জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ১০,১১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১০
আঙ্গুল রাখার সাথে সাথে কি যেন আমাকে টেনে আয়নার ভিতরের দিকে নিয়ে গেল, তখন মনে হচ্ছিল আয়নাটা এক ধরণের পাতলা পর্দা। যাই হোক, ভিতরে প্রবেশ করার সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি আমার চোখে লাগল।
তাকাতেই পারছিলামনা। একটু বাদে আস্তে আস্তে আলো ক্ষীণ হয়ে উঠল। ভালো করে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলাম, চারদিকে ছোট-বড় আয়না দেয়ালে গেথে আছে। মেঝেটা পর্যন্ত স্বচ্ছ আয়না। মনে হচ্ছে এটা কোনো আয়নাঘর। এখন আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছিনা।
মেহরাবের পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করব নাকি নিজেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব!
পরক্ষণেই ভাবলাম, না উনার নির্দেশ ছাড়া এক পা ও এগোনো ঠিক হবেনা। উনি আমাকে যেহেতু বারবার সর্তক করেছে, সেহেতু এখানে কোনো না কোনো বিপদ ঠিক-ই আছে। এমনসময় মেহরাবের ক্ষীণ কন্ঠ শুনতে পেলাম, কথাগুলো এত অস্পষ্ট ভাবে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল যে আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।
তাও মনোযোগ শোনার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট ভাবে যা শুনতে পেলাম তা হচ্ছে, খুব সাবধানে বুঝেশুনে পা ফেলবেন। এখানের শেষ সীমানায় দুটো দরজা দেখবেন, বুদ্ধি-বিবেচনা করে বেছে নিবেন সঠিক দরজাটা।
এরপর আর উনার কন্ঠস্বর শুনতে পেলামনা।
আল্লাহর নাম নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। তার আগে গায়ের ওড়না দিয়ে চোখ-মুখ ভালো করে ঢেকে নিলাম।
যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই ক্ষীণ আলো প্রখর হচ্ছে। চোখ ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা। আগে থেকে চোখ ঢেকে ভালো ই করেছি, নতুবা চোখ ঝলসে যেত। যদিও হাটতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
অনেকটা আসার পর আলোর ঝলকানি কমে এল। দেখা গেল দুটি দরজা। একটা খুব ই সুন্দর এবং পরিষ্কার , আরেকটা খুব ই জীর্ণ- জায়গায় জায়গায় দাগ এবং শ্যাওলায় ভর্তি। দুটোর উপরেই আরবিতে লেখা আছে, এখানে প্রবেশ করো। কনফিউজড হয়ে গেলাম কোনটায় ঢুকব! বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই কোনটা কেমন। একবার ভাবলাম, জ্বীনরাজ্য হয়ত অনেক সুন্দর হবে অতএব সুন্দর দরজাটার পিছনেই জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পথ থাকতে পারে। এই ভেবেই যেই দরজা খুলতে যাব, অন্য একটা চিন্তা মাথায় এল। উপরের আরবি লেখাটার দিকে তাকালাম। দুটো মিলানোর চেষ্টা করলাম, সুন্দর দরজাটার উপরের লেখাটায় ভুল রয়েছে।
আর বুঝতে বাকি রইলনা, কোনটায় প্রবেশ করা ঠিক হবে আমার পক্ষে।
আল্লাহর নাম দরজাটা খুলে প্রবেশ করতেই ঝাকে ঝাকে বাদুর এসে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ক্রমান্বয়ে খামচি দিতে লাগল আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে। ওড়নাটা ঝেড়ে ঝেড়ে তাড়াতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। একটাকে তাড়ালে আরো তিনটা এসে ঘিরে ধরছে। উপায়ান্তর না দেখে সামনের দিকে ছুটতে লাগলাম। এরা কিছুইতেই পিছু ছাড়ছেনা, ছুটতে ছুটতে খোলা প্রান্তরে চলে এলাম। এখানে ঘাসের ডগায় ডগায় বড় বড় জোকের দল আস্তানা গেড়ে আছে।
কি এক উভয়সংকটে পড়লাম! পিছনে বাদুর আর সামনে জোক। আমি কি ভুল দরজায় প্রবেশ করেছি! সেটা কি করে হয়! আল্লাহ আপনি আমার সহায় হন। বাদুর গুলো তেড়ে আসছে। দুটো রাস্তা আমার জন্য খোলা আছে। হয়ত পিছু হটে বাদুরের সাথে লড়াই করা নতুবা জোকভর্তি খোলা মাঠে নেমে যাওয়া। কোনোটাতেই বাচার উপায় নেই। বাদুরের ঝাক যেভাবে তেড়ে আসছে আমি কিছুতেই এদের সাথে পারবনা। জোকে ধরলেও সেটাকে পড়ে ছাড়ানো যাবে হয়তবা।
আর দেরী না করে খোলা মাঠে নেমে গেলাম। জোকগুলো যেন আমার নামার অপেক্ষা করছিল। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পিছন তাকিয়ে দেখলাম বাদুরগুলো সব একলাইনে বসে আছে আমার অপেক্ষায়।
কি করব মাথায় ধরছেনা!
