জ্বীনবর_২,পর্বঃ ০৭,০৮

0
2906

জ্বীনবর_২,পর্বঃ ০৭,০৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

অনেক দেরী করে ঘুম থেকে জাগলাম। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে নিলাম। ভেজা চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে বসলাম। হঠাৎ দেখলাম আয়নায় মেহরাবের ছায়া অবয়ব ফুটে উঠল। এক মূহুর্তে এত খুশী হয়ে গেলাম, একটানা বলেই চললাম, ” এই কয়েকদিন কোথায় ছিলেন আপনি? একবারো বুঝলেন না মেয়েটা আপনাকে কতটা মিস করছিল। সেদিনের জন্য সত্যিই লজ্জিত এবং দুঃখিত। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। কি হল? কিছু বলছেন না যে। ক্ষমা করবেন না আমাকে?” ফুপি রুমে ঢুকে বলল,
— কি হল? কার সাথে বিড়বিড় করছিস? ফুপির কথায় চমকে উঠে এক পলকে আয়নায় তাকালাম। সেখানে কেবল আমার ই প্রতিচ্ছবি। হতাশকন্ঠে বললাম,
— তেমন কিছু নাহ। কিছু বলতে এসেছিলে?
— একি তোর হাত,গলা খালি কেন?
— মাত্র গোসল করে আসলাম তো তাই খুলে রেখেছি।
ফুপি হাতে কিছু চুড়ি আর নাকে নথটা পরিয়ে দিয়ে বলল, এইবার ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি নিচে আয়, জামাই তোর সাথে নাস্তা করার জন্য বসে আছে।
জামাই কথাটা শুনেই বিরক্ত লাগল। ফুপি নিজের বয়সী একটা লোককে জামাই বলে সম্বন্ধ করছে, আর ওই বুইড়া ব্যাটার শেষ বয়সে এত কিসের রস আসে! আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলল কে। না এখন আমি নিচে যাবনা। লোকটা খেয়েদেয়ে উঠে পড়ুক, তারপর যাব। কিন্তু এভাবেই বা কতক্ষণ! আজ তো উনার সাথে আমি চলে যাব উনার বাড়ীতে। তখন তো কিছুতেই এইভাবে এড়িয়ে চলতে পারবনা।
“ফুপি তুমি যাও, আমি আসছি একটু পরে। বাবাকে ফোন করে নিই।”
— এখন আবার ভাইকে ব্যস্ত করছিস কেন? কাল-পরশু জামাইকে নিয়ে তো যাবিই। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তো আমাদেরকে আর মনেই থাকবেনা, হয়ত আর আসবিও না দেখতে। বিড়বিড় করে বললাম,
— তোমাদেরকে ভুলি কি করে, আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো। এই অপূরণীয় ক্ষতি কি আমি কখনো ভুলতে পারি! এর মেয়াদ তো আমার সারাজীবন।
— কিছু বললি মুশু?
— নাহ ফুপি। তুমি যাও, আমি রেডি হয়ে নামছি।
রেডি হয়েও বসে রইলাম ফোন হাতে নিয়ে। বাবা কেন এমন করছে আমার সাথে? ফোনটা ও বন্ধ করে রেখেছে, যতদিন না বাড়ীতে ফিরছি ততদিন কোনো খোজ নিতে পারবনা আর এসব জানাতেও পারবনা। হঠাৎ নিচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এল। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে এসে দাড়ালাম। আরেহ সীমার হবু স্বামী এসেছে কিছু লোকজন নিয়ে। চেহারা দেখে খুব রাগান্বিত মনে হচ্ছে। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকাল। কাছে এগিয়ে এসে বলল,
— তুমি কি আমাকে প্রমাণ দেখানোর জন্য আজ চুড়ি, নথ, শাড়ি পড়ে বউ সেজেছো? ফুপি ভয়ার্তকন্ঠে বললেন,
— বাবা, সত্যিই ও বিবাহিত। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
— মুশায়রা আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি।
— ফুপি যা বলছেন তাই ঠিক, আমি বিবাহিত। আর আপনি কে যে আপনাকে প্রমান দেখানোর জন্য আমি এসব করব। সে আমার হাত চেপে ধরে বলল,
— আমি বিশ্বাস করছিনা, এই মূহুর্তে আমি তোমাকে বিয়ে করব৷ কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।
— আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আমি তো বললাম আমি বিবাহিত। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
— অহহ আচ্ছা, তা কার সাথে হয়েছে? কে তোমার বর! তাকে ডেকে আনো, সেই এসে বলুক তোমাকে বিয়ে করেছে।
পিছন থেকে কেউ একজন বলল, মুশায়রাকে আমি বিয়ে করেছি। অবাক হয়ে পিছনে তাকালাম। কালকের সেই অর্ধবৃদ্ধ নয়, একজন সুঠাম সুদর্শন ছেলে এই কথাটা বলল। লম্বা, ফর্সা এবং মায়াবী চেহারা ছেলেটার।পুরো রাজকুমারের মত দেখতে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, এই ছেলেটা কে?
