জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ১৪,১৫

0
1219

জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ১৪,১৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৪

আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে নিচে পড়লামনা, আমার হাতের লাঠিটা একটা খাড়া পাথরের চিপায় আটকে গেছে। এক হাতে ঝুলে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ভয় হচ্ছে আমি উপরে উঠতে গেলে যদি লাঠিটা কোনোভাবে খুলে বের হয়ে যায়। অন্য হাত ও অবশ নতুবা সে হাতটা দিয়ে খাড়া পাথর ধরে বেয়ে উঠা যেত। এভাবে ঝুলে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
এজন্য কয়েকবার সাহস করে লাঠিটা শক্ত করে গেথে আছে কিনা চেক করে নিলাম। বেশ শক্ত ভাবেই আটকে আছে ওটি, এর ওপর ভর দিয়ে খাড়া সিড়িতে উঠে যাব। তারপর আস্তে আস্তে নামতে সমস্যা বেশী হবেনা।

আল্লাহর নাম জপ করতে করতে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম, বেশ কয়েকবারের পর উঠতে পারলাম। খাড়া পাথরগুলোর উপর দাঁড়িয়ে লাঠিটা উঠানোর জন্য বেশ কয়েকবার টানলাম। নিচের দিকে যতবার চোখ যাচ্ছে ভয় লাগছে। এখানে পড়লে মরব কিনা জানিনা, তবে হাত-পা কিছু আস্ত থাকবেনা। তখন বিপদে মাথা কাজ করছিলনা বলে ঝাপ দিয়েছি। এখন যা করব ভেবেচিন্তে করতে হবে, এখান থেকে ফেরা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছেনা। এর মধ্যে আকাশটা কালো হয়ে এল। লাঠিটা কোনোমতে ভাঙ্গা অবস্থায় বের করে আগের মত মাটিতে গেথে খাড়া সিড়িতে চলে এলাম। বৃষ্টি নামার আগে পাহাড় থেকে নামতে হবে আমায়, যা মেঘ করে অন্ধকার নেমে এল তাতে বুঝতে পারছিনা আমার ফেরার সময় কতটা এগিয়ে এল।

