জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১৭,১৮

0
2703

জ্বীনবর_২,পর্বঃ ১৭,১৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আমি ভয়ে ঢক গিলে নিলাম। হিংস্র হাতটা এইবার আমার সন্তানের উপর এসে পড়ছে। চাচ্চুকে এখন কিছু বুঝতে দিলে চলবেনা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— চাচ্চু আমি যতটুকু জানি এ্যাবরোশনের সময় ও নেই এখন। এখন যদি বাচ্চা নষ্ট করি, তাহলে আমারো ক্ষতি হবে। চাচ্চু শুনে কিছুটা হতাশ হল। তারপরো বড়জোর মুখে হাসি ফুটিয়ে চলে গেল। আমার ব্যাপারটা খটকা লাগল। আমিও চাচ্চুর পিছু নিলাম। উনি সোজা রান্নাঘরে চাচীমার কাছে গেলন।
আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে আড়ি পাতলাম। কিছু থালাবাসন নিচে পড়ার শব্দ শুনলাম। নিশ্চয়ই রাগে চাচ্চু সেগুলো ফেলে দিয়েছেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
— এই মেয়েটাকেই শেষ করতে পারছিনা। তার উপর এসে জুটল তার সন্তান। ঝামেলা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, আর সহ্য হচ্ছেনা। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে গলা টিপে দুটোই একসাথে শেষ করি। গ্রামের সবাই জেনে গেছে মেয়েটা আমার কাছে। ওর সন্দেহজনক কিছু হলে গ্রামের লোকেরা আমাকে ই সন্দেহ করে বসবে। ইদানিং গ্রামে কিছু গোয়েন্দা বাড়ছে।
— আপনি শান্ত হন।
— কিসের শান্ত হব? যতক্ষণ না শত্রু শেষ করতে পারছি ততক্ষণ আমি শান্তি পাচ্ছিনা সালেহা। বাপ-বেটির কাহিনী শেষ ই হচ্ছেনা। এত কষ্ট করে বাপটাকে সরালাম, মেয়েটা এসে হাজির। এত কিছু করলাম মেয়েটাকে মারার জন্য, কিছুতেই কিছু হলনা। উলটো আরেকটা জ্বীনের বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছে।
ভেবেছি বিয়ের নাম করে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় করব ঝামেলা ছাড়া। সেটাও আর হল না।
এভাবে একের পর এক প্ল্যান নষ্ট হচ্ছে আমার। আর সহ্য হচ্ছেনা, এবার একটা কিছু করতেই হবে। ও আর ওর সন্তানকে টুকরো টুকরো করে তবেই থামব আমি।
শুনে আমার হাত-পা কাপাকাপির পর্যায়ে চলে গেল। আমার সন্তানের কি হবে?
হাত দিয়ে পেট চেপে ধরলাম, আমি বেচে থাকতে আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে দিবনা। মেহরাব তুমি কোথায়? প্লীজ আমার কাছে ফিরে এসো। তোমার বউ আর সন্তানের পাশে এসে দাড়াও। চাচ্চুর কাছ থেকে আমাকে নিয়ে যাও।
সারারাত ঘুম হলোনা, কেবল ছটফট করতে লাগলাম। আমাকে যে মেহরাবকে খুজে বের করতে হবে? আর চাচ্চুর মুখোশ সবার সামনে খুলে দিয়ে তার উপযুক্ত শাস্তি তাকে দিতেই হবে।
ডায়েরীটা হাতে নিলাম। তখন অতটা ভাল করে ঘাটাঘাটি করতে পারিনি, এখন একটু চেক করে দেখি কোনো নতুন ক্লু পাই কিনা? কিন্তু কিছুই পেলামনা।
এদিকে শরীরটাও আর টলছেনা। পেটের ভিতর টা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে, ক্লান্তিটাও অনেক বেশী। আমার তো ২মাস ও শেষ হলনা। এর মধ্যে এটা এত ভারী লাগার তো কথা নয়। তবে কি সত্যি আমার ভিতরে মেহরাবের মতই কেউ একজন বেড়ে উঠছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? কিন্তু যেখানে আমার সাথে মেহরাবের বিয়ে হতে পারে সেখানে আমার গর্ভে জ্বীন জন্ম নেওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। সবই আল্লাহর অশেষ রহমত, তার ইচ্ছেতেই সব হয়।
আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও।

বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে এসে দাড়ালাম। মেহরাব এর কথা বড্ড মনে পড়ছে, এই সংবাদে না জানি কত খুশি হত সে। কিন্তু আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহরাব সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও কেন সেদিন চুপ ছিল? ও তো আমায় সবটা বলতে পারত। আর চাচ্চু ই বা মেহরাবের ব্যাপারে এত কিছু কি করে জানে? তবে কি চাচ্চু মেহরাবকে আগে থেকেই চিনত!
চাচ্চু সবাইকে মেরে ফেলল কেন? কি স্বার্থ আছে চাচ্চুর! বাবা তো তাকে অনেক বেশী স্নেহ করতেন! আর উনি বাবাকে চোখে বেধেই বা কোথায় নিয়ে গেলেন!
এত প্রশ্নের জট পেকে আছে, কিন্তু কোনোটার ই উত্তর আমি পাচ্ছিনা।
এমন সময় খেয়াল করলাম একটা কালো ছায়া এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইদিক ওদিক উকি মারছে। এত রাতে কে ওখানে উকিঝুকি মারছে। চাচার ঘরের দরজাটা খুলে গেল তখনি। চাচা বের হয়ে এসে বারান্দার আড়ালের কোণে চলে গেলেন তার সাথে ওই ছায়াটাও।
আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। এখানে তো চাচ্চু নেই। তবে চাচ্চু কোথায় গেল? ঘরের দরজা তো এখনো খোলা তার মানে চাচ্চু ঘরে ঢুকেনি। বাড়ীর গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা হাট করে খোলা।
চাচ্চু এত রাতে বেরিয়েছে তার মানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। দেরী না করে আমিও বাড়ী থেকে বের হলাম। একটু হাটার পর দেখি চাচ্চু দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমিও অনেকটা দূরত্ব রেখে চাচ্চুকে ফলো করছি। চাচ্চু মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে এই দিক ওই দিক তাকিয়ে দেখছেন।
কিছুটা হাটার পর আমাদের গ্রামের নির্জন জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। আমি জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম ঢুকব কিনা! শুনেছি এই জঙ্গলটা বেশ ভয়ানক। আমাদের গ্রামের কেউ তো ভুলেও এই জঙ্গলে পা রাখেনা। আমিও এর ধারে কাছে আসিনি কখনো।
এত কিছু ভাবলে চলবেনা, এক্ষুনি চাচ্চুর পিছু নিতে হবে। অতি সাবধানে পা ফেলে চাচ্চুর পিছু পিছু হাটছি। চাচ্চু এসে জঙ্গলের পুরোনো বাড়ীটার সামনে এসে দাড়ালেন। এমন একটা জঙ্গলের পুরোনো বাড়ী আছে আমি কখনোই শুনিনি। কিন্তু চাচ্চুর এখানে কি কাজ থাকতে পারে?
চাচ্চু তাড়াতাড়ি বাড়ীটার ভিতরে ঢুকে গেলেন। আবছা অন্ধকারে আমার চলতে কষ্ট হচ্ছে, আজ চাঁদ ভালো করে জ্যোৎস্না দিচ্ছে বলে এখনো দেখে দেখে হাটতে পারছি। শরীরটা আর সত্যিই টলছেনা। বাড়ীর দরজায় ঢুকব এমন সময় দেখি একটা বিশালকৃতির সাপ ফণা তুলে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আল্লাহর নাম জপ করছি মনে মনে। সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এসে আমার শরীর পেচিয়ে আমার পেট পেচিয়ে ধরে রাখল।
আমি বুঝতে পারছিনা আসলে কি হচ্ছে! চোখ বুঝে আল্লাহর নাম নিচ্ছি। একটু পরে সাপট আমাকে ছেড়ে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।
শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে।
আর দেরী না করে বাড়ীর ভিতরে ঢুকলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল উপরের একটা ঘর থেকে সামান্য আলোর ছটা আসছে, চাচ্চু নিশ্চয়ই ওখানেই আছে। উপরে উঠতে গিয়ে ছোচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও বাচলাম। আমার কেমন গা ছমছম করছে।
একটা বাসি পচা গন্ধ নাকে আসছে, তাতে আমার বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাড়াতাড়ি ওড়না টা নাকে দিয়ে সেই ঘরের সামনে এসে দাড়ালাম। দেয়ালে দেখলাম ছায়াটা ভাসছে, নিশ্চয়ই এইদিকেই আসছে। মোটা থামের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম দেরী না করে। ছায়াটা ঢুকার সাথে সাথে ঘর থেকে কথা আর হাসির আওয়াজ আসতে লাগল।

