ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #পর্ব_১৬,১৭

0
333

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_১৬,১৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
১৬

সকাল ৮ টা নাগাদ ইরফানের ঘুম ভাঙে । ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হতেই সাড়ে ৮ টা । টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে পূর্বের ন্যায় বেলী সব নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে । ইরফান আর তেমন কোন কথা বলে নি , নাস্তা খেতে বসে যায় সে । কিছুক্ষণ পর বেলী চা নিয়ে ইরফানের কাছে যায় । চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীকে একা রেখেও যেতে ইচ্ছা করতেছে না তার । অন্যান্য দিন তো মিনু বাসায় থাকে ৷ আজকে সেও নাই । মেয়েটা এখনও আসে নি বাসায় ।

– একা থাকতে পারবা ?
– হু ,
– ভয় লাগবে না ?
– উহু ,
– আমার আজ অফিসে যেতেই হবে না হয় আমি থাকতাম ।
– আমি যখন থাকবো না তখন ?
– মানে ?
– কিছু না , আপনি খান ।

ইদানীং বেলীকে অনেক অচেনা লাগে ইরফানের কাছে । বেলী কি বলে , কি করে , কি বলতে চায় , কি করতে চায় কিছুই বুঝে না সে । তবে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা শান্তি আসে মনে তার । দেখতে দেখতে ইরফানের অফিসের সময় হয়ে যায় , তখন আর কিছু না বলেই ইরফান চলে যায় অফিসে । পুরো বাসায় আজ বেলী একা । একা মস্তিষ্কে অনেক কিছুই ভর করে । জানালার কাছে গিয়ে গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখছে বেলী । নীল আকাশে কয়েকটা পাখি উড়ে যায় । বেলীর নিজেকে পাখি মনে করতে চায় । পাখিরা যেমন স্বাধীন তেমনি সেও স্বাধীন হয়ে উড়তে চায় । যেখানে থাকবে না কোন কষ্ট , থাকবে না কোন গ্লানি । শুধু দুচোখ ভরা ভালোবাসা আর স্বপ্ন মাখা কিছু মিষ্টি অনুভূতি ।

তুমি উড়বে আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে
তুমি উড়বে আকাশে শত ভালোবাসার
তারা হয়ে
আমি চাই গো তোমায় আপন করে
যদি দেও একটু সাড়া ভালোবেসে

মুহুর্তের মাঝেই চারটা লাইন মনে পড়ে যায় বেলীর । বহুদিন আগে কেউ একজন মোড়ের মাথার দাঁড়িয়ে তার জন্যে এই চারটা লাইন বলেছিল । লাইনের সাথে সাথে মানুষটার চেহারা টাও মনে পড়ে যায় তার । সেদিনের মানুষটা আপন হতে হতেও হলো না ।
বেলীর রাজুর কথা মনে গেছে । ছেলেটা বড্ড মায়াবী ছিল । এক কথায় বেলীকে খুব পছন্দ করতো সে । তার কাছে বেলী শুধু বেলী ছিল না , তার কাছে বেলী ফুল হয়ে ছিল । বেলীকে সে ফুল বলে ডাকতো , শুধু ফুল । গায়ের রঙ হালকা শ্যামলা রঙের বলে সে বেলীকে কালচে ফুল নাম দিয়েছিল যদিও এটা মজা করে বলতো । এটা বেলীর জানা ছিল । একদিন কলেজ থেকে আসার পথে , পথ আগলে ধরেছিল রাজু । হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে । আজও ডাকটা কানে ভাসে বেলীর । রাজুর ডাকে অনেক মায়া ছিল সেইদিন । যখন সে ‘ কালচে ফুল ‘ বলে ডাকতো বুকের ভেতরটা মায়ায় ছেয়ে যেতো । নিজের থেকে ছোট বলে তুই তুই করে ডাকতো বেলীকে সে । সেদিন দুপুরের পথ আগলে ধরাটা ছিল অন্যরকম ।

– কালচে ফুল,,,,,,,,,, দাঁড়া
-……………
– এই দাঁড়া ,
– আপনে আমারে কালচে ফুল ডাকেন কেন ?
– হুর কালি , কালিরে কালি বলবো না তো কি বলবো ?
– হুহ , তাইলে আর ডাকবেন না কখনো ।
– ওরে ওরে কালচে ফুল রাগও করে , ওই দেখো ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যায় । দাঁড়া না প্লিজ ,
– কি হইছে ?
– এইটা নে ,
– কি এইটা ?
– খুলে দেখ ?