ছেলেটা এসে আমার হাত ধরে বলল, আমিই ওর স্বামী। আপনার কিছু বলার আছে?
— আপনাকে ভাড়া করে আনা হয়েছে তাইনা নিজেকে তার স্বামী বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য! আমাকে বোকা পেয়েছেন আপনি?
ছেলেটা কাজীর দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
— কি ব্যাপার কাজী সাহেব? আপনি কি চুপ করে থাকবেন? কাল আপনিই তো আমাদের বিয়ে পড়ালেন। সত্যিটা আপনি বলুন, তাদেরকে আপনার রেজিষ্টার খাতাটা দেখান। কাজী এইবার মুখ খুললেন,
— আসলে এতক্ষণ ভেজাল দেখে চুপ করে ছিলাম। এই মেয়েটি আর এই ছেলেটির বিয়ে কাল বাদ যোহরে আমিই পড়িয়েছিলাম। এই খাতায় উনাদের স্বাক্ষর এখনো আছে।
আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলামনা। এই ছেলেটাই বা কে? কোথা থেকে আসল। আমি কি করে ওর বিয়ে করা বউ হব, আমি তো বিয়ে করেছিলাম ওই বুড়ো টাইপ লোকটাকে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ফুপির কাছে ছেলেটির মা বলতে লাগল, বিয়াইন আজকে এখনিই আমি আপনার মেয়েকে আমার বউমা করে ঘরে তুলতে চাই। ছেলেটি এসব শুনে বলল,
— মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না এই মেয়েটিকে বিয়ে করা। ছেলেটির মা রেগেমেগে বলল,
— সিদ্ধান্ত, তোর সব পাগলামী আমি সহ্য করে আসছি। আর নয়, এক্ষুনি তুই সীমাকে বিয়ে করবি। তোর এসব পাগলামীর জন্য আমরা একঘরে হতে পারবনা, তুই যদি এই বিয়েটা না করিস আমাদের আর মুখ দেখানোর জো থাকবেনা। তুই যদি বিয়েটা না করিস, আজ থেকে আমি ভুলে যাব তুই আমার ছেলে। যে ছেলে বংশের মুখে চুনকালি লাগাতে পারে, তাকে ত্যাজ্য করতে আমি দ্বিধা করবনা।
ছেলেটার মুখ হতাশায় ঢেকে গেল। খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
— মা তুমি যা বলবে, তাই হবে।

সীমার বিয়েটা ঝামেলাহীন ভাবে মিটে গেল। ফুপা কলে তাদেরকে দোয়া করলেন, আজ কি মিষ্টি লাগছে সীমাকে! ওদের দুজনকে খুব মানিয়েছে বটে। কিন্তু আমার বর দাবী করা ছেলেটাকে তো কোথাও দেখছিনা। একটু ভালো করে উঁকি -ঝুকি দিয়ে দেখতেই খেয়াল করলাম তিনি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।
একটু একা ও পাচ্ছিনা উনাকে যে জিজ্ঞেস করব কাহিনীটা কি? বর বদল হল নাকি লোকটা জাদুর কেরামতিতে ছেলে হয়ে গেলেন।
কাল তো আমি ভুল দেখিনি, স্পষ্ট দেখেছিলাম লোকটাই বর সেজে বসে ছিল, ফুপি তাকে জামাই বলে সম্বন্ধ করছিল। উফফফফ! কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আর। সীমার পাশে গিয়ে বসে তার কানে কানে বললাম,
— তোর সাথে একটু কথা আছে আমার।
— হ্যাঁ বল।
— এখানে না, উপরে চল একটুখানি।
— কিন্তু…..
