#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
রান্নাঘর থেকে পানি নিয়ে আসে মিনু । ইরফান তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । মিনু গরম পানি রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ।
– ভাই আপনে যান ফ্রেশ হইয়া নেন , আমি ভাবীর গা ডা মুইছা দিয়া খাবার দিমু নে ।
– ওর কি বেশি খারাপ লাগে ? তাহলে ডক্টর খবর দেই ।
– নাহ থাউক , ডাক্তারে জিগাইলে কি কইবেন আপনে ? যে বউরে ফিডাইছেন । মানুষ জানাইয়া কি লাভ ভাই । আমিই ভাবীরে মালিশ কইরা দিমু নে । আপনে যান এইখান থাইকা ।
মিনু দরজা বন্ধ করে দেয় । ইরফান মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে । নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই বেলীর রুম থেকে আর্তনাদ ভেসে আসে ।
– ও মাগো ,,,,,,
– ভাবী বেশি ব্যাথা করে ?
– মিনু ডইলো না , আর পানি দিও না জ্বলে ।
– ভাবী রক্ত গুলি মুইছা দেই ।
– ও মাগো,,,,,,,, মিনু আস্তে ,
– আইচ্ছা ভাবী ।
– আহহহ , ও মাগো,,,,,,
– ভাবী এত মাইর কেমনে সহ্য করেন আপনে , ব্যাথা ফাওয়ার ফরেও এমনে খিট্টা থাহেন কেমনে আপনে ?
ইরফান আর দাঁড়ায় নি সেইখানে । সোজা রুমে চলে আসে । এসে কিছুক্ষণ পায়চারি করে , আর তারপর কি যেন ভেবে দেয়ালের মধ্যে জোরে নিজের হাত দিয়ে একটা ঘুষি মারে ইরফান । এতটা নির্দয় সে কবে থেকে হয়েছে তাও শুধু বেলীর সাথে , কেন ? কিছুক্ষণ পর ওয়াসরুমে যায় ইরফান । শার্টের বোতাম গুলো খুলে শার্টটা খুলতে যাবে ওমনি শার্টে লেগে থাকা ছোট একটা জিনিসে নজর যায় ইরফানের । ছোট আর চিকুন একটা কানের বাউচি । বাউচিটা হাতে নেয় ইরফান । কিছুক্ষণ ভাবার মনে পড়ে তার বেলীর কানে সেইদিন এমন দুল দেখেছিল সে । বেলী যখন রাতে পানি খেতে আসছিল । তার মানে আজকে মারার সময় হাত পা ছুড়তে গিয়ে বাউচির হুক খুলে গিয়ে তার শার্টের মধ্যে আটকে যায়
। ভাবতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ইরফান , এতটাই নির্দয়ের মত মেরেছে সে বেলীকে , কে জানে কানের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা ।
শাওয়ার নিয়ে রুমে আসে ইরফান । ক্ষুধাও লাগছে ভিষণ তার । কিন্তু বেলী কি খাবার দিবে টেবিলে ? তার কিছুক্ষণ পরই মিনু এসে ডাক দেয় ,
– ভাই আছেন নি ?
– হ্যাঁ মিনু আয় ,
– ভাই খাবার দিছি , আসেন
– যা আসছি
মোবাইলটা চার্জে দিয়ে ইরফান খেতে যায় । টেবিলে সব খাবার সাজানো কিন্তু তবুও কেন জানি ইরফানের ভালো লাগছে না । মিনু টেবিলটা সাজিয়েছে ঠিকই কিন্তু বেলীর মত না ।
– মিনু ,
– জ্বে ,
– ভাতের বোল টা এইদিকে দে ,
– নেন ভাই ,
– জুঠা ফালানোর প্লেট কই ?
– দেই নাই ?