নাহ থামলে চলবেনা, হয়ত জানে বাচব নয়ত এদের হাতেই মরব। যা থাকে কপালে, আল্লাহ রক্ষা করুন। সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি জোকগুলোকে পা দিয়ে সরাতে সরাতে। দু-একটা কামড় ইতিমধ্যে পায়ে পড়ে গেছে, এত যন্ত্রণা হচ্ছে। তাও থামছিনা, জোরে জোরে পা চালিয়ে খোলা প্রান্তর পেরিয়ে উচু ঢালুতে উঠে বসলাম। পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে, দু-একটা জোক এখনো কামড়ে ধরে আছে। ব্যথায় দাতে দাত চেপে আছি।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি এখানে অসংখ্য কাটাগাছ রয়েছে। কয়েকটা ভাঙ্গা ডাল জড়ো করে নিয়ে জোকের পেটের ধরে সজোড়ে টান দিলাম। মূহুর্তে দ্বিখন্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জোকগুলো। রক্ত পড়া জায়গাগুলোতে মাটি লাগিয়ে ওড়নার টুকরো দিয়ে বেধে নিলাম।
এখানেই লক্ষ্যে পৌছার লড়াই শেষ হয়নি বলে ধারণা করছি। এবার কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিনা, এটাও নিশ্চিত হতে পারছিনা আদৌ আমি সঠিক পথে এসেছি নাকি! এতক্ষণে মেহরাবের সাথে আমার একবারো যোগাযোগ হয়নি, উনি কি আমার অবস্থান সম্পর্কে অবগত নন! তবে কি আমার জ্বীনরাজ্যে যাওয়া হবেনা!
এসব ভাবতে ভাবতে হেটে চলেছি কাটাগাছ গুলো কোনোরকমে সরিয়ে। নিজের পুরো শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত লাশ মনে হচ্ছে।
ব্যথায় হাটার জোর ও পাচ্ছিনা, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অদূরে একটা ঝর্ণা দেখতে পেয়ে বেশ খুশি ই হলাম।
ঝর্ণার কাছে এসে যেই এর পানি পান করতে গেলাম, প্রচন্ড তান্ডবে সবকিছু কাপতে লাগল। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম, আবার কোন বিপদ ডেকে আনলাম আমি!
ঝর্ণার পানির ভিতর থেকে বেশ বড় বড় পা ফেলে এক থুড়থুড়ে অদ্ভুত চেহারার বুড়ি আমার সামনে এসে দাড়াল।
এর গায়ে সাদা কাপড় এলোমেলো ভাবে পেচানো।
চেহারায় বেশ রাগ রাগ ভাব, শরীর এত্তটাই পাতলা যে বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারবে।
রাগান্বিত কন্ঠে বলল, তুই কে? এত বড় সাহস তোর কি করে হয় যে তুই আমার পানি স্পর্শ করিস।
— ভুল মার্জনা করবেন বুড়িমা।
আমি ইচ্ছে করে করিনি, তেষ্টায় বড্ড কাহিল হয়ে এসেছিলাম। নিষেধাজ্ঞা আছে জানলে আমি স্পর্শ করতামনা।
বুড়ি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
— তুই কে? এখানে কিভাবে এলি!
— আমি একজন মনুষ্যকন্যা, নাম মুশায়রা। আমি জ্বীনরাজ্যের উদ্দেশ্যে এসেছি।
বুড়ি বিকট শব্দে হেসে উঠে বলল,
— মানুষ হয়ে জ্বীনরাজ্যে যেতে চাস? নিজের মৃত্যু ডেকে আনার খুব শখ হয়েছে। জানিস এর ফল কি হতে পারে!
