জ্বীনবর_৪,পর্বঃ২২,২৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সাদা গাউন পরে তৈরী হয়ে নিলাম। ২-১ জন জ্বীনি মহিলা পাঠানো হয়েছে এসবের তদারকি করার জন্য। এরা আমাকে নজরে নজরে রাখছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারবি ডলের মত দেখাচ্ছে আমাকে।
তাসবীনের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। কান্না আটকে আছি, কিন্তু চোখের পানি তো বাধা মানেনা। দু-এক ফোটা অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে। চোখ মুছে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১২টা বাজার আর ২৫মিনিট বাকি। শয়তানী মহিলা এসে আমাকে সাথে করে সেই গুপ্তঘরে নিয়ে গেলেন।
আঙ্গুলের কর ধরে সময় গুনছি। যেভাবে হোক এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। নিয়ে সারবানের পাশে বসানো হল আমাকে। শুরু হল সেই একি আওয়াজ, ঘরভর্তি ধোয়া। এমন একটা ভাব করলাম আমার এসবে অস্বস্তি হচ্ছে।
সারবান বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। ফিসফিস করে বলল, কি হয়েছে তোমার?
— আমার খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে বমি আসবে।
— সহ্য করে বসো কিছুক্ষণ। একটু পরে চার্চ এসে আমাদের বিয়ে পড়াবেন।
— বসে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বলে বমি করার ভান করলাম।
শয়তানী চোখ পাকিয়ে বলল, এটা পবিত্র জায়গা। শয়তানের আরাধনার জায়গা। এটাকে নোংরা করোনা।
সারবান তুই ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে যা। ফ্রেশ করিয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে চার্চ চলে আসবেন। সারবান মাথা নেড়ে আমাকে উঠে চলে এল। আমি টলমল পায়ে হাটতে হাটতে হোচট খেয়ে বুঝাচ্ছি আমার শরীর অনেক খারাপ।ও আমাকে নিয়ে রুমে ঢুকল। আমি ওয়াশরুমে ঢুকার সাথে সাথে ও আসতে চাইল। আমি বললাম,
— একটু ওয়েট করুন। আমি ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি।
— দেরী করোনা।
দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে একটা গোলাকার চক্রে সাদাফের প্রতিবম্ব ভেসে উঠল। দেখে একটু স্বস্তি পেলাম।
— এসেছো তুমি??
— হ্যা। এখন আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনো। যা করার তাড়াতাড়ি ই করতে হবে। জ্বীনরাজ্যের দরজা একমিনিটের জন্যই খোলা হবে। এ সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারলে আর জ্বীনরাজ্যে ঢোকা সম্ভব না।
তুমি আয়না জগতে চলে আসার পর অনেকরকম পরীক্ষার মুখোমুখি হবে, সেগুলো যদি বুদ্ধি দিয়ে সঠিকভাবে অতিক্রম করতে পারো তবেই তুমি জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বারের কাছে পৌছাতে পারবে।
সময় নষ্ট করবেনা কোনোভাবেই। আমি তোমাকে সঠিক জায়গায় খুজে নিব। এখন তাড়াতাড়ি আয়নায় আমার হাতের উপর হাত রাখো। বিসমিল্লাহ বলে চোখ বন্ধ করো।
বাহিরে থেকে সারবানের গলা শুনতে পেলাম।
— ত্বোহা তোমার হয়েছে?
চার্চ চলে এসেছেন। তাড়াতাড়ি বের হও নাহলে আমি দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকব।
আমি পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে বললাম, আসছি একটু অপেক্ষা করুন। সাদাফ হাতটা বাড়িয়ে দিল আমি কিছু না ভেবেই তা ধরার চেষ্টা করলাম। শরীরটা প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে উঠল।
একটু পর নিজেকে অন্য এক জগতে আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে নীল রঙ্গের ছোয়া, সরু টানেল, আবছা আবছা আলো, দেয়ালে দেয়ালে টুকরো টুকরো আয়না লাগানো।
আমি কি এই সরু টানেল ধরে হাটতে থাকব??
