জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১১,১২

0
2344

জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১১,১২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বন

আমি মেহরাবের হাতটা আমার হাত থেকে সরিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে ভুলে যান মেহরাব। আমি এখন অন্যের স্ত্রী, আর আমি তাকেই ভালোবাসি। আমি আপনার সাথে যেতে পারবনা। দোয়া করে এমন আবদার নিয়ে আমার সামনে আর আসবেননা। আপনি আমার অতীত আর উনি আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত। আর আপনি অনেক দেরী করে ফেলেছেন, তখন যদি বলতেন আপনি জ্বীন হলেও আমি আপনার হাত ধরতাম সবকিছুর বিনিময়ে। এখন তা আর সম্ভব না। আপনি ফিরে যান।
মেহরাব পিছু হটতে হটতে বলল, আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো মুশু?
আমি চোখের পানি মুছে বলল, হ্যাঁ। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না দোয়া করে। আমি আপনাকে ভুলে গেছি, আমিও চাই আপনিও আমাকে ভুলে যান।
— ভালো থেকো, আল্লাহ হাফেজ। শুনে মনে হল তাকে পিছু ডাকি, কিন্তু আমার বিবেকে সেটা আটকাল। যেটা চলে গেছে সেটা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। অতীতকে ভুলে যাওয়াই ভাল। তখনি বিদ্যুৎ চলে এল, রুমের আলো জ্বলে উঠল। আর কিছুক্ষণ মন ভরে কেদে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। উনি তো এখনো এলেন না! কোথায় বের হলেন এই রাতের বেলা। একবার নিচে গিয়ে দেখি বরং। নিচে নেমে আসলাম, কিন্তু কোথাও উনি নেই।
দেখলাম শাকি পানি ভর্তি জগ নিয়ে দাদীমার ঘরের দিকে যাচ্ছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার ভাইয়াকে দেখেছো?”
— অনেকক্ষণ আগে দেখলাম বাগানের দিকে গেলেন।
— আচ্ছা ঠিক আছে, দাদীমাকে ওষুধটা খাইয়ে দিও।
বেরিয়ে বাগানের দিকে এলাম। কিছুটা দূরে দেখলাম উনি উলটো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। এত রাতে বাগানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কোনো কারণে কি উনার মন খারাপ? যাব একবার? না থাক একা থাকুক। বিরক্ত না করাই ভাল। কিছুটা এগিয়ে ফিরে আসব এমন সময় কিছু কথা কানে এল। কাছের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম উনি একা নয়, উম্মেও আছে উনার সাথে। দুজন দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কথা বলছে। কোনো ব্যাপারে কি কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদের মাঝে? শুনলাম উম্মে কাদতে কাদতে বলছে, তুমি এটা কি করে করতে পারো আমার সাথে?
— আমার কিছু করার নেই উম্মে।
— তাহলে কি এতদিনের সব আশা ব্যর্থ আমার? ৮বছর ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, কিছুদিন পর আমাদের বিয়েও হত। দাদীমাই তো সব ঠিক করে রেখেছিল আমি তার নাতবউ হব। উনিও কি করে তোমার এই কাজটা সমর্থন করল?
— উম্মে শান্ত হও, আমার কথাটা একটু শুনো।
— আমাকে ঠকিয়েছো তুমি।
— না ঠকাইনি তোমাকে। হ্যাঁ এটা ঠিক আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, তোমাকে বিয়েও করব বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমি মুশায়রাকে বিয়ে করে ফেলেছি। ব্যাপারটা এখন আমার কর্তব্যে সীমাবদ্ধ নেই উম্মে, এখন ওকে আমি ভালোবাসি ও।
— আমাকে কি ভালোবাসতে না তুমি?
