#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৪০ শেষ
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
অন্ধকার রুম , চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । ভালোবাসা গুলো আজ পালিয়ে গেছে । এখানে না আছে ভালোবাসা , না আছে অনুভূতি । অনুভূতিরা আজ এখানে মৃত ।
ঘড়ির কাটাতে রাত ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট । ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটা রুম চুপচাপ হয়ে আছে । এখানে চাপা আর্তনাদ আর যন্ত্রণা । তবুও বেঁচে থাকতে হচ্ছে । সম্পদ বলতে এখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই । আছে শুধুই এক নিঃস্ব দীর্ঘশ্বাস । যা নিয়ে বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন ।
বারিধারায় অবস্থিত এই ফ্ল্যাটে আজকাল আর হাসির গুনগুন শব্দ শুনা যায় । সব স্মৃতি যে আগের ফ্ল্যাটে ফেলে এসেছে সবাই । এই ফ্ল্যাটে শুধুই কান্না আর কষ্ট । এই ফ্ল্যাটে শুধুই হাহাকার । এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে শুধুই অন্ধকার এখন ।
জীবন থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নিতে হয় । এক জীবনে মানুষ হয়তো সবটা পায় না , জীবন প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে । বদলে যায় স্বপ্ন গুলো , বদলে যায় দিন গুলো । কিন্তু বদলায় না স্মৃতি গুলো ।
ভালোবাসা যেখানে আর হার মানতে বাধ্য হয় অভিমানের কাছে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ভালোবাসাকে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কিছু রক্তের বাঁধনকে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আলোকে ।
অনেক অভিমান হয় এই ভাগ্যের উপর । কিন্তু এখানে না পারা যায় অভিমান পুষে রাখতে । না পারা যায় আল্লাহকে ভুলে থাকতে । না পারা যায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ থেকে বিরত থাকতে । কথায় বলে আল্লাহ নাকি যা করেন ভালোর জন্যে করেন । কিন্তু আল্লাহ ভালো করতে গিয়ে তার বান্দাদের চরম কষ্টের সামনে ফেলে দেন । তখন সেই আল্লাহ পাককেই প্রয়োজন পড়ে সেই কষ্ট গুলো ভুলে থাকার জন্যে ।
এমতাবস্থায় ফোন বেজে ওঠে , হাতে নিয়ে দেখতেই পরিচিত এক নাম্বার । রিসিভ করে কানে নেয়া ,
– হ্যালো ,
– কেমন আছো ?
– বেঁচে আছি কোন রকম ,
– যা হয়েছে ভুলে যাও । কষ্ট আঁকড়ে আর কত দিন বেঁচে থাকবে ।
– ওর পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলছে ।
– ডক্টর কি বলে ?
– ব্রেইনে সমস্যা , মানষিক ভাবে ভেঙে পড়ায় এই অবনতি ।
– একটা বছর তো এইভাবেই কেটে গেলো ।
– তবুও উন্নতি দেখছি না ।
– তোমার গলা ধরে গেছে যে , কাঁদছিলে নাকি ?
– আল্লাহ পাক আমাকে কান্না দিয়েছে এখন তো কান্না ছাড়া উপায় দেখিনা ।
– আফসোস করে কি হবে আর , সে তো ফিরে আসবে না ।
– আমার পাপের ফল নিষ্পাপ প্রাণটা পেলো ।
– ও-কে সামলে রেখো , এখন তো পাগলামি করলে হবে না । এই সময় আরও রিস্ক হয়ে যাবে ব্যাপারটা ।
– তাই তো ২৪ ঘন্টা লোক রাখা আছে । মা আছেন , সাথে বুয়াও আছে ।
– আগামী কাল তার দ্বিতীয় জন্মদিন , তাই না ?
– মনে রেখেছো তাহলে তুমি ?
– আমিও তো কম পাপ করি নি ।
– এমন যন্ত্রণা যাতে আল্লাহ পাক আমার শত্রুকেও না দেয় । যাই হোক মেহেরাব কেমন আছে ?
