জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১৫,১৬

0
2321

জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১৫,১৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

ডায়েরীটা লুকিয়ে চাচ্চুর বৈঠকখানায় আসলাম। চাচ্চু আমাকে দেখে কাছে ডাকল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিরে মা, মন খারাপ তোর?
— নাহ, আমি ঠিক আছি। ডেকেছিলে?
— হ্যাঁ রে মা।তোর সাথে কিছু কথা ছিল আমার।
— বলো চাচ্চু।
— কাল রাতে মেহরাব আমার উপর আক্রমণ করেছিল। আমি যখন তাহাজ্জুদের নামায পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম ও আমার পথ আটকে দাঁড়ায়। তখন ওর সে কি ভয়ংকর রুপ ছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে সুরা-কেরাত পড়া শুরু করি। একটু পরে দেখি ও নেই। কালকের ঘটনাটার পর আমি খুব চিন্তিত তোকে নিয়ে।
আমার বিশ্বাস হলনা কথাগুলো। আমার মেহরাব এসব করতে পারে বলে আমার মনে হয়না। তাও অবিশ্বাস করার উপায় নেই, চাচ্চু বলছেন। তাছাড়া যে এতগুলো মানুষকে নিজের স্বার্থের জন্য মেরে ফেলতে পারে, যে তার মুখোশ খুলে দিল তাকে মারতে যাওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার না। কি হচ্ছে আমার? আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। আমি চাইলে মেহরাবকে ঘৃণা করতে পারছিনা। বার বার মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি। মেহরাবের ভালোবাসায় কোনো খুত নেই। এসব ও করতে পারেনা। কিন্তু নিজের মনটা সঠিক ভাবার মত কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই।
— চাচ্চু তুমি একটু সাবধানে থেকো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা।
— চিন্তা তো করতে হয় মা। এখন তো তোর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাই-ভাবী দুজনেই তোকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন তোর সব দায়িত্ব আমার। আমার একটা কিছু হয়ে গেলে তোকে কে দেখবে?
বোনের কথা তো আমি ভাবতে পারিনা, ওর উপর আমার কোনো ভরসা নেই। ২১বছর আগে নিজের প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে চলে গেল বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে। তোর বিয়েও দিয়ে দিল কোনো বাছ-বিচার ছাড়া নিজের মেয়ের স্বার্থে।
ওকে বোন বলতেও লজ্জা করে আমার।
— না চাচ্চু ফুপি খুব ভালো। ফুপি ছিল বলেই তো এতদিন একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলাম। আমার জন্য অনেক করেছে ফুপি, তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবনা।
— মা তুই বড্ড সরল। সবকিছুকে তোর মতই সরল ভাবিস।
— না চাচ্চু।
— ওসব নিয়ে আর ভাবিসনা মা। আমি তোকে যেটা বলার জন্য ডেকেছি সেটাই বলি। আমি চাচ্ছি তোকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য।
— সেটা কিছুতেই করতে পারবনা আমি চাচ্চু।
— দেখ মা তুই একটা সাবালিকা মেয়ে। তোর দায়িত্ব নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের সবাই জেনে গেছে তুই ফিরে এসেছিস। কখন তোর উপর কোন কলংক চাপিয়ে দেয় তার ঠিক নেই। এমন মেয়ে ঘরে থাকলে লোকে তোর বদনাম করবে।
আমি তোর বাবার মত, বাবা হয়ে কি করে মেয়ের বদনাম সহ্য করি?
সবাই এখনো ভাবে সেরাতে তুই পালিয়ে গিয়েছিলি তোর ফুপুর মত। আড়ালে-আবডালে লোকে তোকে নিয়ে এখনো সমালোচনা করে।

