্লাহ আপনার হেফাজত করেছেন বলেই এত বড় বিপদ থেকে বাচতে পারলেন।
আল্লাহ ‘ই সর্বোত্তম রক্ষাকর্তা।
উনার কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত লাগছে। মনে হচ্ছে, ইনি কিছুতেই খারাপ প্রকৃতির মানুষ হতে পারেননা। কিন্তু উনি ই বা কে?
এখানে থাকেন কেন! আমার বিপদের ব্যাপারে জানলেন কি করে? উনি বিনীতকন্ঠে বললেন,
— চলুন, আপনাকে এখান থেকে বের করে দেই। আমি আর চুপ থাকতে পারলামনা, জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
— আপনি আসলে কে? এত রাতে এই নির্জন জায়গায় কি করছেন?
উনি হালকা শব্দ করে হেসে বললেন,
— সত্যটা বললে ভয় পাবেন না তো?
— ভয় পাব কেন? আপনি কি সন্ত্রাসী বা চোরাকারবারীর দলের কেউ?
— তার ও বড় কিছু।
— মানে?
উনি একটু চুপ থেকে বলল, ছাড়ুন। আপনাকে এখান থেকে বের করে দিই আসুন। পরিচয়ের ব্যাপারটা না হয় তোলা থাক, শুধু নিজের মনকে দূর্বল করে কোনো লাভ আছে!
— আপনি কি আমাকে ভীতু প্রমাণিত করছেন? সত্যটা শুনলে হয়ত একটু আতঙ্ক কাজ করবে, এমন নয় যে আপনি জ্বীন বা হিংস্র প্রাণী। শুনেই ভয়ে লাফাব।
কথাটা বলার পর আমি নিজেই অবাক হলাম, এভাবে কখনো কারো সাথে তর্ক করিনি। কিন্তু, উনার পরিচয়টা না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিনা।
— যদি বলি আমি ওইরকম কিছু ই।
— মজা করছেন আমার সাথে?
— একদম ই না। আমি সত্যিই একজন জ্বীন।
শুনে আমার ভেতরের আত্মাটা কেপে উঠল। অন্ধকারেও যেন তার দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
— আপনি জ্বীন!!!!
— বললামনা, ভয় পাবেন। শুধু শুধু ই জোর করলেন। ভয় পেয়ে এখন এখান থেকে পালাতে যাবেন না যেন।
ঘন অন্ধকারে হোচট খেয়ে পড়ে যাবেন।
— আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিনা।
একজন জ্বীন আমার সামনে, অথচ সে আমার কোনো ক্ষতি করছেনা। তখনকার মত আমার উপর নির্যাতন করছেনা।
— আমি আপনার ক্ষতি করতে আসিনি।
আপনাকে বিভিন্ন ক্ষতি থেকে আগলে রাখতে এসেছি।
— মানে??
— মানে কি এখনি জানতে হবে! আল্লাহর ইচ্ছেতে যদি আবার কখনো মুখোমুখি হই, তখন না হয় বলব।
এখন আসুন, এই ভয়ংকর জায়গা থেকে আপনাকে বের করে দিই। এই জায়গাটা আপনার জন্য একদম ই নিরাপদ নয়, আর কখনো এখানে আসবেননা।
আমি আর কথা বাড়ালামনা। হয়ত পরে জানাটাই আমার জন্য ভাল হবে। আগে এই ভয়ংকর জায়গা থেকে মুক্ত হই।
চারিদিকে নিকষ অন্ধকার দেখে উনাকে বললাম,
— এই অন্ধকারে আমি নিচে নামব কি করে?