– ভালো আছে , তার বাবার সাথে খেলছে ।
– মেহেরাবকে নিয়ে আর এসো না এখানে , আর সেইদিনের জন্যে আমি দুঃখিত ।
– ছিহ , কি সব বলো তুমি । আমি মানছি আমি খারাপ আমি জঘন্য , তাই বলে মায়ের মন বুঝবো না ? আমিও বুঝি একজন মায়ের শোকটা কত বড় আর কত কঠিন হতে পারে ।
– আচ্ছা ভালো থেকো । আল্লাহ হাফেজ
– হু , আল্লাহ হাফেজ , ও-কে দেখে রেখো ।
– হু ,
লাইন কেটে চোখের চশমা টা খুলে চোখের পানি মুছে নেয় সে । মানুষ বদলায় , কারণে অকারণে বদলায় । ভালো খারাপ হয় আবার খারাপ ভালো হয় । এই নারীটিও হয়তো ভালো হয়েছে এখন । বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে তার । তবুও সে শক্ত হয়ে আছে ।
অন্ধকার রুমে লাইট জ্বালিয়ে রুমটি আলোকিত করে সামনে এসে বসেন এক বয়স্ক লোক । বয়স্ক লোকটিও অনেকটা আধ-মরা হয়ে আছেন । শোক সামলাতেও এক বছর লেগে গেছে , তবুও সামলে উঠছে না । ছেলের পাশে এসে বসে ছেলের কাঁধে হাত রাখেন রহমান আলী । আজকাল স্পর্শটা বড্ড বেশি চেনা হয়ে গেছে । হাতের স্পর্শতেই বুঝে যায় তার বাবার হাত ।
চোখের পানি মুছে বাবার দিকে নজর তুলে তাকায় ইরফান । হ্যাঁ , অন্ধকার রুমে বসে থাকা নিঃস্ব মানুষটা আর কেউ নন , সে ইরফান । জনাব ইরফান মাহমুদ । ছেলের চোখে পানি দেখে নিজেকে সামলে নেন রহমান আলী ।
– আজকেও এইভাবে বইসা আছো ?
বাবার কথায় হতভাগ্যদের মত তাকিয়ে থাকে ইরফান । কি বলবে , কি করবে জানা নেই তার । তবুও কথা বলে সে ,
– কি করবো আর ,
– বেয়াইন বললো আজকে নাকি পাগলামি বেশি করছে ।
– রোজ রোজ বেড়েই যাচ্ছে ।
– এই সময় এমন পাগলামি ভালো না , ক্ষতি হবে পরে ।
– দেখছি কি করতে পারি ।
এমন সময় রাবেয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ড্রইং রুমে আসেন । আবেয়া বেগমকে দেখে ইরফানও বুঝে যায় আবারও হয়তো সে কিছু করেছে । রাবেয়া বেগম এসে ইরফানের সামনাসামনি বসে ।
– বাবা শান্ত করতে পারি না তো ,
– কি করেছে আবার মা ?
– খাওন খায় না তো ।
– আচ্ছা আমি যাচ্ছি আপনি এইখানেই থাকেন ।
– তুমি গেলে সব ঠিক হইবো , যাও বাবা যাও ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইরফান । পা বাড়ায় ভেতরের রুমের দিকে । তার জানা নেই কি করে শান্ত করবে ভেতরে থাকা সেই মানুষটাকে । সাহস করে রুমে পা দেয় ইরফান । ভেতরে থাকা মানুষটা তখন কাপড় চোপড় গুছাচ্ছে আর বিড়বিড় করছে ।
ইরফান সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তার । ইরফানকে দেখে সামনে অবস্থিত নারীটির মুখে হাসি ফুটে উঠে । ইরফানের দুই হাত ধরে ইরফানের খুব কাছে চলে আসে সে ।
– তুমি আসছো ,,,, আসছো তুমি । দেখো না , জামা কাপড় গুলা রাখার জায়গা নাই । এত বড় বাসা এত বড় রুম কিন্তু এই টুকুন ছোট ছোট জামা গুলা রাখার জায়গা নাই , এটা হয় কখনো বলো তুমি ।
ভালো হয়েছে তুমি আসছো । মাকে বকা দিয়ে দেও তো , আমি তখনই এইগুলা গুছাই তখনই মা খালি আসে । আমার এই টুকুন ইন্নির সাথে মায়ের কিসের এত রাগ আমি বুঝি না । নানীরা নাতনিদের কত্ত আদর করে আর আমার মা সে আমার এইটুকুন ইন্নিটাকে সহ্য করতেই পারে না ।
৫ মাসের ভরা পেটটা নিয়ে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি আর কেউ নয় । সে ইরফানের বেলীফুল । তার বেলীফুলটা আজ মানষিক রোগী । তার বেলীফুলটা আঘাত আঘাত পেতে পেতে আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে । বেলীকে দেখলে ইরফান নিজেকে আর সামলাতে পারে না । আপনা আপনি চোখ দিয়ে তার পানি আসতে থাকে ।
মানষিক রোগটা আস্তে আস্তে বড় আকার ধারণ করছে বেলীর মাঝে । বেলীর মানষিক রোগটা ধরা পড়ে ইন্নির মৃত্যুর পর থেকেই । হ্যাঁ , ইন্নি আর নেই । ইরফান বেলীর ছোট ইন্নিটা আজ আর এই দুনিয়ায় নেই । আজ থেকে এক বছর আহে প্রচন্ড জ্বর , জন্ডিস আর নিওমোনিয়ায় শেষ হয়ে গেছে তাদের ছোট পরীটা ।
ইরফান বেলীকে কিভাবে শান্ত করবে ভেবে পাচ্ছে না । আজ মিনুটাও নেই । মিনু থাকলে অন্তত বেলীকে সামলে নিতে পারতো । ইরফান চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বেলীর গলা জড়িয়ে ধরে ।