বেলী খুলে দেখে ঠোঙা ভর্তি বেলীফুল রাখা আছে । বেলীফুল গুলো একদম তর তাজা , একদম সতেজ । বেলীফুল গুলো নিজের হাতে পেয়ে বেলী নিজেকে সব থেকে খুশি মানুষ ভাবে সে সময় । ঘ্রাণ নিতে থাকে সে বার বার ।

– রাজু ভাই , আমার জন্যে আনলা ?
– হু ,
– কই থেকে আনলা গো ?
– আমার গাছের ,
– অনেক সুন্দর ফুল গুলা ।
– তোর কাছে এর সৌন্দর্যও ব্যর্থ রে ।

রাজুর কথায় হাসিমুখে মুহুর্তের মাঝেই লজ্জার আবরণ পড়ে যায় । ‘ আমি যাই ‘ বলে বেলী সামনে পা বাড়াতেই রাজুর ডাকে পা জোড়া আটকে যায় তার ।

– কি হইলো ?
– চলে কেন যাস ?
– বেলা বাইরা যাইতাছে , মায় বকবো পরে ।
– কালকে দেখা করবি ?
– কই ?
– মিয়াগো পুকুর পাড়ে ।
– ও মা গো , ওইদিকে যামু না , দেইখা ফেললে মায়ের কাছে খবর যাইবো গা লগে বাবার কাছেও ।
– তাহলে আসবি না ?
– পারলে আসমু ,
– ওই কালি দাঁড়া ,

..

কলিংবেলের আওয়াজে ধ্যান ভেঙে যায় বেলীর । এতক্ষন ভাবনার জগতে ছিল বেলী । অতীতের কিছু কিছু দিক হঠাৎ করে মনে পড়ে মনটাকে কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ করে দিয়ে যায় । ওড়নাটা দুই পেচ করে পেচিয়ে মাথায় দিয়ে দরজার কাছে যায় বেলী । দরজা খুলতেই একটা চিৎকার শুনতে পায় বেলী ।

– আয়ায়ামিইইইইই আইয়া ফচ্চি ভাবীইইই
– আরে মিনু !
– হ হ আমি মিনু , আইয়া ফচ্চি ।
– এসো এসো , এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলা ?
– ও মোর খোদা , আপনে কি কন ভাবী , কয়টা বাজে দেখছেন নি , ১১ টা বাইজ্জা গেছে ।

মিনুর কথায় বেলী ঘড়িতে নজর দেয় । আসলেই ১১ টা বেজে গেছে । কখন যে এত সময় পাড় হয়ে গেল বলতেও পারবে না সে । মিনু আবার তার কথার মেশিন স্টার্ট করে ফেলে ।

– ও ভাবী , কি ভাবেন এত ?
– কই না তো , কিছু না
– ভাইয়ে কই , গেছে গা কামে ?
– হুম ,
– আইচ্ছা কন কি কি কাম করতে হইবে ?
– কিছু করতে হবে না তুমি আগে রেস্ট করো ।
– আরে আমি ঠিকাছি , আইয়েন আইয়েন কইয়া দেন কি কি করা লাগবো ।

এমন সময় ইরফানের রুমের দিকে নজর যায় মিনুর । উকি দিয়ে দেখে রুবি নেই রুমে । এই আবার শুরু করে মেশিন ,

– খবিশডায় কই ,
– কে ?
– রুবি খবিশডায় কই আইয়ে না হেতি ?
– ছিহ মিনু এইসব বলো না , সে খবিশ না সে তো মানুষ তাই না ?
– থামেন থামেন , সতীনের গীত কইয়েন না , আইয়ুক নাইলে মরুক আমার কি , আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।