আস্তে তবে দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। উঠার চেয়ে নামাটা সহজ হলেও এখানে ততটাও নয়। খাড়া পাহাড়ের কোণ যা এমন ই, লাঠি থাকা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে ঝুকে পড়ে যাব। ঝাপ দেওয়ায় একটা ভালো হয়েছে, সমতলের মোটামুটি কাছে এসে আটকেছি। নাহলে এই পাহাড় বেয়ে নামতে সন্ধ্যা পার হয়ে যেত। খানিকটা পর পাহাড় থেকে নেমে সমতলে নেমে আসল।
এর মধ্যে আকাশের অবস্থা ক্রমশ ই খারাপ হয়ে এল। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে, চারপাশে কোনো বড় গাছ বা আশ্রয়স্থল নেই যেখানে মাথা গুজে বজ্রপাত থেকে বাচব। বজ্রপাত গুলো আমার চারপাশে পড়ছিল, প্রচন্ড শব্দ গুলো শুনে আমি বারবার ভয়ে কেপে উঠছিলাম। আল্লাহ আমার কপালে কি রেখেছেন, তিনিই জানেন।
ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু হল, কিন্তু তাতে অন্ধকার একটুও কাটলনা। আর কিছু ভেবে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটতে লাগলাম। এরমধ্যেই বজ্রপাত পড়ে আমার চারপাশে আগুন ধরে গেল, আগুনের মাঝখানে আমি আটকে পড়ে গেলাম।
এর থেকে কিভাবে বের হব বুঝতে পারছিলামনা। বৃষ্টিতে আগুন একটুও নিভতে চাইছেনা, ক্রমশ দাউদাউ করে বেড়ে চলেছে। আগুনগুলো হঠাৎ বিশাল আকৃতি ভয়াবহ প্রাণীর রুপ নিল, সেগুলো আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে সজোড়ে হাসছিল।
বুঝতে বাকি রইলনা, এগুলো কোনো শয়তান হবে। আমার ক্ষতি করতেই এরা এসেছে। কিন্তু আমি এদের সাথে মোকাবিলা করব কি করে! আমি একজন সাধারণ মানুষ আর ওরা ভয়ানক প্রাণীরুপী শয়তান। ভয় না করে ওদের একজনের দিকে হাতের লাঠিটা ছুড়ে দিলাম, লাঠিটা ওরা হাত নেওয়া মাত্রই সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
এভাবে ওদের সাথে পারা যাবেনা কিছুতেই। আমার শেষ ভরসা, আল্লাহ তায়ালা। উনার কালাম দিয়েই লড়াই হোক। এর মধ্যে শয়তান গুলোর একজন আমার দিকে আগুনের গোলা ছুড়ে মারল, আমি বেকে যাওয়ায় আমার গায়ে লাগলনা।
এরা আমাকে চেপে ধরার জন্য চারপাশ থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি মুনাজাত ধরে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। মুনাজাতের মুষ্টিতে বৃষ্টির পানি পড়ে জমা হল, আমার ছোট মস্তিষ্কে অন্য চিন্তা এল। আমি পানিতে আয়াতুল কুরসী এবং সূরা ফাতিহা পড়ে ফুকে দিয়ে শয়তান গুলোর গায়ে ছিটালাম। সাথে সাথে এদের শরীরের আগুন নিভে উধাও হয়ে গেল।
শোকর-আলহামদুলিল্লাহ বলে দুহাত দ্বারা চেহারা ম্যাসাহ করে আবার ছুটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে বৃষ্টি ও বন্ধ হয়ে গেল। আমার পা দুটো আর চলছেনা, শুধু মনে হচ্ছে হেরেই গেলাম আমি। এখন এই রাজ্য থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। দাদীমার কথামত ওইস্থান থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি, শূণ্য হাতে ফিরতে হচ্ছে।