সাদাফ তো বিস্তারিত কিছুই বললনা। ও কোথায়!
নিরুপায় হয়ে টানেলের পথ ধরে সোজা হাটতে লাগলাম। পথে একটা মোটামুটি বড় গভীর গর্ত পড়ল। সেটা টপকে কিছুতেই ও পাড়ে যাওয়া যাবেনা। গর্তে যদি পা রাখি তাহলে নিশ্চিত গভীরে তলিয়ে যাব। লাফ দিয়েও এতবড় গর্ত পার হওয়া যাবেনা।
তাহলে কি করব এখন? এদিকে একমূহুর্ত সময় ও নষ্ট করা যাবেনা। তাহলে পৌছাতে দেরী হয়ে যাবে। গর্তে নামা ছাড়া কোনো উপায় দেখছিনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটুকরো ছোট্ট মাটির শক্ত টুকরো নিলাম। এটা ছুড়ে গর্তের গভীরতা নির্ণয় করা যাবে। ছুড়ার সাথে সাথে এটি অতলে তলিয়ে গেল। বেশ গভীর গর্ত বুঝতে বাকি রইলনা। এখন কি করে আমি গর্তটা পার হব! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
আল্লাহর নাম নিয়ে আরেকটি মাটির টুকরো ছুড়লাম এই ভেবে গর্তের ভিতরে নেমে আবার উঠা যাবে কিনা! কিন্তু অবাক ব্যাপার টুকরোটা গর্তের মুখে পড়ে রইল।
অবাকতার ঘোর কাটিয়ে তাড়াতাড়ি গর্তের মুখে পা রাখলাম। মনে হচ্ছে আমি বিছিয়ে রাখা কোনো স্বচ্ছ টাইলসের উপর হাটছি। দেখে বুঝার উপায় নেই এখানে সত্যি কোনো স্বচ্ছ কিছু বিছানো আছে।
নিরাপদে গর্তটা পেরিয়ে হাটতে লাগলাম। মস্তিষ্কে এখনো বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে। হাটতে হাটতে টানেলের শেষ সীমানায় এসে পড়লাম।
জানিনা আর কতটা যেতে হবে। আমার হাতেও আর কত সময় আছে সেটাও পরিষ্কার না। টানেল থেকে বের হতেই অনেক বড় মাঠে চলে এলাম। চারিদিকে ফলের গাছ আর মাঠ ভর্তি কাচের টুকরো পড়ে আছে। শেষ মাথায় ঝরণা হতে সৃষ্ট বিরাট জলাশয়।
ঝুলন্ত পাকা পাকা আঙ্গুর আর আতাফল দেখে খেতে ইচ্ছে হল, স্বচ্ছ পানি দেখে পিপাসায় কাতর হয়ে গেলাম। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলাম। কে জানে কোথায় বিপদ ওত পেতে আছে। কিন্তু এই কাচের টুকরা গুলো পার হব কি করে? পা দিলেই তো পায়ে ঢুকে যাবে। এখানেও বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা করতে হবে।
কিন্তু কি করা যায়? আশেপাশে তো এমন কিছু দেখছিনা যেটার সাহায্যে নির্বিঘ্নে পার হওয়া যাবে।
শেষমেষ ভাবলাম গাছের ফল দিয়ে কিছু হয় কিনা দেখি? মস্তিষ্ক কেন জানি বার বার বলছে এইগুলোর দ্বারা কিছু একটা হতে পারে। ভয়ে ভয়ে দু-একটা ফল ছিড়লাম। ছুড়ে দিয়ে সবগুলো দুটুকরো করলাম। এত শক্ত ছিল যে হাত দিয়ে ভাগ করতে পারছিলামনা। ভয়ে তো মুখেই নিলামনা।
ফলগুলোতে অদ্ভুত গন্ধ ছিল।
তারপর টুকরোগুলো কাচভর্তি মাটির উপর রাখলাম। প্রচন্ড শব্দে কাচগুলো ফেটে গলে গেল। দেখে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। ফলগুলো যদি আমি খেতাম না জানি কি অঘটন ঘটে যেত।