মিনু মনে মনে ১০০ গালি দিতে দিতে রুবির গুষ্ঠির ষষ্ঠী পূজা করতে করতে কাজে লেগে যায় । বেলীও এইদিকে সব গুছিয়ে দুপুরের রান্নার কাজে লেগে যায় । আজান পড়ে গেলে গোসল করে নামাজে দাঁড়ায় সে । নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে যেইনা দাঁড়িয়েছে , ওমনি আবার কলিংবেল বেজে ওঠে । বেলী জায়নামাজ টা রেখে দরজা খুলতে যায় । বেলী দরজা খুলে চমকে যায় । যদিও এটা চমকানোর মত কিছু না । এটা তো হওয়ারই ছিল । দরজায় রুবি দাঁড়িয়ে আছে । বেলীকে সাইডে ধাক্কা দিয়ে রুবি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় । রান্নাঘর থেকে আবার মিনু রুবিকে দেখে ফেলে ।

– শয়তানের নামডা যে কিত্তে নিছিলাম , শয়তানের নাম নিছি সকালে , শয়তান দুফুরে হাজির । এত মানুষ মরে এই শয়তান মরে না । অসিভ্য মাতারি একডা।

ইচ্ছামত রুবিকে বকতে থাকে মিনু । মোট কথা মিনু রুবিকে দেখতেই পারে না । তাই এত কটাক্ষ করে রুবিকে তবে তা অবশ্য রুবির অগোচরেই ।

রুবি এসেই পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে । বেলীর সাথে অনর্থক বাড়াবাড়ি করছে সে । বেলীকে ইচ্ছে করেই বকছে , উউল্টাপাল্টা মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে সে । তবুও বেলী একদম চুপ করে আছে । বেলীর নিজেকে এখানে এখন বড় বেশি অসহায় লাগে । এইভাবে নিংড়ে নিংড়ে মরতে হবে তাকে । অহেতুক চিল্লাচ্ছে রুবি বেলীর উপর ।

বিকেলের শেষের দিকে বেলী রুমে শুয়ে আছে । সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্তু সে । কাজ করা আগেই শেষ হয়েছিল কিন্তু রুবি এসে আবার তার জামাকাপড় গুলো বেলীকে দিয়ে ওয়াস করায় । এই সব কাজ করতে কর‍তে বেলী খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে । শোয়ার পরেও বেলীর চোখে ঘুম আসে নি । ঘুরে ফিরে মাথায় একই ভাবনা কাজ করে যায় । কি হবে তার ভবিষ্যত । কিভাবে থাকবে সে এখানে । এরই মাঝে রাজুর কথা মনে পড়ে তার । রাজুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১ বছর আগে যেদিন রাজু একেবারেই ঢাকা চলে আসবে তার আগের দিন সন্ধ্যায় । বেলীকে বাধ্য করেছিল সে তার সাথে দেখা করতে । সেদিন বেলী গিয়েও ছিলো তার সাথে দেখা করতে । চারপাশে অন্ধকার নেমে যায় আর সেই আঁধারের মাঝে চুপিসারে রাজুর সাথে কথোপকথনের ঢল পড়েছিল বেলীর ।

– এই কালি , এত দেরি করলি কেন রে
– তো কি করতাম ?
– মশার কামড় গুলা আমি খাইছি
– ভালো হইছে
-…………..
– রাজু ভাই,,,,,,,?
– হুম ,
– সত্যিই কি কালকে চইলা যাবেন ঢাকা ?
– হু
– আসবেন না আর ?
– আসবো তো ,
– রাজু ভাই ,,,,,,,,,?
– বল ,
– ভয় লাগে অনেক ,
– চাকরি টা আরেকটু পাকা পক্ত করে আবার আসবো তখন তোর বাবার সাথে কথা বলবো আমি ।
– সত্যি তো ?
– হ্যাঁ রে সত্যি , বল কি আনবো তোর জন্যে
– কিছু লাগবো না আমার ,
– কেন ?
– আপনে আসলেই হবে ।

কথা গুলো মনে পড়ে গিয়ে এক গাল হেসে দেয় বেলী । ওইটাই ওদের শেষ দেখা ছিল । কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সে এখন বিবাহিতা । তার স্বামী আছে আর রাজু এখন পর পুরুষ । তাই তার কথা মনে আনাও পাপ । কিন্তু বেহায়া মন টা কেন যেন বেশি করে মনে করিয়ে দেয় তাকে । পরিস্থিতি সব গোলমেলে লাগে বেলীর কাছে । সেই সময় সবে মাত্র মনটা রাজুতে বসেছিল আর তখনই নিয়তি ইরফানকে বসিয়ে দেয় । সেই থেকে সব টাই শেষ । ভাবনার সাথে বাস্তবতার মিল কখনোই ছিল না ।

