জ্বীনবর ৫,পর্বঃ০৬,০৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০৬
মাঝরাত শেষ হয়ে আসছে প্রায়, এখনো ঘুম আসছেনা। বার বার শুধু উনার কথা ই মনে পড়ছে। আজ যদি আল্লাহর রহমত হয়ে উনি না আসতেন তাহলে যে কি হত!
আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম না আসায় উঠে জানালার পাশে দাড়ালাম। বোনের দিকে একবার তাকালাম, সারাদিনের ঝড়-ঝামেলার পর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
জানালা খুলতেই হু হু করে হালকা বাতাস ঢুকল। জানালা থেকে পোড়াবাড়ীর ছাদ টা দেখার চেষ্টা করলাম। কেন জানি উনাকে বার বার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে!
হঠাৎ মনে হল, পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরাতে গেলে কেউ বলে উঠল,
— আমার কথা ভাবছিলেন??
— কে? বলে ঘাড় ঘুরাতেই কাউকে দেখতে পেলামনা।
— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি সেই জ্বীন।
— আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন? কোথায় আপনি?
— আমি অদৃশ্য হয়ে আছি তাই দেখতে পাচ্ছেননা।
— কেন সামনে আসতে ভয় পান বুঝি!
— তা নয়। এই ঘরে আপনি ছাড়াও অন্য একজন আছেন। তার যদি কোনোভাবে ঘুম ভেঙ্গে যায়, উঠেই যদি আমাকে দেখে নেয় কি হবে বুঝতে পারছেন?
— বুঝতে পেরেছি। আপনি প্রাসাদ ছেড়ে এখানে আসলেন যে?
— একটা কথা আছে জানেন তো, যদি কেউ কাউকে খুব বেশী স্মরণ করতে থাকে, সে তার সামনে আসতে বাধ্য।
আমি এই নিয়ম অমান্য করি কি করে?
— তা কে আপনাকে স্মরণ করছে, যার টানে আপনি চলে আসলেন?
— নিজের মুখে নিজের নাম নিতে লজ্জা লাগে নাকি আমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে?
— আমি আপনাকে স্মরণ করেছি ঠিক ই, কিন্তু এত বেশী তো করিনি যাতে আপনাকে আমার সামনে আসতে হয়।
— আচ্ছা, তাহলে চলেই যাই।
— আরেহ শুনুন। এসেছেন যখন কিছুক্ষণ থাকতে সমস্যা কি! তাছাড়া আপনার নাম- পরিচয় ও তো জানা হলনা।
— আমার পরিচয় আমি একজন জ্বীন। এর বাহিরে আর কোনো পরিচয় নেই, হ্যা তবে একটা নাম আছে।
মেহরাব।
— কোথায় থাকেন আপনি?
— আপাতত আপনার পাশেই আছি।
— আচ্ছা!! বেশ মজা করেন তো আপনি।
আমার নাম জিজ্ঞেস করবেননা?
— জানি তো। যতটা জানার ততটুকু জেনে নিয়েছি।
— কি জেনে নিয়েছেন?
মনে হল উনি আমার খুব কাছে এসে দাড়ালেন। তার নিঃশ্বাস আমার চোখে-নাকে লাগছিল। আমার মধ্যে একরকম ভালোলাগা কাজ করছে।
— এটাই জানি যে, আপনি খুব ই ভীতু।
অল্পতেই আতঙ্কে কাপুনি উঠে যায় আপনার। বলে অট্টহাসি দিল সে। রাগ লাগলেও তার হাসির শব্দ টা ভীষণ ভালোলাগছিল। মুক্তা ঝরা হাসি সম্ভবত এটাকেই বলে।
হঠাৎ ফজরের আযান পড়ে গেল। উনি হাসি থামিয়ে বলল,
— আসি তাহলে?
— আবার কখন আসবেন?