গলে যাওয়া কাচগুলো গলে সুন্দর প্রলেপ হয়ে গেছে মাটির উপর। আরো কিছু ফল টুকরো করে নিয়ে নিলাম। আস্তে আস্তে ওইগুলো ব্যবহার করে ধাপে ধাপে জলাশয়ের নিকট পৌছে গেলাম।
দূর থেকে এতক্ষণ খেয়াল করিনি পানিতে বিশাল বিশাল ভয়ংকর কাটাদাত ওয়ালা মাছ ঘুরাঘুরি করছে। আমার কাছে এগুলো সাধারণ মাছ মনে হলনা। হতে পারে এইগুলো পাহারাদার জ্বীন, যারা এমন ভয়ংকর ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।
যাতে কোনো আগন্তুক জলাশয় পার হয়ে জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বারে না যেতে পারে।
এত কঠিন নিরাপত্তা দিয়ে জ্বীনরাজ্যে ঘেরা তাও কি করে সারবানদের মত শয়তান রাজ্য দখলের চিন্তা করতে পারে।
এদেরকেই তো এই জলাশয়ে নামিয়ে দেওয়া উচিত।
কামড় খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে ক্ষমতার লোভ মন থেকে দূর করত।
সারবান চুপচাপ বসে রইল। মহিলাটা ওর সামনে কয়েকবার পায়চারী করল, চোখ-মুখ দিয়ে তার যেন আগুনের ফুলকা ছুটছে। কপালে রীতিমত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চিন্তায় মুখ শুকিয়ে আছে। পায়চারি থামিয়ে শুণ্যে পা ছড়িয়ে বসে বলল, আমার ছেলে হয়ে তুই কি করে এত বোকামী করিস?
তুই জানিস মেয়েটার উপর আমাদের এতদিনের সাধনার ফল নির্ভর করছে। ওর গর্ভস্থ সন্তান আমাদের পুরো পৃথিবী পরিচালনার অস্ত্র হবে।
সব নষ্ট হয়ে গেল। ওকে ছাড়া কোনোকিছুই সম্ভব না।
— মা তুমি চিন্তা করোনা। ও যেখানে থাকুক আমি ঠিক ওকে খুজে বের করে আনব।
— ততদিনে যদি ও কুমারী না থাকে?
সবকিছু ভেস্তে যাবে। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে, শয়তান ওই মেয়েকেই এ বর দিয়েছে। ও ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে দ্বারা কিছু হবেনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে খুজে বের করার চেষ্টা কর।
যদি না পারিস তবে আমি সব ছারখার করে দিতে দুইবার ভাববনা।
— মা তুমি শান্ত হও। আমাকে ভাবতে দাও ও কোথায় যেতে পারে? আর কেন ই বা যেতে পারে! তাসবীন তো বেচে নেই, ওর তাসবীনের আশায় তো কোথাও পালাতে পারেনা।
— শোন, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।
ভুলে যাসনা, তাসবীন একজন শক্তিশালী আর জ্বীনবংশের ক্ষমতাধর জ্বীন। আর এসব জ্বীন এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। এরা কি করতে পারে, কি হতে পারে তা আমাদের মত ক্বারিন জ্বীনদের চিন্তার বাহিরে।
কোনোকিছুকেই তুচ্ছ করে নেওয়ার সুযোগ নেই।
— তাহলে তুমি বলছো তাসবীন ফিরে আসতে পারে?
— সেটার কোনো সম্ভাবনা দেখছিনা। আমি শুধু ভাবছি ত্বোহা কি করতে চায়? এভাবে উধাও হওয়ার কারণ কি! কে তাকে এসবে সাহায্য করছে?
— সাদাফ-মাইশা করতে পারে। সেদিন ও ওরা ত্বোহাকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে।
— সব যখন বুঝে গেছিস তো বসে আছিস কেন?