– আমার নিয়তিই আমায় বার বার ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে । আমি কি কখনো ভালো থাকতে পারবো না । কপাল টা খারাপ মানি কিন্তু এত খারাপ হবে ভাবি নি । আমার জীবন টা একটা কালো অন্ধকার যেখানে আলোর রেখা নিয়ে দাঁড়ানোর কেউই নেই ।

নিজে নিজেই কথা গুলো সাজাতে থাকে বেলী । ইদানীং মনটাই তার সব থেকে কাছের । মনের সাথেই সব বলা যায় । আত যাই হোক মন কখনো ধোঁকা দেয় না । এরই মাঝে রুবি অনেক জোরে জোরে বেলীকে ডাকতে থাকে ।

– বেলী , ওই বেলী , বেলী , মরছিস নাকি , সাড়া দেস না কেন ?

মরার কথা শুনে বেলীর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠে ।

– হ্যাঁ , হয়তো একদিন আমাকেও এই রঙ্গমঞ্চের মায়া ত্যাগ করতে হবে । যত পারো নিংড়ে নাও আমায় । আমি কিছুই বলবো না !!

বেলী এইটা বলতে বলতে তাড়াতাড়ি রুবির কাছে চলে যায় ।

.
.

চলবে…………………….

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_১৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রুবির ব্যবহার গুলো অনেকটা চাড়ালের মত । মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সাথে তার এমন ব্যবহার গুলো মেনে নেয়ার মত না । বেলী এখানে নিতান্তই অসহায় । তাই ছাড়তেও পারে না থাকতেও পারে না । ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছে সে । শত হোক সে তার স্বামী । বিয়ে তো তাকেও করেছে । থাকুক না সতীন ক্ষতি কি তাতে ? স্বামী সংসার কিছুই ছাড়তে পারবে না সে । এখানে দুটো জিনিস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় , এক গ্রামে তার শ্বশুরের সম্মান দুই তার নিজের মায়ের সম্মান । বেলী কাউকে বলতেও পারে নাই যে তার স্বামী বিয়ে আরেকটা করেছে এতে তার শ্বশুরের মান সম্মান সব যাবে আর তার মা হয়তো শোকটাই নিতে পারবে না । আর যাই হোক কোন মা নিশ্চয়ই চাইবে না তার মেয়ে আর যাই হোক সতীন নিয়ে যাতে সংসার না করে সেখানে তার মেয়ে নিজেই সতীনের সাথে থাকছে তাও এক বাড়িতে । এই শোকটা সে মানতে পারবে না । আবার ছেড়ে চলে গেলে আরও বদনাম । গ্রামের সবাই তার মায়ের মুখে চুনকালি মারবে । সব দিক দিয়েই বেলী আটকে পড়ে গেছে । পরিস্থিতি এত খারাপ যে এর বিকল্প কোন পন্থা নেই । যেই পন্থাতে যাবে তাতেই কোন না কোন বাঁধা ।
আর এদিকে মিনুর রুবিকে একদম সহ্য হয় না । মিনু ভেবে রেখেছে আজ ইরফান বাসাতে এলেই রুবির নামে সব বলবে । যা সত্যি তাই বলবে পারলে আরও বানিয়ে বানিয়ে বলবে । মিনু কথা দারুণ বানায় । বেলীকে নিজের রুমে ডেকে পাঠায় রুবি । বেলীও যায় সেই রুমে । বেলীকে রীতিমত চোখের বিষ ভাবে রুবি । কেন জানি তার সহ্য হয় না বেলীকে । তাই সেও চাইছে যে কোন একজন এই বাড়িতে থাকবে । আর সেই একজনটা সে-ই হবে । এর জন্যে যতটা করা লাগবে সে করবে যতটা নিচে নামার সে নামবে । বেলীকে দেখে তার মেজাজ আরও গরম হয়ে যায় তার । বেলীকে টর্চার করে রুবি এক রকম পৈশাচিক আনন্দ পায় তার কারণ , শত কিছু হয়ে গেলেও বেলী টু শব্দ করে না আর ইরফানের কাছে তো ভুলেও বলে না । আর এটারই সুযোগ নেয় রুবি ।