জ্বীনরাজ্যে প্রাসাদের সামনে এসে আমি আর নড়তে পারছিলাম, হঠাৎ করেই জ্ঞান হারালাম। জানিনা কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল, চোখ মেলে দেখি মরিয়ম আমার পাশে বসে আমার বাম হাতটা মালিশ করছে। হাতের নীলচে বর্ণ নেই, তবে হালকা নাড়াতেই ব্যথা করে উঠল।
মরিয়ম আমাকে বাধা দিয়ে বলল,
— বোন এক্ষুণি নাড়াবেননা, ক্ষতের যন্ত্রণা এখনো রয়ে গেছে। আমি ভেষজ লাগিয়ে দিয়েছি, সেরে যাবে।
বিষ যা ছিল, সব বের করা হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
— দাদীমা কোথায়?
— উনি এতক্ষণ এখানে ছিলেন, আমাকে আপনার দেখাশুনা করতে বলে জরুরী কাজে গিয়েছেন।
আমি নিষ্প্রাণ ভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার কেন জানি ভয় হচ্ছে, আজ আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারিনি। আমাকে মেহরাবকে ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজের দুনিয়ায়।
কিন্তু আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমাকে তো এমনিতেই চলে যেতে হত, আমি যে মেয়েটিকে কথা দিয়েছি। ভালো ই তো হল, একটা অযুহাতে মেহরাবের জীবন থেকে সরে যেতে পারব। আর কখনো আমাদের সাক্ষাত হবেনা, সব এখানেই সমাপ্তি পেয়ে যাবে।
মরিয়ম আমাকে নাড়া দিয়ে বলল,
— আপনার শরীর এখন খুব দূর্বল। একটু কিছু খেয়ে নিন।
— আমার এখন ইচ্ছে করছেনা।
— মেহরাব ভাই বলেছেন, এই ব্যাপারে আপনার কোনো বারণ না শুনতে। আপনি বিশ্রাম নিন, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।
আমি আর কিছু বললামনা। মেহরাবের সাথে স্বাভাবিক ই থাকতে চাইছি। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই শেষ হোক।
রাতে দাদীমা আমার কক্ষে আসলেন। আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার শরীর কেমন এখন?
— আলহামদুলিল্লাহ অনেকটা ভাল আছি।
— খাওয়া দাওয়া করেছো?
— জ্বী দাদী।
উনি কিছুক্ষণ নিরব থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
— সেই বস্তুটি এনেছো? দাও আমাকে!
আমি উনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, তারপর ক্ষীণকন্ঠে বললাম, গুহায় যেসমস্ত বস্তু দেখেছি কোনোটাই আপনার বর্ণণা মত নয়। সোনা-রুপা কিংবা মাণিক্য হয়ত অনেক দামী, কিন্তু এর কার্যকারীতা স্বল্পকালের জন্যই। সবকাজে এদের লাগেনা, হয় ও এদের দিয়ে।
— তাহলে তুমি কি শূণ্য হাতেই ফিরেছো?
— না দাদীমা, সাথে আমার আত্মবিশ্বাস-মনোবল নিয়ে ফিরেছি। যা যেকোনো দৃশ্যমান বস্তু অপেক্ষায় অনেক দামী, এর কার্যকারীতা ফুরায়না বরং দিন দিন সেটি নতুন নতুন কার্য সৃষ্টি করে নিজস্ব কার্যকারীতা বাড়ায়। আর এটিই সেই জিনিস, যা সব কাজেই প্রয়োজন।
— মারহাবা। তোমার মত বুদ্ধিমতী এবং সাহসী মেয়ে আমি খুব কম ই দেখেছি। তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছো, আমার কথানুযায়ী আমি তোমাকে আমার মেহরাবের বধূ হিসেবে স্বীকৃতি দিব।
কাল রাতেই তোমাদের বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে।
এই কথাটা শুনে আমি খুশি হবে নাকি বেজার হব বুঝতে পারছিলামনা। কথাটা শুনে মনটা এত চঞ্চল হয়ে উঠেছে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন কোনোকিছু পেলে মানুষের মন স্বস্তি পায়। তেমন স্বস্তি পাচ্ছি আমি, কিন্তু এটা তো আমার ভাগ্য লেখা নেই।