তাড়াতাড়ি জ্বীনরাজ্যে রওনা দে, আর ঐ মেয়েকে টেনে হিচড়ে এখানে নিয়ে আয়। ওকে আমি জীবিত আর কুমারী অবস্থায় ই চাই।
— ঠিক আছে মা৷ চিন্তা করোনাম
আমি ওকে তোমার সামনে ঠিক হাজির করব।
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৪
পর্বঃ২৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই স্বচ্ছ জলাশয় কি করে পার হব? সাতরে পার হওয়া অসম্ভব। মাছগুলো খুব হিংস্র, নামলেই ছিড়ে খেয়ে নিবে।
তবে কি আমি পারবনা পার হতে? আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও। কয়েকবার আয়াতুল কুরসী পড়ে পানিতে নেমে গেলাম। যা হবার হোক, সাতরেই পার হব। সাতার কাটতে শুরু করলাম। মাছগুলো কাছে এসে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করল, কিন্তু কিসের সংস্পর্শে দূরে ছিটকে পড়ল। এদিকে আমি সাতার কাটতে পারছিনা, পায়ে গাউন জড়িয়ে সাতার কাটতে অসুবিধা হচ্ছে। কয়েকদফা ডুবে ডুবে পানি খেয়ে ফেললাম। এভাবে তীরে পৌছানো সম্ভব না কোনো ভাবেই। সাতার কেটে আরেকটু এগোতেই দেখি একটা ভেলা ভাসছে মাঝখানে। কোনোরকম সাতার কেটে ভেলায় উঠে পড়লাম। উঠে অনেকক্ষণ হাফাতে লাগলাম। এটা পানির টানে ভেসে ভেসে তীরে চলে এল। নেমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
এত সহজে লক্ষ্যে পৌছাতে পারব কল্পনা করিনি। যা হোক, সময় খুব কম হাতে। এপারটা জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা। আল্লাহর নাম নিয়ে সরু পথ ধরে হাটতে লাগলাম। দুপাশের ঘন ঝোপের ভেতর থেকে বিভিন্ন ভয়ংকর আর্তনাদ ভেসে আসছে। থমকে দাড়াচ্ছি বার বার, বুকের ভেতরটা ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে। পিছন থেকে কেউ অনেকবার আমার নাম ধরে ডাকছে। মনে হল দাদীমার গলা। ভাবলাম একবার পিছন ফিরে দেখব কিন্তু মস্তিষ্ক বাধা দিচ্ছে। এটা কোনো ফাদ, পিছনে তাকালেই কোনো বিপদ হবে। পিছন তাকানোর সিদ্ধান্ত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হাটতে লাগলাম। এইবার টের পাচ্ছি কেউ আমার পিছু পিছু আসছে।
এইবার হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পথটা বাক নিল, সেই বাকেই কিছুটা হেটে দেখি বিশাল আকৃতির দরজা। উপরে আরবীতে লেখা, জ্বীনি। তার নিচে ছোট্ট করে লিখাঃ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আগুন হতে জ্বীনদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের ক্ষমতা দিয়েছেন অদৃশ্য হওয়ার।
এটাই তাহলে জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার। দরজাটা কি এখনো খোলেনি নাকি খুলে এতক্ষণে বন্ধ করে ফেলেছে! পিছনে হিসহিস শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম। বিশাল ভয়ংকর সাপ আমার দিকে তেড়ে আসছে। হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে, সে আমাকে গিলে খেতে চায়। আল্লাহ এখন কি হবে? দরজাটা এখনো খুলছেনা কেন?
ভাবতে ভাবতেই প্রচন্ড শব্দে দরজাটা খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভিতর থেকে আলোর ঝলকানি বের হয়ে আসছে। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছেনা। এদিকে সাপটাও আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিসমিল্লাহ বলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সাপটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু দরজার কাছে এসে আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারছেনা। হিসহিস শব্দে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করছে। দরজাটা আবারো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।
এবার এদিক সেদিক তাকিয়ে জ্বীনরাজ্যটা দেখতে লাগলাম। অনেকটা মানুষের পৃথিবীর মতই। এদিক সেদিক লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চারিদিকে ফুল-ফলের গাছ, হালকা বাতাস কিছুটা দূরে দূরে ছোট ছোট ছাউনিওয়ালা ঘর-বাড়ি, প্রশস্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে আরবী সাইন।
আরেকটু এগোবো এমনসময় কে জানি আমার হাত টেনে গাছের আড়ালে নিয়ে এল। আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম,
— কে? কে?