– তোকে যে আমি এতক্ষন ডাকলাম , কানের মধ্যে কি দিয়ে রাখছিস , শুনিস নাই ?
– আমি তো ডাকার সাথে সাথেই আসলাম ।
– বাপরে বাপ, ভালো চোপা লাড়াস তো তুই ? এত সাহস পেলি কোথা থেকে ?
– কিছু বলবেন ?
– কেন কষ্ট লাগে নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে ?
– নাহ ,
– তা তোর বাড়িতে ইরফান ছিল ?
– হু ,
– ঘুমিয়েছে কই রাতে ?
– ঘরেই ।
– আর তুই ?
– আমিও ঘরেই ঘুমাইছি ।
– ওহ আচ্ছা এইজন্যই বলি ইরফান রাতারাতি মাগুর মাছ কোথায় পেলো ?

রুবির নোংরা মানসিকতার নোংরা ইংগিত টা বেলীর বুঝতে সময় লাগে নি । খুব বিশ্রী লাগছিল কথা গুলো শুনতে । তাই নিজেই সাহস করে দুইটা কথা বলে ,

– আপনি যা ভাবছেন তা নয় , এইসব কিছুই হয় নাই ।
– সব জান্তা হয়ে গেছিস দেখতেছি ।
– নাহ , শুধু যতটুকু বুঝার তাই বুঝছি , আর কিছু না ।

রুবির মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় । বিশ্রী ভাষায় বেলীকে গালি দেয় সে । তারপর খাট থেকে এসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় বেলীকে । চড়টা খেয়েও বেলী সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে । একটা আওয়াজও করে নাই ।

– টিভির মধ্যে যেই রাক্ষুসি গুলা থাকে তেমন হলি তুই । ১০০ রঙ তোর , অভিনয় করস তুই । গ্রামে গিয়ে কি তাবিজ করছিস ইরফানকে , কি তাবিজ করছিস বল ।

রুবির কথা শুনে বেলী অবাক হয়ে যায় । এত শিক্ষিত হয়ে এত বাজে চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আসে কিভাবে । তখন বেলী আবারও বলে ,

– যদি তাবিজ করার হতো আমি তার জীবনে আপনার আসার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না । তার আগেই তাবিজ-তুমার করে নিজের বশে রাখতাম তাকে । আর আপনি তো তার স্ত্রী যাকে সে আব থেকে বেশি ভালোবাসে অথচ এই আপনি তাকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । এখানে আপনার বিশ্বাস ডগমগিয়ে যাচ্ছে

বেলীর কথা শুনে রুবি চুপ হয়ে যায় । ভাবতে থাকে ওর এত সাহস হয় কিভাবে , যে ও রুবির সামনে মানে তার সামনে দাঁড়িয়ে এত স্ট্রংলি কথা বলে যাচ্ছে । কিভাবে সম্ভব এটা ? সে চায় শুধু সে বলবে আর বেলীকে সব শুনতে হবে এবং মানতে হবে । বেলীকে চুপ করানোর জন্যে আরও বাজে ভাবে বেলীকে একিউজ করে রুবি ।

– অশিক্ষিত থার্ড ক্লাস মানুষ , কি যোগ্যতা আছে তোর যে তুই ইরফানের সাথে দাঁড়াবি । নিজের চেহারা আয়নায় দেখছিস , এই চেহারায় আসছে ইরফানের বউ হতে । ওর সাথে কেবল আমাকেই যায় তোকে নয় ।