– কই আর দিলি ,
– আনতাছি
মিনুকে বলে বলে সব করায় ইরফান । এক প্রকার বিরক্ত হয়ে গেছে সে । এইভাবে বলে বলে করানো যায় নাকি ? বেলী হলে সব করে রাখতো । মনে মনে ভাবছে আর খাচ্ছে ইরফান ।
– তোরা খাবি না ,
– ভাবী ঘুমাইয়া গেছে আমি আর খামু না ।
– ওহ ,
ইরফান কয়েক লোকমা খেয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে যায় । অন্যান্য দিন তৃপ্তি নিয়ে খায় সে কিন্তু আজ তার খাবার মনে হয়েছে গলা দিয়েই নামছে না । তাই দ্রুতই উঠে যায় সে । মিনু সব গুছিয়ে নিয়ে বেলীর রুমে চলে যায় ।
রাত প্রায় ৪ টার বেশি বাজে , ইরফানের চোখে ঘুম নেই । বার বার বেলীর মুখটা ভেসে আসছে তার চোখের সামনে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো রুবি যে চলে গেছে তাতে তার কোন মাথা ব্যাথাই ছিল না । সে এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু তার ঘুম আসছে না । টেবিলের উপরে থাকা বেলীর কানের ছোট দুলটা নজরে যায় তার । দুলটার দিকে তাকিয়ে আছে সে পলকহীন চোখে । কিছুই বুঝতে পারছে না সে , কেন এতটা অত্যাচার করে সে বেলীর উপরে । আর বেলীই বা কেন মা’র খেয়েও পড়ে আছে তার কাছে । চারদিকে আজানের শব্দ শুনা যাচ্ছিলো তখন । ইরফান বুঝে যায় পুরো একটা নির্ঘুম রাত পার করলো সে । ফজর নামাজের আজান পড়ে গেছে , নিশ্চয়ই বেলী এখন উঠবে । কারণ এর আগেও একদিন সে দেখছে বেলী ফজর নামাজ আদায় করার কোরআন শরীফ পড়ে । ইরফান বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল জোড়া পরে নিয়ে রুম থেকে বাহিরে যায় ।
বেলীর রুমের দরজা খোলা । অন্যান্য দিন তো দরজা আটকানো থাকে আজ খোলা কেন , আর আজ বেলী উঠে নাই ? প্রশ্ন গুলো কৌতুহল জাগায় ইরফানের মনে । পরে ভাবে এই কাজ মিনুর । মিনু অনেক ভুলভাল কাজ করে থাকে , হয়তো দরজা দিতে ভুলে গেছে মেয়েটা । ইরফান বেলীর রুমের দরজার সামনে আসে , নিচে মিনু কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর খাটের উপরে বেলী এপাশ ফিরে গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে । ড্রীম লাইটের আলোতে সব কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । প্রায় ৫ টা বাজে আজ বেলী উঠে নাই কেন নামাজ পড়তে ? প্রশ্নটা বার বার মনে খচ খচ করছিলো ইরফানের । আগের বারও তো মা’র খেয়েও নামাজ পড়তো তাহলে আজ কেন পড়লো না । ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে যায় ইরফান । চুপ করে শুয়ে শুয়ে বেলী কেন নামাজ পড়তে উঠলো ন সেই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বলতেই পারেনি ইরফান ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইরফান । অফিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে তাকে । প্রজেক্ট নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত সে । তার উপর , উপরমহল থেকেও অনেক চাপ আসছে তার । কিন্তু নাস্তা কি পাবে সে ? বেলী যদি নাস্তা না দেয় ? এইসব ভাবতে ভাবতে ডাইনিং টেবিলের কাছে যায় সে । অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে ইরফান । আগের মত করে সব সাজানো আছে টেবিলে , ঠিক যেমন বেলী সাজায় তেমনটাই আছে । রান্নাঘরের দিকে হাক্লা উঁকি দেয় সে , দেখে সেখানে মিনু আর বেলী দাঁড়িয়ে আছে । সেই আগের মত মাথায় ওড়নাটা দুই পেচ করে পরা । পরোটা , ডিম ভাজি , গাজর আর আলুর মিক্সড ভাজি , জুস সহ সব কিছু দেয়া আছে টেবিলে । ইরফান মোবাইলটার ঘড় দেখে টেবিলে বসে পড়ে । মিনুর হাত দিয়ে চা পাঠিয়ে দেয় বেলী তবুও নিজে সামনে যায়নি ।
– ভাই আপনের চা ।
– রাখ ,
মিনু দিয়ে চলে আসে । ইরফান আরও একবার রান্নাঘরের দিকে তাকায় । দেখে বেলী ওইদিকে মুখ করে রান্না করতেছে । ইরফান আর কিছু না বলেই খেয়ে চলে যায় । ইরফান চলে গেলে বেলীও সব কাজ শেষ করে বিছানায় এসে শুয়ে যায় ।
অন্যদিকে , অফিসে বসের কাছে ইচ্ছামত ঝাড়ি খেয়েছে ইরফান । হাউজ বিল্ডিংয়ের প্রজেক্টটা অনেক জরুরী । আর এর সাথে জড়িয়ে আছে ইরফানের প্রমোশন । বাসায় এত সমস্যার কারণে বেচারা কাজ ঠিক মত করতে পারেনি বলে বস ঝেড়েছে । বসের কেবিন থেকে এসে নিজের কেবিনে বসে পড়ে ইরফান । এমন সময় হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে । ইরফান ফোন রিসিভ করার পর একজন ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর শুনা যায় ।
– হেলো ,,,,,,
– হ্যালো কে বলছেন ?
