জ্বীনবর ৫,পর্বঃ১৮,১৯
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৮
সারারাত আমি মেহরাবের জন্য অপেক্ষা করলাম কিন্তু মেহরাব আর ফিরলনা। আমার মাথায় কতশত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সব মেহরাব কে জিজ্ঞেস করার ছিল। উনি তো আর ফিরলেন ই না। শেষরাতে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে উনাকে খুজতে লাগলাম।
কোথাও না পেয়ে দাদীমার কক্ষে আসলাম। কক্ষের দরজা ভিতর থেকে আটকানো, ডাকব কি ডাকব না কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে দাদীমার কন্ঠ ভেসে এল, “মুশায়রা, আমি এখন ব্যস্ত। তুমি পরে এসো।”
আমি আর না দাঁড়িয়ে কক্ষে ফিরে এলাম। মেহরাব কি দাদীমার কক্ষে অবস্থান করছে? ঠিক বুঝতে পারছিনা। মনের মধ্যে একটা দৃঢ় ধারণা হল, মেহরাব মেহেরজানের সাথে আছে। মেহরাব আমাকে অপেক্ষা করিয়ে মেহেরজানের সাথে সময় কাটাচ্ছে। কি দরকার ছিল এসব অভিনয়ের! প্রাক্তন বাগদত্তার কষ্ট উনাকে এতটাই বিমর্ষ করল যে উনি ছুটে চলে গেলেন। এইদিকে উনার বিবাহিতা স্ত্রী সারারাত উনার জন্য অপেক্ষা করছে এতে উনার কিছুই আসে যায়না।
সারাদিন যা করেছেন, এসব উনার কেবল লোক দেখানো ভালোবাসা! আমার প্রতি কর্তব্য সমাধা! এমনসময় কক্ষে মেহরাব ফিরে এল। উনাকে কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে, নিশ্চয়ই মেহেরজানকে বুঝাতে পারেননি কিংবা তার কষ্ট মেহরাবের জন্য সহ্য হচ্ছেনা! আমি মেহরাবের সামনে গিয়ে বললাম,
— আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
উনি বিছানায় বসে পড়ে বললেন, বলো।
— মেহেরজানের সাথে আপনার সম্পর্ক কি?
উনি বিমর্ষতার মধ্যে চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেহেরজানের কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?
— আমি যা যা বলছি আপনি শুধু তার ঠিক ঠিক জবাব দিন। এর বাইরে কোনো ব্যাখার প্রয়োজন নেই।
— মেহেরজান আমার প্রয়াত বাগদত্তা। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
— আপনি জানতেন মেহেরজানের সাথে আপনার বিবাহ ঠিক ছিল তাহলে আপনি কোন উদ্দেশ্যে আমাকে বিবাহ করতে চাইলেন? কেন আমাকে জ্বীনরাজ্য পর্যন্ত টেনে আনলেন?
মেহরাব একটু নীরব হয়ে রইল। তারপর বললেন,
— হ্যা আমি জানি, আমি কথা ভঙ্গকারী।
— কেবল কথাভঙ্গকারী ই নয়, আপনি একজন প্রতারক ও বটে।
মেহরাব বিস্ফোরিত চোখে আমার পানে তাকাল। আমি তা কটাক্ষ করে বললাম,
— যে পুরুষ বাগদত্তা থাকা সত্ত্বেও তাকে ঠকিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিবাহ করতে পারে, নববিবাহিতা স্ত্রীকে তোয়াক্কা না করে বাগদত্তার কষ্টে ছুটে যায় এবং সারারাত তার সাথে কাটায় তাকে কি কেবল কথাভঙ্গকারী কিংবা প্রতারক বলা যায়!
