ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #পর্ব_৩১,৩২

0
219

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩১,৩২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
৩১

বেলীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে । কতদিন পর রাজু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সেই চিরচেনা মুখ তার সামনে দাঁড়িয়ে । আগের থেকে বেশ বদলে গেছে সে , চোখে চশমা পড়ে এখন । অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে রাজুর দিকে । আর রাজু চেয়ে আছে তার সেই চিরচেনা কালচে ফুলের মুখের দিকে । কতটা বদলে গেছে মেয়েটা । দুচোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গুলো গড়িয়ে পড়ে যায় বেলীর ।

– কেমন আছিস রে বেলীফুল ?
– ভালো , আপনি ?
– হ্যাঁ ভালোই আছি , কেমন ভালো আছি দেখতেই তো পাচ্ছিস ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– চোখে পানি কেন ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই পানির কারণ কি আমি ? নাকি হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা , কোনটা ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

রাজুর কোন কথার জবাবই বেলী দেয় নি । বেলীর নিরবতা আর চোখের পানিই বেলীর বলতে না পারা কথা গুলো বলে দিচ্ছে । বেলীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল রাজুর । তাই আবারও শুরু করে সে ,

– অনেক দিন পর দেখলাম তোকে । এইদিকে কি মনে করে ?
– আমি এইখানের কিছুই চিনিনা , মিনুর সাথে আসছিলাম ।
– মিনু কে ?
– আমাদের বাসাতেই থাকে ।
– তোর জামাই কেমন আছে ?
– আলহামদুলিল্লাহ ,
– তুই সুখে আছিস তো ?

রাজুর ভেতর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটা কথাই বেলীর অন্তরে গিয়ে লাগে । কি করতে যে সে এখানে এসেছিল আর কেনই যে রাজুর সাথে দেখা হয়ে গেল । এটা ভেবেই কষ্টে বুক ফাটে তার । সুখ নামক জিনিসটাই তো তার জীবনে ছিল না । সুখটা তার জীবনে হুট করেই চলে আসে । তাই আর বেশি কিছুই মুখে আসছে না তার ।

– কিরে , বললি না তো ?
– কি ?
– সুখে আছিস তো ?
– দেখে কি মনে হয় ?

বেলীর কথা শুনে রাজুর সব কথা গুলো যেন থমকে যায় । তার মানে বেলী ভালোই আছে । খুব সুখে আছে । এরই মাঝে বেলী বলে উঠে ,

– আপনার কি খবর ? বিয়ে শাদী করছেন ?
– নাহ ,
– ওহ , করে নিন । এভাবে আর কত দিন ?
– করতে তো চেয়েছিলামই , পারলাম আর কই ।

রাজুর ইংগিত বুঝতে বেলীর সময় লাগে নি । মিনু টাও যে কেন আসছে না । তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারলে ভালো হতো ।

– দোয়া করি সুখে থাক , ভালো থাক ,
– হু ,

রাজু কেন জানি পিছনে ফিরে হাটা শুরু করে দেয় । আর একবারের জন্যেও বেলীর দিকে তাকায় নি । হয়তো তারও বুঝা হয়ে গেছে তার কালচে ফুল এখন অন্যের হয়ে গেছে । এক বুক হাহাকার নিয়ে চলে যাওয়া রাজুর পথপানে চেয়ে আছে বেলী ।

এর পর পরই মিনু চলে আসে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিনু তার ভ্রু কুচকে তাকায় বেলীর দিকে ।

– ও ভাবী ,,,,
-,,,,,,,,,,
– ভাবী , ও ভাবী,,,,,,,,
– হু ,
– কি গো , ইরাম আতকাইয়া উঠছেন কেন ?
– কোথায় ছিলে এতক্ষন ?
– আর কইয়েন না যেই ভিড় আছিল গো ভাবী ।
– চলো বাসায় যাবো ,
– খাইবেন না ? আমি এত্ত কষ্ট করে আনলাম ।
– খাবো তবে বাসায় গিয়ে , বাসায় যাবো এখন ।
– ভাবী আপনের শরীর ঠিকাছে নি ?
– হ্যাঁ , চলো ,
– আইচ্ছা চলেন ।