আমি চুপ করে রইলাম। কথাগুলো খারাপ লাগলে এটাই সত্যি। চাচ্চুর ঘাড়ের উপর বসে খেলে নিন্দে করবেই। তাছাড়া সারাগ্রাম রটে গিয়েছিল আমি পালিয়ে গিয়েছি। যাওয়ার পিছনে কি কারণ তা তো তারা বুঝতে চাইবেনা, জানার চেষ্টা তো দূরে থাক। নিজেদের মত করে গল্প রটিয়ে দিবে।
কিন্তু সব বুঝেও আমি কিছু করতে পারছিনা, আমার পক্ষে আর বিয়ে করা সম্ভব না। আমার সবটা জুড়ে এখনো মেহরাব ই আছে, ওর স্থান কাউকে দেওয়া সম্ভব না।
চাচ্চু একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, একবার ভেবে দেখিস মা। তুই যদি না চাস আমি জোর করবনা। তোর সারাজীবনের দায়িত্ব নিব। কিন্তু মেহরাবের হাত থেকে আমি কতদিন বেচে ফিরব। আমার যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায় তবে তোর কি হবে? এই গ্রামের লোকেরা তো তোকে হিংস্র প্রাণীর মত ছিড়ে খাবে। তোর চাচীমা মেয়ে মানুষ, মুখ ফুটে কিছু বলার মুরোদ নেই তার। সে তোকে নোংরা লালসার হাত থেকে কি করে বাচাবে?
এই জন্যই আমি তোকে নিয়ে বড্ড চিন্তিত। তাই বলছি একটু ভেবে দেখ। কথা দিচ্ছি তোর জন্য খুব ভালো পাত্র খুজে এনে দিব। খুব সুখে রাখবে তোকে।
আর আমি তোর সুখ ই চাই মুশু। আমার নিজের তো কোনো সন্তান নেই, ছোট থেকে তোকেই নিজের মেয়ে ভেবে এসেছি। তোর খারাপ কিছু আমি সহ্য করতে পারবনা। বলতে বলতে চাচ্চু কেদে দিলেন।

চাচ্চুর কান্না দেখে আমিও চোখের পানি আটকে রাখতে পারলামনা। চাচ্চুর কোলে লুটিয়ে পড়লাম। চাচ্চু মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নামিশ্রিত স্বরে বললেন,
— আমার মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু আমার মেয়েকে সারাজীবন নিরাপত্তা দিতে পারব কিনা আমি জানিনা রে মা। কিন্তু ভেবে দেখ, আমাকে জানাস।
তোর মতের বিরুদ্ধে আমি কিছু করবনা। এখন কাদিসনা, তোর কান্না আমার বুকে আঘাত করে। সালেহা মুশুকে খেতে দাও, মেয়েটার মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে।
শরীর ভালো নেই মা?
— কিছুদিন ধরে একটু খারাপ যাচ্ছে।
— এসব নিয়ে ভাবলে তো খারাপ হয়ে যাবে। বিকালে একটু বাহির থেকে ঘুরে আসিস। কেউ কিছু বললে কথা বলবিনা। আমাকে এসে বলিস! এখন তোর চাচিমার কাছে যা, কিছু খেয়ে নে।
আমি একটু বের হব। একটা সালিশের কাজ আছে।
— সাবধানে যেও চাচ্চু।