এইবার বেলী আরেকটু বলে ,

– আলহামদুলিল্লাহ , আমি অনেক খুশি যে ওনার সাথে কেবল আপনাকেই যায় । আপনি শিক্ষিত দেখতেও সুন্দর । সব গুন আছে আপনার মাঝে তাহলে দাঁড়াতে কেন পারছেন না ওনার সাথে । বিশ্বাস কেন রাখতে পারছেন না ওনার উপর ।
– সেটা তোকে নিশ্চয়ই বলবো না আমি ।
– আইন অনুযায়ী আমি এখনও ওনার স্ত্রী , আমি থাকা অবস্থাতে উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এটা দিয়ে থানায় মামলা করলে কেইসটা আমার পক্ষেই আসবে । আর আমি পড়াশোনা কম করছি তাই বলে অশিক্ষিত নই । আর অহেতুক আমাকে জ্বালিয়ে কি লাভ বলেন তো ? আমি না আগেও আপনাদের মাঝে ছিলাম না এখনও আছি আর না ভবিষ্যতেও থাকবো । কোন কাজ থাকলে বলবেন আমি সব করে দিবো তবে এইসব বাজে কথা আর বলবেন না ।

এইসব বলে বেলী রুম থেকে বের হয়ে যায় । রুবি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও অবদি । বেলীর কথা গুলো তার পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে । রুবি ভেবেছিল কি আর হয়েগেছে কি । বেলীর মুখে বুলি ফুটেছে । এইবার রুবির আরও সচেতনতার সাথে খেলতে হবে । এইসবই ভেবে যাচ্ছে রুবি ।

রুমের পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা গুলো শুনছিল মিনু । রুবিকে বলা বেলীর কথাগুলো শুনে অনেক খুশি মিনু । এতদিন পর বেলী কিছু তো বলেছে রুবিকে । এটাই বা কম কিসের ? তাই সে আজ একটু হলেও অনেক খুশি । যতটা খুশি সে বেলীর উপর ততটাই ক্ষিপ্ত সে রুবির উপর । কারণ , রুবি আজকে একদম অতিরিক্ত করে ফেলছে । মিনু হাসি মুখে বেলীর রুমে যায় ।

– ভাবী ,,,,,,,,?
– হুম ,
– আইজ্জা তো ফাটাইয়া দিছেন আপনে ।
– কি ?
– ডাইনীটারে ইচ্ছামত কথা শুনাইছেন ,
– ডাইনী কেন বলো , সেও তো মানুষ ।
– মানুষ , কিন্তু কাজ কাম ডাইনীগো মত , তবে আপনে ভালা কাম করছেন শয়তান এইডারে ইচ্ছামত বলছেন ।
– একটা কথা কি জানো তো মিনু , দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন পিঠও কথা বলে । আমার অবস্থাটাও ঠিক ওই রকম । আমি চাই না সে বার বার তার আর ওনার মাঝে আমায় টানুক । আর দেখতে গেলে রুবি আপু তো বেশি হকদার এই সংসারের । আমি কে ?
– আপনে কে মানে ? আপনে তো ভাইয়ের বউ ।
– আমি বউ হলে কি আরেক বউয়ের দরকার পড়তো ওনার মিনু ? আমি তো আমার সবটা উজাড় করে দিয়েছিলাম কিন্তু লাভ কি হলো , বলতে পারো ?
– সবই কপালের দোষ ,
– কপালের দোষ বলেই তো টিকে আছি , একদিন দেখবে আমি আর থাকবো না ।
– এইডা কি কন ভাবী ?
– আমি এখনও থাকতে চাই না , কিন্তু যেতেও পারি না ।
– এডি কইয়েন না ভাবী ।
– যাও কাজ করতে যাও , শরীর টা ভালো লাগছে না আমার একটু ঘুমাবো ।
– আইচ্ছা ,
– আর শুনো , তোমার ভাই আসলে তাকে কফি করে দিও আমি আজ আর বের হবো না কেমন ?
– আইচ্ছা ভাবী ।

[ বিঃদ্রঃ বাস্তব জীবনে আমরা এমন অনেক পরিস্থিতিতে পড়ি যেখান থেকে ওভারকাম করা খুব কঠিন । কথা শুনতে শুনতে মস্তিষ্ক এমন অবস্থায় চলে যায় যেখানে না চাইতেও কথা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । আসলেই যেতে যেতে যখন পিঠটা দেয়ালে আটকে যায় তখন দিক বিক না দেখে না ভেবে পিঠাটাই কথা বলা শুরু করে দেয় । তেমন সাধু ব্যাক্তিও একবার না একবার বলবেই । যে হাজারো হাদিস জানে সেও একবার না একবার একটা হলেও গালি দিবে । আজ বেলীও তেমন , শুনতে শুনতে বড্ড বেশি তিক্ত সে । তাই আজ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে সেও বাধ্য হয় । বাঁচতে হলে এভাবেই হয়তো বাঁচতে হবে । যুদ্ধ করে নিজের জন্য হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে । এটাই নিয়ম , সব কিছু নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় কিন্তু নিজের আত্নমর্যাদা আত্নসম্মান নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না নতুবা নিয়তি বার বার ধোঁকা দিতে থাকে ]