অন্তরে তার কি ঝড় বইছে শুধু সে-ই জানে । কোন রকম বাসায় পৌঁছে রুমে চলে যায় বেলী । বুকে প্রচন্ড রকম ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার । দরজাটা লাগিয়ে পাশেই ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে বেলী । বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার । পাগল পাগল লাগছিল নিজের কাছে । দৌড়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে বেলী । বালিশ চেপে ধরে চাপা আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে বেলী ।

– আজ কেন ? ইয়া খোদা আজ কেন আবার সে সামনে এলো । আসা টা কি খুব প্রয়োজন ছিল ? আমি তো নিজেকে সেই কবেই গুছিয়ে নিছিলাম , যেদিন ওনার ঘরে আসছিলাম । সব তো মেনেই নিছিলাম , তাহলে আজকে আবার কেন আল্লাহ । এই কোন খেলা খেলছেন আল্লাহ । আমি তো ওনাকে ভালোবাসি তাহলে রাজু ভাই আবার কেন এলেন আল্লাহ পাক । আল্লাহ পাক আমি সব ভুলতে চাই । সবটাই ভুলতে চাই ।

বেলী কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে নি ।

ইরফান প্রায় ১৫ মিনিট যাবত দরজা ধাক্কাচ্ছে । কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আরও জোরে জোরে দরজায় নক করে । মিনুও প্রায় কেঁদেই দিছে । এতক্ষন যাবত ইরফান দরজা ধাক্কাচ্ছে খুলার নামই নেই বেলীর । ইরফানের কলিজায় কে যেন ছুড়ি দিয়ে কোপাচ্ছিল মনে হচ্ছে । সে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল । একমাত্র ভাড়া বাসা বলেই দরজাটা ভাঙতে পারেনি । বেলীর কানে আচমকাই নিজের নামটা যাওয়ায় লাফ দিয়ে উঠে ঘুম থেকে ।
খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় বেলী । বেলী দরজা খুলার সাথে সাথে ইরফান ভেতরে ঢুকে পড়ে রুমের মধ্যে । সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বেলীকে সে । চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে ইরফানের । বেলীকে এইভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে মিনু সেখান থেকে সরে যায় আর বেলীর তো প্রায় দম বন্ধ হয়েই আসছে ইরফান অত্যন্ত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে ।

– দরজা বন্ধ করছো কেন তুমি , হ্যাঁ , আমি সেই কতক্ষন যাবত দরজায় নক করছি ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হইছে তোমার , এই সময় তো কখনো ঘুমাও না তুমি ?
– একটু ছাড়েন , দম আটকে আসছে আমার ।

বেলীর কথায় ইরফান বেলীকে হালকা করে দেয় । বেলীর সামনে আজ যেন এ এক অন্য ইরফান দাঁড়িয়ে আছে । যার দুটো ভয়ার্ত চোখে শুধু বেলী নিজেকেই খুজে পায় । বেলীকে হারানোর ভয়টা কেন যেন তাকে খুব পোড়াচ্ছে । ইরফান পাগলের মত বেলীকে চুমু খেতে থাকে । কপালে , গালে , হাতে , চোখে কোথাও কমতি রাখে নি । যেন মনে হচ্ছিল তার সামনে একটা বাচ্চা শিশু দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে আবারও জড়িয়ে নেয় নিজের মাঝে । বেলীকে পাগলের মত আদর করে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় সে ।

– কি হলো , তোমার কি হইছিল ?
– কিছু না তো ?
– আমি খুব ভয় পাইছিলাম ।
– কেন , কি ভাবছিলেন ? মরে গেছি ?