আমার এত খারাপ লাগছে এখন বলার বাহিরে। আমার জন্য গ্রামের মানুষ চাচ্চুকে বাজে কথা বলে তাও চাচ্চু আমার প্রতি এত যত্নশীল। নিজের কাছে সারাজীবন রেখে দিতেও রাজি। কিন্তু এভাবে কতদিন চাচ্চুর ঘাড়ের উপর বসে খাব। নিজেরও যাওয়ার মত কোনো জায়গা নেই, বিয়ে করেও সুখের জীবন পেলামনা। এটাই শুনতে হল আমার স্বামী খুনি।
মরে যেতে ইচ্ছে করছে। না পারছি চাচ্চুর কাছে থাকতে, না পারছি মেহরাবের কাছে ফিরতে আর না পারছি বিয়ে করতে!
এখন মরে গিয়ে পরকালটা ও হারাতে চাচ্ছিনা। সময় যত যাচ্ছে, নিজেকে খাপছাড়া পাগল মনে হচ্ছে। বিকালে একটু বের হলাম চাচ্চুর কথামত। এখানে পাশে একটা দীঘি আছে। যেখানে বসলেই আমার মন ভালো হয়ে যেত, খুব ভালো লাগত। অনেকদিন পর এসেছি দীঘিটার পারে।
আগের মতই আছে দীঘিটা। কত হেটেছি বাবার সাথে এর পাড়ে, শিরিন কে নিয়ে সাতার কেটেছি, নৌকা ভাসিয়েছি দুবোন মিলে। ভাবলেই কষ্টটা তীব্র হয়।
দীঘির পাড়ে বসতেই গ্রামের পরিচিত পাগল হোসাইন মিয়া এসে হাজির।
হাসতে হাসতে বলল,
— উত্তর খুজচ্ছিস? এত সহজে তো পাবিনা।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
— বড় জালে আটকা পড়েছিস, বের হবি কেমনে? তাই তাই তোর কোনো গতি নাই। বাচাতে চাইলে উত্তর খোজ, নাহলে অকালে সবাই মরবি।
বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। পিছু ডাকলাম শুনলনা। তার কথাটা গুলো খুব গভীর। সত্যিই আমি প্রতিনিয়ত উত্তর খুজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কে দেভে আমাকে সব উত্তর।
এমনসময় আমার গ্রামের আগের মেয়েবন্ধু দের সাথে দেখা হল। পানি আনতে এসেছিল আমাকে দেখে বলল,
— আমাদের মুশু যে! কেমন আছিস রে তুই?
— ভাল আছি, তোরা?
— আমাদের খবর আর কে নেয় বল! শুনলাম চুপি চুপি নাকি গ্রামে আসলি, তা একবার আমাদের সাথে দেখা করলিনা! নাকি এখন সখী ভাবতে ইচ্ছে করেনা।
— তা নয়, শরীর খারাপ ছিল তাই বের হইনি।
— অহ! মুশু তোর বর কোথায় রে যার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলি। ছেড়ে দিয়েছে নাকিরে? এত রুপ দিয়েও তাকে বেধে রাখতে পারলিনা। একেই বলে কপাল! আমরা তো না পালিয়েও সুখে আছিরে মুশু।
বংশের নাম ডুবাইনি বলে এখনো সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারি। ঘরের এক কোণে বসে হা-হুতাশ করিনা।
এখন তোর কি হবেরে মুশু? স্বামীর মুখ কি আর এই জীবনে দেখবি!

আমার মাথাটা ঘুরাচ্ছে এসব শুনে। গায়ে কাটা দেওয়া কথা, এক একটা ছুড়ির মত শরীরে ঢুকে যাচ্ছে মনে হল। তাও নিজেকে সামলে বললাম,
— এসব কি না বললেই নয়।
— তুই কর‍তে পারিস? আর আমরা বললেই দোষ। এতকিছুর পরো তুই কিভাবে মুখ দেখিয়ে বেড়াচ্ছিস আল্লাহ ই জানে। আমরা হলে তো গলায় কলসি বেধে ডুবে মরতাম। আমাদের চামড়া তো আর গন্ডারের চামড়া না, যে লাজ-লজ্জা নেই।
— আমি আসছি।
— আর কত পালাবি রে মুশু? সেই পালিয়ে তো চাচার ঘাড়েই উঠলি। এই জন্য ই বলে পাপ বাপ কেও ছাড়েনা। আল্লাহ তোকে এভাবেই খাওয়াক সারাজীবন। স্বামীর ভাত তো কপালে জুটল না, চাচার ভাত ই খা।
— যার ভাত ই খাই ভাতের অভাবে তোদের দোরগোড়ায় যাচ্ছিনা আল্লাহর কাছে এইটুকু শুকরিয়া। আর এত কথা বলছিস যে, তোর স্বামী তো শুনলাম তোকে সুখে রাখার জন্য আরেকটা সতীন নিয়ে এসেছে। সেই সুখে নাকি তুই ঝগড়া করে বাপের বাড়ীতে এসেছিস। আল্লাহ তোকে সুখ ভরিয়ে দিয়েছেরে।
— তুই আমাকে অপমান করছিস?
— অপমান কেন করব, যা শুনলাম তাই বলছি।
— চল রে সবাই। আমরা ওর মত মানুষের কথা নিয়ে পড়ে থাকিনা। ওর মত নষ্টা নাকি আমরা যে স্বামীর উষ্টা খেয়ে চলে আসব।
এইজন্য ই মা বলেছিল ওর থেকে দূরে থাকতে। তাও এতদিনের সখী বলে গল্প করতে এলাম, মুখের উপর অপমান করল।
এভাবে কথা গুলো বলে ওরা চলে গেল। বাড়ী ফেরার সময় কিছু মানুষের চোখে পড়ে গেলাম। সবাই আমার সামনেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল,
— হানিফ হুজুরের মেয়ে মুশায়রা না? যে নাগরের সাথে পালিয়েছিল।
স্বামীর উষ্টা খাইয়া আবার বাপের ঘরে আসছে।
এই মেয়েগুলার জন্য গ্রামের সব মেয়ে সাহস পায়, যেমন কর্ম তেমন ফল ই পাইসে। নষ্টা মাইয়া একটা।