— বাসতাম, সেটা অতীত। এখন আমার স্ত্রী আছে এটা আমি অস্বীকার করতে পারিনা। আল্লাহর ইচ্ছেতেই আমাদের বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। এটাই বলব তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও উম্মে।
এসব শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। উনি আর উম্মে একে অপরকে ভালোবাসতেন আর আমি তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সেদিন কর্তব্যের খাতিরে উনি আমাকে বিয়ে করে নিজের ভালোবাসাটাকে ত্যাগ করে দিলেন। এত অলক্ষী কেন আমি? যেখানে যাই, কারো না কারো সর্বনাশ করে ছাড়ি।
খুব শব্দ করে কান্না আসছিল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আবার তাদের কথায় কান দিলাম। উম্মে চোখ মুছে বলল,
— আসলেই তুমি আমার কপালে ছিলেনা, তাই এমনটা হয়ে গেল। এসব নিয়ে আর কষ্ট পাবনা আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো জ্বীন হয়ে তুমি একজন মানুষকে কেন বিয়ে করলে?
— সেটা তোমাকে আগেও বলেছি। আমি কেন জ্বীনজগত ছেড়ে এখানে পড়ে আছি দাদীমাকে নিয়ে! সেই একি কারণে আমি মুশায়রাকে বিয়ে করেছি। এখন আমি চাই বাকি জীবন টা ওর সাথেই কাটাতে।
— শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরে মেহরাব?
— না আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি, আর এটাও জানি ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাই এখন আমাদের ছাড়াছাড়ি কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমি এসব শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। উম্মে ওকে জ্বীন বলছে, মেহরাব বলে ডাকছে। তার মানে যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে আর কেউ নয়, মেহরাব। তাহলে এতদিন কেন ও পরিচয় গোপন রাখল, একটু আগেও তো সে ভালোবাসার দাবী নিয়ে এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে। যদি সে মেহরাব ই হবে তাহলে এত ছলচাতুরি কেন করল! তার কন্ঠটাই বা এতদিন আমার কাছে অচেনা ঠেকল কেন? কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি।
উম্মে মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যেটা তে সুখে থাকো তাই করো। আমার কাছে তোমার সুখটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
— আমাকে ভুল বুঝোনা উম্মে।
— উহু ভুল বুঝিনি। মেহরাব আমার সত্যি গর্ববোধ হচ্ছে তোমার মত একজন নিঃস্বার্থ মানুষকে আমি ভালোবেসেছি। তুমি মুশুকে নিয়ে সুখে থেকো, শুধু বন্ধু হিসেবে আমাকে পাশে রেখো।
— থাকবে সবসময়।
— আমি কাল জ্বীনজগতে ফিরে যাব মেহরাব।
— ফিরে যাবে কেন?
— ভেবেছিলাম তো তোমাকে বিয়ে করব। সেটা যখন হচ্ছেনা, তবে বাবার পছন্দের জ্বীনকেই বিয়ে করতে হবে। সেখানে ফিরেই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলব।
— সুখে থেকো দোয়া করি।
— তুমিও সুখে থেকো মেহরাব। কখনো যদি মনে হয় আমাকে পাশে পাওয়া দরকার, স্মরণ করো।
আমি ওখান থেকে চলে এলাম। অনেক প্রশ্ন আমার মনে জট বেধে আছে, ওকে সবগুলোর উত্তর দিতে হবে। উত্তর না পাওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাচ্ছিনা।
মেহরাব রুমের সামনে আসতেই দাদীমা ওকে ডেকে বলল,
— উম্মে সব মেনে নিয়েছে তো?
— হ্যা দাদীমা।
— এটা নিয়েই আমি ভয়ে ছিলাম। আমি চাইনি মুশুর মত এত ভাল মেয়েটার সংসারে অশান্তি হোক। যাক সব ভালোই ভালোই মিটেছে এটাই আমার শান্তি। তুই ও আর দেরী করিসনা নিজেদের দূরত্বটা কাটিয়ে ফেল। সব সত্যিটা ওকে বলে দে।
— সবটা বলতে পারব কিনা জানিনা। তবে যেটা বলা প্রয়োজন সেটা বলব।
— কিন্তু….