বেলীর মুখ থেকে মরা শব্দটা শুনে ইরফানের বুকে কামড় পড়ে যায় । বেলীর মুখটা সাথে সাথেই চেপে ধরে ইরফান ।

– ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় মারবো কিন্তু বেলী , কি সব বলো ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– আমি আমার জীবন থাকতেও তোমাকে হারাতে পারবো না । আর বার বার মরার কথা কেন বলো যখন জানো যে এটা আমি শুনতে পারি না ।

বেলী ইরফানের কথা শুনছে আর ঘড়িতে দেখছে । রাত প্রায় ১০ টার বেশি বাজে । বেলীর আজ কি হয়েছিল এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে । আর ইরফান এত ডাকার পরেও সে শুনতে পায় নি ।

রাতে খাবার পর দুজনেই শুয়ে আছে । ইরফানের আজ মনটা ভালো নেই । কেমন যেনো ছটফট করছিল । আজ বিকালে এডভোকেটের চেম্বারে রুবিও এসেছিল । সেখানে দেখা হয় দুজনের । অবাক করার বিষয় ছিল রুবি এমন ভাব করছিল যেন সে ইরফানকে চিনেই না অথচ এই রুবিই ইরফানকে প্রেশার ক্রিয়েট করেছিল বিয়ে করার জন্যে । রুবির সাথে রুবির বাবাও ছিলেন সেখানে । রুবি তার এডভোকেটকে জানিয়ে দিয়েছে সে মিউচুয়াল ডির্ভোস চায় , সাথে কাবিনের সব টাকা । ওদের বিয়ের সময় ইরফান প্রায় ১০ লাখ টাকা কাবিন করেছিল , যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা ইরফান বিয়ের দিনই উশুল করে দিয়েছিল । রইল বাকি ৭ লাখ টাকা তা ইরফান তাকে নগদ দিবে বলেছে । আজ পেপারে সাইন করতে রুবির হাত কাপে নি বরং তাকে খুশিই লাগছিল । ইরফানের নিজেকেও হালকা লাগছে আজ । হয়তো দুই মাস পড়ে একেবারেই ডির্ভোস হয়ে যাবে তাদের । রুবি শুধু লাষ্টে কিছু কথা বলে গেছিল । যা ইরফানের বুকের মধ্যে তুফান শুরু করে দিয়েছে সেই বিকাল থেকেই । যখন রুবি তাকে বলেছিল ,

– মিষ্টার মাহমুদ , আমার এক্স হাজবেন্ড আমার টাকাটা পাই পাই বুঝে নিতে চাই আমি ।
– পেয়ে যাবে ।
– আর হ্যাঁ , ওয়েট এন্ড ওয়াচ , বেলীও তোমার জীবনে থাকবে না ।
– রুবি,,,,,,,
– ডোন্ট শাউট , বেলী নামক কাটা আপনা আপনিই ঝরে যাবে । শুধু মিলিয়ে নিও । তোমার সুখের ঘরে অতি শীঘ্রই গ্রহণ লাগবে । অভিশাপ দিলাম ।
– রুবিইইই ,,,,,,,,,

রুবি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় । তবে রুবির পক্ষ থেকে রুবির বাবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় । ভদ্রলোকও মেয়েকে নিয়ে ফেঁসে গেছেন ।

তাই তো আজ বেলীকে এইভাবে দরজার ওপারে দেখে তার কলিজায় পানি ছিল না । ইরফান হুট করেই বেলীর দিকে ঘুরে যায় । বেলী তখন ঘুমাচ্ছিল , বেলীকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল । ইরফান তার হাতটা দিয়ে বেলীর গাল স্পর্শ করে ।

– আমি তোকে হারাতে পারবো না । কখনোই না , তবুও কেন জানি রুবির বলে যাওয়া কথা গুলো শুনে খুব ভয় লাগছে । এই প্রথম আমি খুব ভয় পাচ্ছিরে বেলী । তুই আমার হৃদয় মাঝে থাকা সেই ছোট্ট পাখি যাকে আমি আমার অন্তিম নিঃশ্বাস অবদি আগলে রাখতে চাই । তবুও কেন জানি বুকটা বার বার কেঁপে ওঠে আমার । আমি তোকে হারাবো না তো ?