আমি আবারো উকি মেরে দেখলাম, যা দেখলাম তা দেখে আমার পুরো শরীর উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে এল। চেয়ারে দুজন লোককে বেধে রাখা হয়েছে আধমরা করে। মুখটা নিচে ঝুলে আছে তাই বুঝতে পারছিনা ওরা কে! তার উপর কালো কাপড় দিয়ে মুখ বাধা। চাচ্চু গিয়ে ওদের কাপড় টা টেনে নিল। একি এ তো আমার বাবা আর মেহরাব।
ছুটে যেতে যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজেকে আটকালাম। এটা উপযুক্ত সময় নয়। কালো ছায়াবেশী কালো চাদরে ঢাকা মানুষটা তার চাদর খুলে ফেলল। মুখটা এখনো দেখতে পাচ্ছিনা। এখন নিশ্চিত হচ্ছি এসব জঘন্য কাজে চাচ্চুর সহযোগী কেউ ছিল। চাচ্চুর ঘরের কোণ থেকে পানির বালতি টা এনে বাবার গায়ে ঢেলে দিলেন। বাবা চমকে মুখ তুলে তাকালেন। চাচ্চু হেসে হেসে বলল,
— কিরে ভাই, তর কষ্ট হচ্ছে? আহারে শুধু তোর নয়, চেয়ে দেখ তোর জামাইটার ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোদের কে আর বাচিয়ে রাখা যাচ্ছেনা, তোরা তো নাছোড়বান্দা, কিছুতেই আমার কথা মানবিনা। এখন উপরেই যেতে হবে তোদের।
ওই ছায়াবেশী মেহরাবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর আঙ্গুলে জোরে কামড় দেয়। মেহরাব চিৎকার করে উঠে মূহুর্তে। ওর চিৎকার শুনে আমার বুকটা ধড়ফড় করছে। ছায়াবেশী এইবার এইদিকে ফিরে চাচ্চুকে কিছু একটা ইশারা দিতে লাগল। চাচ্চু মশালে আগুন জ্বালিয়ে বাবা আর মেহরাবের সামনে ধরল। তখনি ছায়াবেশীর চেহারা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল।
নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি, এ আমি কাকে দেখলাম?
.
(চলবে)