– কি হয়েছে আজ আমার বেলীফুলের ? মায়ের উপর রাগ হয়েছে বুঝি ।
– হবে না কেন বলো , মা ইন্নির জামা গুলা সরাতে কেন চায় । ইন্নি কাঁদে মা কি তা বুঝে না ।
বেলী মানতেই চায় না ইন্নি আর নেই । তার ছোট মা টা যে আর নেই তা সে বুঝতেই চায় না এবং মানতেই চায় না । বেলী শেষ কেঁদেছিল ইন্নিকে যখন গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় । আর তার পর দিন থেকেই আবারও নরমাল হয়ে যায় । কতবার বলা হয়েছে ইন্নি আর নেই । ইরফান আর সামলাতে না পেরে বেলীকে টেনে হিচরে ইন্নির কবরের সামনে পর্যন্ত নিয়ে দাড় করিয়েছে । কারণ , তখন বেলীর মেন্টাল পজিশন খুব খারাপ ছিল ।
আর সেইদিনই বেলী প্রথম ইরফানের গায়ে হাত তুলে । কথা গুলো হুট করেই মনে পড়ে যায় ইরফানের । নিজেকে সংযত রেখে ইরফান বেলীকে খাটে বসায় । ঠান্ডা মাথায় শান্ত গলায় বেলীকে বুঝাতে শুরু করে ,
– এইযে দেখো , আমার দিকে দেখো । এইযে তোমার পেটে যে এখন ইন্নি আছে । তুমি যে এমন করো সে তো দেখছে সব । তা মা কারো কথা শুনে না , খায় না । এইগুলা কি ভালো কাজ ?
ইরফানের কথায় নিজের পেটে হাত রাখে বেলী । সে বিশ্বাস করে তার পেটের মধ্যে চলে গেছে ইন্নি । মাথার সমস্যাটা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে , সব আজেবাজে চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে তার ।
– হ্যাঁ , ঠিক ঠিক । তুমি তো ঠিক বলছো । ইন্নি তো দেখতেছে সব । আমি এত রেগে যাই কেন ?
– হ্যাঁ , সেটাই তো । বুঝেও কেন অবুঝের মত করো বেলী । কেন খাও না । ইন্নিকে আনবা না আবার ?
– ইন্নিটা আসলে এমন মাইর দিবো , কেন যে আবার পেটের ভিতরে চলে গেলো ।
– আচ্ছা আমরা এক সাথে মারবো তাকে । এখন খেয়ে নেও । ডক্টর না বলছে না খেলে ইন্নি আসবে না । ইন্নিকে আনতে হলে খেতে হবে তো ।
– এই খাবার গুলাতে গন্ধ আসে তার জন্যে খাই না ।
– গন্ধ লাগবে না । তুমি খাও । দেও আমি খাইয়ে দেই ।
– দেও দেও তুমিই খাইয়ে দেও । না হয় ইন্নিটাও কাঁদবে ।
বেলীকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইরফান । ৫ মাস শেষ হতে চললো তার । তার খেয়ালই নেই সে আবার মা হতে চলেছে । গত ছয়মাস আগে সেই রাতের মিলনের ফল আজকের এই অনাগত সন্তান । বেলীর মাথায় হাত রেখে অতীতে ডুব দেয় ইরফান ।
ইন্নির সেদিন প্রচুর জ্বর এসেছিল । পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার । হাসি খুশি বাচ্চাটা আস্তে আস্তে চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে দিন দিন । পাগল প্রায় বেলী তখন দিন রাত মেয়ের সেবায় নিয়োজিত । ডক্টর বলে নিওমোনিয়া হয়েছে । মাথা আরও খারাপ হয়ে যায় বেলী আর ইরফানের । ১ মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা শেষ করে ইরফান । এই ডক্টর না ওই ডক্টর , এই মেডিসিন না ওই মেডিসিন । কিছুই বাদ রাখে নি ইরফান । বেলী দিন রাত হত্ত্বে দিয়ে পড়ে থাকতো জায়নামাজে । সন্তানের আরোগ্য কামনায় ।
চোখের সামনে ইন্নির শেষ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি তারা । এক সময় বেলী খেয়াল করে ইন্নির চোখ মুখ হলুদ আকার ধারণ করেছে । বেলী জানতো এইসব জন্ডিসের লক্ষন । আবার ইন্নিকে নিয়ে দুজন ছুটে ডাক্তারের কাছে ।
হ্যাঁ , যা ভেবেছিল তাই হয়েছে । ইন্নির জন্ডিস হয়েছে এবং তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে । পাগল প্রায় বেলী ইরফান তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় । তাদের দুজনের জীবনে ফেরেশতা হয়ে আসা ইন্নিকে আর হাসতে দেখা যায় না । সারাক্ষণ কান্নার উপরে থাকতো বাচ্চাটা । ইরফান অফিস থেকে ফিরে এসে ইন্নির মুখ থেকে বা,,,,,,,বা,,,,, ডাক শুনে না । হাত বাড়িয়ে ইরফানের কোলে মাঝে সাঝে আসে ইন্নি । মিনুও কোলে কোলে রাখে ইন্নিকে ।
একদিন দুপুরে বেলী ইরফানের পাশে এসে বসে । সেদিন ইরফানের ছুটি ছিল ।
– শুনছো ?