ইরফানের মন বলছে এইসব । কিন্তু চোখ বলছে অন্যকিছু ।

– আমি ভালোবাসি রে বেলী তোকে , অনেক ভালোবাসি ।

.
.

চলবে,,,,,,,,,,,

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সুখময় মুহুর্ত গুলো অতিবাহিত হতে বেশি সময় লাগে না । আল্লাহ পাক হয়তো এই নিয়ম গুলো এইভাবেই করে দিয়েছেন । যেমন বিপদের রাত অনেক দীর্ঘ হয় , সেই রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার যেন প্রকৃতিকে গ্রাস করে নেয় । কিন্তু রাত যতই গভীর হোক না কেন এক সময় না এক সময়ে ভোরের আলো তো ফুটে উঠেই । ঠিক তেমনটাই এইখানে , বেলীর দুঃখের দিন গুলো দীর্ঘ হলেও এখন সুখের দিন গুলো অনায়াসেই পার হয়ে যাচ্ছে ।

সব মিলিয়ে প্রায় দুইমাস পেরিয়ে গেল । ইরফান আর রুবির মিউচুয়াল ডির্ভোস হয়ে গেছে । তাদের দুজনের মধ্যে এখন আর কোন রকম যোগাযোগ নেই । কিন্তু তবুও কোথাও যেন ইরফানের মনে শান্তি নেই । কিছু একটা যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত । বেলীর ব্যাপারে সে খুব পজেসিভ । যেন বেলীকে সে চোখে হারায় । বেলীর শরীরের একটু আঘাত যেন তার কলিজাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় । বেলী মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না , এটা ইরফানের ভালোবাসা নাকি পাগলামি । না হয় কোন পুরুষ কোন নারীকে এতটা ভালোবাসতে পারে ?

যেই পুরুষ আগে দিন রাত তার স্ত্রীকে মারধর করতো আজ সেই পুরুষ সেই স্ত্রীকেই চোখে হারায় । এতটাই চোখে হারায় যে রাতের মিলনেও বেলীর মুখের উফফফফ শব্দটাও তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য করে । সে ভালোবাসে তার বেলীফুলকে । বেলীও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক । অস্বাভাবিক থাকারও কারণ নেই । বেলীও যে ভালোবাসে তার বরকে । কোন শর্ত ছাড়াই ভালোবাসে সে তার বরকে । জীবনের গল্প গুলো যদিও ছবির মত হয় না । আবার অনেক সময় ছবিকেও হার মানিয়ে নেয় ।

ইরফান বেলীকে আবার পড়াশোনা শুরু করতে বলে । সে নিজের করা ভুল গুলো শুধরে নিয়েছে অনেকটাই । এইবার বেলীকে পড়াশোনাও করাতে যায় সে ,

– বেলী ,,,,,,,,?
– হু ,
– তুমি কেন মানছো না ?
– কি মানছি না ?
– এইযে পড়াশোনা করতে চাইছো না , কেন ?
– এখন আর ভালো লাগে না এইসব ।
– তুমি তো প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিলে ।
– যা বন্ধ হয়ে গেছে তা শুরু করতে চাই না ,
– এটা কিন্তু ঠিক না ।
– আমি এভাবেই ভালো আছি , এইসবে আর টানবেন না ।
– আমি বুঝলাম না এতে তোমার সমস্যা কোথায় ।
– ঘুমিয়ে পড়ুন , অনেক রাত তো হলো ।

বেলী এইসব বিষয়ে কোন কথাই বলতে চায় না । তাই সবটাই এড়িয়ে যায় । বেলীর কেন জানি পড়াশোনায় অনিহা চলে আসছে ।

গ্রাম থেকে ইরফানের বাবা এসেছ । আজ প্রায় অনেক দিন পর তিনি এলেন এই শহরে । জমি নিয়ে কিছু কাজ ছিল আবার ছেলে ছেলের বউকেও দেখার ইচ্ছা ছিল । তাই দুটো কাজই সম্পন্ন করেছেন তিনি । কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার । রুবির বিদায় হওয়া , আর তার পর পরই ইরফানের বাবা তার বাসায় আসা সব কিছুই একটা গোলকধাঁধা ।