মেহরাব কিছু না বলে বেরিয়ে যেতে চাইল। আমি তাকে আটকে বললাম, এভাবে আর কতদিন পালাবেন! আর কোথাও পালানোর সুযোগ নেই আপনার।
— মুশায়রা তুমি মাথা ঠান্ডা করো তারপর আমি তোমাকে সব খুলে বলব। তুমি যে ধারণা পোষণ করছো তা সম্পূর্ণ ভুল।
— কোনটা ভুল? সারারাত মেহেরজান আপনার সাথে ছিলনা? আপনি বাগদত্তা থাকাসত্ত্বেও আমাকে ঠকাননি।
— সব ই ঠিক। কিন্তু তুমি শান্ত হয়ে সবটা শুনো।
— আর কিছুই শোনার নেই। আমার ভুলটা কি ছিল বলুন তো! আপনি জ্বীন জেনেও আপনাকে ভালোবেসে এত কিছু সহ্য করে জ্বীনরাজ্যে আসা! অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম।
আর কিচ্ছু চাইনা আমার, আমি এই সম্পর্কটা শেষ করতে চাই। আপনি আমার এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
মেহরাব আমার গাল দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
— তুমি এসব কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?
এভাবে ভুল বুঝোনা আমাকে।
— ঠিক বুঝার রাস্তাটা আমার বন্ধ করে দিয়েছেন আপনি!
এমনসময় মেহেরজান আমাদের কক্ষের সামনে এসে দাড়াল। আমার চোখ পড়তেই আমি তাকে টেনে মেহরাবের সামনে দাড় করলাম। তারপর ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— আমার জন্য তোমার অনেক বড় সর্বনাশ হয়েছে না!
এখন আমি তোমাকে তোমার সব ফিরিয়ে দিচ্ছি।
আমি মেহরাবের জীবন থেকে চলে যাচ্ছি।
মেহেরজান আমার হাত দুটো ধরে বলল,
— ভাবী তুমি এসব বলছো? তুমি মেহরাবের বিবাহিতা স্ত্রী। আমার কোনো সর্বনাশ হয়নি, যেটা ভাগ্যে ছিল সেটাই হয়েছে। আমি এ নিয়ে একটুও বিচলিত নই।
মেহরাব তুমি ভাবীকে আটকাচ্ছো না কেন? ভাবী অনুরোধ করছি তোমার কাছে, আমার জন্য তুমি তোমাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি করোনা।
আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমাদের প্রতি।
আমি মেহেরজানের এই রুপ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। যে মেয়ে আমাকে এত কটু কথা শুনিয়েছে মেহরাব কে নিয়ে, সে এখন এসব বলছে। এসব কি তার ছলচাতুরী মেহরাবের সামনে নিজেকে সৎ আর ভালো প্রমাণ করার!
খানিকবাদে সে আবার এসে আমাকে কটু কথা শোনাবে বলে!
মেহেরজান আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে যথেষ্ট কটুকথা বলে এখন মেহরাবের সামনে ভালো সাজছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম, ভালোই অভিনয় জানো তুমি। বিয়ের আগের দিন অবধি তুমি আমার পা ধরে কান্নাকাটি করে বলেছিলে আমি যেন তোমার সর্বনাশ না করি, বিবাহ করেছি বলে তুমি আমার মৃত মা-বাবাকে অবধি কটুকথা বলেছো আর আজ তুমি ভালোমানুষি দেখাচ্ছো।
মেহরাব অবাক হয়ে বলল,
— এসব তুমি কি বলছো?
— ঠিক ই বলছি। এই মেয়েটা সব নষ্টের মূল, আমাদের সম্পর্কে ও ই বিষ ঢেলেছে। কি না করেছে ও!