– হু বলো ,
– ইন্নিটার শরীর আবার খারাপ হয়েছে । এখন তো কিছুই মুখে দিচ্ছে না ।
– বুঝতেছি না কি করবো ।
– মা তো তাবিজ দিলো , কই কিছুই হচ্ছে না ।
– এইসব তাবিজে বিশ্বাস নেই আমার ।
– আরেকজন শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখালে ভালো হতো না ?
– হ্যাঁ , খবর নিয়েছি । একজন আছেন , ওনার কাছে কাল নিয়ে গেলে কেমন হয় ?
– তাহলে তাই-ই করো
– আচ্ছা , টেনশন নিও না । আল্লাহর রহমতে ভালো হয়ে যাবে আমার আম্মাজান ।
পরদিন ,
ইরফান আর বেলী ইন্নিকে নিয়ে সেই ডক্টরের কাছে যান । ডক্টরও সব চেক-আপ করে মেডিসিন দেয় । সব নতুন মেডিসিন দেয় তিনি । আশার আলো দেখতে পায় ইরফান আর বেলী ।
বেলী ডক্টরের কথা অনুযায়ী ইন্নিকে নিয়মিত সব মেডিসিন দিতে থাকে । কোন রকম অনিয়ম করে নি সে তার সন্তানকে সুস্থ করতে । আর সময়ের সাথে সাথে আল্লাহর অশেষ রহমতে ইন্নি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে । পরীর মত ইন্নি তখন আবার হাসতে থাকে , খেলতে থাকে । বাবাকে দেখলেই মায়ের পিছনে গিয়ে লুকায় । ছোট ছোট পা গুলো দিয়ে হেটে হেটে ইরফানকে ছোয়ার চেষ্টা করা তার নিয়মিত রুটিন ছিল । মায়ের ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে খিল খিল হাসতে থাকে ইন্নি । তার এই হাসির শব্দে প্রাণ ফিরে পায় ইরফান আর বেলী ।
ইরফান আর বেলী তাদের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তাদের ইন্নিকে আগলে রাখে । সারাক্ষণ ইন্নি ইন্নি আর ইন্নি । পুরো বাসা ইন্নিতেই মগ্ন থাকে ।
ইন্নি সুস্থ হওয়ার ১ সপ্তাহ পর , ইরফান ইন্নি আর বেলীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় । ইন্নিকে নিয়ে বিনা টেনশনে ইরফান আর বেলী দুহাতে সুখ গুলো কুড়িয়ে নেয় । সেখানেই হঠাৎ করে রুবির সাথে দেখা হয়ে যায় । বেলী ইরফান আর ছোট ইন্নিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় রুবি । অত্যন্ত সহজ ভাবেই বুঝে যায় তাদের সাথে থাকা ছোট বাচ্চাটা হয়তো ইরফান আর বেলী তাদেরই সন্তান । ইন্নি দেখতে এতটাই সুন্দর ছিল যে , যে দেখবে সেই পাগল হয়ে এক বার অন্তত কোলে নিতে চাইবে । রুবিও তখন প্রেগন্যান্ট । প্রেগন্যান্সির ৬ মাস চলছিল তার । নিজে এক নারী হয়ে অতীতে আরেক নারীকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল । কিন্তু বেলী কখনো কিছুই বলেনি রুবিকে । সেইদিক থেকে রুবি কৃতজ্ঞ বেলীর কাছে ।
ইন্নিকে দেখে রুবি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । ততক্ষণে ইরফানকে প্রশ্নও করে বসে সে ।
– এটা তোমার মেয়ে ইরফান ?