— সবটা বলার সময় এখনো আসেনি দাদীমা। তুমি চিন্তা করোনা, বিশ্রাম নাও।
উম্মের কাছে যাও, ওকে ভালো করে বুঝাও যাতে আমাকে ভুল না বুঝে। এসব নিয়ে কষ্ট না পায়।
— আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

মেহরাব এসে রুমে ঢুকল। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত দিয়ে বলল,
— শরীর খারাপ নাকি বউ?
— না ঠিক আছি। কোথায় ছিলেন আপনি?
— উম্মের সাথে কথা বলছিলাম। সারাদিনে কথা হয়নি তো তাই।
— হুম। মেয়েটা অনেক ভালো।
— হ্যা। বউ আমি যদি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই!
— হ্যা বলুন কি বলবেন?
— তুমি তো একটা জ্বীনকে ভালোবাসতে, যে সবসময় তোমার পাশে থাকত, তোমাকে আগলে রাখত…..
— হ্যা, কিন্তু ওর কথা আর বলবেন না। ওকে তো আমি ভুলে গেছি, তাকে তো আমি না করে দিয়েছি আপনার কথা ভেবে।
— এখন যদি জানতে পারো সে আর আমি আলাদা কেউ নই, একজন ই। তবে তুমি কি করবে?
— তাহলে তুমি সত্যিই মেহরাব?
— হ্যা বউ। আমি ই তোমার মেহরাব।
— যদি মেহরাব হও তবে তোমার কাছে আমার অনেক প্রশ্ন আছে।
— আমি সব প্রশ্নের ই উত্তর দিতে প্রস্তুত।
— তুমি এতদিন কেন জানাওনি? আর তোমাদের কন্ঠ আলাদা হয় কি করে?
কিছুক্ষণ আগে কেন বা বললে তোমার সাথে চলে যাওয়ার কথা?
আমার উপর তোমার কিসের কর্তব্য রয়েছে যার জন্য তুমি তোমার ৮বছরের ভালোবাসা ত্যাগ করে দিলে?
মেহরাব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি সব শুনে নিয়েছো?
— হ্যা শুনেছি। এখন উত্তর দাও।
— বেশ, শুনো। এতদিন নিজেকে আমি প্রকাশ করিনি, কারণ তোমাকে আমি সময় দিয়েছিলাম তোমাকে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় তুমি অনেক ডিপ্রেশড হয়ে গিয়েছিলে, তার উপর তুমি আমার উপর খুব রেগে ছিলে। আমি জ্বীন, আমি কন্ঠ আর রুপ দুটোই পরিবর্তন করতে পারি। আমি চাইনি তুমি অত তাড়াতাড়ি আমার সত্যিটা জেনে ফেলো তাই কন্ঠ পরিবর্তন করেছি। উম্মের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ করার আগে আমার এটা জানা প্রয়োজন ছিল তুমি কাকে চাও? আর আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে সংসার করতে চাও কিনা? এটা সিউর হওয়ার জন্যই এসব করা।
তারপর মেহরাব আমার গাল দুহাতে জড়িয়ে বলল,
— অতীতে কি ছিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী, তোমার উপর আমার স্বামী হিসেবে কর্তব্য আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেদিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি।
মেহরাবের কন্ঠে বলল, মুশু আমি কিচ্ছু চাইনা, শুধু চাই বাকিজীবন টা তোমার সাথে তোমাকে ভালোবেসে কাটাতে।
আমি উনাকে জাপটে ধরে বললাম, আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি।
.