— জানি বুড়িমা। কিন্তু নিজের ভালোবাসার জন্য সব করতে রাজি আমি।
— জ্বীন আর মানুষের মিলন কখনোই সম্ভব না জেনেও এখানে এসেছিস! এক ধাপে না হয় বেচে গেলি কিন্তু কয়বার বেচে ফিরবি এভাবে!
— জীবন-মরণ আল্লাহর হাতে। তার ভরসায় আমার এতদূর আসা। আপনি আমাকে বলতে পারবেন আমি সঠিক রাস্তায় এসেছি কিনা!
বুড়ি একটু নরম হয়ে বলল,
— হুম, সঠিক রাস্তায় ই এসেছিস। তোর মনের জোর অনেক বেশী বটে।
— আমি বুঝতে পারছিনা আমি কোনদিকে কিভাবে এগোবো! অসহায় হয়ে পড়েছি বড্ড।
— আমি তোকে জ্বীনরাজ্যে পৌছানোর পথ দেখিয়ে দিতে পারি।
— সত্যিই দেখাবেন বুড়িমা!
— হুম, তবে এর বিনিময়ে আমার কিছু প্রাপ্য রয়েছে।
— কি প্রাপ্য চান আপনি? আমার কাছে তো কিছুই নেই, তবে আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দিব।
— ঠিক আছে। আমি সময়মত ঠিক চেয়ে নিব।
নিজের অঙ্গীকার ভুলে যাস না কিন্তু।
— না বুড়িমা। কথা দিচ্ছি আপনাকে, আপনি যা চান আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাকে সেটা দেওয়ার।
বুড়িমা তার হাসি প্রসারিত করে পথ দেখিয়ে দিলেন। বুড়িমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার হাটতে লাগলাম। হাটতে হাটতে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ গুহাতে ঢুকে পড়লাম। কোনোরকম হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছি, এমন সময় পিছন থেকে বোনের গলায় ডাক এল, “মুশু”
জবাব দিয়ে যেই পিছনে ফিরতে যাব মেহরাবের সর্তকবাণী মনে পড়ে গেল।
কোনোভাবেই পিছনে তাকানো যাবেনা। মনে হচ্ছে কেউ আমার পিছু পিছু আসছে, চারপাশ থেকে বিশ্রী গন্ধ আর হাড় চিবানোর শব্দ আসছে।
ভয় লাগছে খুব, খুব ভয়ংকর গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ। দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ কিছু একটা হাতে উঠে এল। স্বল্প আলোয় দেখলাম এটা একটা কাটা মাথা, যার চোখ গুলো ঠেলে বের হয়ে এসেছে সাথে জিহবা ঝুলে পড়েছে। চিৎকার দিয়ে সেটা ফেলে দৌড়াতে লাগলাম।
ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গেছি, পদে পদে হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি। তাও উঠে ছুটে চলেছি। ভয়ংকর শব্দ গুলো আমার পিছু পিছু আসছে। অনেকটা দৌড়ে একটা আলোকিত জায়গায় এলাম। এখানে চারিদিকে মশাল জ্বলছে, সামনে বিশাল একটা দরজা। তাতে চোখ ধাধানো সজ্জা।
সম্ভবত এটাই জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার।
উপরে আরবিতে কিছু লেখা আছে। যার অর্থ আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু আমি এই দরজা দিয়ে ঢুকব কি করে! কয়েকবার ধাক্কা দিলাম দরজায়। কোনোভাবেই খুললনা।
বিকট হাসির শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম, অনেক গুলো ভয়ংকর কাটা মাথা লাফাতে লাফাতে আমার দিকে তেড়ে আসছে। একটা একটার চেয়েও বিভৎস দেখতে।
এখন দরজা না খুললে আমি এদের হাতেই মারা পড়ব। আরো কয়েকবার দরজা ধাক্কালাম, কিন্তু কোনো লাভ হলনা।
উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। বুড়িমার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে ঢুকতে হলে সেখানকার সম্পর্কিত আয়াত তোকে জানা লাগবে। কিন্তু কোনো আয়াত বা কি সেটা আমাকে বিস্তারিত বলেননি।
এখন আমি কি করব! কোনো সূরা বা কোন আয়াত পড়ব।
কিছুটা সময় ভেবেও কিছু ঠাহর করতে পারলামনা।
হঠাৎ আল্লাহর রহমতে আমার মাথায় একটা ধারণা এল, এটা যেহেতু জ্বীনরাজ্য, জ্বীনের জগৎ এটার সম্পর্কিত কেবল সূরা জ্বীন ই আছে। ঝটপট সূরা জ্বীন এর প্রথম কয়েকটি আয়াত পড়তে হাট করে দ্বার খুলে গেল। চারিদিক থেকে সূরা তিলওয়াত কানে আসতে লাগল যা শুনে কাটা মাথা গুলো পালিয়ে গেল। আল্লাহর নাম নিয়ে নির্বিঘ্নে দ্বারের ভিতর প্রবেশ করলাম।
অবশেষে আমি সক্ষম হলাম জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে।
কিন্তু মেহরাব কোথায় আছেন?