– বাজান আমি , বেলীর মায় কইতাছিলাম ।
এই সময়ে বেলীর মাকে একদম আশা করেনি সে । কিন্তু এই সময়ে হঠাৎ বেলীর মায়ের ফোন । তবুও কথা বলে ইরফান ।
– জ্বি বলুন ,
– কেমন আছো বাজান ?
– জ্বি ভালো , আপনি ?
– ভালা আছি , বাজান বেলীফুলে কই , একটু কতা কইতাম ।
– আমি তো অফিসে , ও বাসায় ।
– আসলে কাইলকা দুফুরে মাইয়াডায় একটা নাম্বারের তন ফোন দিছিলো , জিগাইলাম কার মোবাইল কইলো দোহানের মোবাইল । বাজান ওরে একটা মোবাইল দিতা , আমার লগে একটু কতা কইতো । মন ডা আনচান আনচান করে মাইয়াডারে কত দিন হইছে দেহি না ।
বেলীর মায়ের এমন কথায় হতভম্ব হয়ে যায় ইরফান ।।
– তার মানে কাল দুপুরে বেলী তার মায়ের সাথেও কথা বলেছিল । আর আমি রুবির কথায় এইভাবে বেলীকে………. [ মনে মনে ]
– হেলো বাজান ,
– জ্বি বলুন , নাম্বার পেলেন কোথায় আমার ?
– তোমার আব্বার কাছ থেকে নিছিলাম ।
– আচ্ছা আমি বাসায় গিয়ে বেলীর মাখে কথা বলিয়ে দিবো আপনাকে ।
– আইচ্ছা বাজান আইচ্ছা , তাইলে রাহি এহন ?
– জ্বি ভালো থাকুন ।
– তোমরাও ভালা থাহো ।
এইবলে ইরফান লাইনটা কেটে দেয় । অফিসের কাজে মন দেয় । অন্যদিকে একা ঘরে বেলী কঁকিয়ে মরছে । ব্যাথায় আর যন্ত্রণার চোটে কাঁদছে মেয়েটা । বাসাতে একটা মোবাইলও নেই যে ইরফানকে ফোন দিবে মিনু ।
রাত ৮ টার পর ইরফান বাসায় আসে । মিনু দরজা খুলে দেয় । ইরফান মিনুর মুখের দিকে তাকায় , মিনু মুখটা গম্ভীর করে আছে । তাই নিজ থেকেই প্রশ্ন করে ,
– মিনু বেলী কোথায় ?
– শুইয়া আছে , আপনে ফেরেস হোন ভাই , কফি আনতাছি । আর আইজ্জা আমি বানামু , খারাপ অইলে বইকেন না ।
এইটা বলে মিনু রান্নাঘরে চলে যায় । ইরফান দরজা লাগিয়ে বেলীর রুমের দিকে যায় । খাটের মধ্যে উপুর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা । এক পায়ের সেলোয়ার উপরে উঠা , গায়ে ওড়না নেই । ইরফান যখন অফিস থেকে বাসায় আসে ওই সময় বেলী নামাজে থাকে । ইরফান প্রায় সময়ই দেখেছে কিন্তু আজ বেলী নামাজও পড়ছে না এইভাবে শুয়ে আছে , কারণ টা উপলব্ধি করে পারেনি ইরফান ।
নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইরফান । এর মাঝে আজ সারাদিনেও রুবির খবর নেয় নি সে । আর রুবিও নেয় নি ।
কফি নিয়ে রুমে আসে মিনু ।
– ভাই আপনের কফি ,
– দে ,
– ভাই এইডা ভাবী আপনেরে দিতে কইছে ।
– আর কইছে আজকেই লাগবো , আপনেরে আরও আগেই কইতো কিন্তু মোবাইল নাই কি দিয়া কইবো ।
– কিসের কাগজ এটা ?