সকালে মরিয়মসহ কিছু মেয়ে এসে হলুদ মাখিয়ে গোলাপ ভেজানো পানি দিয়ে আমার গোসলের ব্যবস্থা করে দিল। তারপর মেহেদী পড়িয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল আয়োজন করা হচ্ছে। কানের কাছে অদৃশ্য কন্ঠ শুনে হালকা ভয় পেয়ে গেলাম,
— আপনি এখানে? এইসময়?
— আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব হলুদবরণ গালে আপনাকে কেমন লাগছে! বাহ, মেহেদী টা খুব সুন্দর ভাবে একেছো!
বউ বউ লাগছে একদম।
— জানেন, কেউ যদি জেনে যায় আপনি বিয়ের আগে বউয়ের মুখ দেখতে এসেছেন কি হবে?
— সেই ভয়ে কি নিজের বউকে দেখব না! এই মেয়েগুলোকে এত বার করে বলে দিলাম মেহেদী দিয়ে হাতে আপনার আমার নাম লিখে দিতে, লিখলনা!
— ব্যস্ত ছিল তো তাই ভুলে গেছে।
— সমস্যা নেই, আমি ই লিখে দিচ্ছি। ডালা থেকে মেহেদী নিয়ে হাতের মাঝখানের ফাকা জায়গাটায় আরবিতে আমাদের নাম লিখে দিল।
তারপর বলল, আপনাদের সমাজে নাকি খুব প্রচলিত যে মেয়ের হাতে মেহেদীতে লেখা নামের রঙ গাঢ় হয় সে মেয়ে স্বামীসোহাগী হয়। এসবে অবশ্য আমি বিশ্বাস করিনা, আমি জানি আপনি স্বামীসোহাগী হবেন। আপনার স্বামীর বাম পাশের পাজড় হয়ে যত্নে-ভালোবাসায় ঘিরে থাকবেন।
আমি নিজের অজান্তে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম
উনি হেসে বললেন, লজ্জা পেলে আপনাকে লাল টুকটুকে বউ লাগে। খানিকটা হলুদ নিয়ে উনি আমার নাকে এবং গালে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, আজ নিজেকেই সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে, এমন একটা হলুদরঙ্গা লাল টুকটুকে বউ আমার ঘর আলো করবে।
কোনো স্বামী হয়ত এর আগে নিজের বউকে হলুদ ছোয়ায়নি, আমি ছুয়ে দিলাম। অনুভূতিটাই আলাদা।
বাহিরে থেকে মরিয়মের গলার স্বর শুনতে পেলাম। উনি আমার হাতে হলুদ লাগিয়ে নিজের হাতে লাগিয়ে দিলেন, অদৃশ্য অবস্থায় শুধু তার ছোয়াটাই অনুভব করলাম।
— আপনি কি কখনো আমার সামনে আসবেননা?
— একদিন বলেছিলামনা, যেদিন অধিকারটা তৈরী হবে সেদিন আসবে। আজ রাতেই বরবেশে আমাকে দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ। তখন আবার অপছন্দ করে পালিয়ে যাবেননা যেন! আসি বউটাহ।
উনার কথাশুনে অনেককিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনি মরিয়ম এসে বলল, ভাবী আপনার গোসলের ব্যবস্থা সম্পন্ন, আসুন সেরে নিবেন। চিন্তাগুলোকে এক পাশে রেখে মরিয়মের সাথে চলে গেলাম।

সন্ধ্যায় সারাপ্রাসাদে সাজ সাজ রব, চারপাশের নানা ধরণের জ্বীন এর আনাগোণা-কলবরে মুখরিত। অবশ্য আমি দুপুর থেকেই কক্ষেই অবস্থান করছি বাহিরের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি। খানিকবাদে মরিয়ম বধুর সাজসজ্জা নিয়ে উপস্থিত হল। লাল রঙ্গের বড় গাউন, তার সাথে মিলিয়ে হিজাব- ওড়না, হালকা গয়না এবং বড় সুগন্ধী ফুলের তোড়া। সাজানোর পর যেন নিজেকে চিনতেই কষ্ট হচ্ছে আমার। এমনভাবে সাজতে কেবল আরবিয়ান দেশের বধুদের দেখেছি। মরিয়ম চুড়ি পরাতে গিয়ে আমার হাতের লেখা নামের দিকে খেয়াল করে বলল,
— মাশা-আল্লাহ মেহেন্দী তো বেশ টকটকে রঙ ধারণ করেছে, কিন্তু এত সুন্দর করে নামটা লিখল কে!
আমার লজ্জামাখা চেহারা দেখে বুঝতে পেরে মরিয়ম আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেই লেখা নামটা দেখছিলাম, এত সুন্দর গাঢ় রঙ হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই আমার পাওয়ার কথা না।
অন্যের হক কেড়ে নিচ্ছি আমি, আর দেরী নয় সময় হয়েছে আমার নিজের কথা রাখার। এক্ষুনি সবার চোখ ফাকি দিয়ে পালাতে হবে।
হাতের ফুলটা রেখে বাহিরের দিকে উকি দিলাম, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এখনি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পা টিপে টিপে কক্ষ থেকে বেরিয়ে লন থেকে বারান্দার দিকে গেলাম।
.
(চলবে)