মেহেরজান আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করল,
— ভাবী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছেনা। আমি এমন কিছুই করিনি। আপনারা আপনাদের কলহ মিটিয়ে নিন, আমি কথা দিচ্ছি আমি আর আপনাদের সামনে আসবনা।
— অনেক হয়েছে মেহেরজান।
একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি ভেঙ্গে দিয়ে তার উপরের অংশ ঢালাই করে সেটা গড়ে তোলা কেবল বৃথা। সেই বৃথা চেষ্টা করে নিজেকে আর ভাল সাজিওনা।
তোমার মিথ্যাচার আমার সহ্য হচ্ছেনা। প্রতিটা মূহুর্ত তোমার কটুকথা, অসদাচরণ আমাকে কষ্ট দিয়েছে। প্রতিটা মূহুর্ত আমি নিজের সাথে লড়াই করেছি। আর সে তোমার মুখে এত কথা মানায় না।
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি এভাবে একজনকে অকারণে দোষারোপ করতে পারোনা মুশায়রা। মেহেরজান তেমন মেয়ে ই নয়, যেমন তুমি বর্ণনা দিচ্ছো।
— খুব আঘাত লাগছে আপনার! ওর জন্য খুব খারাপ অনুভব হচ্ছে। তাহলে বিয়েটা কেন ওকে করলেননা, আমাকে নাহয় দাসী বানিয়ে রাখতেন। আপনারা জ্বীনরা তো অনেক নিচে নামতে পারেন, প্রয়োজনে অনেক হিংস্র হতে পারেন।
মেহরাব রেগে গিয়ে আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেছিল। মেহেরজান আটকে দিয়ে বলল,
— মেহরাব তুমি কি করতে যাচ্ছো? শান্ত হও। দাদীমা তোমায় এটা শিক্ষা দেননি।
— কি করব আমি মেহেরজান? ও কোনো কথা ই বুঝতে চাচ্ছেনা, বলার সুযোগ টুকু দিচ্ছেনা। নিজের মত করে সব ভেবে যাচ্ছে, তোমার সম্পর্কে কিছু না জেনে তোমাকে অপমান করছে।
— থামলেন কেন মেহরাব? মারুন আমাকে, এই প্রতিদান পাওয়ার জন্য ই আমার এতদূর আসা। মেহেরজান কেন আটকাচ্ছো তুমি!
— মুশায়রা তুমি চুপ করো।
— আর কত চুপ থাকব আমি? আমার পক্ষে আর এসব মুখ বুজে সহ্য করা সম্ভব নয়। আমি এখান থেকে ফিরে যাব, আপনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।
আপনি আমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
বলে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলাম।
কক্ষ থেকে বেরিয়ে দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করলাম আমি। দাদীমা আমাকে দেখে বলল, নাতবউ তুমি কাদছো কেন?
আমি দাদীমার পায়ে পড়ে বললাম,
— ক্ষমা করবেন আমায়। আমার পক্ষে এখানে থাকে আপনার নাতবউয়ের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। আমার আমার নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে চাই, আপনি আমাকে অনুমতি দিন। দয়া করে আমাকে থাকার অনুরোধ করবেননা।
দাদীমা একটু চুপ থেকে বলল,
— বেশ তোমাকে তোমার বাড়ীতে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি। তবে তোমাকে একটা কথা বলব, সম্পর্কটা বিচ্ছেদ করার আগে ভালভাবে চিন্তা করে নিও।
একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা যতটা কঠিন, ভেঙ্গে ফেলা ততটাই সহজ। অতএব, তুমি কিছুদিন নিজের সাথে বুঝাপড়া করে নাও। এই জ্বীনমহল আবার ফিরে আসার আহবান রইল তোমার প্রতি। এই নিয়ে কিছু বলবেনা, এটা আমার আদেশ।
আমি এক্ষুণি তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
মেহেরজান দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করে বলল,
— দাদীমা আপনি ওকে যাওয়ার সম্মতি কেন দিচ্ছেন?