— আপনি যখন খুব বেশী স্মরণ করবেন। আল্লাহ হাফেজ।
ঘরের মধ্যে থাকা বাতাস বাহিরের দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে মুচকি হাসতে লাগলাম। জ্বীন হলে কি হবে এই ছেলেটা একটা পাজির ছড়া।
জানালা বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়তে চলে গেলাম।
সারাদিনটা আমার কেমন কাটত নিজেও বুঝতামনা। অকারণেই বার বার পোড়াবাড়ীটার দিকে তাকাই। ইচ্ছে হয় আরেকবার যাই সেখানে, উনার সাথে দেখা করে আসি।
উনার কথা আর হাসি শুনি।
কিন্তু সেরাতের কথা মনে পড়লে বাড়ীটার দিকে তাকাতেও ভয় লাগে। অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকার পর টের পেলাম কেউ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
তবে কি উনি এসেছেন? বেশী বেশী স্মরণ করার কারণে উনি আমার কাছে আবার এসেছেন?
এত্তটা আনন্দ নিয়ে পিছনে তাকানোর পর বোনকে দেখে মনটা ভার হয়ে গেল। বোন আমার এই অবস্থা দেখে বলল,
— কি হয়েছে তোর?
— কই কিছু না তো। নিঃশব্দে এভাবে দাড়িয়েছিলি যে!
— একপলকে জানালার দিকে চেয়ে আছিস কেন? আসার পর থেকে তোকে এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন?
সত্য করে বল তো। বলেই আমার বাহু অনেক শক্ত করে চেপে ধরল। আমি বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ রাগ উঠল কেন ওর!
— তেমন কিছুনা। গতকালকের ভয়ংকর ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবছিলাম।
— তুই কি সত্য ই এটা ভাবছিলি?
নাকি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছিস!
— কিচ্ছু লুকাচ্ছি না বোন। আমার হাতে ব্যথা লাগছে খুব।
— এখানে এসে তোর অনেক অধঃপতন হয়েছে। আমার কোনো গুরুত্ব ই নেই তোর কাছে, জাস্ট পাত্তা ই দিচ্ছিসনা।
শোন, অতি বাড় বাড়িসনা, ঝড়ে পরে যাবি।
— আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দে বোন।
সত্যিই আমি হাতে খুব ব্যথা পাচ্ছি।
বোন আমার হাতটা ঝেড়ে ছুড়ে ফেলল। এত্ত জ্বলছিল আর ব্যথা করছিল হাতের উপরের অংশ। জামার হাতা একটু উঠিয়ে দেখিয়ে ওর পাচ নখের-ই গভীর দাগ বসে গেছে।
ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল অল্প অল্প।
জ্বলুনিটা সহ্য হচ্ছেনা। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম। আয়নার দিকে কান্না পাচ্ছিল খুব, কেন বোন হঠাৎ করে আমার সাথে এত কঠোর হয়ে গেল!
বাবা আমি কি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলামনা। বোনের সাথে কোনো অন্যায় করে ফেললাম!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বোনকে খুজতে লাগলাম। ভদ্রলোক আমাকে এভাবে ছুটতে দেখে বলল,
— আফরাহকে খুজছেন??
— ও কোথায় গেছে আপনি বলতে পারবেন?
— হ্যা, বলে তো গেল আমাদের শহরের বাজারে গেল। কিছু দরকারী জিনিসপত্র লাগবে।
যাওয়ার সময় বলল, ফিরতে খানিকটা দেরী হবে।
আপনি চিন্তা করবেননা।
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, বোন রাগ করে একা বেরিয়ে গেছে। এখানকার কিছুই তো ও ঠিক করে চিনেনা, যদি কোনো বিপদে পড়ে। আল্লাহ তুমি ওর সহায় থেকো।
— আপনার কি কিছু লাগবে মুশায়রা?
— নাহ। কিছু লাগবেনা।
বলে বেরিয়ে দালান থেকে কিছুটা দূরে থাকা পুকুরঘাটের সিড়িতে বসে রইলাম। মনটা ভীষণ ভার হয়ে আছে।
চোখের পানি তো থামছে ই না।
সন্ধ্যা যখন যে নেমে এল সেদিকে কোনো খেয়াল ই নেই আমার। একা একা এখানে বসে থাকতে একটু ভয় লাগছেনা, ভয়-জড়তা সব যেন মন খারাপের সাথে পালিয়ে গেছে।
ততক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানিনা।
হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ভাবলাম বোন এসেছে।
প্রায় কাদতে কাদতে বললাম,
— বোন তুই কি এখনো রাগ করে আছিস আমার উপর?
আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে বল আমি তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে শুধরে নিব।
সেই পরিচিত কন্ঠ বলে উঠল, মুশায়রা।
— আপনি এখানে!!