চলবে
জ্বীনবর_৫?
পর্বঃ১১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মেহরাব কি এখনো জানতে পারেননি আমি জ্বীনরাজ্যে ঢুকে গেছি। ভাবতে ভাবতে আনমনে সামনে হাটতে লাগলাম, হঠাৎ গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। খেয়াল করলাম, চারিদিকটা ভীষণ সুন্দর। যেন আরেকটা পৃথিবী, এখানকার পরিবেশ আমাদের চেয়েও চমৎকার আর মনোরম। চারিদিকে অজস্র ছোট-বড় গাছপালা, এক দিকে বিশাল ঝর্ণা এবং জলাশয়। গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, ফলে নুয়ে পড়েছে। পায়ের নিচে অতি সবুজ নরম ঘাস, প্রতিটা গাছের গুড়িতে বেয়ে উঠেছে আঙ্গুর গাছ। সেখানে ঝুলে আছে থোকা থোকা আঙ্গুর। এসব দেখে ক্ষিধে পেয়ে গেল। কিন্তু এইসময় খাওয়া দাওয়া বিপদজনক হতে পারে, আর খুব উদ্বিগ্ন আমি। মেহবারের খোজ কেন এখনো পাচ্ছিনা!
জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে পেরে যতটা আনন্দিত, ততটাই শঙ্কিত আমি। না জানি কখন কোন জ্বীন এসে আমার উপর হামলা করে, এখানে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে এ যেন কোনো ঘুমন্ত রাজ্য। প্রায় কিছুটা আসার পর কিছু মেয়েদের দেখলাম একত্রে জড়ো হয়ে কথা বলছে। তাদের কথার ভাষা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
খুব অস্বস্তি আর ভয় কাজ করছে। এদের সাথে আমি কথা বলব কিভাবে! এরা জ্বীন আর আমি মানুষ। আমাকে দেখে এরা হামলা করবে নাতো আবার, নাকি তিরস্কার করবে!! মেহরাব আপনি কোথায়? এ কেমন পরিহাস করছেন আমার সাথে!
চুপ করে ওদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি। মেহরাবের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে, এত পথে একটা বার ও যোগাযোগ করলনা। এখন জ্বীনরাজ্যে ঢুকার পর ও উনি লাপাত্তা। উনি ভালো করেই জানেন, আমি এখানে এলে উনাকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে। তাও এলেননা!
হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েদের দল থেকে একজন সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
এসেই বলল, আপনি মুশায়রা??
আমি আস্তে করে জ্বী বলে তার দিকে ভালো করে তাকালাম। অবিকল মানুষের মতই দেখতে, বাহিরে থেকে কেউ তাদের পার্থক্য করতে পারবেনা সে মানুষ নাকি জ্বীন!
ছোট্ট থেকে জ্বীনদের ভয়ানক রুপের গল্প শুনে এসেছি কিন্তু এখন সামনাসামনি দেখে সেগুলো আজগুবি ই মনে হচ্ছে।
মেয়েটা একগাল হেসে বলল,
— স্বাগতম, আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষিত ছিলাম।
আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর সৌভাগ্য পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। আসুন, প্রবেশ করুন জ্বীনরাজ্যের অভ্যন্তরীণ সীমানায়।
মেয়েটার মনছোয়া অভিবাদনে আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। মেয়েটা আমার বাহু কোমলভাবে ধরে বলল,
— চলুন আপনাকে কাঙখিত স্থানে নিয়ে যাই।
আমি মুচকি হেসে বললাম, ধন্যবাদ।
মেয়েটি উত্তরে মিষ্টি হাসি উপহার দিল।
জ্বীনরাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকলাম আমরা। চারদিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। মানুষের জগতের মত জ্বীনজগতেও বাসস্থান, উপশহর, হাট-বাজার সবই আছে। চারিদিকে লোকজন নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
আমার অবাকতা দেখে মেয়েটি বলল,
— ভীষণ অবাক হচ্ছেন?