— কিন্তু কিছুনা, আয় আমার সাথে।
ওকে উপরে নিয়ে এসে ভিতরে ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। সীমা অবাক হয়ে বলল, কি এমন বলবি যে দরজা বন্ধ করতে হল।
— ওই ছেলেটা কি সত্যিই আমার বর?
— হ্যাঁ, তোর ই তো বর।
— কিন্তু আমি যে কাল এক বয়স্ক লোককে দেখলাম। সীমা মাথার ঘোমটা ঠিক করতে করতে বলল, তুই সেটা দেখে নিয়েছিস?
— ইয়ার্কি মারিস না তো। সত্যিটা বল আমাকে।
— আচ্ছা আচ্ছা বলছি ওয়েট। কাল নিচে ভীষণ ঝামেলা হওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলি?
–হ্যা, পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানিনা ওটা কিসের ঝামেলা ছিল?
— আরেহ যে বয়স্ক লোকের সাথে তোর বিয়ে ছিল তার প্রথম ৩টা বউ এসে এখানে ভীড় করেছিল। পরে অই ব্যাটাকে মারতে মারতে বিয়েটা হওয়ার আগেই এখান থেকে বের করে নিয়ে যায়। আমরা তো প্রচুর টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম। তোকে কে বিয়ে করবে ভেবে! তখন ওই ব্যাটার দূরসম্পর্কের ভাগ্নে বলল, সে তোকে বিয়ে করতে রাজী। তাই আমরা ও অত কিছু না ভেবে মত দিয়ে দিলাম।
তার সাথেই তোর বিয়েটা হল।
— কিন্তু চিনিনা, জানিনা এমন ছেলের সাথে ফুপি বিয়ে দিতে রাজি হল?
— ছেলেটা যথেষ্ট শিক্ষিত আর ধনী। দাদী ছাড়া আর কেউ নেই ওর। দেখতেও তো কত সুন্দর, হ্যান্ডসাম। নিজেকে ভাগ্যবতী ভাব, এমন ছেলেকে স্বামী হিসাবে পেয়েছিস।
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
— চিনিনা, জানিনা এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিব। পুরাই অসম্ভব। সুন্দর তো কি হয়েছে, তাই বলে কি মেনে নিতে হবে।
কেউ একজন দরজায় নক করায় দরজা খুললাম। ফুপি সাথে সাথে রুমে ঢুকে বলল, সীমা তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে তোর শ্বাশুড়ি। আর মুশু তুইও রেডি হয়ে নে, এক্ষুনি তোকে নিয়ে জামাই রওনা দিবে। নিচে আয় দুজন তাড়াতাড়ি।
আমি আর কি রেডি হব! যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামলাম, সীমা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমিও আর কান্না আটকে রাখতে পারলামনা, কান্না মুছে ওকে গাড়িতে তুলে দিলাম। জনাব সিদ্ধান্ত হতাশচোখে আরো একবার শেষবারের মত আমার দিকে তাকালেন। বেচারাটাহ!