তখন ইরফানও একটু অবজ্ঞার স্বরে জবাব দেয় ।
– হ্যাঁ , আমার আর বেলীর সন্তান ও ।
ইন্নি তখন বেলীর কোলে থেকে টুকুর টুকুর করে রুবিকে দেখছিল । পিংক কালারের ফ্লাপি ফ্রক পরে মাথায় পিংক কালারের দুইটা ক্লিপ দিয়ে একটা পরীর মত দেখাচ্ছিল ইন্নিকে । রুবি তখন একটা আবদার ছুড়ে মারে ইরফানের দিকে ।
– আমি কি একটু কোলে নিতে পারি ও-কে ?
– নাহ , খবরদার না । আমার সন্তানের আশেপাশেও আসবে না তুমি ।
– ইরফান,,,,,,,?
রুবিকে এইভাবে বলে ভালো করেনি ইরফান ৷ এটা বেলীর ধারণা । তখন বেলীই ইরফানকে বলে ইন্নিকে রুবির কোলে দেয় । রুবির কোলে গিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ইন্নি ।
রুবি এক নাগারে অনেক গুলা চুমু দেয় ইন্নিকে । অচেনা বলে ঠোঁট ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কেঁদে দেয় ইন্নি । পরে বেলীই বলে ,
– মা এটা আন্টি , কাঁদে না মা ।
এইদিকে ইরফানের খুব বিরক্ত লাগছিল । তবুও বেলীর জন্যে চুপ করে ছিল সে । সেইখান থেকেই ইন্নির প্রতি রুবির একটা টান চলে আসে । ইন্নিকে বেলীর কোলে দিয়ে রুবি সেখান থেকে চলে যায় ।
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা হয়তো ভেঙে গিয়েই সুধরে যায় । যদি মানুষ গুলোর ভালো হয় তাহলে সেই সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়াই উত্তম । যেমন টা ইরফান আর রুবি । হয়তো তাদের সম্পর্কটা ততটুকুই ছিল যতটুকু তারা ভোগ করেছিল ।
সেদিনের মত তারা ঘুরে বাসায় চলে আসে । বাসায় এসেই ইন্নি মিনুর দিকে হাত বাড়ায় । তার এখন মিনুর কোলে চড়ার শখ হয়েছে । মিনুও কোলে তুলে নেয় ইন্নিকে ,
– মা আমার কোলে আইতে চায় । কি গো মা , আজকে কতখানি ঘুরছেন । কতখানি ঘুরছেন ।
মিনুর কাছে ইন্নিকে দিয়ে ইরফান আর বেলী রুমে যায় । সেদিন বেলীকে অন্য রকম লাগছিল । এক বাচ্চার মা হয়ে যেন রূপ তারও বেড়ে গেছে । বেলীকে একটু একা ভাবে নিজের করে পেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ইরফানের । রুমে ঢুকেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় ইরফান । নিজেদের মাঝে একটু একাকীত্বের প্রয়োজনও আছে । তা নিজেদের মাঝে হালকা কোয়ালিটি টাইমটাও স্পেন্ট হয়ে যায় । এই ইরফান এখন অনেক বদলে গেছে । এই ইরফানের দুনিয়া এক দিকে । আর তার বেলী এবং ইন্নি এক দিকে । খুব ভালোবাসে এই দুইটা মানুষকে সে ।
সুখের অন্ত ছিল না এখানে । কিন্তু গ্রহণ লাগে পরদিন সন্ধ্যায় । রাতে ইন্নিকে খাইয়ে দুজনে মিলে ইন্নিকে নিয়ে খেলা করে ইন্নিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় । কিন্তু কে জেনেছিল এই ঘুম টাই তার শেষ ঘুম ছিল । রাতের পর আর চোখ খুলে নি পিচ্চি পরীটা ।
পরদিন প্রায় ৯ টা বেজে যায় । ইরফানের অফিস যাওয়ার টাইম হয়ে যায় । কিন্তু তখনও ইন্নি উঠেনি ঘুম থেকে । তারা ভেবেছিল হয়তো এভাবেই ঘুমিয়ে আছে তাদের ছোট পরী । কিন্তু ছোট পরীর ভেতরের প্রাণ টা যে আর নেই সেইদিকে নজর দেয় নি কেউই । ইরফানকে নাস্তা করতে দিয়ে বেলী ইন্নির কাছে যায় । গিয়ে ইন্নিকে মা বলে জড়িয়ে ধরতেই বেলী শিউরে উঠে । ততক্ষণে ইন্নির ছোট শরীরটা একদম ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে । বেলী কয়েকবার মা মা করে ডাকে , আর তারপর নাকের কাছে হাত দিতেই দেখে তার ছোট পরীর নিঃশ্বাস আর পড়ছে না । বেলী আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নাই । এক চিৎকার দিয়ে উঠে ইন্নি বলে । সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায় বেলী ।