জ্বীনবর ৫?
পর্বঃ১৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

বারান্দার এদিকটা প্রায় জনশূণ্য। এখন থেকে প্রাসাদের খাম্বা ধরে নিচের দিকে নামা যাবে। নিচেও অনেক লোকজনের আনাগোণা দেখছি। কিভাবে পালাব ঠিক বুঝতে পারছিনা! আগে এখান থেকে নেমে যাই, তারপর না হয় এসব ভাবা যাবে। অনেক কষ্টেও খাম্বা বেয়ে নামতে পারলামনা। বাধ্য হয়ে বারান্দা ছেড়ে সোজা সদর দরজার দিকে চললাম, মনে মনে প্রার্থনা করছি কেউ যাতে আমাকে দেখে না ফেলে। এইজন্য আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে যেতে লাগলাম। নির্বিঘ্নে সদর দরজা পার হয়ে বাহিরে আসলাম। এখানকার সবাই নিজেদের কাজ আর খোশ-গল্পে ব্যস্ত। কারো নজর পড়লনা আমার উপর। গেইট দিয়ে খুব সহজেই বের হওয়া যাবে।
গেইট দিয়ে বের হয়ে দৌড়ে অনেকটা চলে এলাম, ক্লান্ত হয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। এত দূর থেকেও প্রাসাদ টার আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে এভাবে চলে আসার জন্য, আমি স্বপ্ন তো এটাই ছিল যে মেহরাবকে নিজের করে পাব, এরকম জাকজমকভাবে আমাদের বিয়ে হবে। কিন্তু আর কিছুই হলনা…….
আমি জানিনা, এই জ্বীনরাজ্য থেকে কিভাবে বের হব! এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু ঘরবাড়ি আর গাছপালা ছাড়া কিছুই চোখে পড়লনা। যেভাবে এসেছি হয়ত সেভাবেই ফিরতে হবে, ওই জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবেনা, এতক্ষণে হয়ত সবাই আমাকে না পেয়ে চারিদিকে খোজা শুরু করে দিয়েছে।
আর কিছু না ভেবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।

বিয়ের সময় হয়ে এসেছে। জ্বীনদের মধ্যে বড় আলেম এসে উপস্থিত হয়েছেন বিয়ে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। দাদীমা কয়েকজনকে বর আর কনে কে ডেকে আনার জন্য পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহরাব এসে উপস্থিত হল বিয়ের স্টেজে। মেয়েরা এসে জানালো, কনেকে কক্ষে পাওয়া যাচ্ছেনা। আশেপাশে কোথাও নেই। মূহুর্তেই আনন্দের পরিবেশ থমথমে হয়ে এল। কারো মুখে রা নেই, সবাই গম্ভীর হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
মেহরাব মাথা থেকে টুপি খুলে পাশে রেখে দিল। দাদীমার সামনে এসে পায়ের কাছে বসে বললাম,
— দাদীমা জানিনা, এই খারাপ পরিণতির কি প্রতিদান দিব আমি! আমি নিজেই এর জন্য দায়ী। সবকিছু আমার দোষে হয়েছে, তুমি আমাকে শাস্তি দাও।
আমাকে জ্বীনরাজ্য থেকে বহিঃস্কার করে জ্বীনরাজ্যের গ্লানি মুছে ফেলো। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবে।
মেহরাবের চোখ থেকে অশ্রু ঝড়তে লাগল। দাদীমা নির্বাক হয়ে একইভাবে বসে রইলেন। উনার পাশে থাকা আরেকটি জ্বীন বললেন, উপস্থিত মেহমানবৃন্দ, আসুন আপনারা আহার সেরে নিবেন। চলুন, আপনাদের সম্মানার্থে সামান্য আয়োজন করা হয়েছে। কেউ আহার সম্পন্ন না করে যাবেননা।
এই কথায় যেন কারো টনক নড়লনা, তবে সবাই নড়েচড়ে উঠল। সবাই চুপচাপ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহারের আয়োজন দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এইটুকু না করলে হয়ত তাদের দ্বারা দাদীমাকে অপমান করা হত। দাদীমা উঠা দাড়ালেন, চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলেন।