এতকথা শুনার পর ও যে আমি চুপ আছি এটা দেখে নিজের ই অবাক লাগল। আল্লাহ কষ্টের সাথে সাথে ধের্য্য ও বাড়িয়ে দিসে। এই সেই মানুষগুলা যাদের জন্য আমি অনেক কিছু করেছিলাম।তাদের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে ছিলাম।
নিজের জমা টাকা খরচ করে এদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলাম, আজ সেই মানুষগুলো আমাকে থুথু দিচ্ছে।
এরা পারেও! কেন যে আল্লাহ তুমি আমাকে মৃত্যু দিচ্ছোনা।
আমার জন্য চাচচু না জানি কত কথা শুনে, কত অপমানের মুখোমুখি হয়। সত্যিই মনে হচ্ছে চাচ্চুর কথায় বিয়েটা করা জরুরী। এই গ্রাম থেকে বের হতে পারলে নিজের অপরাধবোধটা আর ঝেকে বসবেনা।
আবার মনে হচ্ছে আমি বিয়ে কি করে করব? আমার তো একবার বিয়ে হয়েছেই। মেহরাব কে ছাড়া কাউকে মানা আমার পক্ষে সত্যিই সম্ভব না।
বড় একটা প্যাচে পড়ে আছি।
.
(চলবে)

জ্বীনবর_২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

পর্বঃ ১৬

অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম চাচ্চুর কথায় ই রাজী হয়ে যাব। আমার জন্য চাচ্চুর এত অপমান আমি আর মেনে নিতে পারছিনা, আর মেহরাব যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি ওকে আমি এভাবেই দিব। পারলে বিয়ে আটকে দেখিয়ে দিক। আমারো কষ্ট হবে অন্য কাউকে মেনে নিতে, কিন্তু কষ্ট পেয়ে কি লাভ? যার জন্য কষ্ট পাব সেই তো আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। সন্ধ্যায় চাচ্চুর রুমের দরজায় এসে কড়া নাড়লাম। চাচ্চু-চাচীমা মিলে কথাবার্তা বলছিলেন। আমাকে দেখে চাচ্চু উঠে বসে বললেন, আয় মা, ভেতরে আয়।
চাচীমা হাত ধরে নিয়ে এসেছে খাটের উপর বসিয়ে নিজে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। চাচ্চু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— কিছু বলবি মা? খাওয়া-দাওয়া করেছিস তোহ?
— হ্যা, চাচ্চু। তোমাকে কিছু বলার ছিল।আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
— কি সিদ্ধান্ত নিলি মা?
— আমি বিয়েটা করব।
— আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস মা। আমি তাহলে পাত্র দেখা শুরু করি?
— করো চাচ্চু। বলার সাথে সাথে আমার কেমন জানি খারাপ লাগতে শুরু করল। আমি মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে ধরে এসে বমি করলাম। মাথাটা ভীষণ ঘুরাচ্ছে। চাচীমাও আমার এই অবস্থা দেখে ছুটে আসলেন। ফ্রেশ হওয়ার পরই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। শরীরটা নাড়ানোর মত ক্ষমতা নেই আমার। চাচীমা পরমযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। চাচ্চু গম্ভীরমুখে ঘরের এক কোণে পায়চারি করছেন। জ্ঞান ফেরার পর চাচীমা চাচ্চু কে বললেন, মুশুর জ্ঞান ফিরেছে।
— চাচীমা কি হয়েছে?
চাচ্চু আমার দিকে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। চাচীমা ফিসফিস করে বলল,
— ডাক্তার এসে বলল তুই মা হতে যাচ্ছিস।
এই সংবাদে আমি খুশি হব না কষ্ট পাব বুঝতে পারছিনা। আমার আর মেহরাবের অনাগত সন্তান আমার গর্ভে। নিজের অজান্তেই পেটে হাত বুলালাম। চাচীমা দেখে বলল, তোর চাচ্চু একটুও খুশি না রে মুশু। বার বার বলছে একটা বদ ও খুনি জ্বীনের সন্তান ওটা। আমি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— চাচীমা আমাকে একটু একা থাকতে দেবে।
চাচীমা নতমুখে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা আটকে দিয়ে কাদতে লাগলাম। পৃথিবীতে আসার আগেই আমার সন্তানের একটা পরিচয় হয়ে গেল।
এই সন্তান আমার পবিত্র ভালোবাসার ফল, কিন্তু মেহরাবের কথা আমি জানিনা।
ও এই সংবাদ জানলে কি খুব খুশি হত? নাকি নিজের সন্তানকে অস্বীকার করত!
বুঝতে পারছিনা আমার কি করা উচিত? এমন সময় সেই ডায়েরীটা আমার চোখে পড়ল যেটা সকালে আমি বাবার ঘর থেকে এনে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