– আমি জানি না ভাই , আপনে আইনা ভাবীরে দিয়া আইসেন ।
– আচ্ছা যা তুই ।
মিনু গেলে ইরফান কাগজের ভাজটা খুলে । ভাজে একটা জিনিসের নাম উল্লেখ ছিল , আর এক পাতা ‘এলজিন’ ট্যাবলেটের নাম লিখা ছিল । ইরফান এখন বুঝেছে বেলীর নামাজ না পড়ার কারণ । বেলীর মা গ্রাম্য হলে কি হবে মেয়েকে সব ধরনের ভালো জিনিস দেয়ার চেষ্টা করেছেন সব সময় । বেলীর হাতের লিখায় মুগ্ধ ইরফান । হাতের লিখাটা অনেক সুন্দর ছিল । ইরফান আর দেরী করেনি সোজা নিচে নেমে হাটা শুরু করে । মোড়ের মাথার সামনে ফার্মেসি আছে সেখানেই যায় ইরফান । প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে সাথে একটা হট ওয়াটার ব্যাগও কিনে নেয় । যত তাড়াতাড়ি হাটা যায় হেটে বাসায় পৌঁছায় ইরফান । মিনু তখন নাটক দেখে টিভিতে । ইরফান সোজা বেলীর রুমে ঢুকে যায় । বেলী তখন ওপাশ ফিরে আছে । কয়েকবার ডাকে বেলীকে ইরফান । সাড়া দেয়নি বেলী , হয়তো লজ্জায় তাকাতে পারেনি । ইরফান ততটাও বোকা নয় বুঝে যায় সবটা সে । তাই নিজে নিজেই বলা শুরু করে ।
– এখানে ওইটার থেকেও ভালোটা আছে । আর এলজিন তিন পাতা আছে দিন দুইটা করে খেলেই হবে । হটব্যাগটা দিয়ে ছ্যাক দিলে ব্যাথা কমে যাবে হয়তো । আর আজ রাতে খাওয়া দাওয়া করবো না আমি , কিছু বাড়তে হবে না আমার জন্যে ।
এইটা বলে ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । ইরফান বের হলে বেলী তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াসরুমে যায় । ইরফান রুমে এসে একটা কথাই ভাবতে থাকে , বেলী এতটা চাপা স্বভাবের কেন ? হয়তো ওর মাঝে এমন কিছু দেখেছিল তার বাবা দেখেছিলেন যার জন্যে বেলীকে তার সাথে বেঁধে দিয়েছে ।
কিন্তু ঝোকের বসে কিছু ভুল পদক্ষেপও অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
অনেক রাতে টিভির আওয়াজে রুম থেকে বের হয় ইরফান । ইরফান তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল । ড্রইং রুমে টিভি চলতেছে । মিনু সেখাই সোফার মধ্যে টিভি চালিয়ে ঘুমিয়ে গেছে । রুবি না থাকলে মিনু এ বাড়িতে ভালোই স্বাধীনভাবে চলতে পারে । ইচ্ছামত টিভি দেখা আর যা মন চায় খেতে পারে । বেলী কিছুই বলে না আর না বলে ইরফান । টিভি অফ করে সামনে পা বাড়াতেই দেখে বেলীর রুম থেকে আওয়াজ আসতেছে । ইরফান একটু এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বেলী নিচে বসে উপুর হয়ে আছে । দুই হাত দিয়ে পেটে চাপ দিয়ে ধরে কাঁদছে বেলী । ব্যাথাটা হয়তো অনেক বেড়ে গেছে । আজ মিনুও ড্রইং রুমে ঘুমাচ্ছে । যন্ত্রনার চোটে নিচে এসে পড়ে আছে মেয়েটা । ইরফান প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে যায় । ওই মুহুর্তে ইরফান কি করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে । ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে বেলীর দিকে । বেলী তখনও ফ্লোরে মুখ গুজে আছে আর ব্যাথার চোটে কাঁদছে । ইরফান বেলীর পিঠে হাত রাখার পর পরই বেলী ফ্লোরে মুখ গুজেই বলা শুরু করে ,
– মিনু আমাকে ধরো , আমার আর সহ্য হচ্ছে না । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মিনু । অনেক ব্যাথা করছে ।
কথাটা ইরফানের বুকে গিয়ে লাগে । বেলী ভেবেছে হয়তো তার কান্নার শব্দ শুনে মিনু উঠে আসছে । বেলী কেঁদেই যাচ্ছে তল পেটে হাত দিয়ে । পরক্ষনেই ইরফানের মনে পড়ে যায় কাল রাতে মাইরের সময় এলোপাথাড়ি লাথি দিয়েছিল , লাথি গুলো পেটে পড়ে নাই তো আবার । ইরফান আর দিক বিক না ভেবে বেলীকে কোলে তুলে নেয় । এইভাবে হঠাৎ কারো কোলে চড়ে বেয়াক্কেল হয়ে যায় বেলী । ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে বেলী । ইরফানও বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । চোখ মুখ ফুলে একাকার বেলীর । বিছানায় শোয়ানোর পরেও বেলী চাপা স্বরে ‘ ও মাগো ‘ বলে পেটে চেপে ধরে । ইরফান বেলীর কাধে হাত দিয়ে ,
– একটু সহ্য করো , আমি আসতেছি ।
ব্যাথার ঘোরেও ইরফানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘ তুমি ‘ শব্দটা বেলীর কানে জোরেই গিয়ে লাগে । তখনও বেলীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । কিছুক্ষন পর , ইরফান হট ওয়াটার ব্যাগে করে গরম পানি আনে । এনে বেলীর তল পেটে দিতে চায় । কিন্তু বেলী হাত সরায় নি । তাই ইরফানই জোর করে হাত সরিয়ে নিয়ে গরম পানির ছ্যাক দিয়ে দিচ্ছে । প্রায় অনেক্ষণ যাবত ছ্যাক দিয়ে দেয়ার পর ব্যাথাটা অনেকটাই দমে যায় বেলীর । তবে নিরবে কাঁদছে সে । এই প্রথম ইরফান তার একটু হলেও সেবা করেছে ।
– ব্যাথা কমছে ?