আমি উপরতলা থেকে “দাদীমা” বলে ডাকলাম। সবার মূহুর্তেই সেখানে থমকে গেল। দাদীমা অবাক চাহনীতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ধীরে ধীরে সিড়ি ভেঙ্গে নেমে আসলাম। দাদীমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— কোথায় ছিলে তুমি?
— আমি নামাযঘরে ছিলাম।
— এখানে তোমার বিয়ের আয়োজন চলছে, সবাই তোমাকে খোজাখুজি করছিল আর তুমি নামাযঘরে অবস্থান করছিলে! সেখানে কি করছিলে তুমি?
— অনেকবছর হয়েছে মা-বাবাকে হারিয়েছি। তারা আমার বিয়েতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কর্তব্য সমাধা করতে পারলেননা। আমার বিয়ে নিয়ে যে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল, খুব মনে পড়ছিল তাদের কথা।
তাই নামাযঘরে বসে তাদের আত্মার মাগফেরাত এর দোয়া করছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি যে এতটা দেরী হয়ে যাবে।
— কাউকে তো বলে যেতে পারতে, সবাই ভেবেছে তুমি……
— দাদীমা, তখন সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আমি কাউকেই পাইনি ডেকে বলার জন্য। উনাদের সাথে তো আমার পরিচয় নেই কাকে বলে যাব বুঝতে পারিনি।
আমার দোষ মার্জনা করবেন।
— ঠিক আছে, এসো এখানে বসো।
মেহরাব তুমি নির্দিষ্ট জায়গায় বসো। মরিয়ম পর্দার ব্যবস্থা করো, সবাই এখানে চলে এসো। বিয়ের কাজ সমাধা হয়ে যাক। আমাকে আর মেহরাবকে মুখোমুখি বসানো হল, সামনে পাতলা পর্দা টেনে দেওয়া হল। দোয়া পড়া শেষ করে আমাকে আগে কবুল বলতে বলা হল। আমি একনজরে মেহরাবের দিকে তাকালাম, এতক্ষণ ওর দিকে একবারের জন্যও আমার দৃষ্টি যায়না। এই প্রথম ওকে আমি দেখলাম। ওর রুপ-সৌন্দর্য এবং সুদর্শনতা যে কাউকে মুগ্ধ করবেই, আমি কল্পনাও করতে পারিনি মেহরাব দেখতে এতটা সুন্দর এবং মায়াবী চেহারার অধিকারী হবে। লাল শেরওয়ানীতে ওর রুপ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
মনে মনে মাশা-আল্লাহ বলে ফেললাম। আশেপাশের মেয়েগুলো রসিকতা করে আমার উদ্দেশ্যে বললে, লজ্জা পেয়োনা ভাবী। বলে ফেলো।
আমি এক এক বার কবুল বলছিলাম আর মেহরাবের দিকে তাকাচ্ছিলাম। উনি মুখ টিপে হাসছিল, উনার চোখে-মুখে প্রাপ্তির আনন্দ বিরাজ করছিল।
আমার পালা শেষে উনার কবুল বলার পালা এল। উনি এক দমে ৩বার কবুল বলে ফেললেন। দাদীমাসহ আশেপাশের লোকজন হাসছিল তার এই অবস্থা দেখে।