পড়ার মত মনের অবস্থা আমার নেই তাও ডায়েরীটা হাতে নিলাম। মনে ভাবনা আসল হয়ত এই ডায়েরী থেকে জানা যাবে আমার মেহরাব খুনি কিনা? আমার এখনো বিশ্বাস ও সম্পূর্ণ নির্দোষ।
তাই আর দেরী না করে ডায়েরীটা খুললাম। প্রথম পাতায় কিছু দোয়া-মাছুরা দেখে হতাশ হলাম। কিন্তু কৌতুহলে মাঝের পৃষ্টা উল্টালাম। সেখানে একটা তারিখ আর কিছু কথা লেখা আছে। তারিখটা মায়ের মৃত্যুর দিন।

” আমি জানি শাহানা, তোমার মৃত্যুটা স্বাভাবিক হতেই পারেনা। তোমাকে কেউ ইচ্ছে করেই মেরে ফেলেছে। জানিনা, আমার এত বড় ক্ষতি কে করল? তবে কথা দিচ্ছি তাকে আমি খুজে বের করব।”
এটা পরে একটু খটকা লাগল। বাবা কি তখনো জানতেননা যে, মেহরাবই এসব করছে। এর পরের কিছু পাতা খালি, তারপরের পাতায় শিরিনের মৃত্যুর তারিখ লেখাঃ

” আমার ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়েটাকেও ছাড়ল না অচেনা জালিমটা। ছাদের থেকে ওকে ইচ্ছে করেই ফেলা হয়েছে মারার জন্য। আমার খুব ভয় হচ্ছে, আমার মুশু মা কে নিয়ে। এরপরের শিকার কি আমার মুশু মা………….???”
শিরিনের মৃত্যুর কারণ ছিল ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়া। সবাই সেটাই জানত, অবাক ব্যাপার হচ্ছে বাবা তখনো বুঝেনি এটা মেহরাবের কাজ।
কৌতুহলটা ক্রমশ বেড়ে গেল।
পরের পৃষ্ঠায় লেখা আছেঃ

” আজ আমি জেনে গেছি কে আমার গোপন শত্রু! জেনে খুশি হচ্ছিনা, বরং নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে। এতটা নিচে কেউ নামতে পারে তার লোভের জন্য। সব জেনেও চুপ করে আছি আমার মুশুমার নিরাপত্তার কথা ভেবে।”
এইবার সত্যিই আমার মেহরাবের প্রতি সন্দেহ হচ্ছে। চাচ্চুও বলেছিল ও আমাকে পাওয়ার জন্য ই এমন করেছিল। কিন্তু বাবা নিজেকে কেন ঘৃণা করবে?