সাদাফ দৃশ্যমান হয়ে বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলে?
— অকারণে হাটছি। তোমাকে যদি খুজে পাই এই আশায়।
— আরেকটু হলে বিপদে পড়তে। তোমার কাপড়-চোপড়, সাজগোজ দেখে ওরা বুঝে যেত তুমি এই জ্বীনরাজ্যের কেউ নও। সাথে সাথে তোমাকে হত্যা করত।
— তুমি তো বিস্তারিত কিছুই জানাওনি, তাই ভুলবশত করে ফেলছিলাম।
— আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। তুমি নিরাপদে সব ধাপ পেরিয়ে এখানে আসতে পেরেছো। আমি তো দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
— এমন সব ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল যে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
— এসব হচ্ছে বুদ্ধির খেলা। যে বুঝেশুনে পা ফেলবে কেবল সে ই নির্বিঘ্নে পৌছাতে পারবে। যাই হোক, এখন তোমাকে কৌশলে আমার ছাউনিতে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ওখান থেকে জ্বীনহুজুরের কাছে যাব। এখন চোখ বুজে আমার হাত স্পর্শ করো। তোমাকে এখানে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, অদৃশ্য হয়েই যেতে হবে।
আমি চুপচাপ সাদাফের কথামত কাজ করলাম। চোখ খুলে দেখি একটি বিস্তীর্ণ সুন্দর বাড়ীর ভিতর আমি অবস্থান করছি। মাইশা আমাকে দেখে এসে জড়িয়ে ধরল,
— কেমন আছো বুবু?
— আলহামদুলিল্লাহ ভাল। তোমরা কেমন আছো?
কুশল বিনিময় করতেই চোখ পড়ল এক বৃদ্ধ দম্পতির উপর। উনারা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি সালাম দিলাম, উনারা উত্তর নিতেই মাইশা বলল,
— আম্মি, আব্বু এই ই ত্বোহা বুবু। যার কথা তোমাদের বলেছিলাম। ত্বোহা বুবু এরা আমার আম্মি-আব্বু।
এদেরকে বন্ধি করেই শয়তান গুলো আমাকে কাজে লাগিয়েছে। উনারা বললেন,
— বড্ড আশা নিয়ে এই ঝুকিটা নিয়েছো। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমার খায়েশ পূরণ করেন। মাইশা মা, তুই ওকে ঘরে নিয়ে যা কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে দে আর বিশ্রাম এর ব্যবস্থা করে দে।
— জ্বী আম্মি। সাদাফ তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?
— আমি জ্বীনহুজুরকে জানিয়ে আসি ত্বোহা এখানে এসেছে। তুমি ওর জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দাও। এভাবে ও জ্বীনরাজ্যে চলাফেরা করতে পারবেনা।
আমি মাইশার পিছু পিছু অন্য ঘরে গেলাম। ভেজা জামা ছেড়ে ঢিলেঢালা লম্বা গাউন পরে নিলাম, আর মাথায় হিজাব জড়িয়ে নিলাম। কিছু খেয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য একটু শুয়ে পড়লাম। মনটা কেমন জানি ভার হয়ে আছে। আমি কেন এসব করছি তার সঠিক জানিনা? এসব করে কি আমার তাসবীন ফিরে আসবে?