অতঃপর আমাদেরকে পাশাপাশি বসানো হল। আমি বারবার লুকিয়ে লুকিয়ে উনার দিকে তাকাচ্ছিলাম। উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
— বরকে দেখার লোভ সামলাতে পারছোনা বুঝি!
— ইয়ে মানে ওইসব কিছু না।
— এই বউ!
— হ্যা।
— আজ তোমাকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগছে।
আমি লজ্জায় আর কিছু বলতে পারলামনা। এরপর আমরা একে অপরকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানালাম। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে আমাকে উনি খাইয়ে দিলেন। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম তা দেখে দাদীমা বললেন,
— স্ত্রীকে নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া সুন্নত নাতবউ। এতে ভালোবাসাও বাড়ে।
তারপর দাদীমা আমার হাত মেহরাবের হাতে রেখে বললেন, দুজন প্রতিজ্ঞা করো একে অপরের কাছে। সবসময় একে অপরের পাশে থাকবে, একে অপরের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করবে। নিজেদের রাগ-অভিমানকে তোমাদের ভালোবাসার থেকে বড় করে দেখবেনা।
দুজন দুজনের ভালো থাকার দায়িত্ব নিবে।
আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইনশা-আল্লাহ।” দাদীমা আমার কপালে চুম্বন করে বললেন, স্বামীর প্রতি অনুগত থাকবে এবং নিজের কর্তব্য পালনে অবহেলা করবেনা। তার সব দায়িত্ব তোমার।

সমস্ত নিয়মকানুন শেষ করে আমাকে উপরে নিয়ে যাওয়া হল। পোশাক পরিবর্তন করে শাড়ী পরানো হল, বিভিন্ন গয়নাগাটি, খোপায় লাল গোলাপ সব মিলিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ বধু মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে শুধু মেহরাবের মুখটাই ভাসছিল, ওকে দেখার জন্য যেন মনটা ছটফট করছিল। সাজসজ্জা শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল প্রাসাদের থেকে খানিকটা দূরে তৈরী মনোরম কক্ষে। এখানে সবকিছু এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে চোখ ফেরানো যাচ্ছিলনা। পর্দা, তাজা ফুল বিভিন্ন কিছু দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।
আমাকে বসিয়ে মরিয়ম বলল, একটু অপেক্ষা করুন, ভাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুভকামনা আপনাদের জন্য, দোয়া করি আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।
উত্তরে আমি ধন্যবাদ বলে মুচকি হাসলাম।
কিছুটা সময় পর মেহরাব এসে কক্ষে প্রবেশ করল। সুন্দরভাবে সালাম দিয়ে আমার পাশে বসল। তারপর আমার হাতটা ধরে বলল, শোকর-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই এভাবে আমাদের এক করে একটি সুন্দর জীবনের প্রদানের জন্য। এটি আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন যে আমি আপনাকে নিজের স্ত্রীরুপে পেয়েছি। কথা দিলাম, আপনার সকল দায়িত্ব আমি হাসিমুখে পালন করব। আপনি আমার গৃহের রাণীরুপে থাকবেন, আপনার কষ্ট হবে আমার কষ্ট। আপনার খুশি হবে আমার আনন্দ।
কখনো যদি আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আসে, নির্দ্বিধায় জানাবেন। আমি শুধরে নেব। আপনি কেবল আমার স্ত্রী ই নন, আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আপনার উপর কোনো বিপদ আমি আসতে দিবনা।
আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমি মোহর ধার্য করেছে, সেগুলো গ্রহণ করে আমাকে দায়মুক্ত করুন। বলে আমার হাতে একটা ভারী লাল থলি দিলেন।

তারপর আমাকে বললেন, বউ আপনার কিছু বলার নেই। আজ আপনার মনের সমস্ত আবেগ-ভালোবাসা বলতে পারেন। আজ আমাদের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে।
আপনার সমস্ত অনুভূতি সম্পর্কে আমি শুনব।
আমি একটু চুপ থেকে উনার হাত থেকে হাত সরিয়ে বললাম, আপনাকে স্বামী হিসেবে পুরোপুরি মেনে নেওয়ার জন্য আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এই মূহুর্তে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত নই।
মেহরাব আমার থেকে হয়ত এমন কথা আশা করেনি তাই উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে চাইলে আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম
— আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমার কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনার আপত্তি না থাকলে আমি ঘুমাতে যাব।
মেহরাব শুকনোমুখে বলল, অবশ্যই।
তারপর আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। টের পেলাম আলো নিভিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here