— হ্যা, খুব’ই। আমার ধারণা ছিলনা জ্বীনরাজ্য এত সুন্দর এবং পরিপাটি হতে পারে।
— আপনাদের সাথে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। যে পার্থক্য রয়েছে সবগুলো অনেকটাই বাহ্যিক, মনোতাস্ত্বিক এবং সৃষ্টিগত।
যাই হোক, এগোনো যাক। সবাই আপনাত অপেক্ষায় আছেন।
— মেহরাব কোথায়? মেয়েটি হেসে বলল,
— উনিও আছেন। চিন্তা করবেননা, উনার নির্দেশেই আপনাকে নিতে এসেছিলাম আমরা।
আমি আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করলামনা।
অনেকটা হাটার পর আমরা অনেক বিলাসী একটা বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়ী বললে ভুল হবে, এই যেন এক রাজপ্রাসাদ। এত মনোরম এবং সুন্দর প্রাসাদ আমি আগে কখনোই দেখিনি। বিশাল গেইটের পুরোটাই ফুলে মোড়া, গেইটের সামনেই থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা। তার একপাশে ফুল-ফলের বাগান, দোলনা এবং ছোট্ট একটা ঝরণা, অপরপাশে বসার জায়গা রাখা হয়েছে।
আমরা গেইট পার হয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাড়ীটার যত কাছে এগোচ্ছি তত বুক দুরুদুরু করছে। কেমন জানি লাগছে আমার কাছে, আল্লাহ’ই জানেন আমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে সেখানে!
বাড়ী থেকে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। বাহির থেকে ভিতর হাজারগুণ বেশী সুন্দর, একদম রাজপ্রাসাদের সমতুল্য। মেয়েগুলো আমাকে একটা মনোরম কক্ষে বসিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল।
বেশ একটা ঠান্ডা পরিবেশেও আমি কুলকুল করে ঘামছি। আশেপাশে কাউকে দেখলামনা, মেহরাব ও এখনো পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করেননি। সবকিছু কেমন যেন গোলকধাধা লাগছে, এর যত গভীরে যাচ্ছি ততই যেন রহস্য বেড়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা মেহরাবের কথায় বিশ্বাস করে এখানে এসে কোনো ভুল করলাম না তো! ওদের দ্বারা আমার কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই তো! এমন অজস্র প্রশ্ন মস্তিষ্কে ভীড় জমাচ্ছে, পরক্ষণেই নিজের উপর রেগে গেলাম এসব অহেতুক বাজে চিন্তাভাবনার জন্য।
ভালোবাসার মানুষকে এভাবে কেউ সন্দেহ করে!
খানিকবাদে একজন বুড়ো এবং প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা কক্ষে প্রবেশ করল। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উনারা সালামের উত্তর নিয়ে আমার মুখোমুখি বসে আমাকে বসার অনুমতি দিলেন।
আমি শান্ত-নম্র মেয়ের মত বসে রইলাম। বুড়ো মহিলা নিরবতা ভেঙ্গে বললেন, তুমি ই মুশায়রা?