আমি তো নিজের অবয়বটাও দেখতে পাচ্ছিনা।
— বুঝতে পেরেছি।
আমি আপনার দিকে আমার হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছি, আপনি শক্ত করে ধরে সাবধানে পিছু পিছু হাটতে থাকুন।
বলার পর ই একটা শুভ্র সাদা হাত আমার দিকে এগিয়ে আসল। এতটাই উজ্জ্বল যে অন্ধকারে কিছুটা বুঝাতে পারছিলাম। আমার কাপা হাতটা যেন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা হাতটা ধরার। কয়েকবার ধরতে গিয়েও থমকে গেল।
উনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরলেন। সাথে সাথে আমি শিহরিত হয়ে গেলাম, এত্ত কোমল এবং ঠান্ডা হাত কারো হয় কখনো জানা ছিলনা।
উনি আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে হাটতে লাগলেন, আমি একপ্রকার অন্ধের মত উনার পিছু পিছু পা ফেলতে লাগলাম।
নিচে নামার দু-তিনটা সিড়ি বাইতেই সিড়ির এক অংশ ভেঙ্গে আমি পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলাম। সিড়িগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, কারো পক্ষেই সাধারণ ওজন নিয়ে উঠানামা করা সম্ভব না।
অদ্ভুত ব্যাপার, আমি তাহলে কি করে ছাদে উঠলাম। আর ছেলেটিও এতগুলো সিড়ি বেয়ে নামল, তার ভারে সিড়ির কিছু হলনা।
উনি দাড়িয়ে পড়ে বললেন, অনেক পুরোনো বাড়ি, আস্তর খসে সবকিছুই ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। আপনি নিজের ভার নিয়ে এই সিড়ি দিয়ে পায়ে হেটে নামতে পারবেননা।
— তাহলে আমি নামব কি করে!
— যেভাবে উঠেছিলেন।
— আমি জানি আমি কিভাবে উঠেছিলাম! আমার এখন সত্যিই দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
— দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপনি নামতে পারবেন।
— কি উপায়ে!!
দেখছেন ই তো, আমার সাধারণ ভারেই সিড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে।
— আপনাকে আমি কোলে তুলে নিচ্ছে, কোলে তুলে সিড়ি পার করে নামিয়ে দিব।
— আমি আপনার কোলে উঠব? এসব কি বলছেন!
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!
— এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। আপনি এখান থেকে উঠতেও পারবেননা আর নামতেও পারবেননা।
যে সিড়িটাতে দাঁড়িয়ে আছেন, সেটাতেও বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেননা। যেকোনো সময় সেটা ভেঙ্গে আপনি নিচে পড়ে যেতে পারেন।
— আপনি নাকি জ্বীন? ম্যাজিক করে এক মূহুর্তে নামিয়ে দিতে পারেননা! এর জন্য কোলে নিতে হয় নাকি!
— আমি জ্বীন বলেই আমার ভারে সিড়ির কিছু হচ্ছেনা।
দেখুন, হাতে বেশী সময় নেই। আপনি কোলে উঠবেন কিনা বলুন!
আমি তো শাকের করাতে পড়লাম। উনার কোলে উঠা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ভাবতে ভাবতেই সিড়ির কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ে গেল।
আমি তাড়াতাড়ি করে বলে ফেললাম,
— ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি আমাকে কোলে তুলে নিন, নাহলে এক্ষুনি সিড়ি ভেঙ্গে পড়ে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।
উনি মূহুর্তে আমাকে পাজকোলা করে তুলে নিলেন। সাথে সাথে সিড়ি পুরোটাই ভেঙ্গে পড়ে গেল। আল্লাহ রক্ষা করেছেন, আর এক মূহুর্ত দেরী হলে যে কি হত।
ভেবেই নিজের অজান্তে উনার পোশাকের বুকের অংশটুকু শক্ত করে আকড়ে ধরলাম।
এইদিকে উনি তো একনাগাড়ে হেসেই যাচ্ছেন, আমার খুব লজ্জা লাগছে। কিছুটা বিব্রত অনুভব করছি।
কিছু বলতেও পারছিনা, সহ্য ও করতে পারছিনা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে হাসি থামানোর জন্য উনার বুকে সজোড়ে চিমটি কাটলাম।
উনি হাসি বন্ধ করে হালকা ব্যথার শব্দ করে উঠলেন। আমাকে বললেন,
— চিমটি কেটেছেন কেন? এখন ফেলে দিব কোল থেকে?
— নাহ নাহ। কি করছেন কি, আমি তো পড়ে যাব।
— বেশ হবে। চিমটি কাটলেন কেন? ব্যথা লাগেনি আমার!
— সামান্য চিমটির ব্যথা সহ্য করতে পারেননা কিসের জ্বীন আপনি?