সাদাফ খোলসা করে আমাকে কিছু বলছেনা। সত্যি আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে করতে। জানিনা জ্বীনহুজুর আমাকে কি বলবেন? আদৌ তাতে আমার মন শান্ত হবে কিনা! ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো বুজে এল।
মাইশার ডাকে উঠে পড়লাম। জ্বীনহুজুর নাকি আমাকে তলব করেছেন। চোখে-মুখে পানির ছিটে দিয়ে মাইশা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম।
সাদাফ নাকি জ্বীনহুজুরের কাছেই আছে। কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে, উনি আমাকে দেখে কি বলবেন না বলবেন এই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। কিছুটা হেটে একটা বড় আস্তানার সামনে এসে দাড়ালাম। মাইশা আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকে গেল।
আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তানার আশপাশটা নির্জন, জনলোকের চিহ্ন নেই। খানিকবাদে মাইশা বের হয়ে এসে বলল,
— ত্বোহা বুবু চল, জ্বীনদাদু তোমাকে ডাকছে।
অস্বস্তি নিয়ে মাইশাকে অনুসরণ করে আস্তানায় ঢুকলাম। ভিতরে গিয়ে দেখি নূরানী চেহারার এক বৃদ্ধ মনোযোগ দিয়ে কুরআন পড়ছেন। তার শরীর থেকে যেন নূর ঠিকরে পড়ছে। একবার চারিপাশটা দেখে নিলাম। সাদামাটা ঘর, নিচে খেজুর পাতার পাটি বিছানো, এক কোণায় মশকভর্তি পানি-গ্লাস, একটা বড় অংশ জুড়ে ভীষণ সুন্দর বড় একখানা আয়না।
সাদাফ বৃদ্ধের পাশে বসে তসবীহ আওড়াচ্ছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বৃদ্ধ মুখ তুলে আমাকে একনজর দেখে নিলেন। কুরআন পড়া বন্ধ করে চুমু খেয়ে সাদাফের হাতে দিয়ে আমাকে সালাম দিলেন।
আমি লজ্জা পেয়ে সালামের উত্তর দিলাম। ইশারায় কাছে এসে বসতে বললেন। চুপচাপ এসে বসলাম। জিজ্ঞেস করল,
— তুমিই ত্বোহা? তাসবীনের মহব্বত!
আমি মাথা নাড়লাম। উনি গম্ভীর হয়ে বললেন,
— তাসবীনের খুনীও বটে!
আমি চমকে মুখ তুলে চাইলাম। কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে। উনি আমার অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
— তোমাকে আমি একটা কারণেই এখানে নিয়ে এসেছি। আমি চাইলে তোমার সাথে আয়নায় ই কথা বলতে পারতাম, কিন্তু সেটা কারো জন্যই নিরাপদ ছিলনা।
তাই এত কাঠখড় পুড়িয়ে তোমাকে এখানে আনা।
— কি কারণ?
— তোমার নিশ্চয়ই জানতে বাকি নেই শয়তানীগুলোর কোনো কোনো চালে তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছো।
— জ্বী, জানতে পেরেছি।
তারা প্ল্যান করছে আমার আর সারবানের বিয়ে দিতে। আর আমাদের সন্তানকে অস্ত্র বানিয়ে পুরো দুনিয়ায় রাজত্ব করা।
— এখন ওদের শেষ করতে তোমাকে প্রয়োজন।
আমরা চাই তাসবীনের সাথে যা হয়েছে তা আর কারো সাথে পুনরায় না হয়। এইজন্য তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
— আমি এই ব্যাপারে যে কোনো সাহায্য করতে প্রস্তুত।
— মাশা আল্লাহ। খুব ভালো।
কিন্তু এই কাজ তুমি একা করতে পারবেনা। এর জন্য তোমার একজন উপযুক্ত সঙ্গী প্রয়োজন।
— কে হবে এই কাজে আমার সহায়ক?
