জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ২৪,২৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২৪
রান্নাঘরে এসে দেখলাম বোন সবজি কাটছে। অবাক হয়ে বললাম, তুই এখানে?
— কেন আসতে পারিনা বুঝি!
— তা কেন পারবিনা। তোর কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? আমাকে বললেই পারতি আমি বানিয়ে দিতাম।
— আজ আমার রান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাড়ীতে দুলাভাই প্রথমবার এসেছে তাছাড়া ফারহানের ও তো সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। তাই স্পেশাল কিছু বানাচ্ছিলাম।
— কি বানাচ্ছিস বল! আমি হাতে হাতে সাহায্য করে দেই, তোর একা করতে সময় লাগবে অনেক।
— বাহিরে তো বৃষ্টি পড়ছে, এই সময় খিচুড়ি টাই জমবে কি বলিস? সাথে আলুভাজা আর চাটনী।
— দারুণ বলেছিস তো। আচ্ছা আমি তাহলে বসিয়ে দেই। তুই সাবধানে কাটিস, হাতে না লেগে যায় আবার।
বোনকে এমনভাবে মিশতে আমি আগে কখনো দেখিনি। আজ ওর চাপা উচ্ছ্বাস, আপন এর মত ব্যবহার মনটাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এই রুপ কোথায় ছিল এত?
ভালোবাসা সত্যিই মানুষকে বদলে দেয়। এইবার ফারহান আর ওর মিল করিয়ে দিলেই আমার মন শান্তি পাবে। রান্না চাপিয়ে বোনকে বললাম,
— আমার বোন তো সংসারী হয়ে যাচ্ছে। এইবার তো বিয়েটা দিতে হয়! আমারো তো একটা দুলাভাইয়ের প্রয়োজন আছে।
বোন লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলিস!
— ফারহান ভাইয়াকে বিয়ের প্রস্তাব টা দিব কি?
— নাহ তুই এখন কিছু বলতে যাস না। সময় হোক, আমিই বলব। আচ্ছা জ্বীনরাজ্য তোর কেমন লেগেছে? সেখানে যাওয়ার-থাকার সৌভাগ্য তো তোর হয়েছে।
— ভালোই লেগেছে। সবকিছু সাজানো-গোছানো। আর সবচেয়ে বড় কথা হল সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে।
বলে বোঝানোর মত নয়।
— ওহ আচ্ছা। জ্বীন তলোয়ারের ব্যাপারে তোকে কেউ বলেনি?
— তুই কি করে জানিস এটার কথা!
— সারাজীবন জ্বীন নিয়ে স্টাডি করলাম এইটুকু তো জানার ই কথা।
— হুম বলেছে। সেটার কাছাকাছি গিয়েও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে। শুনেছি ওটার শক্তি অনেক, ওটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকবার শত্রুরা জ্বীনরাজ্য আক্রমণ করেছে।
— ইস! যদি দেখতে পেতাম একবার।
— এসব দেখার চিন্তা না করাই ভাল। আমরা সাধারণ মানুষ ওসব নিয়ে কি করব বল। ওটা জ্বীনদের সম্পদ, ওদের কাছে থাকা ই শ্রেয়।
বোন আর কিছু বললনা। আমি রান্না সেরে সব ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে মেহরাবকে ডাকতে গেলাম। গিয়ে দেখি ও শার্ট চেঞ্জ করছে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
— চেঞ্জ করে খেতে আসুন।
— তোমার কি আমার দিকে তাকাতে লজ্জা করছে?
— করার ই তো কথা।
— ওহ আচ্ছা, আমি কি পরপুরুষ?
— অতশত জানিনাহ। বলে পালিয়ে যাওয়ার সময় মেহরাব আমার হাত টেনে কাছে জড়িয়ে বলল,
— পালাই পালাই করো কেন? এত পর বরকে কাছে পেয়েছো, কোথায় সারাক্ষণ ফেভিকলের মত জাপটে ধরে রাখবে তা নয়।
— যে থাকার সে এমনিতেই থাকবে। কেন এসেছেন এখানে?
— নিজের বউয়ের কাছে আসতে পারমিশন লাগে। তাছাড়া তুমি নিজেই তো দিনরাত এক করে আমাকে স্মরণ করেছো, কাছে আসার এই সুযোগটা ছাড়ি কি করে!