— আমি যেহেতু জ্বীন ই নই, তবে আপনাকে কোলে ধরে আছি কেন! ফেলেই দিই?
— নাহ!! আমি মজা করেছি। ফেলবেননা, আমি আর কিছু করবনা। আপনি সাবধানে সিড়ি বেয়ে নামুন।
— ঠিক তো??
তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি সিড়ি বেয়ে শেষ না করছি, আপনি কান ধরে থাকুন।
— এসব কি শর্ত? একদম অনুচিত এসব।
— আপনি আমাকে জ্বালাতে পারেন, আমি পারিনা! না ধরলে আমি আর পা ও নামবনা।
এবার সিদ্ধান্ত আপনার।
— আচ্ছা তাই হবে। আমি কান ধরছি।
আপনি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি নামুন।
— আমি মালবাহী গাড়ি না, বুঝলেন।
যে এত ভারী ওজনের জিনিস নিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটব!
— আমি অনেক ভারী!!!
— তা নয়ত কি!
যেভাবে নামছি, ওইভাবেই নামতে দিন।
আমি চুপ করে কান ধরে রইলাম। একটু পর উনি আমাকে মেঝেতে নামিয়ে সদর দরজা খুলে দিলেন। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে জঙ্গলের বাহিরে নিয়ে এলেন।
এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— সামনে আলো জ্বলছে। এবার নিশ্চয়ই যেতে পারবেন।
— জ্বি পারব।
— আসুন তাহলে। ফি-আমানিল্লাহ।
— আল্লাহ হাফেজ।
কিছুটা এগোতেই আবার পিছন ফিরে উনাকে ডাকলাম, শুনুন। ততক্ষণে উনি সেখান থেকে গায়েব, চারপাশে কোথাও নজরে পড়লনা। হয়ত চলে গেছেন।
আমি আর না দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের ভিটের দিকে হাটা দিলাম। সামনে আলো এসে পড়েছিল বলে আর কোনো অসুবিধা হয়নি।
ভদ্রলোকের বাসার দরজার সামনে আসতেই বোনকে বলতে শুনলাম, আমি জানিনা কিছু! আপনি যে করে হোক আমার বোনকে ওখান থেকে বের করে এনে দিবেন।
আপনার দায়িত্ব এসেছি আমরা, আমার বোনকে ছাড়া আমি এখান থেকে একপা ও নড়বনা।
সব দায়ভার আপনার। যে করেই হোক, আমি আমার বোনকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আমার সামনে দেখতে চাই।
ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর শোন যাচ্ছে, আপনি শান্ত হন আফরাহ। সকাল হতে দিন আমরা ওই বাড়ী থেকে আপনার বোনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব। এতরাতে আর কিছুই করা সম্ভব না।
আমি এক মূহুর্ত দেরী না করে ভেতরে ঢুকলাম। বোন আমাকে দেখে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল। তারপর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কোথায় ছিলি মুশু?
ঠিক আছিস তো? তোর কোনো ক্ষতি হয়নি তো!
— আমি একদম ঠিক আছি বোন।
তুই ঠিক আছিস তো?
— আমি ঠিক আছি, সামান্য চোট পেয়ে বাহিরে বের হয়ে এসেছি। পিছনে ফিরে দেখি তুই নেই, অনেকবার ডাকলাম সাড়া দিলিনা।
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম প্রচুর। তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমার থেকে আলাদা হলি কেন!
— আসলে আমি চোট পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর….. থেমে গেলাম এইটুকু বলে। জ্বীনের কথাটা কি বোনকে বলা ঠিক হবে। বোন বিশ্বাস করবে, আর যদি করেও আমাদের শত্রু ভেবে জ্বীনটাকে কিছু করে বসে।
— চুপ করে গেলি কেন?
— না মাবে, তারপর জ্ঞান ফিরতেই বহুকষ্টে পথ চিনে জঙ্গল থেকে বের হতে পারলাম। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন, উনিই আমার হেফাজত করেছেন।
ভদ্রলোক বলল, এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপনারা ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিন। অনেক ধকল গেছে আপনাদের উপর, আগে শরীর-মনকে বিশ্রাম দিন।
— আচ্ছা। চল মুশু, ঘরে যাই।
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলাম।
.
(চলবে)