ও সম্পর্কটা বিচ্ছেদ করে দিতে চাইছে।
— আমি কেবল ওকে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছি।
সম্পর্ক বিচ্ছেদের ব্যাপারে ওকে আরো ভাবার সময় দিলাম।
মেহেরজান, তুমি মেহরাবকে আমার নিকট আসতে বলো।
মুশায়রা তুমি গোছগাছ করে নাও।
— আমার গোছগাছ করার কিছু নেই দাদীমা। আমি শূণ্য হাতে এসেছি, সেই শূণ্য হাতেই যাব।
— আমাদের নিয়মানুযায়ী আমরা জ্বীনবংশের বউদের শুণ্য হস্তে পৈত্রালয়ে পাঠাইনা। তুমি তোমার কক্ষে গিয়ে প্রস্তুতি নাও।
বিকালের কিছু পূর্বে আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। একটা ঘোড়ারগাড়ী ঠিক করা হল আমার যাওয়ার জন্য, তাতে কিছু বোঝাই করা উপহারসামগ্রী ছিল। দাদীমাকে সালাম করে বিদায় নিয়ে নিলাম। মেহেরজান এগিয়ে এসে বলল,
— তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ভাবী।
— আমার চলে যাওয়ায় তোমার ই বেশী লাভ মেহেরজান। ফিরে আসার কথা তুমি না বললে খুশী হব।
মেহরাবকে নিয়ে ভালো থেকো, ওকে সুখী করো।
দোয়া রইল তোমাদের জন্য। আমি আমার কথা রেখেছি, তোমার সব তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।
মেহেরজান কিছু বলতে পারল না, একটা চাপা কষ্ট-অভিমান নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ছুটে গেল। আমি গাড়ীতে উঠে বসলাম। মেহরাব আমার সামনে বসা ছিল, আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল । আমি সারাপথ উনার দিকে তাকাইনি, কথাও বলার সুযোগ দিইনি।
অনেকক্ষণ পর আমি আমার গন্তব্যে পৌছালাম। কখন যে এসে পড়েছি নিজেকেও খেয়াল করিনি। আমি নেমে চলে যেতে নিলে মেহরাব পিছন থেকে ডাক দেয়,
— বউ।
— আমাকে ওই ডাকে ডাকার যোগ্যতা আপনি হারিয়েছেন। দয়া করে ওই ডাকে ডাকবেননা।
কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলুন।
মেহরাব উপহারসামগ্রী আমার হাতে দিয়ে আমার হাতটা ধরে বলল,
— এভাবে চলে না গেলে হয়না? ফিরে যাই চল। একটা সুখী সংসার গড়ি।
আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বললাম,
— এসব হাস্যকর শুনাচ্ছে। আপনি মেহেরজান কে নিয়ে সুখী হন। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না।
মেহরাব একটা গোলাপফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
— এটা নিজের কাছে রাখো। কখনো মনে পড়লে না হয় স্মরণ করো।
— তার প্রয়োজন হবেনা। আসি, আল্লাহ হাফেজ।
মেহরাবের চোখে পানি টলমল করছিল। তা দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল, কান্না আড়াল করার জন্য আমি এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে হাটা দিলাম বাড়ির দিকে। একবারো পিছু ফিরে তাকালামনা।
যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয়না, তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়।
(চলবে)
জ্বীনবর ৫?
পর্বঃ১৯
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
বাড়ির গেইটে এসে আমি থমকে গেলাম। একনজরে পুরো বাড়ীটা দেখে নিলাম, কেমন জানি ছন্নছাড়া লাগছে। ভালো করে খেয়াল দেখলাম আমার শখের বাগানটার ধ্বংসাশেষ পড়ে আছে। আগের মত সাজানো গোছানো নেই কিছু। বোন কি এইসময় বাড়ীতে আছে? খুব অস্বস্তি হচ্ছে বাড়ীতে ঢুকতে। কোন মুখে ঢুকব? নিজের সম্মান টা নিজেই খুইয়েছি, এখন বোন কি আমাকে ক্ষমা করে বাড়ীতে ঠাই দিবে? বোন যদি রাগ পুষে রেখে আমাকে বের করে দেয় কোথায় যাব আমি! এসব ভেবে আমার পা এগুচ্ছে না। হঠাৎ বাড়ী থেকে বুড়িমা বের হয়ে এসে আমার ছোট্ট পদ্ম পুকুরটার পাশে বসল। চুপচাপ বসে কিসব বিড়বিড় করছিল, সাহস করে ডাকলাম, বুড়িমা!
কয়েকবার ডাকার পর বুড়িমা আমাকে খেয়াল করে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর ছুটে এসে আমার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— তুই এসেছিস মুশু?
বলতে বলতে কেদে দিল বুড়িমা।
— কেমন আছো বুড়িমা? তোমার শরীর ভাল তো? বুড়িমা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
— তোকে ছাড়া কি করে ভাল থাকি মুশু!
কোথায় ছিলি এতদিন তুই? বুড়িটাকে একবারো মনে পড়েনি তোর!