ইরফান খাবার ফেলে দৌড়ে চলে আসে রুমে আর তার সাথে মিনুও । বেলীকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে ইরফানের বুকে এক কামড় পড়ে যায় । সে কাকে ধরবে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না । মিনু তখন দৌড়ে গিয়ে ইন্নিকে ধরে । ইন্নিকে অনেক ডাকে কিন্তু ছোট জানটা সেভাবেই পড়ে থাকে । মিনুও মা বলে এক চিৎকার দেয় । ইরফান যেন দিশেহারা , কি করবে না করবে । পুরুষ মানুষ খুব কম কাঁদে , কিন্তু যখন কাঁদে তখন বুক ফাটিয়ে কাঁদে । মাথায় বুদ্ধি করে ডক্টরকে ফোন দেয় সে । প্রায় আধা ঘন্টার পর ডক্টর আসে । পাশের ফার্মেসির এক লোকও আসে । ডক্টর এসে ইন্নিকে মৃত ঘোষণা করে দেয় । আর বেলীকে দেখে বলে , শকড এর জন্যে সেন্সলেস হয়ে গেছে ।
ইন্নির মৃত্যুর খবর পেয়ে ইরফানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । কাল রাতেও তো তারা দুজন মিলে ইন্নির সাথে খেললো । দুজনে মিলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে । ইরফান পুরো পাগল হয়ে গেছে । মুহুর্তের মাঝেই ইরফানের চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় । মিনুর বুক ফাটা কান্না । ইন্নির নিথর শরীরটা বিছানায় সেইভাবেই পড়ে আছে । দুপাশে ছোট ছোট কোল-বালিশ দিয়ে মাঝে পুতুলের মত ঘুমিয়ে আছে ছোট পরীটা ।
বেলী জ্ঞান ফেরার পর ইন্নিকে বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখেছিল । পুরো পাগল পাগল করছিল । ইরফানকে এই অবস্থায় ভেঙে পড়লে হবে না । শক্ত থেকে সবটা সামলাতে হবে তাকে । ইরফান ছুটি নিয়ে । বাড়িতেও ফোন করে বলে দিয়েছে ইরফান । ইন্নিকে তার দাদার বাড়িতে শায়িত করা হবে ।
এইদিকে সব সামলে নিয়ে ঢাকা থেকে বেলী , মিনু আর ইন্নির লাশ নিয়ে রওনা দেয় ইরফান । বাড়িতে বেলীর মায়ের আহাজারি আর ইরফানের বাবার হাহাকার পড়ে যায় ।
জার্নি শেষ করে অবশেষ বাড়িতে এসে পৌঁছায় ইরফান । গাড়িতেও বেলী ইন্নিকে বুকে চেপে ধরে রাখে । নিজের কাছ থেকে একটুও আলাদা করেনি নিজের সন্তানকে বেলী ।
যে কান্না করে নাই সেও ইন্নিকে দেখে কান্না করেছে । ইন্নি ছিলই এত সুন্দর । বেলীর কোল থেকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্নিকে । ইন্নিকে তার কোল থেকে নিয়ে যাওয়ার পর আরও একবার অজ্ঞান হয়ে যায় বেলী । ইরফান তখনও মূর্তির মতই ছিল । অন্যদিকে ইন্নির জন্য কবর তৈরি করে রাখা হয় । দাদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নাতনির কবর করিয়েছেন ।
বেলীর কপালে সুখ আসলেও সন্তান সুখ সয় নি । ইন্নি তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে মানতেই পারেনি । তার সন্তান আর নেই সে মানতেই পারেনি । খাটে করে নিয়ে যাওয়ার সময় খাট ধরে রাখে বেলী । ইরফানের পা পর্যন্ত ধরে । শ্বশুরের পা ধরে বসে থাকে । সেইদিন সমস্ত লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে সমস্ত পুরুষের সামনে মাথার কাপড় ছাড়া খাট ধরে রাখে বেলী । তখন বেলীর মুখে শুধু একটাই কথা ,
– আমার ইন্নি , আমার ইন্নি । আমার ইন্নিকে নিয়েন না । আপনাদের পায়ে ধরি আমি ।
ইরফানের বুকে জড়িয়ে ধরে একবার ,
আবার পা জড়িয়ে ধরে রাখে সে ।
– তোমার দুইটা পায়ে ধরি ওরে নিও না । তুমি এত নিষ্ঠুর কিভাবে হও । ও তো তোমারও মেয়ে । নিও না নিও না ।