— জ্বী জনাবা।
— তোমার ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত শুনেছি। প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে, তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে এসেছো। জ্বীনের সাথে মানুষের বিবাহ সম্ভব নয় সেটা বলবনা, তবে অনেক কঠিন। যেটা সবার পক্ষেই সম্ভব কিছু নয়।
যাই হোক, আমি তোমাকে কিছু কথা বলি। এরপর তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা তুমি ঠিক করে নিও।
জ্বীনরাজ্য অবধি আসা পর্যন্ত তুমি কেমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো সেটা তুমি ভালোই জানো। আমি বলব, এসব অনেক তুচ্ছ। জ্বীনরাজ্যে এসে একজন জ্বীনকে বিবাহ করে তার সাথে আজীবন সংসার করা তার চেয়েও বেশী বিপদসংঙ্কুল আর কঠিন।
অনেককিছুর মুখোমুখি হতে হবে তোমায়, প্রতিটি পদে পদে তোমার লড়াই। হয়ত এসবের এক পর্যায়ে তোমার জীবনসংকট হয়ে পড়বে। তখন কোনোভাবেই তুমি পিছু হটতে পারবেনা।
এখন গোটা জ্বীনরাজ্যের নিয়ম এর বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা তোমাদের বিয়ে দিলাম, পরে তুমি এই পথ সরে গেলে কি হবে বুঝতে পারছো তো!! তুমি কিন্তু সাধারণ জ্বীনকে বিবাহ করতে যাচ্ছোনা। অতএব, তুমি সবকিছু ভেবে তোমার সিদ্ধান্ত কি?
আমি একটু চুপ থেকে বললাম,
— সবকিছুর জন্য আমার আল্লাহ ই যথেষ্ট। উনার রহমতে আজ আমি এখানে এসেছি, ভাগ্যের দায়ভার সব উনার হাতেই ছেড়ে দিলাম।
আমি যে সিদ্ধান্য নিয়ে এখানে এসেছি আমি তাতেই অটুট আছি এবং থাকব। আমার আগাম বিপদ নিয়ে কোনো ভয় কিংবা অভিযোগ নেই।
বুড়ো মহিলা আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
— আল্লাহ তোমার সহায় হন।
তবে মুখের কথায় ভরসা করে তোমার এত বড় সিদ্ধান্তে আমরা মত দিতে পারছিনা। এরজন্য আমাদের কিছু দময় নিয়ে তোমাকে জানা প্রয়োজন।
আগে কিছুদিন তুমি আমাদের সাথে অবস্থান করো, তোমাকে আমরা বুঝে-শুনে নিই। যেহেতু বিবাহ কোনো ছেলেখেলা নয়, এটা সারাজীবনের ব্যাপার। তার উর্ধ্বে এটা স্বাভাবিক বিবাহ নয়, এখানে একটা ভুল পদক্ষেপ দুটো জগতকেই উলটে পালটে দিবে।
— আমার কোনো আপত্তি নাই। আপনারা যোগ্য মনে করলেই বিবাহ হবে, আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পর্যবসিয় হলে আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমি তাই মেনে নিব।
নিশ্চয়ই আপনারা আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী।
— ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম করো। অনেক ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে তোমায়, তোমার জন্য কিছু আহার-পানীয় এবং পোশাক পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মরিয়ম এসে তোমার ক্ষতস্থানে ভেষজ লাগিয়ে দিবে।
আসি আমরা।
আমি আবার সালাম দিলাম। উনারা আমার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলেন।
নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, আমি জানতাম এটাই আমি শেষ লড়াই নয়, সামনে আরো কঠিন কঠিন ধাপ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। এটাই অবাক ব্যাপার যে আমার মত ভীতু মেয়ে আজ প্রচন্ড মনোবল আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে এতটা আসতে পেরেছে। এসব ছিল আমার কল্পনার বাহিরে।
সব ই সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমত এবং মেহরাবের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা থেকে। কিন্তু মেহরাব এখনো কেন আমার সামনে আসছেননা! অন্তত একটিবার সাক্ষাত তো করবেন। উনার জন্যই তো আমার এতকিছু করা। উনি কি এভাবে আড়ালে থাকবেন!
একটু পর মেয়েটি আসল এবং আমার ক্ষতস্থানগুলোতে কিসব লাগিয়ে দিল। মূহুর্তে অনেক আরাম বোধ করলাম, তারপর বাহিরের ঝর্ণা থেকে ফ্রেশ হয়ে তাদের দেওয়া নতুন পোশাক পড়লাম। বেশ সুন্দর গাউন, পোশাকটা যেন আমার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
তারপর কিছু ফল খেয়ে এবং হালকা আহার সেরে নিলাম। ফলগুলোর স্বাদ একদম অন্যরকম, সাথে দিয়েছিল ক্ষীরের পায়েস। যা খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
মেয়েটি আমাকে বলল, আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। আমি পরে এসে আপনাকে ডেকে নিব।
আমি চুপচাপ সব ই করছিলাম। মনটা একটু ভার হয়ে আছে। খেয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
.
(চলবে)