(চলবে)

জ্বীনবর_২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্বঃ ১২

মেহরাব আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, এভাবেই থেকো আমার সাথে। কখনো ছেড়ে যেও না বউ। তাহলে বড্ড একা হয়ে যাব।
আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, উহু। কখনোই যাবনা। এত্তগুলা ভালোবাসি তোমায়।
— আমিও এত্তগুলা ভালোবাসি। অযু করে এসো একসাথে নামায পড়ব। এতদিন যেদিনটার অপেক্ষা করেছি, সেদিনটা এসে গেছে বউ।
আমি লজ্জামাখা মুখে আচ্ছা বলে অযু করে এলাম। একসাথে নামায পড়লাম, এটা এত সুন্দর অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবনা। নামায পড়া শেষে উনার পা ধরে সালাম করলাম, উনি মুচকি হেসে আরেকটা চুমু দিয়ে কোলে তুলেন আমায়। আমি উনার শার্ট আকড়ে ধরে বললাম,
— কি করছেন কি! নামান আমায়। পড়ে যাব তো।
— উহু পড়বেনা। কোলে করে ব্যালকুনিতে নিয়ে এসে দোলনায় বসালেন। আস্তে আস্তে দোল দিতে দিতে বললেন, বউ…
— হুম।
— তোমার জন্য একটা উপহার রেখেছিলাম বাসররাতে দিব বলে। সেদিন আর দিতে পারিনি, আজ দিব।
— কি উপহার?
— তুমি চোখ বুজে বসো। আমি রুম থেকে নিয়ে আসছি। না বলা অব্ধি তাকাবেনা। আমিও বাধ্য মেয়ের মত চোখ অফ করে বসে রইলাম। উনি এসে মাথার উপর কি যেন জড়িয়ে দিলেন। চোখ খুলে দেখলাম একটা টকটকে লাল শাড়ি, গলায় একটা হার পড়িয়ে দিলেন তাতে একটা অক্ষর ছিল ‘ M’
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতকিছু?
— সামান্য ই। এসো তোমায় মেহেদী পরিয়ে দেই।
— পরাতে পারবেন?
— বউয়ের জন্য এইটুকু পারব না? উনি মেহেদী পরিয়ে দিলেন আমি অবাকচোখে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা জ্বীন এত পাগলামী করতে পারে জানা ছিলনা। এরপর বলে শাড়িটা পরে এসো। শাড়ি জড়ালাম কিন্তু মেহেদীর জন্য কুচি করতে পারছিলামনা। উনি এসে ভাজে ভাজে কুচি করে দিলেন। আয়নার সামনে বসিয়ে চুলে খোপা করে দিলেন তাতে আবার ফুল গুজে দিলেন। চোখে কাজল পরিয়ে দিলেন। শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা চড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ গুজলাম। জ্যোৎস্না ভরা চাদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— দেখুন আজকের চাদটা কত সুন্দর।
— আমার বউয়ের থেকে বেশী নয়। লজ্জামাখা চোখে উনার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে আমার জন্য হাজারো অনুভূতি আর ভালোবাসা দেখয়ে পেলাম। এই প্রথম বুঝতে পারলাম জ্বীনরা ক্ষতি করতে নয়, ভালোবাসতে জানে। মানুষের চেয়ে বেশী ভালোবাসা আর পবিত্রতা তাদের মনে আছে। এমন একটা জ্বীনবর পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মুখে বলেই ফেললাম, জ্বীনবর, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়।
পরেরদিন গুলো আমার এত আনন্দে কেটে গেল, মনেই হল না দুঃখ নামক বস্তু আমার জীবনে আছে। এত ভালোবাসে জ্বীনবরটা আমায়! আমার চোখেমুখে সবচেয়ে সুখী বউয়ের ছাপ লেগে থাকে। সারাটাদিন খুনসুটি, একসাথে নামায পড়া, আমাকে রান্না শিখিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে ছোটছোট সারপ্রাইজ, ঘুরতে যাওয়া,রাত হলেই তার বুকে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া সবমিলিয়ে জ্বীনবর আর আমার সংসার।এর মাঝে ফুপি একবার এসে দেখে গেলেন আমাকে। এত সুখী দেখে হয়ত চোখে-মুখে একটু হিংসে ভাব জেগে ছিল। সীমা খুশি হয়ে বলেছিল, ” মুশু তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী, ভাগ্য করে একটা হীরে পেয়েছিস। আগলে রাখিস, হারিয়ে যাতে না যায় তোর অবচেতনে।”
এর মধ্যে দাদীমা মারা যায় অদ্ভুতভাবে। কেউ যেন তাকে অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলেছে। আমরা দুইজন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাও ও অনেক শক্ত ছিল। আমাকে খুব আগলে আগলে রাখত, একা ছাড়ত না বেশিক্ষণের জন্য।
ভাবলাম, “অতি আপনজনকে এভাবে হারিয়ে, ওর মধ্যে ভয়টা ঝেকে বসেছে। তাই ও আমাকে নিয়েও ভয় পাচ্ছে। আমি ওকে যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করতাম।
সেদিন রাতে মেহরাব বাসায় ছিলনা, আমি রুমে বসে হাদিসের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ নিচ থেকে ধুপধাপ শব্দ আসতে লাগল। ভয় পেয়ে গেলাম একটু, নিচে তো শাকি রা আর আন্টি আছেন। কি হল তাদের আবার?