সীমার গাড়ি চলে যাওয়ার পর ফুপিকে সালাম করলাম, স্বপ্নাকে জড়িয়ে চুমু খেলাম। ফুপু কান্নাভেজা চোখে বলল,
— ভালো থাকিস মা, এই ফুপিটাকে হয়ত খারাপ ভাবছিস। কিন্তু তোর ফুপি তোকে অনেক ভালোবাসে। পরিস্থিতির চাপে তোকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি, ক্ষমা করে দিস আমাকে।
আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম। হয়ত মা বেচে থাকলে বিদায়বেলায় মাকেও এভাবে জড়িয়ে ধরতাম। আজ ফুপির মাঝে মাকে খুজে নিলাম। উনি গাড়ি নিয়ে বাড়ির সামনে ওয়েট করছিলেন, আমি ফুপিকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে উনার পাশে বসলাম। উনি একমনে ড্রাইভ করছিলেন, আর মাঝেমাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি কয়েকবার তার চোখাচোখি হয়ে গেলাম। তারপর একটু রেগে বললাম,
— দেখার জন্য অনেক সময় পাবেন,ঠিকমত ড্রাইভিংটা করুন।
সে উত্তরে কেবল মুচকি হাসল।

আমি আর কিছু না বলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। মেহরাবের কথা মনে পড়ছে খুব, সত্যিই কি উনি আর কখনো আমার সামনে আসবেননা। ছোট একটা ভুলের এত বড় শাস্তি! উনি তো আমাকে অনেক বুঝেন, এইটুকু বুঝেননি সেদিনের একটা কথাও আমি মন থেকে বলিনি।
সবটা রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। জ্বীন হয়েছেন ঠিকিই কিন্তু বডড অবুঝ তিনি।
পাশে ড্রাইভিন সীটে বসে থাকা মানুষটার জন্য আমার কোনো টান অনুভব হচ্ছেনা, মাথায় শুধু মেহরাবের চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
হঠাৎ একটা বড় বাড়ীর সামনে গাড়ি থামালেন উনি। মুচকি হেসে বললেন,
— আমরা পৌছে গেছি বউ।
চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম, “এসব কি ডাক?”
— সবাইকে ক্লিয়ার করতে হবেনা আপনি আমার বউ। নাহলে কে কখন হাত টেনে নিয়ে বলে আমাকে বিয়ে করুন।
আমি বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম, “জাস্ট লেইম একটা জোক্সস।”
.
(চলবে)

জ্বীনবর_২
পর্বঃ ০৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

তিনিও গাড়ি থেকে নেমে বললেন, যাই ই বলুন আমি আপনাকে বউ বলেই ডাকব। চোখ রাঙ্গিয়ে তার দিকে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,
— আসুন ভেতরে আসুন। দাদীমা, আন্টি তোমরা কোথায়? এসো তোমাদের বউমাকে দেখবে।
আমি উনার পিছু পিছু গিয়ে বাসায় ঢুকলাম। অনেক বড় বাড়ী তার, চারিদিকেই গোছগাছ, বাগান সবমিলিয়ে আভিজাত্য এর পরিচয় বহন করে। ঢুকতেই একজন বৃদ্ধমহিলা, অন্য একজন ফুপিরবয়সী আর কিছু অল্পবয়সী মেয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি মহিলাদেরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। উনার হাসিমুখে আমাকে বলল, মাশা আল্লাহ বেশ সুন্দর তুমি, অনেক সুখি হও। উনি পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বললেন, আমাকে কি সুন্দর দেখতে নাহ? আমারো কি সুখি হওয়া লাগবেনা নাকি?
বৃদ্ধমহিলা তার কান চেপে ধরে বলল, ফাজলামি বন্ধ করবি। এখন আর বাচ্চা নস তুই। আমি মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে, আরো জোরে কান মলো।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মজা পাচ্ছেন তাইনা!
আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। এই ব্যাটা দেখি মনের কথাও বুঝে নেয়। অল্পবয়সী মেয়েদের একজন আমাকে উপরের একটা সুন্দর রুমে নিয়ে গেল। লাগেজটা রুমের এক কোণে রেখে দিয়ে বলল, ভাবী এটা আপনার রুম। অনেকদূর থেকে এসেছে টায়ার্ড নিশ্চয়ই আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি যাই।
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। এতক্ষণে একটু ভালোলাগছে, বেডে বসে রুমের চারিদিকে তাকালাম। বেশ বড় এবং পরিপাটি রুমটা, দেয়ালে আল্লাহর কালামের ওয়ালম্যাট ঝুলানো। মনে হচ্ছে এরা ঈমানদার ফ্যামিলি। মানিয়ে নিতে কষ্ট হবেনা, আমি মধ্যবিত্ত হলেও একটা ঈমানদার পরিবারের মেয়ে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কালো-লাল একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে নিলাম। যদিও দেখেছি নতুন বউরা সবসময় শাড়ি পড়ে থাকে, কিন্তু কি করার! বিয়েটা তো ফুপি দিল তাই কপালে বিয়ের দিনে ১টা শাড়ি ছাড়া তেমন কিছু পাইনি। বাবা হলে হয়ত মেয়েকে খালি হাতে শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাত না। এটাই রক্তের সম্পর্ক আর কাছের সম্পর্কের ব্যবধান। দায় নামাতে এমনিতেও ফুপি কিছু কম করেনি, যা করেছে তাও বেশী। আমি আবার কিসব ভাবতে বসলাম, তার চেয়ে বরং নিচে যাই। নতুন বউ গুটিয়ে বসে থাকলে বেমানান লাগবে। বের হব এমন সময় উনি রুমে ঢুকলেন। আমাকে এক পলক দেখে বললেন,
— শাড়ি পরেননি যে? নতুন বউরা বেশ কিছুদিন শাড়ি পরতে হয় এই কিছুদিন শাড়ি পরে থাকার অস্বস্তিটা মানিয়ে নিতে হয় বউ।
— আমার কোনো অস্বস্তি হচ্ছিলনা। আমার কাছে আর শাড়ি….. বলতে গিয়ে বললামনা। এসব কথা বললে বাবার বাড়ির মানুষদেরকে ছোট করা হবে, আর সেটা আমি কখনোই করতে চাইনাহ। উনি বললেন, থেমে গেলেন যে?
— না, কিছুনা।
উনি আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে দিয়ে বললেন,
— এই নিন। আপনার সব প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে রাখা আছে, লাগলে নিয়ে নিবেন। আর হ্যাঁ নিচের তাকের সব কিছু আমার, এগুলো ঘাটাবেননা। অনেক কষ্ট হয় গুছিয়ে রাখতে বুঝলেন।
রাগ হল শুনে, আমাকে কি উনি অকাজের মনে করেন নাকি। ধরতে যাবে কে উনার জিনিস! রাগটা চেহারায় ফুটামাত্রই উনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। তারপর বেরিয়ে গেল। আমি ড্রেস চেঞ্জ করতে যাব এই সময় আবার এসে বললেন, সুন্দর করে সেজেগুজে নামবেন কিন্তু বেশী সময় নিবেননা। পরে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা সকাল হয়ে যাবে।
— আপনি জানেন আমি চেঞ্জ করব তাও এভাবে অসভ্যের মত চলে এলেন?
— স্যরি বউ। আমি কিন্তু তাকাইনি।
রাগ হাই হয়ে গেল আমার। ড্রেসিং টেবিল থেকে বডি লোশনের ভারী ডিব্বাটা ছুড়ে মারলাম উনার দিকে, উনি তার আগে লাফিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
— বান্দর পোলা একটা।

রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। সবাই সাথে বসে ডিনার করলাম। খেতে খেতে জানতে পারলাম, বৃদ্ধমহিলাটি উনার দাদীমা। ফুপির বয়সী মহিলাটি ছোট থেকে উনাকে দেখাশুনা করে আসছেন, আন্টি বলেই সবাই সম্মান করে। বাকি মেয়ে ৩টাকে বাসার কাজে রাখা হয়েছে।
সবাই খুব মিশুক, আমাকে সহজেই তাদের আপন করে নিল। একবারো এই প্রশ্নটা করলনা, আমার বাবা কি করে? আমার ফ্যামিলির স্ট্যাটাস কেমন? শুধু যতটা না জানলেই নয় ততটাই জিজ্ঞেস করলেন।
তার চেয়ে বড় কথা, এভাবে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় কাউকে অখুশি মনে হল না। খুব সহজ ভাবেই আমাকে মেনে নিয়েছেন ওরা। এমন উদার আর ভাল ফ্যামিলি আমি কোথাও দেখিনি। আচ্ছা আমার সমস্যা কি! আমি তো বিয়েটা সহজ ভাবে নেইনি কিংবা মন থেকে মানিওনি। তাহলে তারা কেমন বা নতুন বউ কেমন থাকে না থাকে ওইসব নিয়ে এত ভাবছি কেন?
কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা, একবার শুধু বাবার বাড়ি যাই। আমি আর ফিরব নাহ। এই বিয়েটাও আর মানবনা, যতদিন না অবধি বাবার কাছে যাচ্ছি ততদিন এসব আমাকে মেনে নেওয়ার ভান করতে হবে।
আমি রুমে ঢুকার প্রায় অনেকক্ষণ পর উনি রুমে ঢুকলেন। মনে অনেক ভয় কাজ করতে লাগল। উনি যদি করে বসেন, তখন আমি কি করব! ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসলেন। গলা ঝেড়ে বললেন,
— বউ, আজ আমাদের বাসর রাত। জানো তো?
এটা শুনে আমার হাত-পা কাপাকাপির পর্যায়ে চলে গেল। উনার এতক্ষণের আপনি শব্দটা তুমিতে রুপান্তরিত হতে দেখে বুঝে নিলাম, এই ছেলে নিশ্চয়ই কিছু করে বসবে।
— কি হল বউ? চুপ করে আছো যে?
— কিহ বলব?
— আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানি।
— কি কি জানেন?
— এই যে তোমার বিয়ে করার কাহিনী আজ সীমা আপুর বিয়ে দেখে আন্দাজ করতে পারলাম।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। উনি আবার বলতে শুরু করলেন,
— আমি জানি এই অবস্থায় তোমার একটু অস্বস্তি কাজ করতেই পারে,আর সব মানতে সময় লাগবে। তুমি কি আমার থেকে একটু সময় চাও?
মনে মনে ভাবলাম, সময় নিয়েই নিই। বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া অব্ধি উনাকে আমার থেকে দূরে রাখতে হবে।
আমি সরুগলায় বললাম, হ্যা, সময় দেওয়া দরকার আমাকে। এখন আপনার ইচ্ছে বাকিটা।
— আচ্ছা বেশ দিলাম সময়। জানেন তো, বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রীকে এক সাথে শোকরানা নামায পড়তে হয়। অবশ্য এটা যেকোনো সময় পড়লেই হয়, তাই ভাবলাম যেদিন আমরা সত্যি অর্থে স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠতে পারব সেদিনই পড়ব।
আর হ্যাঁ, এই নাও তোমার মোহরানার টাকা।
আমি টাকাটার দিকে তাকালাম, “শুনেছি স্ত্রীর শরীর স্পর্শের আগে মোহরানার টাকা দিতে হয়। কিন্তু আমি এই টাকা কেন নিব, যেহেতু আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠবেইনা।”
তাই টাকাটা না নিয়ে বললাম,
— আমারো একি যুক্তি। সেদিন আমিও টাকাটা গ্রহণ করব।
উনি মুচকি হেসে টাকাটা রেখে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— অনেক রাত হয়েছে তাছাড়া তুমি বেশ ক্লান্ত। এখন ঘুমিয়ে পড়।
— আপনি কোথায় ঘুমাবেন?
— তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার পাশে।
— আপনার ইচ্ছে যেহেতু এটা আপনার নিজস্ব রুম।
— তোমারো অংশীদারী আছে এতে।
— সেটা আমি এখন নিতে চাচ্ছিনাহ।
— আচ্ছা ঘুমাও। বলেই আলো নিভিয়ে দিলেন উনি। পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমি উলটো পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে মেহরাবের সাথে কাটানো সময় গুলো কল্পনা করতে লাগলাম।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here