উনি আর কিছু না বলে আমার গাল বেয়ে পড়া চোখের পানি তার কোমল হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
উনার অন্য হাতটা আমার বাহু স্পর্শ করার সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠলাম। উনি অস্থির হয়ে বলল,
— আমি কি খুব জোরে স্পর্শ করে ফেলেছি?
— নাহ।
— তাহলে কি হল? দেখি আপনার হাত দেখি।
— ও কিছুনাহ। বাদ দিন। মশা কামড়েছিল তাই এমন করলাম।
— মুশায়রা!! অন্ধকারে উনার চেহারা দেখতে না পেলেও বুঝলাম উনি বড় বড় করে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি আস্ত একটা ঢোক গিলে জামার হাতা একটু উপরে তুললাম। ভেবেছি অন্ধকারে উনি ক্ষতস্থানটা দেখবেননা।
উনি আমার ক্ষতস্থান টায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— নিজের কষ্টটা চেপে রেখে কি লাভ হয়?
উনার কন্ঠটা কেমন ধরে এসেছিল। খানিক বাদেই টের পেলাম আমার ক্ষতস্থানটার উপর বিন্দু বিন্দু পানি পড়ছে।
— আপনি কাদছেন কেন??
— অতকিছু আপনি বুঝবেননা।
এটুকু জেনে নিন, আপনি যে প্রশস্ত হৃদয় নিয়ে এসেছেন, তার মর্যাদা দেওয়ার মত খুব কম ই মানুষ পাবেন।
আপনার সরলতা অন্যের কাছে নিতান্ত বোকামীর ন্যায়। সঠিক কদর আর ভালোবাসা আপনি আজো পাননি।
— এসব কি বলছেন? আপনার ধারণা ভুল। আমাকে সবাই খুব ভালোবাসে, আমার বোনও আমাকে অনেক ভালোবাসে।
আমার কোনো কষ্ট নেই জানেন, খুব সুখে রেখেছেন আল্লাহ আমাকে।
— আমার চোখে চোখ রেখে বলুন, আপনার কি আসলেই চাপা কষ্ট নেই!
আমি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলামনা। এতক্ষণের জমানো কান্না যেন এক্ষুণি কেদে দিলাম। কাদতে কাদতে উনার বুকে নিজের মাথাটা ঠেকালাম।
উনি আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
— ভালো মানুষের মূল্য আর কারো কাছে না থাকলেও, আল্লাহর কাছে নিশ্চয়ই আছে।
উনি অবশ্যই সঠিক প্রতিদান আপনাকে দিবেন।
— আমার কোনোকিছুতেই কষ্ট নেই জানেন। শুধু একটাই কষ্ট আমার বোনটা আমাকে বুঝেনা। অকারণেই ভুল বুঝে রাগ করে। আমার খুব খারাপ লাগে এবং ভয় ও হয়।
এই বুঝি বাবাকে দেওয়া কথা ভঙ্গ হয়ে গেল।
— এসব ভাববেননা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
উনি আমাকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলেন।
উনার পোশাকের কিছু অংশ আমার চোখের পানিতে ভিজে গেল। এদিকে উনার আর আমার কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমি এক অজানা শান্তিতে লক্ষি মেয়ের মত উনার বুকে মাথা রেখে বসে আছি, উনিও অনবরত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর আমি লজ্জা পেয়ে সরে যেতে নিলে উনার ঠোটজোড়া আমার কপালে লেগে যায়। এই সাধারণ ছোয়াতেই আমি আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি।
আমরা দুজনের কারো কাছে এটা কাম্য ছিলনা। তাই দুজনেই সংকোচিত হয়ে দূরে সরে যাই। আমি উঠে চলে আসতে চাইলে উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
— চলে যাচ্ছেন?
দুঃখিত এটা আমার ভুলবশত হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলামনা। এতটা সংকোচ এবং লজ্জা অনুভব করছি যে মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাচি।
কিন্তু এভাবে চলে গেলে উনি হয়ত মনে কষ্ট পাবেন। তাছাড়া এটা তো আমাদের কারো ইচ্ছেতেই হয়নি, ঘটনাক্রমে সাধারণ ছোয়া লেগে গেছে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— এটার জন্য দুঃখিত বলবেননা। কারো ইচ্ছাক্রমে হয়নি এটা।
— তাহলে চলে যাচ্ছেন কেন?