— আমি কখন স্মরণ করলাম?
— গোলাপটা সবসময় সাথে সাথে রাখো। তাই যখন স্মরণ করো, আমি তা বুঝে যাই। জিভ কামড়ে বললাম,
— এটা তো ভুলেই গেছিলাম। শুনে মেহরাব হাসতে লাগল। আমি মুগ্ধচোখে উনার মুক্তোঝরা হাসি দেখতে লাগলাম।
এই হাসিটা আমার সব অভিমান দূর করে দেয়, তখন ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে অভিমান ঝেড়ে উনাকে মনের সব কথা বলি।
ডাইনিং রুম থেকে বোনের ডাক এল। আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
— চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি আসুন। স্পেশাল ডিস রান্না হয়েছে আপনার জন্য। বলে ডাইনিং টেবিলে চলে আসলাম। ফারহান ও প্রায় সাথে সাথে চলে এসেছে। ওর মুখটা কেমন জানি ভার ভার। আমার চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। বুঝলাম, হয়ত আমার কথাগুলোয় বেচারা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার, ওর জন্য একেক বার একেক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি আমি।
পরিবেশন করতে করতে মেহরাব ও চলে গেল। ফারহান থেকে নেওয়া ডার্ক ব্লু টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার পড়েছেন। যেমন কিউট লাগছে, তেমনি পিচ্চি পিচ্চি লাগছে। গাল টেনে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে।
মেহরাব এতটা মিশুক তা জানা ছিলনা। বোন আর ফারহানের সাথে এত সুন্দর করে মিশে মজা-ঠাট্টায় একদম মাতিয়ে রাখল। খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম উনি পা দিয়ে আমার পায়ে চিমটি কাটছে, এই দুষ্টুটা সবার সামনে আমাকে বিপাকে ফেলে কি যে মজা পায় কে জানে।
খাওয়ার এক পর্যায়ে আফরাহ বলল,
— শালী, খাবারে তো একদম ই টেস্ট পাচ্ছিনা। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে।
— কি নেই? মুশু তুই দুলাভাইয়ের প্লেটে কি দিস নি?
— সব ই তো দিলাম। রান্নাটা ভালো লাগেনি আপনার?
অন্য কিছু বানিয়ে দিব?
— রান্নাটা ভালোই হয়েছে। আফটার অল, আমার শালী রান্না করেছে।
— আপনি কি জানলেন দুলাভাই?
— না মানে, তোমার বোন মাঝে মাঝে উকি দিয়ে পাহারা দিয়েছিলাম তাই আর কি।
এখন কি করা যায় বলতো? আমার তো ভীষণ ক্ষিধেও পেয়েছে।
— কি লাগবে আপনি বলুন?
দুঃখী দুঃখী মুখ করে মেহরাব বললেন,
— সব ই তো আছে। কিন্তু বউয়ের হাতে খাওয়ার স্বাদ টা ই নেই শুধু।
শুনে আফরাহ অট্টহাসি দিল। আমার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। সবার সামনে উনি এটা কি শুরু করলেন! এই ছেলেটা আমাকে লজ্জা দিয়ে দিয়েই মারবে।
— এই মুশু হা করে দেখছিস কি? খাইয়ে দে।
— আমি পারবনা।
— থাক, শালী। সবাই কি আর সবকিছুর মর্ম বুঝে? বর থাকতেও বরের সাথে প্রেম করতে উনার অসুবিধা, না থাকলে তখন কপাল ঠুকত।
— মুশু, এমন করছিস কেন? আমরা ই তো। দুলাভাইকে খাইয়ে দে।
একরাশ লজ্জা নিয়ে উনাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম। যা বলে তা করেই ছাড়ো, এমন ছেলে আমি আর দেখিনি।
দেখব ই বা কি করে, উনি তো আমার একটাই জ্বীনবর।
আফরাহ টেবিলের উপর রাখা ফারহানের হাতে হাত রাখতেই ফারহান উঠে চলে যাচ্ছিল।
— ফারহান আর খাবেননা?