– …………
– কি হলো ব্যাথা কমে নাই ?
– কমছে ,
– ট্যাবলেট খাবা ?
– তুই টাই ঠিক আছে , অভ্যাস হয়ে গেছে শুনতে শুনতে ।
ইরফান এই কথাটা শুনে উঠে যাওয়া নেয় , তখনই বেলী কিছু বলে ,
– শুনেন ,,,,,,,?
– হু ,
– আমি যদি মরে যাই , আপনি কি খুব ভালো থাকবেন ?
-…………
– বলেন না , আমি যদি মরে যাই আপনি ভালো থাকবেন তো ? বিশ্বাস করেন এত মা’র আর নিতে পারি না । আর পারি না নিতে । তার থেকে বরং মেরেই ফেলেন । আমি মরে গেলে আমার লাশটা আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েন । বিশ্বাস করেন আমার পুরো শরীরটা ব্যাথা হয়ে গেছে । আর পারি না ব্যাথা সহ্য করতে ।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে কথা গুলো এক নাগারে বলে দেয় বেলী । আর ইরফানের চোখ থেকে কেন জানি হঠাৎ করেই দুই দন্ড পানি বেয়ে পড়ে যায় ।
ইরফান আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়নি সেখানে । সোজা বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায় । আর বেলী তখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় ।
[ বিঃদ্রঃ আজকের ব্যাথাটা কেন ছিল সেটা হয়তো সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বিশেষ করে মেয়েরা । মান্থলি অসুস্থতার সাথে প্রত্যেক মাসে সবাই লড়াই করে আসছি আমরা । এই অসুস্থতায় যার ব্যাথা হয় সেই আসলে বুঝে ব্যাথা কি জিনিস । এতটাই ব্যাথা অনুভব হয় যে এক এক সময় মনে হয় যেন নিজের শরীরের মাংস নিজে কামড়ে নেয় । এই যন্ত্রণাটা এতটাই কষ্টের হয় যে পুরো শরীরটাকে কুচকে দেয় । নারীজাতিকে আল্লাহ পাক এমন যন্ত্রণা দিয়েই তৈরি করেছেন যাতে নারী জাতির জন্যে পুরুষদের মনে একটু হলেও সম্মান আসে । কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা নারীদের সম্মান কি করবে তাদের সম্মান নিতেই ব্যস্ত যার বাস্তব উদাহরণ গুলো প্রায় প্রতিদিনই আমরা টিভির হেডলাইনে দেখে থাকি । আবার কিছু কিছু পুরুষ আছেন যারা নিজেদের থেকেও নারীজাতিকে সব সময় সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে যাচ্ছেন । যেমন এক পুরুষ এস এস সি পাশ করেও বউকে মাস্টার্স অবদি পড়িয়েছেন এখন সেই বউ সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষিকা । দুটি সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাদের । আবার কিছু কিছু পুরুষ আছেন যারা ইরফানের মতও হয়ে থাকেন যারা বউ পিটিয়ে আবার সেই বউয়ের সেবা করতেও দ্বিধা করেন না । এই কথা গুলোর অর্থ হচ্ছে আমাদের সমাজে সব ধরনের নারী এবং পুরুষ আছেন । ভালো খারাপ উভয় মিলেই তো জীবন । তাই না ? আমার কথা গুলো হয়তো কিছু কিছু ভাইয়াদের মনে কষ্ট দিবে । তার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত । কিন্তু কষ্টের হলেও এটাই সত্যি । ]
.
.
চলবে…………….