— না আসলে, বোন এসে যদি আমাকে খুজাখুজি করে না পায় তাহলে তো রেগে যাবে ভীষণ।
ভুল বুঝবে আমাকে।
— আপনার বোন এখনো ফিরেনি। আরেকটু বসে যান, নাহলে আমি ভাবনাতে এটাই আসবে আপনি আমার অনাকাঙ্কিত কাজে রাগ করেছেন।
আমি আবার আগের জায়গায় বসে পড়ে বললাম, না না। সেরকম কিছু নয়।
— আচ্ছা আপনার কোলে যদি আমি মাথা রাখি আপনি কি খুব রাগ করবেন নাকি মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?
— আপনি যদি আমার কোলে মাথা রেখে একটু ভালোলাগা অনুভব করেন তাতে আমি রাগ করব কেন?
রাখবেন?
উনার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি কোল পেতে দিলাম। উনি আলতো করে মাথাটা রাখলেন। এই প্রথম আমি উনার মাথা স্পর্শ করলাম, মাথা ভর্তি মোলায়েম চুল। হালকা সুগন্ধি আসছে চুল থেকে। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে চুল টেনে দিলাম।
উনার চেহারার দিকে তাকালাম, স্পষ্ট না দেখতে পেলেও বুঝলাম নূরানী চেহারা উনার, লম্বাকৃতির সরু নাক..
উনি নীরবতা ভেঙ্গে বললেন,
— আমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?
— না মানে…. হ্যা, সেরকম ই আর কি।
— দেখবেন তো অবশ্যই। যেদিন আলোতে দেখা হবে, সেদিন দেখে নিবেন।
— এখন কেন নয়?
— এখন যে অন্ধকারে তাই। বলে হাসতে লাগলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে উনার হাসি শুনতে লাগলাম।
উনি বললেন, চলুন আপনাকে বাড়ীর সামনে পৌছে দিই।
আপনার বোন হয়ত এক্ষুনি এসে পড়বে।
কেন জানিনা, আমি চাচ্ছিলামনা উনার থেকে দূরে যেতে। ঠায় বসে থাকতে দেখে উনি বললেন,
— আজো কি কোলে নিতে হবে? চাইলে কিন্তু নিতে পারি, আপনি অতটাও ভারী নাহ। ছোটখাটো আলু-সবজির বস্তার মত আর কি।
— মজা নেওয়া হচ্ছে তাইনা!
কোলে উঠার কোনো শখ নেই আমার। চলুন, যাওয়া যাক।
বাড়ীর কিছুটা দূরে উনিয়ামাকে ছেড়ে দিয়ে গায়েব। উনাকে বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকার কিছুক্ষণ পর বোন চলে এল।
আমার কাছে এসে বলল,
— দেখ তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি!
— আমার জন্য টাকা খরচ করে কি আনতে গেলি!!
— এই ধর, তোর পছন্দের বেলি ফুলের মালা।
অনেকগুলা পছন্দের বেলিফুল পেয়ে সবকিছু ভুলে গেলাম আমি। এত ভালোলাগছিল তখন যে, বোনকে জড়িয়ে ধরলাম।
বোন আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— রাগ করে থাকিসনা মুশু। আমি তো সবসময় তোর ভালোর জন্য বলি। সেসব যদি না শুনিস খারাপ তো লাগেই বল। তখন রাগটা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা।
তখন খুব লেগেছে না? দেখি কতটা আচড় লাগল, ওষুধ লাগিয়ে দিব।
— লাগেনি বোন। এখন কোনো ব্যথা নেই।
— তোর কোনো কথা শুনছিনা। দেখা আমাকে, এসব তোর ওষুধ না লাগানোর বাহানা।
বোন জোর করে জামার হাতা উঠিয়ে দেখে, কোনো ক্ষতস্থান নেই। আমিও অবাক হয়ে গেলাম, বিকালেই তো গভীর দাগ গুলো দেখলাম, মেহরাব হাত বুলানোর আগ পর্যন্ত তো ব্যথাও ছিল। বুঝতে আর বাকি রইলনা, এটা উনার ই কাজ।
ভেবেই নিজের অজান্তে মুচকি হাসি চলে গেল ঠোটের কোণে।
ছেলেটা এত ভালো কেন!