জ্বীনবর_২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

পর্বঃ১৮

এ তো মেহরাবের প্রেমিকা উম্মে। ওর মত ভালো মেয়ে কিনা চাচ্চুর সাথে মিলে মেহরাবের ক্ষতি করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন করছে ও? ও তো আমার জন্য মেহরাবকে ছেড়ে দিয়েছিল, এখন কি সেই প্রতিশোধ নিতে এসেছে। উম্মে মুখ থেকে কালো ধোয়াজাতীয় কিছু একটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে লাগল। ধোয়াটা আমাকে ঘিরে ধরতেই মাথা ঘুরিয়ে উঠল হঠাৎ। পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে নিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা আর, নিজেকে সামলাতে গিয়ে রুমের দরজা নাড়িয়ে দিলাম। শব্দ শুনে উম্মে আগুনরাঙ্গা চোখে পিছনে তাকাল। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল দরজার দিকে, আমি তখনো দরজার পিছনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। এইবার নিশ্চিত ধরা পড়ে যাব, য়খন নিজেকে, বাবাকে কিংবা মেহরাবকেও উদ্ধার করতে পারবনা। আল্লাহ তুমি রহম করো। এমন সময় মোটা দড়িজাতীয় কিছু একটা আমাকে পেচিয়ে ধরে একটানে জঙ্গলের বাহিরে নিয়ে চলে এল।
বাহিরে এসে দেখি সেই বিশালকৃতির সাপ তার লেজ দিয়ে পেচিয়ে শূন্যে তুলে রেখেছে আমাকে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, এই সাপটা কি আমাকে খেয়ে নিবে নাকি ছোবল মারবে? সাপটা আমাকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে দিল। অতঃপর এক মানুষের রুপ নিয়ে দেখা দিল। যদিও মুখসহ সারাশরীর কালো চাদরে মুড়ে রেখেছে। তবুও বুঝতে পারলাম এটা একটা মেয়ে। কিন্তু সাপ কি করে মেয়ে হল? মেয়েটা আমাকে বলল,
— ভাবছো তো আমি কে?
— হ্যাঁ, আপনি কে? আমাকে এভাবে কেন টেনে আনলেন!
— ভয় পেয়োনা মুশায়রা। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, একজন জ্বীন আমি। আমি চাইনি তোমার শত্রুরা তোমার আর তোমার সন্তানকে মেরে ফেলুক। আর একটু হলে তুমি ধরা পড়ে যাচ্ছিলে তাই আমি সাপের রুপ নিয়ে তোমাকে টেনে নিয়ে আসলাম।
— অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আমার নিজের জীবনের চেয়ে আমার বাবা আর স্বামীকে উদ্ধার করাটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
— তোমার কি মনে হয় তুমি ওদের সাথে পারতে? ওরা যদি তোমার সন্তানকে মেরে ফেলত! তুমি ভুলে যেও না, তোমার গর্ভে যে আছে সে কোনো সাধারণ মানুষ্য সন্তান নয়, সে জ্বীন বংশ উদ্ভুত। সে ই হবে জ্বীন জগতের পরবর্তী সরদার। ভীষণ শক্তিশালী হবে সে, সে ই রক্ষা করবে তার জ্বীনজগত কে। রক্ষা করবে জ্বীনি তলোয়ারকে।
আমি তার কথা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার গর্ভে যে আছে, তা পুরো জ্বীনজাতির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমার উপর গুরুদায়িত্ব পড়েছে তাকে খেয়াল রাখার। মেয়েটি কাছে এগিয়ে এসে আমার পেটের উপর হাত রেখে বলল,
— তাকে রক্ষা করা আর দেখে রাখার দায়িত্ব এখন তোমার। সবসময় সাবধানে পা ফেলবে, তোমার শত্রুরা তোমাকে ছেড়ে দিবেনা। যেকোনো সময় তোমার উপর আক্রমণ করতে পারে। আমি তোমাকে নিরাপদে জঙ্গলটা পার করে দিলাম, তুমি এক্ষুনি বাড়ী ফিরে যাও। আল্লাহ হাফেজ।
বলেই মেয়েটি উধাও হয়ে গেল, বুঝলাম না কে এই শুভাকাঙ্ক্ষী। আল্লাহর নাম নিয়ে বাড়ীতে ফিরে শুয়ে পড়লাম। সময় যত যাচ্ছে আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। কি ভাবে আমি ওদের কাছ থেকে আমার আপনজন দেরকে রক্ষা করব।
একটু পরে বুঝতে পারলাম চাচ্চু ফিরেছে, ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে।
আমার শরীরটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আর বাচবই না। কিন্তু আমার যে এখনো বড় দায়িত্ব গুলো বাকি আছে। সেগুলো শেষ না করে গেলে আমি মরেও শান্তি পাবনা।
চাচ্চু সারাদিনে আমার সাথে তেমন কথা বলেনি। তবে আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছিল আমার দিকে, মনে হচ্ছিল সেই চোখজোড়া থেকে রাগ ঠিকরে পড়ছে। বাড়ীর উঠোনে বসে বসে ভাবছিলাম কি করা যায়!
নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রণ করছি, আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সেই বাড়ীতে ছুটে যাই আর ওদেরকে মুক্ত করে আনি। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো কিছুরই ফল ভাল হয়নি। খুব ভেবেচিন্তে করতে হবে, চাচ্চু অনেক বেশী চালাক। তিনি যদি কিছু টের পেয়ে যায় তবে এক্ষুনি আমাকে শেষ করে দিবে।
কতটা চালাক হলে তার খেলায় একটা জ্বীনকে সামিল করতে পারে! তিনি কি টের পেয়েছিল একসময় তার পথের কাটা হবে একটা জ্বীন মানে আমার মেহরাব। এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ক্লিয়ার না। কাল রাতে মেয়েটাকেও এসব জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