— অনেক খেয়ে ফেলেছি মুশায়রা। আফরাহ ম্যাম, রান্নাটা অনেক ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
আমি বোনের চোখে-মুখে তখন হালকা খুশির ঝলক দেখতে পেলাম। সবাই চলে যাওয়ার পর সব গুছাতে গুছাতে বললাম, ফারহান অনেকটা লাজুক।
— মনে হচ্ছে। সমস্যা নেই, বিয়ের পর দুলাভাইয়ের মত রোমান্টিক বানিয়ে নিব।
সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে এলাম। দেখলাম মেহরাব জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,
— এভাবে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন যে? খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ছিটে গায়ে পড়বে তো।
মেহরাব কোনো উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে জানালার পাশে নিয়ে এসে দাড় করাল। তারপর আমার কোমড় জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে বলল,
— এটাই তো প্রেম করার উপযুক্ত সময়। আচ্ছা তুমি কিভাবে পারলে এতগুলো দিন আমাকে ছাড়া থাকতে?
আমি তো প্রতিটিক্ষণে তোমাকে অনুভব করেছি। খুব ইচ্ছে হয়েছিল তোমার কাছে ছুটে আসার।
কিন্তু তোমার বাড়িতে ঢুকতে চাইতামনা, প্রতিদিন ১বার করে বাহিরে থেকে তোমাকে দেখে যেতাম। খুব ইচ্ছে করত তোমাকে একবার স্পর্শ করি, বুকে টেনে নেই।
— কেন আসতেন? আপনাকে নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ দিলাম আমি, সেটা কাজে লাগাতে পারতেন।
ভালোই থাকতেন মেহেরজানের সাথে।
বলে উনার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তারপর আবার বলতে লাগলাম,
— এটা তো সত্যি আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসতেন। আপনাদের একটা স্বপ্ন ও ছিল, যেটা আমার কারণে তছনছ হয়ে গেছে। আমি তো সেটা আবার বাস্তবায়ন করার সুযোগ দিয়ে সরে এসেছি।
তাহলে কেন এসেছেন এখানে? আমার শাস্তি হচ্ছিল বলে বাচাতে!
মেহরাব আমার মুখ আলতো করে ধরে বলল,
— বউ আমি তোমাকে বেশীকিছু বলবনা। অল্প কয়েকটা কথা ই বলব, জানি তুমি অনেক বুদ্ধিমান সেগুলোর মর্মার্থ তুমি বুঝতে পারবে।
দেখো, আমরা দুজন আলাদা জাতি। আমাদের মধ্যে মিল বা ভালোবাসা কোনোটাই সম্ভব ছিলনা। কিন্তু সব নিয়ম-অসম্ভবতা ছিন্ন করে আমরা এক হয়েছি। একে অপরকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছি। তাই আমাদের একসাথে চলার পথ কখনোই সম্পূর্ণ মসৃণ হবেনা। অনেক বাধাবিঘ্ন আসবেই, অন্যান্য ২-৩টে সম্পর্কের মত সহজবোধ্য নয় আমাদের সম্পর্ক।
আমাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে তোমাকে সেটা তুমিও জানো। তাই বলব এমন ছোট-বড় অনেক কিছুই আসবে যেটা আমাদের সংসার-ভালোবাসাকে তুসের ঘরের মত ভেঙ্গে দিতে চাইবে। এক্ষেত্রে আমরা যদি শক্ত থাকে এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখি তবে কোনোকিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। আশা করি, আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পারবে
বলে উনি চলে যেতে নিলে আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। কাদতে কাদতে বললাম,
— আমাকে ক্ষমা করে দিন। না বুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি । আমি বড্ড অবুঝ হয়ে গিয়েছিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন।
উনি আমার থুতনি ধরে চোখ মুছে দিয়ে বললেন
— এভাবে কাদে কেউ হুম? এইবার থেকে অবুঝ হয়োনা আর। চারপাশে আমাদের দূর্বলতার সুযোগ নেওয়ার লোকের অভাব নেই। তোমার জ্বীনবরটার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। আমি আছি তো!