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৫
পর্বঃ০৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি শুয়ে পড়ার আগে দেখি বোন কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি করছিস এসব নিয়ে? রাত তো অনেক হল, ঘুমাবিনা।
— আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে ওই পোড়বাড়ীর জ্বীনদের জন্য। একটা কিছু না করে তো আমি ফিরবনা।
এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব, সব জ্বীনগুলোকে ওই বাড়ী থেকে তাড়াব। তার ই বন্দোবস্ত করছি।
শুনেই আমার মেহরাবের কথা মনে পড়ল। উনি ও তো সেই পোড়বাড়ীতেই আছেন। বোন অন্য খারাপ জ্বীনদের ক্ষতি করতে গিয়ে উনার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো।
বোনকে আমি কি করে আটকাব!
— তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?? যা ঘুমিয়ে পড়।
আমি কাজ শেষ করেই ঘুমাব।
— বোন, আমার একটা কথা শোন না।
এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোনো দরকার নেই। ওরা অনেক ভয়ংকর, তুই আর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করিসনা।
বোন আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি ওর হাত ধরে বললাম, আমি চাইনা তুই নতুন করে কোনো বিপদে পড়িস। সত্যিই প্রাসাদটা ভীষণ ভয়ংকর।
বোন সজোড়ে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
আর একটা কথা বলবি তো ভীষণ খারাপ হবে। এই মূহুর্তে আমি একা বাসা থেকে বেরিয়ে যাব।
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। মনে মনে মেহরাবকে অনেক বেশী স্মরণ করছি, যাতে উনি একবার হলেও আসেন। আর উনাকে আমি সর্তক করতে পারি।
কিন্তু উনি এলেননা। সারারাত ঘুমাতে পারলামনা, ছটফট করেছি শুধু।
মাঝরাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ যেন উনাকে রক্ষা করেন।
ফজর নামায শেষ করে বাহিরে বের হতে গিয়ে দেখি বোন বাসার কোথাও নেই। রাতের ঘটনার পর বোনকে আমি আর দেখিনি, কোনো সাড়াশব্দ ও পাইনি।
মেহরাবকে চিন্তিত ছিলাম বলে বোনের খোজ ও নিতে পারিনি। কিন্তু বোন গেল কোথায়!
তবে কি বোন আমার সাথে রাগ করে আবার বেরিয়ে গেল!
খুব খারাপ লাগছে। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে! এত দুশ্চিন্তা আমি আর নিতে পারছিনা, মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে।
ভদ্রলোক কে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, উনিও কিছু বলতে পারলেননা বোনের ব্যাপারে।
আমাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। আমার শরীরটা খারাপ হতে লাগল। এমনিতে সারারাত ঘুম হয়নি, তার উপর এতটা মানসিক চাপে আছি।
কোনোরকমে রুমে এসে শুয়ে পড়তেই চোখজোড়া যেন লেগে এল। অনেক চেষ্টাতেও খোলা রাখতে পারলামনা।
চোখ খুলতেই দেখি আমার মাথার কাছে বোন বসে আছে। ধড়পড় করে উঠে বসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল,
— এখন তোর শরীর ঠিক আছে তো?
হঠাৎ করে আমার মাথায় রাগ উঠে গেল। সজোড়ে বোনের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
— কোথায় ছিলি তুই? না বলে এভাবে বের হলি কেন!
তোর এইটুকু বিবেকবোধ নেই, আমি যে টেনশানে থাকব নাকি এটা তুই জানতিস না!
বোন চুপচাপ থেকে বলল,
— আমি কাজটা সম্পন্ন করতে গিয়েছিলাম এবং সেটা সম্পন্ন করেই এসেছি।
বলে উঠে চলে গেল। একটু পর আমার হিতাহিত জ্ঞান জাগ্রত হল, আমি রাগের বশে বোনের গায়ে হাত তুলে ফেললাম। যে আমি কখনো ওর সাথে উচু গলায় কথা পর্যন্ত বলিনি। আমি এটা কি করে ফেললাম, বোন মনে খুব কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই।
বাবাকে দেওয়া ওয়াদা আমি ভেঙ্গে ফেললাম।
তাড়াতাড়ি করে বোনের কাছে গেলাম। ও জানালার পাশে বসে আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি গিয়ে ওর হাত ধরে কেদে কেদে বললাম,
— বোন আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ইচ্ছে করে তোকে আঘাত করতে চাইনি, জানিনা আমার কি হয়েছিল!