রাতে খাবার পর , বেলীকে আর বাবাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে ইরফান । আজকে ইরফান কিছু কথা বলতে চায় তার বাবাকে । তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য সে আজ অনুতপ্ত । সে যেমন বেলীর কাছে অপরাধী , তেমন সে তার বাবার কাছেও অপরাধী । ওইদিক থেকে দেখতে গেলে সে তার বাবার কাছে আরও বেশি অপরাধী কারণ সে তার পিতার সু-পূত্র হয়ে উঠতে পারে নি । নিজের করা কৃতকর্মের জন্য হয়তো আখিরাতে তার পিতাকেও হাশরের ময়দানে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে । তাই আগেই সে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে চায় তার বাবার কাছ থেকে ।

ইরফান তার বাবার সামনে মাথা নিচু করে বসে । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে আছে । বেলী মাথায় ওড়না পরে ইরফানের বাবার পাশেই বসা তার মাথা নিচু হয়ে আছে । বেলীর মনে ঠিক খবর হয়ে গেছে , ইরফান কি বলবে তার বাবাকে । বেলী শুধু ভয় পাচ্ছে , এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে যখন তার শ্বশুর এইসব শুনবেন তখন কি হবে ।

এদিকে রহমান আলী মানে ইরফানের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । তার মন তাকে জানান দিয়ে দিয়েছে যে তার ছেলে হয়তো কোন অপরাধ করেছেন , যার জন্যে তার নজর আজ নিচু হয়ে আছে ।

– ইরফান , নজর নিচে কেন ? কিছু একটা শুনার জন্যেই তো আমাকে এইখানে বসানো হয়েছে । সেটা কি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– ইরফান ,,?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– বউমা , কি হইছে ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– দুজনেই চুপচাপ , কেন ?

ইরফানের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না । অন্যদিকে , ভয়ে বেলীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি বের হচ্ছে । ইরফানের স্তব্ধতা যেন অনেক কিছুই ইংগিত করছিল । তবুও রহমান আলী আবার প্রশ্ন করেন ,

– ইরফান , কি হইছে ?

বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত করে মুখ দিয়ে কথা বের করে ইরফান ,

– বাবা , আমি কয়েকটা কথা বলবো । আপনাকে শুনতে হবে ।
– হ্যাঁ , শুনতেই তো আছি ।
– বাবা কিছু অপরাধ করছি , যার কখনো ক্ষমা হয় না । জানি না এই মেয়েটা কিভাবে আমায় ক্ষমা করে দিছে ।

আঙুল তুলে বেলীকে উদ্দেশ্য করে ইরফান কথা গুলো বলে । বেলীর চোখে তখন পানি । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয় । কারণ মিনুর সামনে তখন তার রাগী ইরফান ভাই ছিল না । তার সামনে তখন একজন অনুতপ্ত নিঃস্ব অসহায় পুরুষ বসেছিলেন । যার মুখটা দেখলে যে কারোই মায়া হয়ে যাবে । তার থেকেও বড় ভয়টা হচ্ছে সে তার বেলী ভাবীর কাছে শুনেছিল রহমান সাহেব অনেক রাগী মানুষ । কারোই জানা নেই , এইসব শুনার কি রিয়েকশন হবে । এইসবের মাঝে রহমান আলী আবারও বলে ওঠে ,

– কি এমন অপরাধ করছো তুমি ?
– বলতেছি বাবা ,

তারপর বেলীকে ঢাকা নিয়ে আসার পর থেকে রুবিকে ডির্ভোস দেয়ার দিন পর্যন্ত সমস্ত কিছু বলে দেয় ইরফান তার বাবাকে । এমন কি বেলীকে মারধরের বিষয়টাও বলে দেয় সে তার বাবাকে । ইরফানের বাবা তার ছেলের কথা শুনে স্তব্ধ । ওনার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । রাগ কিনা জানা নেই কিছু দুঃখে ওনার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে । বেলীও চাপা কান্নায় ব্যস্ত । মিনুও মুখে হাত দিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে । ইরফানের কথা না বলাই ভালো কারণ সে তখন তার বাবার পায়ে ধরে নিজের দোষ গুলো বর্ণনা করছিল তার কাঁদছিল । ইরফান তখন মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– বাবা আমার সব অত্যাচারের সাক্ষী ছিল এই মিনু । আমি বেলীকে মেরে আধমরা করে রেখে যেতাম এই মিনুই ও-কে সামলে নিয়েছে । মিনুর অনেক রাগ আমার প্রতি । হয়তো অনেক বকা বাধ্যও করেছে আমাকে ।