— খুব মনে পড়েছে বুড়িমা। তোমাদের টানেই তো আবার ছুটে আসা।
— আয়, ভিতরে আয়। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোকে, আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নে।
বুড়িমা আমার হাত টেনে বাড়ীর ভিতরে ঢুকাতে চাইলে আমি বাধা দিয়ে বাহিরেই দাড়িয়ে রইলাম।
— কিরে মুশু? ভিতরে আসতে চাইছিস না কেন?
— এই বাড়ীতে ঢুকার মত মুখ নিয়ে আমি আসিনি বুড়িমা। বোন কোথায়? ও কি আমাকে এই বাড়ীতে ঠাই দিবে?
— আফরাহ ভিতরেই আছে। কেন দিবেনা? তুই ছাড়া ওর আছে ই বা কে! সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস, আয় ভিতরে আয়। আফরাহ তোকে দেখলে আর অভিমান করে থাকতে পারবেনা।
অনেকটা ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে বাড়ীতে ঢুকলাম। ঢুকেই সোজা বোনের কক্ষে চলে গেলাম, বোন আগের মতই তার বই-পত্র ঘাটাঘাটি নিয়ে ব্যস্ত। আমি অস্ফুটস্বরে ডাকলাম,
— বোন! ও আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে থ হয়ে গেল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
— কেন এসেছিস এখানে?
— বোন তুই আমার উপর রাগ করে আছিস?
— কে তোর বোন? আমাকে তুই বোন ভাবিস! বোনের সাথে এভাবে অন্যায় করতে তোর বিবেকে দিল কি করে?
— বোন, আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি। আমার উপর আর রাগ করিস না।
— এসব ন্যাকাকান্না কেন কাদছিস? যার হাত ধরে পালিয়েছিস সেই নাগর কি তোকে ঠাই দেয়নি, তাই ঠাই পেতে এখানে এসেছিস?
আমি তো এখন ই ভেবে পাইনা, তোর বিবেকে একবারো বাধল না আমার সাথে এভাবে ছলনা করতে? আমার সম্মান টা নষ্ট করে?
এতবছর তোকে আগলে রাখার এই প্রতিদান দিলি? নিজের বোনকে লোকসমাজে ছোট করতে তোর খুব ভালোলেগেছে?
আমি বোনের হাত টা ধরে কাদতে কাদতে বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দে বোন। আমি তোকে ছোট করার জন্য কিছু করতে চাইনি।
বোন আমার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল, আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আমি এখন তোর সাথে কোনোরকম কথা বলতে চাচ্ছিনা, তোকে দেখে আমার রাগ আর ঘৃণা দুটোই হচ্ছে। তুই এখান থেকে যা।
বুড়িমা তুমি ওকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও।
বুড়িমা আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এসে আমার নিজের রুমে বসিয়ে চলে যায়। আমি রুমের এক কোণায় বসে কাদতে থাকি। জানিনা কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে! নিয়তি আমার সাথে এ কেমন খেলা খেলছে! কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। মনে হচ্ছে, এক্ষুণি নিজের জীবনটা শেষ করে দিই।
এমনসময় বুড়িমা আমার রুমে আসল। আমি চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। বুড়িমা আমার সামনে বসে বলল,
— মন খারাপ করিসনা মুশু। অনেকদিনের অভিমান তাই এভাবে বকাঝকা করে ফেলেছে, তুই তো তোর বোনকে খুব ভালো করেই চিনিস।
দেখবি একটু পরেই ওর রাগ কমে যাবে।
— বিশ্বাস করো, বুড়িমা ওকে অসম্মান করার জন্য আমি কিছু করিনি। ওকে তো আমি খুব ভালোবাসি বলো।
— আমি জানি মুশু। তোর মত মেয়ে কখনোই কারো খারাপ চাইতে পারেনা।
এসব নিয়ে কান্নাকাটি করিসনা। আফরাহ ওইরকম ই, তুই যাওয়ার পর ও তোর সমস্ত কিছু বিনষ্ট করতে চেয়েছিল, খুব আঘাত পেয়েছিল বোধহয়। কেমন জানি বিভ্রান্ত হয়ে গেছিল!