আমাকে তুই যে শাস্তি দিবি আমি সব মাথা পেতে নিব, তবু তুই আমার উপর রাগ করে থাকিসনা।
— উঠ, নিচে বসলি কেন!
আমি রাগ করিনি। রাগ করলে উলটা তোকে ঝাড়ি দিতাম।
আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমাব।
বোনকে এভাবে কথা বলতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বোন কখনো এত নরম ভাবে আমার সাথে কথা বলেনি, ওর গায়ে হাত তোলার পর ও এভাবে ক্ষমা করে দিল!
আমি চোখ মুছে বললাম,
— কিছু খাসনি তো। কিছু খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।
আমি নিয়ে আসছি, দাড়া।
এমনসময় ভদ্রলোক নাস্তা নিয়ে এসে বললেন,
— আমি নিয়ে এসেছি, আপনারা নাস্তা করে নিন।
মিস. আফরাহ আপনার শরীর ঠিক তো?
— হ্যা, ঠিক আছে।
আপনি বসুন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
— হ্যা বলুন।
— আমি আপনার কাজটা করে দিয়েছি। পোড়বাড়ীতে যত জ্বীন ছিল সব বিতাড়িত হয়েছে।
আসলে ওরা অতটাও ভয়ংকর নয়, ওরা সেখানে নিরাপদে থাকার জন্য ভয়ানকভাবে আক্রমণ করে। কাউকে মারতে চায়না। আপনারা এবার নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
— ধন্যবাদ মিস. আফরাহ।
অসম্ভবটাকে যে আপনি সম্ভব করবেন আমি ভাবতেই পারিনি। আপনাদের বাকি পারিশ্রমিক আপনারা পেয়ে যাবেন। আর আপনাদের দুজনকেই ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে, আপনারা আর কয়েকটা দিন এখানে বিশ্রাম নিন।
— অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
কথাগুলো শুনে বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে উঠল। বোন সব জ্বীন এর চলে যাওয়ার কথা বলল, তাহলে কি মেহরাব ও চলে গিয়েছেন!
উনার সাথে আর কখনো আমার দেখা হবেনা। উনি এখান থেকে একেবারের জন্যই চলে গেছেন।
ভেবেই খুব কান্না পাচ্ছে আমার।
সেইসময় থেকে উনাকে কতবার স্মরণ করলাম, উনি একবারের জন্যও আমার কাছে এলেননা। মনে মনে ভেবে নিলাম, উনি সত্যিই চলে গেছেন৷ আর কখনো আমাদের দেখা হবেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি ঝড়ে পড়ল। বোন এসে পাশে দাড়াল আমার।
টের পেয়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি মুছে নিলাম।
— এখানে একা দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিস?
— হুম।
— তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ মুশু?
— নাহ তো। তোর শরীর ঠিক আছে এখন?
— হ্যা বেশ আছে। কালকেই আমরা ফিরে যাচ্ছি, আজকেই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাসের টিকেট পেলামনা।
সব গোছগাছ করে নিয়ে নে, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।
— আচ্ছা।
— চল ঘুমিয়ে পড়বি।
বেশী রাত হলে কাল বাস মিস করব।
— তুই শুয়ে পড়। আমি গোছগাছ সেরেই ঘুমাচ্ছি।
— আচ্ছা, আয় তাহলে।
বোন চলে যাওয়ার পর আমার চাপা কান্নাটা আর দমিয়ে রাখতে পারলামনা। কাল এখান থেকে চলে যাব, মেহরাবের সাথে আর কখনো দেখা হবেনা আমার।
এই কয়েকটা দিনের মূহুর্ত গুলো মনে গেথে গেছে, চাইলেও ভুলতে পারছিনা। মেহরাবের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, ইচ্ছে করছে পোড়বাড়ীতে গিয়ে উনার খোজ করি।
কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, উনি এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।
কিন্তু সত্যটা আমাকে মেনে নিতে হবে। যতই অপেক্ষা করি উনি আর ফিরবেননা।
চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে যখন রুমের দিকে চলে যাব তখন মনে হল পিছন থেকে কেউ আমার হাতটা টেনে ধরল।
অবয়ব দেখেই বুঝতে পারলাম আর কেউ নয়, মেহরাব এসেছেন।
এক ছুটে এসে উনাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। জানিনা এভাবে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরে ছিলাম। উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে শান্তস্বরে বললেন,
— এভাবে বাচ্চাদের মত কেউ কাদে!