বইটা রেখে নিচে আসলাম। আন্টির ঘরের সামনে আসতে দেখি দরজা হাট করে খোলা। আস্তে আস্তে রুমে ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। একটা কালো লোমশ ভয়ানক প্রাণী আন্টির পেটে তার বড় বড় চোখ ঢুকিয়ে পেটের সব বের করে আনছে। আন্টি চিৎকার চিৎকার করতে চুপ হয়ে গেলেন, আমি এই অবস্থা দেখে জোরে চিৎকার করে উঠলাম।
প্রাণীটি শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকায়। তার সারা মুখে রক্তমাখা। মুচকি হেসে আমাকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লম্বা করে।
এসবদেখে আমি স্থির থাকতে পারলামনা দৌড়ে রুমে এসে দরজা লক করে ওয়াশরুমে চলে এলাম। চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা যেন ভাসছে। আর সহ্য হলনা, বমি করে দিলাম। ফ্রেশ হওয়ার পর যেন শক্তি পাচ্ছিলামনা উঠে দাড়ানোর। তাও রুমে আসলাম এমনসময় দরজা জোরে জোরে ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। এতজোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হচ্ছে ভেঙ্গে ই যাবে। জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।

কয়েকবার পড়ার পর দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। কিছুটা সাহস ভর করে দরজা খুলে দেখতে যাব, অল্প খুলতেই প্রাণীটির ভয়াবহ চিৎকার শুনলাম। সাথে সাথে আবার লক করে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। মেহরাব যে কোথায়? আমার ভীষণ ভয় করছে। বাবা বলেছিলে কখনো বিপদে পড়লে সুরা তিলওয়াত করতে। মনে মনে যত সুরা পারি সব পড়লাম, আল্লাহকে ডাকছিলাম। তখনো কিন্তু দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়নি। হঠাৎ দরজার বাহিরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনলাম। মনে হল খুলে দেখি, কিন্তু দ্বিতীয়বারের মত সাহসটা পেলামনা। প্রায় কিছুক্ষণ পর মেহরাবের গলা পেলাম,
— মুশু দরজা খুলো।
তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলতে যাব, তখন আরেকটা আওয়াজ এল,
— বউ আমি না বলা অব্ধি দরজা খুলবেনা। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, আবার আওয়াজ, মুশু দরজা খুলো, ওটা নাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার কন্ঠে নকল করে সে তোমাকে বাধা দিচ্ছে। মুশু বাচাও আমাকে।
— বউ, ওর কথায় ভুলোনা। যতক্ষণ না ফজরের আযান পড়ছে, তুমি ঘর থেকে বের হবেনাম এটা তোমার স্বামীর আদেশ।
দরজা না খুলে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদা দিয়ে লম্বা মোনাজাত ধরলাম। আমি বুঝে গেছি কে আসল আর কে নকল। বিয়ের পর থেকে মেহরাব আমাকে কখনোই মুশু বলে ডাকত না, এটাও আমি জানি ওর জীবন যত বিপন্ন হোক ও আমাকে ওকে বাচাতে বলবে না। অপেক্ষা শেষ হল, ফজরের আযান দিয়ে দিল। নামায শেষ করে দরজা খুলতে গেলাম। ভয় আর দুশ্চিন্তায় সারা রাত কেদেছি, আমার মেহরাবের কিছু হয়ে যায়নি তো।
দরজা খুলে দেখলাম, ও মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কপাল আর মুখে আচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই ধস্তাধস্তিটা ওর সাথেই হয়েছিল। সেদিন রাতেও তবে এই প্রাণীটির সাথে মেহরাবের সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক কষ্টে ও উঠিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। প্রাথমিক চিকিৎসা দিলাম, আমার ভাবনা হতে লাগল এত কিছু হয়ে গেল শাকি বা বাকি মেয়েগুলোর কোনো সাড়াশব্দ পেলামনা কেন? তার মানে কি ওদেরকেও! আল্লাহ কে এ শত্রু যে আমাদের সুখের জীবনে অভিশাপ লাগাতে এসেছে। প্রায় কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল ও। আমি ওকে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে শান্ত্বনা দিতে লাগল এই বলে যে, আমার কিছু হয়নি বউ। কেদোনা।
— কে ওই প্রাণীটি? এভাবে কেন আঘাত করছে আমাদেরকে?
