ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #পর্ব_৬,০৭

0
301

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৬,০৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
০৬

আজ দুইদিন হলো রুবির খবর নেই । ইরফানও রেগে ফোন করেনি তাকে । মাঝে জাফর সাহেব (রুবির বাবা) ফোন করে বাসায় যেতে বলেছেন ইরফানকে । কিন্তু ইরফানই যায় নি । রুবির বলা মিথ্যা কথা গুলো মেনে নিতে পারেনি ইরফান । সে এমনিতেও মিথ্যা পছন্দ করে না তার উপর না বলে টাকা খরচ করে আরেকজনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে । এর জন্যে আরও বেশি রাগ ইরফানের । তাই ইচ্ছা করেই যায় নি সে ।
অফিস থেকে এক গাদা কাজ নিয়ে বাসায় ফিরেছে ইরফান । বেলীর শরীরটা দুদিন পর ভালোই আছে এখন । তাই দৌড়ে দৌড়ে সব কাজই করতে পারে সে ।
আর বেলীকে দেখে ইদানীং বড্ড বেশি মায়া হয় ইরফানের । মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালো লাগাটা বের হয়ে আসতে বেশি সময় নেয় না ।
ইরফান নিজের রুমে ফ্রেশ হয়ে নেয় । বেলী সেই সময়েই কফি হাতে রুমে যায় । ইরফান তখন খালি গায়ে শরীরের পানি মুছতেছে । ইরফানকে ওই অবস্থাতে দেখে অনেকটাই ইতস্তত বোধ করে বেলী । বেলীর ইতস্তত বোধ করা দেখে ইরফান টি-শার্ট টা পরে নেয় ।

– আপনার কফি ,
– রেখে দে ,
– হু ,

বেলী চলে যেতে নিলে ইরফান ডাক দেয় তাকে ।

– বেলী শুন ,
– জ্বি
– তোর একটা জিনিস আমার কাছে আছে ,
– জিনিস ! কি জিনিস ?

এরপর ড্রয়ার থেকে কানের দুলটা নিয়ে আসে ইরফান ।

– হাত পাত ,
– কি জিনিস আছে ,
– হাত পাত আগে ,

বেলী হাত পাতলে ইরফান বেলীর এক কানের দুলটা বেলীর হাতে দেয় ।

– এই জিনিসটা ,
– হায় আল্লাহ এইটা আপনার কাছে ছিল ।
– হ্যাঁ
– আমি কত খুজছি এইটা , আমার বাবার শেষ স্মৃতি এইটা । অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে বানিয়ে দিছিলো ।
– ওহ ,
– আচ্ছা , কি খাবেন রাতে ?
– দুপুরে রান্না করস নাই ?
– ভাত রান্না করছিলাম , আর কালকের রান্না করা তারকারি ছিল , তাই খেয়ে নিছি আমি আর মিনু ।
– ফ্রিজে তো মোটামুটি সবই রাখা আছে বেলী তাহলে কালকের রান্না করা জিনিস কেন খাস তুই ।
– ফেলে দেয়ার থেকে খেয়ে নেয়া টা ভালো । আপনি কি খাবেন , বলেন আমি রান্না বসাবো ।
– মাছ ভুনা করিস ,
– আচ্ছা ।

বেলী রুবির থেকে অনেকটা আলাদা । অপচয় করতে একদম চায় না । ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায় ইরফান । এক মনে কাজ করতেই আছে তো করতেই আছে । ল্যাপটপ থেকে কাজ শেষ করে আড়মোড়া দেয় ইরফান । ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখে রাত ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট । তার মানে ১২ টা বাজতে আর মাত্র ৫ মিনিট । বেলী কি এখনও রান্না করে নাকি৷। একবার এসে ডেকেও গেলো না । কান থেকে হেডফোন খুলে ডাইনিং টেবিলে যায় ইরফান । বেলী সেখানেই সোফায় বসে কাত হয়ে আছে । ইরফান গিয়ে আস্তে করে নাড়া দেয় বেলীকে । ইরফানের ছোয়া পেয়ে বেলী উঠে যায় ।