বেলী বিছানায় শুয়ে আছে । শরীরটা আসলেই ভালো লাগছে না তার । পুরো শরীর কাঁপছে তার । শরীরটাও গরম হয়ে আছে । মনে হয় জ্বর আসবে । জ্বরের কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে যায় বেলীর ।
সেদিনও বেলীর জ্বর ছিল , কিন্তু তবুও সেদিন সে কলেজে গিয়েছিল । মোড়ের মাথার সামনে সেদিন রাজু তার জন্যে অপেক্ষা করতেছিল । বেলী সেদিন আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছিলো আর তখনই ,

– কালচে ফুল,,,,,,,,,,,,,?
– কেহহহহহ ,
– কিরে কলিজা এত ছোট কেন তোর ?
– আপনারে না বলছি এমনে হুটহাট ডাক দিবেন না ।
– তোর কলিজা ছোট হইলে আমি কি করবো ,
– কি করবো মানে , আমার এগুলা ভালো লাগে না ।
– তোরে এমন দেখা যায় কি জন্যে , শরীর কি ভালো না ?
– উহু , জ্বর আইসা গেছে
– আহারে , কালির আবার অসুখও করে ।
– এমনে বলেন কেন ?
– তোরে রাগাইতে ভালোই লাগে আমার ।
– ধুর , বাইত যাই গা ।

সেদিন অনেকটা রাগ করেই বেলী চলে আসছিল রাজুর সামনে থেকে । সেদিন রাজুও হেসেছিল বেলীর রাগ দেখে তাই তো জোরে জোরেই বলেছিল ,

– ওই কালিইইইই , দাঁড়া যাস কই , আয় আমি ওষুধ কিনে দিবো
– আপনের ওষুধ আপনিই গিলেন ।

কথাটা শুনে রাজু অনেক হেসেছিল । রাজুর হাসিমাখা মুখটা আজও বেলীর চোখে ভাসে । এইসব ভাবতে ভাবতে বেলীর চোখে ঘুম নেমে আসে ।

রাত ৮ টার পর ইরফান বাসায় আসে । ক্লান্ত শরীরে কলিংবেল বাজানোর পর ভেবেছিল দরজায় বেলীর মায়াবী চেহারাটা দেখবে । কিন্তু দুর্ভাগ্য দরজা খুলে মিনু । মিনুকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় ইরফান ।

– কিরে তুই কখন এলি ?
– ১১ টার দিকে , খালি আমি একলা আই নাই আরও একজনও আইছে ।
– কে ?
– নিজে যাইয়াই দেখেন ,
– এক কাপ কফি করে দে ,
– আইচ্ছা ,
– বেলী কোথায় ?
– ঘুমায় ,
– এখন ?
– জানি না আমি

দরজা থেকে ভেতরে গিয়ে নিজের রুমে যায় ইরফান । রুমের ভেতরে গিয়ে খাটের উপর রুবিকে শুইয়ে থাকা অবস্থায় দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় ইরফানের । হাতে থাকা মোবাইল টা রেখে রুবির সাথে কথা না বলেই বেলীর রুমে যায় ইরফান । বেলীর রুমে গিয়ে বেলীকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বসে ইরফান । হাত ধরতেই দেখে বেলীর পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । মুহুর্তের মাঝেই ইরফানের সাড়া মুখে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে । উদ্বিগ্ন হয়ে চিন্তিত গলায় বেলীকে কয়েকবার ডাকে ইরফান ।

– বেলী,,,,,,,,?
-………
– এই বেলী , বেলী
– হু,,,,,,,,,

হালকা স্বরে হু করে উঠে বেলী ।

.
.

চলবে…………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here