— আপনি কোথায় ছিলেন এই কয়েকদিন? জানেন কত অপেক্ষা করেছি আমি! কত কষ্ট হয়েছে, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনি এখান থেকে চলে গেলেন কিনা!
— কেন কষ্ট পেয়েছেন?
— জানিনা আমি। এটা জানি খুব কষ্ট হয়েছিল।
— আচ্ছা। এখন কান্না করবেননা, আমি তো এসেছি।
দেখি দেখি।
বলে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন।
তারপরও আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম।
— আহা! কাদছেন কেন বোকা মেয়ে?
— কাল আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
আর কখনো কি আমাদের দেখা হবে?
— আপনি চাইলেই হবে।
— কিভাবে? আমি তো আর এখানে আসতে পারবনা।
— আমি তো আপনার কাছে যেতে পারব।
— আপনি সত্যিই আসবেন?
— আপনি স্মরণ করলে কেন আসবনা! যদি যাওয়ার পরও আমাকে মনে থাকে, স্মরণ করেন অবশ্যই আসব।
এভাবে আর কাদবেননা।
আপনাকে হাসলেই বেশী ভালোলাগে। এখন একটা হাসি দেওয়া যায়?
উনার কথা শুনে আমি হাসলাম। ভিতর থেকে বোনের ডাক এল। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমাকে যেতে হবে। আপনি কিন্তু আপনার কথা ভঙ্গ করবেননা। আল্লাহ হাফেজ।
— শুনুন।
— হ্যা বলুন। বেশী দেরী করলে বোন এখানে চলে আসবে।
উনি একটা টকটকে লাল গোলাপ আমার হাতে দিলেন। আর বললেন, এর সৌরভ অবশ্যই আমার উপস্থিতি হয়ে আপনার কাছে থাকবে।
আল্লাহ হাফেজ।
আমি উধাও হওয়া অবধি উনার দিকে অপলকেই তাকিয়ে রইলাম। অস্ফুটস্বরে বললাম, ফি-আমানিল্লাহ।
ইনশা’আল্লাহ আপনার উপহার আমার কাছে সযত্নেই থাকবে।
পরেরদিন বিকেলের দিকে আমরা বাড়ীতে পৌছে গেলাম। বুড়িমা আমাকে দেখে বললেন,
— আমার মুশুকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
সব ভালোভাবে সমাধা করেই এসেছিস তো? কোনো বিপদ হয়নি তো!
— না বুড়িমা, সব ঠিক আছে।
রাতে ব্যাগ থেকে পলি মোড়ানো গোলাপটা বের করলাম। এখনো সম্পূর্ণ তাজা রয়েছে এটি, একটা পাপড়িও শুকায়নি।
গোলাপটা ভীষণ টকটকে লাল আর বড়।
এমন গোলাপ আমি আর কখনোই দেখিনি। এর সৌরভটাও ভীষণ সুন্দর আর তীব্র।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মেহরাব আপনি কবে আসবেন? আপনাকে খুব মনে পড়ছে। আপনার উপহারটা অনেক যত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি, ইচ্ছে করে আপনাকেও এভাবে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিই।
এমনসময় বোন আমার রুমে এসে ডাকল, মুশু।
চমকে উঠলাম ডাক শুনে, সাথে সাথে গোলাপটা আমার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। ভয় লাগছিল, বোন এটা দেখলে কি ভয়ানক কান্ড হবে!
যে ভয়টা পেয়েছি সেটাই হল। বোন গোলাপটা দেখে ফেলল, মেঝে থেকে তুলে নেড়েচেড়ে দেখে বলল,
— এই গোলাপ তুই কোথায় পেলি?
আমি কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলামনা, খুব ভয় পাচ্ছিলাম। এখন কি বলব আমি! কি মিথ্যা বলব বোনকে!
.
(চলবে)