এসব শুনে আমি কান্না করতে লাগলাম।
— কাদিসনা তো। আমার নাতজামাই কই বল তো? সে এল না কেন?
আমি চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
— তোমার নাতজামাইয়ের সুখ আমার কপালে নেই বুড়িমা। তাই তো ঠাই খুজতে এখানেই ফিরতে হল।
— মান-অভিমান হয়েছে বুঝি? চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। নাতজামাই তোকে ঠিক নিতে আসবে।
মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। খাওয়া-দাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই। তুই মুখ-হাত ধুয়ে নে, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
— না বুড়িমা, আমি কিচ্ছু খাবনা।
— জেদ করিস না। খাবার আনছি খেয়ে লক্ষী মেয়ের মত একটা ঘুম দিবি। উঠে দেখবি সব স্বাভাবিক লাগছে। তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে গেলাম। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম, আমার পটে যেন বিবাহিত চিহ্নটি জ্বলজ্বল করছে। অন্য এক মুশায়রা দেখছি আমি, যার নাকে মেহরাবের দেওয়া নাকফুলটা শোভা পাচ্ছে। বউ বউ একটা ভাব এখনো সমুজ্জ্বল। নিজের দিকে তাকিয়ে একটা উপহাসের হাসি হাসলাম।
ফ্রেশ হয়ে শাড়ি ছেড়ে আগের মত সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ পড়লাম। নাকফুলটা খুলতে গেলে বুড়িমা এসে বাধা দেয়। বলে, কি করছিস মুশু? নাকফুল খুলতে নেই। এটা তোর বিবাহিতা পরিচয় বহন করে।
— যার পরিচয় বহন করব সে ই তো আমার জীবনে নেই।
এসব এখন আমার কাছে মূল্যহীন।
— দেখ মুশু, যা ই হোক না কেন! স্বামী তো স্বামী ই। তার পরিচয় নিয়েই তোর বাচতে হবে।
মা-বোন এসব কিছুইনা, বিয়ের পর মেয়েদের পরিচয় ই স্বামী দিয়ে। ওসব থাক এখন, আয় খেতে বস।
— আমি খাবনা বুড়িমা।
— তোর কোন কথা ই শুনব না আমি। চুপচাপ খেতে বস।
আমি আর না করলাম না, খেতে বসলাম। সত্যি বলতে আমার ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে। কাল রাতে মেহরাবের হাতে খেয়েছিলাম, তারপর আর খাওয়া হয়নি।
মেহরাবের সাথে কাটানো সেই মূহুর্ত মনে পড়তে চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
— মুশু, খাওয়ার সময় কাদতে নেই। ভাত মুখে নে।
ভাতের লোকমা মুখে নিব এইসময় কেউ আমার হাতটা ঝটকায় ধাক্কা দিল, হাত থেকে ভাতের লোকমা মেঝেতে পড়ে গেল।
তাকিয়ে দেখি বোন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও ভাতের প্লেটটা নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল। বুড়িমা উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
— এসব কি অসভ্যতা আফরাহ! কারো মুখ থেকে এভাবে ভাত কেড়ে নেয়, ছি!
— চুপ! একটা কথাও বলবে না তুমি।
মুশু তোর লজ্জা করেনা, এত কিছু করার পর ও তোর গলা দিয়ে এই বাড়ীর ভাত নামবে! তুই কি দিয়ে তৈরী? নিলর্জ্জের মত এই বাড়ীতে ফিরে এসেছিস, শান্তিমত ভাত ও গিলছিস!
তুই সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ভুলতে পারিস, কিন্তু আমি ভুলবনা। তোর জন্য আমি যতটা অপমানের চাবুক আমার গায়ে পড়েছে, তার ঘা এত তাড়াতাড়ি শুকানোর নয়।
— বোন!