এত কিছু উপেক্ষা করে যখন তোমাকে পেয়েছি, ইনশাআল্লাহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার হাত কখনোই ছাড়বনা।
বলে আমার কপালে একটা চুম্বন একে দিলেন। দুজন দুজনকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলাম। আজ নিজেকে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এমন বর ক’জন মেয়ে পায় যে এতটা আগলে রাখে, সবকিছু ফেলে বিপদে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ায়।
সারারাত উনার বুকে মাথা রেখে গল্প করলাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সব শুনলেন। সব গল্প ই আমাদের ভবিষ্যতের গল্প, সংসার সাজানোর গল্প। উনি বলেছেন, জ্বীনরাজ্যে একটা সমস্যা চলছে। সেই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেলেই আমাকে নিয়ে যাবেন এবং আমরা নতুন করে সংসার শুরু করব। ঠিক নিজেদের মত করে।
গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
সকালে উঠে দেখি মেহরাবের ঠোটজোড়া আমার কপাল স্পর্শ করে আছে। এতদিনে মনে অনেক স্বস্তি আর আনন্দ পেলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় মেহরাবকে অনেক নিষ্পাপ দেখাচ্ছিল। দুষ্টুমি করে উনার মাথার চুল এলোমেলো করে উঠে এলাম। ফ্রেশ হয়ে দেখি বোন চুপচাপ বাহিরের সিড়িতে বসে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে বোন? এভাবে বসে আছিস কেন?
বোন কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
বোন কিছু বলতে না পারল না কেবল ফারহানের নামটাই নিল। আমি আর দেরী না করে ফারহানের রুমে চলে গেলাম। দেখলাম ও তার ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত।
— ফারহান, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
— আমি আর এই চাকরীটা করবনা, তাই চলে যাচ্ছি।
— মানে কি? বললেই হল যে চলে যাবেন।
আপনি কোথাও যাচ্ছেন না। আপনি এই বাড়ির জামাই হয়ে থাকবেন।
— আমাকে ক্ষমা করবেন মুশায়রা। আপনাদের দেওয়া প্রস্তাবে আমি রাজি নই। আপনারা আমাকে আপনাদের হাতের পুতুল ভাবতে পারেননা।
যখন যে ভাবে খুশি অপমান করবেন, তারপর নতুন করে মন ভাঙ্গার সুযোগ নিবেন।
— আপনি এসব কি বলছেন? আমার বোনকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি কিসের! ও আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
— ঠিক ই বলছি। মনে একজন রেখে মুখে আরেকজন স্বীকৃতি দিতে আমি পারবনা।
— আপনি তাহলে আগে বলেননি কেন আপনার মনে অন্য কেউ আছে?
— আগে জানতামনা। আর যে আছে সে আমার হবেনা, এইজন্য আমিও কারো হতে চাই। যে মনে আছে, তাকে নিয়েই বেচে থাকতে চাই।
— আমার বোনের কি হবে? এভাবে ওর মনটা আপনি ভেঙ্গে দিতে পারলেন?
— আপনার বোনকে আপনি সামলে নিবেন। তাছাড়া এত স্বার্থপর আর উগ্র মেয়ের মন এত সহযে ভেঙে যাবেনা। আপনার বোন তাই হয়ত আপনি অনেককিছু ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু আমি আপনার মত এতটাও মহৎ নই।
এমন একটা স্বার্থপর মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবন বরবাদ করতে পারিনা। ভাল থাকবেন আপনারা।
বলে ফারহান ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল, আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলনা।
আফরাহ ফারহানের পথ আটকে বলল,
— তুমি যদি এখন এখান থেকে চলে যাও, সত্যিই অনেক খারাপ কিছু হবে।
— আপনারা দ্বারা খারাপ কিছু করাই সম্ভব। এসব বলে আমাকে আটকাতে পারবেননা। আসি।
বলে ফারহান বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। বোন কাদতে কাদতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক করে ডাকলাম তাও দরজা খুললনা। এই মূহুর্তে আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছিনা।
.
(চলবে)
জ্বীনবর_৫?
পর্বঃ২৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মেহরাবকে ডেকে বলতে গিয়েও কিছু বললামনা। এমনিতেই বেচারা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত থাকে, এতদিন ধরে মেন্টাল ডিপ্রেশন এর ধকল সামলেছে । আমি বোনকে বুঝিয়ে নিব, ফারহানকে যাতে ভুলে যায়। কত আশা করেছিলাম, ফারহানের সাথে বোনের মিল হলে বোনটা সুখে থাকবে। ফারহানকে পেয়ে বোন অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখেছিল, আর ছেলেটা কোনো কারণ ছাড়াই সব ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেল। পুরুষজাতিকে বুঝা আসলেই দায়!