– ও বাবা , বাবা । ওরে নিয়েন না বাবা আমি আপনার পায়ে ধরি বাবা । আমার ইন্নি , আমার ইন্নি , আমার মা , ওরে দিয়ে দেন বাবা ।
সন্তান হারা পাগল বেলীকে তখন কেউই সামলাতে পারেনি । ইরফান তখন নিজের বুকে নিয়ে নেয় বেলীকে । তারপর ইশারা দিয়ে দেয় খাট নিয়ে যাওয়ার জন্যে । তারপর ইরফান বেলীকে অন্যদের কাছে দিয়ে কবরের কাছে চলে যায় । কবরে নেমে নিজ হাতে নিজের সন্তানকে কবরে শুইয়ে দেয় ইরফান ।
সেদিন আর কেউই বেলীকে আটকে রাখতে পারেনি । নিজের হাতে নিজের চুল টেনে ছিড়েছে সে । ইরফানকে দেখে ইরফানের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বেলী ।
– আমার মেয়েকে এনে দেও । এনে দেও আমার মেয়েকে । এক্ষুনি এনে দেও ।
বেলীর এমন পাগলামি দেখে ইরফান নিজের বুকে পাথর রেখে বেলীকে বুঝায় যে ইন্নি আর নেই । তবুও শুনে নি বেলী । সহ্য করতে পারেনি ইরফান । টানতে টানতে গোরস্তানের কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । হাত দিয়ে দেখায় তাদের ছোট পরীর কবর ।
– ওইযে দেখো , দেখো ভালো করে । ওইখানে ঘুমিয়ে আছে আমাদের ইন্নি । ও আর নেই । নেই ও , কেন বুঝতে চাও না । আমার এই হাতে , এই হাতে ও-কে শুইয়ে দিয়েছি ওইখানে । কেন বুঝো না । এই টুকুন শরীরটা কাফনে মুড়ে রেখে আসছি সারাজীবনের জন্য ও-কে ।
বেলী আর শুনতে পারেনি ইরফানের কথা গুলো । কষে এক থাপ্পড় মেরে দেয় ইরফানের গালে । সেদিন গ্রামের অনেকেই বেলীর পাগলামি দেখছিল । সবাই দেখেছে বেলী আর নিজের মাঝে নেই ৷
এই শোকের মাতম শেষ করে প্রায় ১ সপ্তাহ পর বেলীকে নিয়ে ঢাকা ফিরে ইরফান । মিতু তো সাথেই ছিল । তাদের সাথে বেলীর মাও আসে । কারণ বেলীকে সামলানো ইরফান অথবা মিতুর একার পক্ষে সম্ভব না । তাই বেলীর মাকেও নেয়া হয় ।
ঢাকায় ফিরে বাসার আনাচে কানাচে ইন্নিকে খুজতো বেলী । ইন্নির বালিশ ইন্নির জামা কাপড় গুলো নাকের কাছে ইন্নির শরীরের ঘ্রাণ নিতো বেলী । আর রাতে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে আবল তাবল বলতো । আস্তে আস্তে বেলীর মানষিক রোগ দেখা দেয় । ইরফান ঠিক করে এই বাসা ছেড়ে দেবে । কারণ বেলী এখানে থাকলে আরও পাগল হয়ে যাবে । এক জীবনে পিতৃশোক আর সন্তানশোক পেয়ে বেলী আপনা আপনিই ঝরে গেছে । হ্যাঁ ইরফানের বেলীফুল ঝরে গেছে ।
এই ঘটনার এক মাসের মাথাতেই ইরফান বাসা চেঞ্জ করে বারিধারায় চলে আসে । দিন যেতে থাকে আর বেলীর পাগলামি বাড়তে থাকে ৷ এরই মাঝে একদিন রুবি নিজ থেকে ইরফানের সাথে যোগাযোগ করে । ইরফানের সাথে যোগাযোগ করে সব শুনে হতবাক হয়ে যায় রুবি । বিশ্বাসে আনতে পারেনি সে , যেই পরীকে সে কোলে নিয়েছে সেই পরীটা আর নেই ।
মাস ঘুরতে থাকে , সময় যেতে থাকে । কিন্তু বেলীর উন্নতি হয় না আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে । বেলীকেও ডক্টর দেখানো হয় । সবার একই কথা সে মানতেই পারছে না তার সন্তান মারা গেছে । সে সন্তানশোকে নিজের সব খুইয়ে ফেলেছে । এক রকম মানষিক রোগে ভুগছে সে । অন্যদিকে রুবির কোল জুড়ে এক ছেলে আসে । যার নাম রাখা হয় মেহেরাব ।
দুজনের মাঝে ভালোবাসাটা ফিকে পড়ে যায় । প্রতিটা দিন বহু কষ্টে পার করতো ইরফান । অসুস্থ বেলীকে সামলাতে আর পারছিল না সে । মিনুর বাবার অবস্থা খারাপ থাকায় সেও এখানকার সব মায়া ত্যাগ করে নিজ গ্রামে ফিরে যায় । একদিন রাতে বেলী নিজ থেকে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে ।
– আমার ইন্নি চাই , ইন্নিকে এত ডাকি আসে না কেন আমার কাছে । কেন আসে না । বলতে পারো ?