— তোর কোনো ন্যাকাকান্না আমি শুনতে চাইনা। কাল সকালেই তুই এই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবি, আর একটা কথা মনে রাখবি আফরাহ নামে তোর কোনো বোন ছিলনা। যে ছিল তাকে তুই মেরে ফেলেছিস। নিমকহারাম একটা।
— বোন আমার কথাটা শুন।
— এরপরেও তোর মুখ দিয়ে কথা বের হয়? লজ্জা শব্দটা ই তোর জানা নেই না।
বুড়িমা রেগে গিয়ে বলল, আফরাহ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস। মেয়েটা সারাদিন কিচ্ছু খায়নি, সবে দুটো খেতে বসেছে। আর তুই এসে তার ভাতের থালা ফেলে দিয়ে এভাবেও কথা শুনাচ্ছিস? একবারো বুঝতে চেষ্টা করছিস না মেয়েটা কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে!
তোদের মা-বাবা আমার হাতে তোদের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল, সেখানে আমার অধিকার আছে মুশুকে এখানে রাখার। মুশু কোথাও যাবেনা।
— ওর যদি চক্ষুলজ্জা না থাকে, তো ও থাকবে।
কিন্তু আর কখনো ও আমার কাছের বোনের জায়গাটা পাবেনা।
বোন চলে যাওয়ার পর আমি চুপ করে মেঝেতে বসে রইলাম। আমার একটা সিদ্ধান্ত আজ আমার জীবনটাই ওলট-পালট করে দিয়েছে। নিজের বোন আমাকে সহ্য করতে পারছেনা। কি করব আমি এখন! মরে গিয়ে সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিব? বুড়িমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— এসব নিয়ে ভাবিসনা।
আফরার মনের কথা ছিলনা এসব। রাগের বশে এসব বলেছে। রাগ কমলে ঠিক কাছে টেনে নিবে। ওর রাগটাই ওর অনেক ক্ষতি করবে। তোর উপর রাগ করে তোর শখের বাগান ও নষ্ট করে ফেলেছে, তোর সব পছন্দের জিনিস ফেলে-ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি অবশের মত বললাম,
— বুড়িমা, আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি তাইনা!
এই ভুলের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। বোন বলেছে তো।
— মুশু তুই কোনো ভুল করিসনি, কাউকে ভালোবেসে পালিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ না। এখানে আফরার দষ আছে।
ও তোকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তোর কোনো মতামত ও অগ্রাহ্য করেনি। সেই হিসেবে সে উপযুক্ত শাস্তি ই পেয়েছে। তুই এসব একদম মাথায় আনিসনা।
আমি আবার খাবার আনছি।
— না বুড়িমা আমি আর কিছু খাবনা।
আমাকে একটু একা থাকতে দিবে বুড়িমা?
— আচ্ছা থাক। কিন্তু মন হালকা হলে খেয়ে নিস কিছু। আমি আসছি।
বুড়িমা যাওয়ার পর আমি রুম থেকে বেরিয়ে উঠোনে চলে এলাম। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটছি আর ভাবছি। জীবনটা হয়ত এখানেই শেষ আমার। দুনিয়ায় কোথাও আমার জায়গা হলনা, যার জন্য সব ছাড়লাম সে আমার সাথে বেঈমানি করল আর নিজের বোন আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।
ক্ষুধায় পেট টা চো চো করছে। ভীষণ মাথা ঘুরাচ্ছে, সবকিছু যেন ঝাপসা দেখছি। হাটার শক্তি টাও পাচ্ছিনা। হাটতে হাটতে পুকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে আসছে, এক্ষুণি হয়ত ঘুরেই পড়ে যাব। চাচ্ছিলাম পুকুরের সামনে থেকে সরে আসতে, কিন্তু আমি নড়ার ও শক্তি পাচ্ছিনা।
এখনি হয়ত মাথা ঘুরে পুকুরেই পড়ে যাব, বিনা অযুহাতেই মৃত্যু হবে আমার। এমনসময় কেউ আমাকে টেনে নিয়ে এল পুকুরের পাড় থেকে, আমার মাথাটা তার শক্ত বুকে এলিয়ে নিল। আমি চোখ মেলে দেখতে চেষ্টা করলাম কে সে! কিন্তু চোখের সামনে ক্রমশ অন্ধকার নেমে এল।
আর জ্ঞানেই রইলাম না আমি। এলিয়ে পড়লাম অপরিচিত মানুষটার বাহুর উপর।
.
(চলবে)