বোনকে খাওয়ার জন্য ডাকলাম কয়েকবার, জবাব দিল খাবেনা। খুব বেশী ভেঙ্গে পড়েছে ও। কিন্তু এভাবে চললে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে, তখন কি হবে!
মনে মনে ভয় হল এই মনভাঙ্গার কষ্ট থেকে বোন আবার উলটাপালটা কিছু করে না বসে। বোনের রুমের জানালাটার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলাম বোন কি করছে। মনে মনে যা ভয় করছিলাম তাই হল। বোনের হাতে ধারালো ব্লেড, কাদতে কাদতে হাতের রগের উপর ধরে রেখেছে। জোর চিৎকার করে ডাকলাম বোনকে। ও আমাকে দেখতে পেয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিল। দিগ্বশূন্য হয়ে পড়লাম আমি, কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি গিয়ে মেহরাবকে ডাকতে লাগলাম, এখন কিছু একটা করলে মেহরাব ই করতে পারে। মেহরাব সবটা শুনে অবাক হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বোনের রুমের দরজা ভাঙ্গল। ঢুকে দেখলাম, বোনের অবশ শরীর মেঝেতে পড়ে আছে। হাত থেকে অনবরত বের হওয়া রক্তে মেঝে ভেসে গেছে। এই অবস্থা দেখে আমি হাউমাউ করে কাদতে শুরু করলাম। বোন এটা কি করল!!
এতবছর যে বোনটাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দেইনি, আজ সে কষ্টে ছটফট করছে। মেহরাব তার আঙ্গুল আফরাহর নাকে কাছে ধরে বলল, এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। মেহরাব আফরাহকে পাজকোলা করে বাড়ির বাহিরে নিয়ে গেল, একটা গাড়ি থামিয়ে আমিসহ হাসপাতালের দিকে ছুটল। ডাক্তার ভিতরে বোনকে দেখছে। আমি ওয়েটিং রুমে বসে কাদছি, মেহরাব আমার মাথাটা তার বুকে রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
— চিন্তা করোনা বউ। সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি জ্বীনরাজ্য থেকে ওর জন্য ভেষজ এনে দিব। ক্ষত উবে যাবে, একটু শান্ত হও।
— এমন কেন হল মেহরাব! আজ যদি বোনের কিছু হয়ে যেত, আমি নিজেকে কি বলে বুঝ দিতাম?
— আফরাহ এমন একটা জঘন্য কাজ কেন করতে গেল?
— ফারহানের জন্য। ও হয়ত ফারহানকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল, ফারহান তা রিজেক্ট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেছে। আর তাই বোন….
— বুঝতে পেরেছি। চিন্তা করোনা, ফারহানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। তার আগে আফরাহকে পুরোপুরি সুস্থ করতে হবে। ডক্টর বেরিয়ে এসেছেন, আমি আফরার অবস্থা জেনে আসি। তুমি বসো।
মেহরাব ডক্টরের সাথে কথাবার্তা সেরে আবার ফিরে আসল। আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
— শোকর আল্লাহ। আফরাহ এখন ঠিক আছে, হাতের শিরা কাটেনি তেমন। আপাতত সেলাই করে দিয়েছেন। শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় এখনো দূর্বল।
খেয়াল রাখতে বলেছেন, চাইলে আজ ই ওকে নিয়ে যেতে পারব। আমি মোনাজাত ধরে বললাম,
— আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া। উনার রহমতে বোন বেচে আছে। আল্লাহ তুমি ওকে সুস্থ করে দাও।
মেহরাব, আমি কি এখন ওর কাছে যেতে পারব?
— হ্যা পারবে। তুমি যাও, আমি গাড়ি ডেকে আনি। সাথে রিলিজের ব্যবস্থা করছি।
গুটিগুটি পায়ে বোনের কেবিনের ভিতর ঢুকলাম। বোন চুপচাপ পাথরদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
— এসব কেন করতে গেলি বোন?
আফরাহ শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ভালোবাসার মানুষ হারানোর কষ্ট বুঝলে এটাও বুঝবি।
— এসব কোনো সমাধান। যদি মরেই যাস, তবে তোর ভালোবাসাকে নিজের করে পাবি কি করে?