মিনু এইসব শুনছিল আর চোখের পানি ফেলছে । রহমান আলী শুধু নিচের দিকে চেয়ে আছে । তারপর ইরফান আবারও বলে ,

– বাবা , আমি অনেক অপরাধ করছি । হয়তো এই অবরাধের ক্ষমা হয় না । আমি আপনার সু-পূত্র হতে পারি নাই বাবা । আপনার আদর্শে নিজে গড়ে তুলতে পারি নাই । আমায় ক্ষমা করে দিন বাবা ।

ইরফানের কথায় রহমান আলী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দিলেন । তারপর দু’হাত এক করে বেলীর দিকে এগিয়ে আসলেন । তখন কেন জানি ওনার-ই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল ।

– মাগো , আমি ভুল করছি গো মা । আমি বুঝতে পারি নাই যে আমি আমার কথার দাম রাখতে গিয়ে এক এতিমকে এক নরপিশাচের হাতে তুলে দিছি । আমায় মাফ কর মা ।

নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে ইরফানের কলিজাটা যেন ফেটে যাচ্ছিল । বেলীও ঢুকরে কেঁদে দেয় । ইরফান তখন তার বাবার পা জোড়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । তখন রহমান আলী পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ,

– খবর দার , তোমার ওই পাপী হাতে আমার পা ধইরো না । আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি । আমার শরীর অপবিত্র কইরো না তুমি ।
– বাবা,,,,,,,?
– কে বাবা , কিসের বাবা । আমার কোন ছেলে নাই ।
– বাবা ,,,,,,,?

রহমান আলী তখন বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুই আমার কাছে চলে গেলি না কেন রে মা ? তোকে কে বলছে এই পশুর কাছে থাকতে । আমরা দুইজনে এক বাড়িতে থাকতাম । আর ওই মেয়ে কেন তালাক দিলো ? তুই কেন দিলি না মা , তুই কেন দিলি না । কেন এই পশুর কপালে লাত্থি মাইরা আমার কাছে আসলি না রে মা ?

রহমান আলীর কথায় বেলী অবাক হয়ে যায় ।

– বাবা আপনি এইসব কি বলেন ?

রহমান আলী একদম ভেঙে পড়েছেন । তার নিজের ছেলে এত জঘন্য অপরাধ করতে পারবে তা ওনার জানা ছিল না । চোখের পানি মুছে ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন ,

– তোমার মায়ের কাছে কথা দিছিলাম , সেই কথা রাখতে পারি নাই আমি , তুমি মানুষ হলে না তুমি অমানুষই রয়ে গেলা । তোমার মায়ের শরীরে আমি কখনো ফুলের টোকা লাগাই নি আর সেই তুমি আমার ছেলে হয়ে এই ফুলের মত এতিম মেয়েটাকে মারছো । আমি আল্লাহ পাকের কাছে কি জবাব দিবো । আমি হাশরের ময়দানে এই নিষ্পাপ মেয়ের বাবার কাছে কি জবাব দিবো ?

তখন তিনি বেলীকে আবারও বললেন ,

– মারে এর কপালে লাথি মারলি না কেন রে মা ।

শ্বশুরের কথায় বেলী তখন একটা কথাই বলে ,

– যে নিজ কর্মে অনুতপ্ত তাকে কিভাবে দূরে ঠেলে দিবো বাবা ? সে আমার সব কিছু বাবা । আমি পারি নাই , আমি পারি নাই বাবা ।

.
.

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here