– ইন্নি আছে । তোমার কাছেই আছে ।
– তুমিও আমায় ভালোবাসো না আর ? তুমিও বদলে গেছো ।
– আমি বদলে যাই নি বেলী ।
– আমায় একটু ভালোবাসবা ? ঠিক আগের মত ।
– তুমি চাও আমি তোমাকে ভালোবাসি ?
– হ্যাঁ , তবে তাড়াতাড়ি ভালোবাসা লাগবে ইন্নি না হয় চলে আসবে । একটু ভালোবাসো না আমাকে ?
চোখের পানি মুছে বর্তমানে ফিরে আসে ইরফান । ইরফান চেয়ে আছে বেলীর দিকে । বেলী শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে । হঠাৎ করেই ইরফানের নজর যায় বেলীর পেটে । সেদিন রাতে তাদের দুজনের মিলনের ফসল আজ বেলীর পেটে । হয়তো আবারও আরেক ইন্নির জন্ম হবে এই গর্ভ থেকে ।
খারাপ লাগছিল রুবির জন্যে । তখনকার ফোনটাও রুবিরই ছিল । গত কয়েকদিন আগে স্বামীকে বলে বেলীকে দেখতে এসেছিল সে । সাথে তার ছয়মাস বয়সী মেহেরাবকেও নিয়ে এসেছে । কিন্তু বেলী মেহেরাবকে দেখেই ইন্নি ভেবে নিয়ে নেয় । রুবির কোল থেকে নিয়ে নেয় সে বাচ্চাকে । অনেক কষ্টে তিন জন মিলে বাচ্চাকে তার কাছ থেকে ছুটিয়ে রুবির কোলে দেয় । যদিও এই রুবি আর আগের রুবি নেই । আল্লাহ পাক চাইলে কি না হয় । শয়তানও ভালো হয়ে যায় । রুবিও ভালো হয়ে গেছে । আজ যেন ইরফানের চোখের পানি থামছেই না । আগামীকাল ইন্নির দ্বিতীয় জন্মদিন । বেঁচে থাকলে হয়তো সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো ।
ইরফান বুঝে যায় । এটা তারই কৃতকর্মের ফল । আল্লাহ পাক নেই কে বলেছে ? আল্লাহ পাক আছেন । ইরফানের করা পাপের ফল স্বরূপ আল্লাহ পাক তার কাছ থেকে তার সব থেকে প্রিয় জিনিসটাই নিয়ে নেয় । বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ইরফান । আজ তার নজর আকাশের দিকে । আকাশের বুকে খোঁজার চেষ্টা করছে তার ছোট পরীকে ।
তখন অজান্তেই নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কিছু কথা ,
– আমার বেলীফুল আজ ঝরে গেছে । আমার চোখের সামনে সে ফুল ঝরে গেছে । আমি চাইলেও তাকে সতেজ করতে পারছি না । আমি হেরে গেলাম । আমার অনুভূতি গুলাও হেরে গেছে । আমার আশ্বাসটাও হেরে গেছে । মাঝ থেকে অভিমান গুলা জিতে গেছে । ভালোবাসা নামের ছোট খেলায় আজ আমি হেরে যাওয়া খেলোয়াড় । আমার এই জন্মের করা পাপের ফল আমি এই জন্মতেই পেলাম । আমার সন্তান । যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি । আমার বেলীফুল যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি । যে আজ বেঁচে থেকেও মৃত । যে আজ দুনিয়া বুঝে না । আল্লাহ আমায় কেন নিলে না । আমায় নিয়ে আমার সেই ছোট আম্মাজানটাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে না ।
কিছু আর্তনাদ চাপা হয় । কিছু কান্না বুক ফাটা হয় । বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইরফান কাঁদছে । যেই কান্না আল্লাহর কান অবদি পৌঁছাচ্ছে কিনা তার জানা নেই । হয়তো জীবন এটাই হয় । হয়তো নিজ কৃতকর্মের ফল এইভাবেই ভোগ করতে হয় ।
জীবন পাতায় চোখ দিয়ে
ভালোবাসা আপন করে
চলে যেতে পারলে ক্ষতি কোথায়
নিজের পাপের ফল যখন
নিজেকেই ভোগ করতে হয়
তখন সব কিছু উলটে যায় হেথায়
আর এইভাবেই কিছু ফুল ঝরে যায়
আর এইভাবেই হয়তো থেকে যায় মুকুল
আর এইভাবেই হয়তো প্রত্যেক বেলী হয়ে যায়
ঝরে যাওয়া বেলীফুল
★★★ সমাপ্ত★★★