— সে তো, বেচে থেকেও পাবনা।
আর বেচে থেকে হারানোর যন্ত্রণায় তিলে তিলে মরতে পারবনা।
— তোর কি আমার উপর একটুও ভরসা নেই?
— আমার এখন নিজের উপর ই ভরসা নেই। কেন বাচালি বল তো, এখন প্রতিটি মূহুর্তে বেচে থেকেও মরব।
— নিজেকে একটু শক্ত করো, বাড়ী ফিরে চল। এসব কথা এখন থাক। আগে তোর সুস্থ হওয়া বেশী প্রয়োজন।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে বোনকে নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম। বোনকে এক মূহুর্তের জন্য ও একা ছাড়লামনা। ওকে হারানোর ভয়টা মনে জাপটে বসে আছে। ওর রুম পরিষ্কার করে ওকে এনে শুইয়ে দিলাম। ওর চোখ থেকে এখনো পানি ঝড়ছে। নিজের কাছে এত খারাপ লাগছে।
আমার রুম থেকে মেহরাব আমাকে ডাকল। বোনের কাছে বুড়িমাকে বসিয়ে রেখে আমি মেহরাবের কাছে এলাম।
মেহরাব আমার হাতে একটা কৌটা ধরিয়ে দিল এবং বলল,
— এটা ঘুমানোর আগে আফরাহের হাতের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিও। ইনশাআল্লাহ সেরে যাবে, লাগানোর আগে আল্লাহর কালাম পড়ে মোনাজাত করে নিও।
আমি মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— আপনি আমার জন্য রহমতস্বরুপ। আপনি না থাকলে আজ কি হত আমি কল্পনা করতে পারছিনা।
— তুমি আমার স্ত্রী। তোমার সবকিছুতে পাশে থাকা আমার দায়িত্ব। কথা দিলাম, ইনশাআল্লাহ তোমার সব রকম পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে পাশে পাবে। আল্লাহ ছাড়া কেউ কখনো আমাদের আলাদা করতে পারবেনা।
— তাই যেন হয়। সারাজীবন আপনার ছায়াতলেই যেন আমি বাচতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তওফীক দান করুন।
— আমীন। তুমি আফরাহর কাছে যাও, ওকে বেশীক্ষণ একা রাখা ঠিক হবেনা। মনে করে এটা হাতে লাগিয়ে দিও।
— আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
— আমাকে একটু জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে। চিন্তা করোনা, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ততক্ষণ তুমি নিজের এবং আফরাহর খেয়াল রেখো।
— আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন। দাদীমাকে আমার সালাম জানাবেন। ফি-আমানিল্লাহ।
মেহরাবকে বিদায় জানিয়ে আফরাহর জন্য স্যুপ নিয়ে ওর রুমে গেলাম। পাশে বসে বলল,
— বোন, এই স্যুপটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। তোর শরীর এখনো অনেক দূর্বল।
— আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা মুশু। নিয়ে যা তুই।
— এসব বললে কি করে হবে? না খেলে আরো অসুস্থ লাগবে। এত ভেঙ্গে পড়িসনা তুই।
— সুস্থ থাকব কার জন্য! কিছুই ভালো লাগছেনা আমার।
আমি বোনের হাত আলতো করে ধরে বললাম,
— আমি তোকে কথা দিচ্ছি, ফারহানকে আমি তোর কাছে ফিরিয়ে আনব। খুব তাড়াতাড়ি ও তোর ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিবে। আমার উপর একটু ভরসা রাখ।
— তুই কথা দিচ্ছিস?
— হ্যা, আমি কথা দিচ্ছি। তুই জানিস, আমি নিজের কথার খেলাফ করিনা। একটু বিশ্বাস কর, তুই পুরোপুরি সুস্থ হলেই আমি ফারহানকে তোর কাছে নিয়ে আসব।
বোনকে কিছুটা স্বস্তি পেল। বোন খাইয়ে ওষুধ লাগাতে লাগাতে ভাবলাম, কথা তো দিয়ে দিলাম। এই কথার মান কি আমি রাখতে পারব? পরক্ষণে ভাবলাম, কথা যখন দিয়েছি যে করেই হোক তার মান আমি রাখব। বোনের মুখে হাসি ফুটিয়ে তাকে সুখী করব।
মাঝরাতে আফরাহর ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবছা আলোয় দেখলাম তার রেকিং চেয়ারে কেউ বসে বসে দোল খাচ্ছে। আফরাহ একটু ভয়ে ভয়ে বলল, কে ওখানে?