— আছে। সে একজন জ্বীন, আমার হেফাজতে থেকে সকল কৌশল রপ্ত করেছে। আশা করছি সে তোমাকে পূর্ণ সহযোগীতা করবে।
আরাফ, আরাফ। এদিকে আয় তো।
কয়েকবার ডাকতেই অন্য ঘর থেকে কেউ একজন এই ঘরে প্রবেশ করল। আমাকে জ্বীনহুজুর বললেন,
— এই হচ্ছে আমার নাতী আরাফ।
সে ই তোমাকে পূর্ণ সহযোগীতা করবে।
আমি ছেলেটির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি! তাসবীন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে।
অস্ফুটস্বরে বলে ফেললাম, তাসবীন।
মাইশা আমাকে বলল, উনি তাসবীন নন, উনি আরাফ।
— চোখের সামনে তাসবীনকে দেখে তুমি বলছো উনি তাসবীন নন। আমি কি তাসবীনকে চিনিনা!!
— দেখতে একই হলে কি মানুষ একই হয়।
উনি তাসবীনের মত দেখতে তবে তাসবীন নন।
আমি হতাশ হয়ে একপলকে তাকিয়ে রইলাম। হুবহু তাসবীনের মত দেখতে ছেলেটি। তাসবীন ভেবে যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলাম নিমিষে ততটাই চেহারা মলিন হয়ে গেল। উনি আমাকে সালাম দিলেন।
আমি সালামের উত্তর নিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। একরাশ হতাশা কাজ করছে। আর কোনো কথা ই বললামনা তার সাথে।
চুপচাপ ফিরে এলাম মাইশা আর সাদাফের সাথে। দরকার পড়লে আমাকে আবার তলব করা হবে। চোখের সামনে বার বার ছেলেটির চেহারা ভেসে উঠছে। এতটা মিল কারো থাকতে পারে! অবশ্য উনারা ভুল কিছু বললেননি, তাসবীন তো মারা ই গেছে। সে কি আর ফিরে আসতে পারে?
একই চেহারা দেখে আমি সব ভুলে তাসবীন ভেবে ভুল করেছি। চিরন্তন সত্য মেনে নিতে হবে, তাসবীন আর কখনো আমার কাছে ফিরবেনা।
এতভাবে বুঝ দেওয়ার পর ও মনকে মানাতে সক্ষম হলামনা ও অন্য কেউ। নিজের মনটাকেই শান্ত করতে পারছিনা। ছেলেটার মুখ থেকেই যদি কড়াভাবে শুনতাম তবে হয়ত মনটা কে দমাতে পারতাম।
ছেলেটির সাথে একবার হলেও এই ব্যাপারে কথা বলব। অন্তত নিজের মনটাকে তো বুঝ মানাতে পারব আমি যা ভাবছি তা ভুল।
এপাশ ওপাশ করার পর ও ঘুম এলনা। সাহস করে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। একবারো ভাবছিনা এই সময় বের হলে বিপদ হতে পারে, মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছেলেটার মুখ থেকে শুনতে চাই সে অন্যকেউ।
চুপিসারে আস্তানার সামনে এসে দাড়ালাম। মধ্যরাতে চারিদিক নিস্তব্ধ, আস্তানার দোর ও বন্ধ। একবার ভাবলাম করাঘাত করব কিন্তু জ্বীনহুজুর এতে রেগে যাবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলাম। দেখি বিপরীত দিকে থেকে ছেলেটা আসছে।
তার চালচলন-ব্যবহার সব ই তাসবীনের মত।
আমি ছুটে গিয়ে তার সামনে দাড়ালাম।
উনি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি? এত রাতে এখানে!
আমি ছলছল করা চোখে উনার হাত জড়িয়ে বললাম,
— আপনি কে?
আমার তাসবীন না!
উনি একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
— কি যা-তা বলছেন? কে তাসবীন?
আপনাকে এতবার করে বলা হল আমি আরাফ। জ্বীনহুজুরের নাতীম
তাও বার বার এক প্রশ্ন করে কেন আমাকে বিব্রত করছেন।
ভালো করে শুনুন, আমি আরাফ তাসবীন নই। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। এইবার চলে যান, এতরাতে বাহিরে থাকা আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
বলে উনি পাশ কাটিয়ে আস্তানায় ঢুকে গেলেন।
আমি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে চলে এলাম।
.
(চলবে)