এই তারিখটায় আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেদিনের লেখাঃ

” মুশুকে আমি পালাতে বলেছি, কারণ আমি বুঝে গেছি এরপরে ওর উপর ই আক্রমণ করবে। জানিনা, মুশু কতটা ভাল থাকবে? কিন্তু জানোয়ারটার হাত থেকে তো বাচবে। ওই জানোয়ারটা আজ নিজের রুপটা আমাকে দেখিয়ে দিল।
সারারাত আমার উপর নির্যাতন করেছে মুশুকে কোথায় পাঠিয়েছি জানার জন্য।
তবু আমি মুখ খুলিনি, আর খুলব ও না।”
শেষ পাতায় আরেকটা কথা লেখা ছিল যেটা আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে,
” শত্রু বাহিরের হলে তাকে শেষ করা যায়,
কিন্তু শত্রু তো বাহিরের নয় ঘরের……..
আমার নিজের রক্তের……..
তাকে নিঃশেষ করার উপায় টুকুও আমার জানা নেই….
ও বলেছে আজ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে এখান থেকে। জানিনা আর বেচে ফিরব কিনা! আল্লাহ আমার মুশুমা কে তুমি হেফাজতে রেখো।
আমার শেষ আর্তনাদ……….”

আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেছি। এতটাই শক হলাম যে ডায়েরীটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। তার মানে শত্রু আর কেউ নয়। আমার বাবার কলিজার টুকরা আর আমার প্রিয় চাচ্চু। চাচ্চু আমাকে এতগুলো মিথ্যে অনায়াসে বুঝিয়ে দিল, আমার মেহরাবকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল।
পুরো রহস্যটা আমার সামনে না এলেও কিছুটা আমি বুঝে গেছি। এখন আমি কি করব? আমার সত্যিই মাথা কাজ করছে না। এক্ষুনি চাচ্চু যদি জানে তার আসল রুপ আমার সামনে চলে এসেছে তাহলে আমাকেও মারতে দুইবার ভাববেনা। যার পক্ষে নিজের ভাইকে শেষ করা সম্ভব, আমার ক্ষতি করা কোনো ব্যাপার না। আমার কিছু হলে আমার সন্তানটাও যে শেষ হয়ে যাবে।
না এখন চুপ থাকব, আমার মেহরাব কোথায় সেটা আগে খুজে বের করতে হবে।
আমার মন বলছে ওকে চাচা কোথাও বন্দি করে রেখেছে।

এমনসময় চাচ্চু দরজা ধাক্কাল, “মা মুশু, দরজাটা খোল মা!”
এই মা ডাকটা তার শুনতে বড্ড ঘৃণা হচ্ছে। ডায়েরীটা লুকিয়ে ফেলে দরজাটা খুললাম। চাচ্চু ভিতরে এসে আমার রুমের চারপাশটা একবার দেখে নিল।
— কিরে মা, দরজা খুলতে এত দেরী হল যে?
— চাচ্চু, শুয়ে ছিলাম উঠতে কষ্ট হচ্ছিল।
— হুম, তোর চাচীর কাছে তো শুনলি তোর পেটে ওই বদজ্বীনের বাচ্চা আছে। এই বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা পাপ হবে মুশু। পেটে শত্রু পুষে লাভ নেই। আমি বলছি কি, বাচ্চাটা তুই নষ্ট করে ফেল।
খুনির সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনো ঠ্যাকা নেই তোর।
শুনে কলিজার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, এই কথা তো চাচ্চুর মুখেই মানায়। এত নিষ্ঠুরতা এই নূরানী, ভদ্র চেহারার পিছনে থাকতে পারে বাবার লেখা গুলো না পড়লে জানতাম না। কিন্তু এখন এসব প্রকাশ করলে চলবেনা। আমাকে ধীরেসুস্থে কাজ করতে হবে।
এই বাচ্চাটা আমি কিছুতেই মারতে দিবনা, এটা আমাদের পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন। কিছু একটা করে চাচ্চুর হিংস্রতার হাত থেকে ওকে বাচাতেই হবে।
— কিরে মা, চুপ করে কি এত ভাবছিস?
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here