আগন্তুক চেয়ারটা ঘুরিয়ে বলল, আমি।
আফরাহ কালো মুখোশ পড়া আগন্তুককে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তাও সাহস করে বলল,
— কে আপনি? এভাবে মুখোশ পড়ে আছেন কেন? আমার রুমেই বা ঢুকলেন কি করে! মুশু… মুশু…..
— চুপ! একদম চুপ। চিৎকার না করে আমার কথা ভালো করে শুনো। আমি বিশেষ কেউনা, ধরতে পারো তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।
তোমার ব্যাপারে আমি প্রায় সব ই জানি। তুমি তোমার বোনের প্রতি এতবছর ধরে চাপা রাগ পুষে আছো। কয়েকবার জ্বীন দিয়ে তোমার বোনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছো।
শুধু ক্ষতি ই নয়, মেরে ফেলতেও চেয়েছো। কিন্তু প্রতিবার ই ব্যর্থ ফলাফল পেয়েছো। ঠিক বললামনা?
আফরাহর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। কোনোরকম হাতের তালু দিয়ে মুছার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললাম, এসব বাজে কথা আপনাকে কে বলেছে?
— উহু, একটাও বাজে কথা নয়। এটাই সত্যি।
— আপনি কে? কি চান বলুন তো!
— এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আস্তে আস্তে সব বলব।
তুমি কি জানো, আজ তোমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? শুধুমাত্র তোমার সৎ বোন মুশায়রা।
সৎ শব্দ টা শুনে আফরাহ চমকে উঠল। এই কথাটা আফরাহ আর তার পরিবার ছাড়া বাহিরের কেউ জানেনা, এমনকি মুশায়রাও না। তাহলে এই আগন্তুক জানলেন কিভাবে? আসলে উনি কে!
— চমকে গেলে তাই তো! আমি আরো অনেককিছুই জানি। ফারহান তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ ও তোমার বোন। কারণ, ফারহান তোমাকে নয় তোমার বোনকে ভালোবাসে এবং তাকেই চায়।
তাই তোমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে ও চলে গেছে। এসব কিছুর জন্য একমাত্র দায়ী মুশায়রা।
তাছাড়া মুশায়রা নিজেও চায়নি তুমি সুখী হও, ফারহানকে আকড়ে ধরে তুমি ভালো হতে চেয়েছিলে, ভালো থাকতে চেয়েছিলে মুশায়রার সেটা সহ্য হয়নি। তাই ও ছলে-বলে ফারহানকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
— এসব কি বলছেন আপনি?
— এসব ই সত্যি। তোমার বোন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে তোমার ক্ষতিটাই করে এসেছে। কখনো তোমাকে বোন ভাবেনি, নিজের স্বার্থটাই দেখে এসেছে।
নাহলে বলো পারত তোমাকে না জানিয়ে একটা জ্বীনকে বিয়ে করে নিতে।
ভাবো আফরাহ ভাবো।
— সত্যিই মুশু আমার সাথে অন্যায় করেছে। এর যোগ্য শাস্তি ওকে পেতেই হবে।
— তুমি যদি আমার কথামত কাজ করো তাহলে তোমার দুটো লাভ হবে। এক. তোমার বোনকে যোগ্য শাস্তি দিতে পারবে এবং দুই. ফারহানকে তুমি ফিরে পাবে।
এখন বলো, তুমি কি আমার শর্তে রাজি?
— আমি রাজি। কিন্তু এখানে আপনার লাভটা কি?
অকারণে কেউ কাউকে সাহায্য করেনা।
আগন্তুক হেসে বলল, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমারো লাভ আছে, কিন্তু সেটা সময় এলেই জানতে পারবে। এসো হাত মিলাই, আজ থেকে মুশায়রা ধবংস শুরু।
বলে আগন্তুক উচ্চস্বরে হাসতে লাগল, সে হাসিতে তাল মিলাল আফরাহ ও।
.
(চলবে)