— বউ ভয় পেয়োনাহ। কিচ্ছু হবেনা, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে তোমাকে একা রেখে গিয়ে। আর কখনো তোমায় একা ছাড়বনা।
— আমরা আর এখানে থাকবনা মেহরাব।
— কোথায় যাবে?
— আমার বাবার কাছে যাব।
— এটা হয়না বউ।
— কেন হয়না? আমি এত বুঝি বুঝতে চাইনা মেহরাব। আপনি আমার সাথে বাবার বাড়ীতে যাবেন। নতুবা আমি কিন্তু কিছু করে বসব।
মেহরাব অনেক পীড়াপীড়ি তে হ্যা বলতে বাধ্য হল। সব গুছিয়ে আমরা বিকেলের দিকে বের হলাম। গাড়িতে উঠে টলমল চোখে বাড়ীটাকে দেখতে লাগলাম। এই বাড়ীতে এতদিন সুখে সংসার করলাম, এই বাড়ীটাই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবার কথা খুব মনে পড়ছে। চোখের পানি মুছে নিলাম পড়ার আগেই। মেহরাব দেখলে কষ্ট পাবে, ওকে আমি কষ্টে রাখতে চাইনা।

অনেকদিন পর নিজের বাড়ীতে পা রাখলাম, যে বাড়ী থেকে একদিন রাতের আঁধারে পালিয়েছিলাম। আমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করেছি বাবা জানলে জানিনা কি হবে! কিন্তু মেহরাবকে দেখলে বাবা মানতে বাধ্য, ও যে অনেক ভাল।
দরজা নক করতেই চাচ্চু দরজা খুলল। আমি সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরল, আমাকে দেখে খুব খুশি হল চাচ্চু। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
— এতদিন কোথায় ছিলাম?
— চাচ্চু আমি বিয়ে করে ফেলেছি। শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম।
— বলিস কি! এত খুব খুশির সংবাদ। জামাই কই আমাদের?
— আসছে, গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছে।
— আয় জামাই নিয়ে আগে ভেতরে আয়। তারপর বাকি কথা হবে।
— তুমি যাও, আমি উনাকে নিয়ে আসছি।
মেহরাব লাগেজ নিয়ে চলে আসল একটু পর। আমি বাসা দেখিয়ে বললাম,
— এটা তোমার শ্বশুড়বাড়ি। এসো ভেতরে এসো। বাবা একটু রাগী, তবে খুব ভাল। জ্বীন বিয়ে করেছি জানলে হয়ত একটু রাগ করবে। সমস্যা নেই চাচ্চু আছে। বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে। এসো ভেতরে এসো।
আমি ভেতরে ঢুকার পরো দেখলাম উনি বাহিরে দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে?
— কিছু না তো। আমি হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসলাম। চাচ্চু ওকে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— তুই কাকে বিয়ে করেছিস?
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here