এমনসময় দেখি হোসাইন পাগলা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ও তো সেইদিন দীঘির পাড়ে আমাকে কিছু বলেছিল, পরবর্তী তে তার কথা গুলো সত্যতা আমি পেয়েছিলাম। এ সংকট মূহুর্তে সে কি আবারো আমাকে কিছু ইঙ্গিত করতে চায়। তাড়াতাড়ি গিয়ে গেইট খুলে বের হলাম। পাগলাটা আমাকে একটা তাবিজ হাত ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা শুধু একটা কাজেই ব্যবহার করতে পারবি। তোর কাছে যেটা বেশী দরকারি মনে হবে, সেটায় ব্যবহার করবি।
আমি তাবিজটা হাতে নিলাম। সে ড্যাবড্যাব করে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সে আসছে, খেয়াল রাখিস। বলে নাচতে নাচতে চলে গেল নিজের পথে। আমি তাবিজটা গলায় বেধে নিলাম।
নিজের রুমে পা রাখতে একটা বড় শক খেলাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার। চাচ্চু আমার ঘরে ঢুকেছে, অন্যদিকে তাকিয়ে কিছু একটা করছে। আমি ধীরপায়ে ঢুকে বললাম, চাচ্চু তুমি এখানে?
চাচ্চু আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তার হাতে বাবার সেই ডায়েরীটা। চমকে উঠলাম, চাচ্চু সব বুঝে গেছে। আমি যে তার সত্যি বুঝে গেছি সেটা চাচ্চু ধরে ফেলেছে। সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তোমার হাতে ওটা কি চাচ্চু?
— তোর ঘরে এটা ছিল আর তুই জানিসনা এটা কি?
ভয়ে ঢক গিলে বললাম, আমি তো বাবার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছিলাম। এনে রেখেছিলাম বাবার শেষ স্মৃতি হিসাবে। পড়ে দেখব বলে আর মনে ছিলনা।
চাচ্চু এটা নিয়ে বলল, এটা আমার কাছে থাক। এখন এসব না পড়াই ভাল, বাচ্চার খেয়াল রাখ বরং।
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম, চাচ্চু তাহলে কিচ্ছু বুঝেনি। চাচ্চু ডায়েরীটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খাটের উপর এসে বসতেই পোড়া পোড়া গন্ধ পেলাম। চাচ্চুর ঘরে উকি দিয়ে দেখি চাচ্চু ডায়েরীটা জ্বালিয়ে ফেলেছেন। এভাবে কি নিজের পাপ ঢাকতে পারবে চাচ্চু? আল্লাহ তোমার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ঠিকিই বরাদ্দ করে রেখেছেন। তোমার পাপ তোমাকে কখনোই মুক্তি দিবেনা।

সন্ধ্যায় রান্নাঘরে চাচীমার সাথে টুকটাক কাজ করছিলাম। চাচীমা সবি জানে সেটা আমি বুঝি। কিন্তু চাচ্চুর ভয়ে কিছু করতে পারলনা, চাচীমার উপর আমার কোনো ঘৃণা কাজ করছেনা। চাচীমার মত মানুষ কখনোই চাচ্চুর এসব কাজ সমর্থন করবেনা সেটা আমি জানি, নিজের স্বামীকে ভয় পেয়ে চুপ করে আছে। কাজ করতে করতে চাচীমা হাতের কব্জিতে বড় একটা গর্ত দেখলাম। মনে হল কেউ সেখান থেকে কেটে মাংস উঠিয়ে নিয়েছে। কেপে উঠলাম দেখে, এতদিন চাচীমা আচলের তলায় এটা লুকিয়ে রেখেছে।
আমি চাচীমার হাত টা ধরে বললাম, তোমার এটা কি করে হল?
— ও কিছুনা, সামান্য চোট লেগেছিল।
— চোট এমনই লাগল যে এক টুকরো মাংস ই উঠে গেল।
চাচীমা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাদতে লাগলেন।
— চাচীমা আমি সব জেনে গেছি। চাচীমা আমার মুখ চেপে ধরে বলল,
— চুপ, এসব একদম বলবিনা। তোর চাচচু জানলে তোকে বাচতে দিবেনা কোনোমতেই। মুশু আমি তোর মা হিসেবে চাই তুই আর তোর বাচ্চা জীবিত থাক। হাত জোড় করে বলছি এসব কথা বলিসনা।
অই শয়তানটা আমার চোখের সামনে একে একে সবাইকে মেরে ফেলেছে। আমি বাধা দিয়ে গিয়েছি বলে আমার এই অবস্থা করেছে। আমি চাইনা তোর কোনো ক্ষতি করুক ওই পাষন্ডটা। আমি চাচীমাকে জড়িয়ে ধরলাম। এমনসময় চাচ্চু রান্নাঘরে ঢুকে চাচীমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে টেনেহেচড়ে নিয়ে যেতে চাইল। চাচীমা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
–ওকে ছেড়ে দিন আপনি। এমন কাজ করবেন না, আল্লাহ নারাজ হবে। ও যে একটা নিষ্পাপ শিশু ধারণ করে আছে।
— ওই তুই চুপ, তুই ই আমার আসল শত্রু। ওকে বাচাতে এসেছিস, দেখ তোকে কে বাচায়।
আমাকে সরিয়ে চাচ্চু চাচীমার মুঠি ধরে ফেলে। টেনে টেনে চুলার কাছে এনে, আগুন বাড়িয়ে দিয়ে, চুলায় চাচিমার মাথা ঢুকিয়ে দেয়। দাউদাউ আগুনে পুড়িয়ে যাচ্ছে চাচীমার মাথা।কি নৃশংসতা! চাচীমার আর্তনাদ আমাকে স্পর্শ করে গেল। সহ্য করতে পারছিলামনা আর! অবশ হয়ে এলো সব……

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here