– কিরে , রাত ১২ টা বেজে গেছে আমাকে ডাকলিও না , আর এখানে বসে ঘুমিয়ে গেছিস ।
– কয়েকবার গেছিলাম রুমে , ডাকছিলামও , আপনি কানের মধ্যে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করতেছিলেন । ভাবলাম কাজ শেষ হলে আবার ডাক দিবো , আর আমিই ঘুমিয়ে গেছি ।
– হায়রে , চল
– আসেন
– মিনু কোথায় ?
– সে খেয়ে দেয়ে ঘুম ।
– ওহ ,

বেলী ইরফানকে ভাত বেড়ে দেয় । প্রয়োজনীয় সব কাছে এনে দেয় । ইরফান খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বেলীর দিকে তাকায় ।

– তুই খাইছিস ?
– হু
– সত্যিই খেয়েছিস ?
– হু
– ইদানীং মিথ্যা বলস তুই , রুবিকে চড় মেরেছিলাম কিন্তু মিথ্যা বলার কারণে ।
– আর আমি সত্য বলার পরেও লাথি খাই ,
আপনি খেয়ে নেন ।

বলে বেলী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল । ওমনি ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নেয় ।

– কিছু বলবেন ?
– তোর সাথে একদিন বসেও ভাত খাওয়া হয় নাই , রুবির সাথে সময় মিলে না । আমি বরাবর খাবার একাই খাই । আজ না হয় তুই আমার খাওয়ার সাথী হলি ।
– মানে ,
– আমার সাথে বসে খেতে হবে আজকে তোকে ।

কথাটা শুনে কলিজায় একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । বিয়ের প্রায় ১০ মাস পর ইরফান নিজ থেকে বেলীকে তার সাথে ভাত খেতে বলেছে । অনুভূতি টা ঠিক কি রকম বলে তা বুঝতে পারছে না বেলী । কিছুক্ষণ ইরফানের দিকে তাকিয়ে আবারও নজর নিচে নামিয়ে ফেলে সে ।

– কিরে , বসবি না ?
– আপনি খান , আমি এখন আর খাবো না ।
– আমি কি এতই খারাপ নাকি যে আমার সাথে বসে ভাত খাওয়া যায় না ।
– নাহ নাহ তা কেন হতে যাবে ?
– তাহলে খেতে বস ।
– হু ,

কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে যায় বেলী । ইরফান আড় চোখে বেলীর খাওয়ার ধরণ দেখে । এর আগে কখনো ইরফান বেলীকে খেতে দেখে নি । যতক্ষন ছিলো শুধু মারধর আর বকাবাধ্য করে গেছে মেয়েটাকে । মেয়েটাও যেমন , চুপচাপ মানিয়ে নিয়েছে সবটা । এমনকি সতীনের সাথে সংসার করতে হবে সেইটাও মানিয়ে নিয়েছে সে । একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করেনি বা না জানিয়েছে নিজের আপত্তির কথা । গত সাতটা মাস যাবত চোখের সামনে নিজের স্বামীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এক রুমে থাকতে দেখেছে । প্রাত্যহিক সতীনের ভেজা চুল দেখতে হয়েছে তাকে । তবুও নিজের অধিকারের দাবি নিয়ে একবারের জন্যেও দাঁড়ায় নি সামনে এসে । ওর মত মেয়ে খুব কমই আছে , বা পাওয়া যায় । ইরফান কথা গুলো মনে মনে ভাবছে । ঠিক এক চামচের মত ভাত নিয়েছে আর একটু ডাল ।

– মাছ নিবি না ?
– উহু ,
– কেন ?
– ডালটা দিয়েই খাই ।
– মাছে কি সমস্যা ?
– কিছু না , আপনি খান । আরেক টুকরা দিবো ?
– নাহ থাক ।

কোন রকম খেয়ে উঠে যায় বেলী । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলী তার সামনে থাকতে চায় না । অবশ্য এইসবের একমাত্র কারণ ইরফানের করা খারাপ ব্যবহার গুলো । তাই সেও আর কিছু বলে নাই ।

আব কিছু গুছিয়ে পরিষ্কার করে বেলী শুতে যাবে এমন সময় দেখে ইরফান ড্রইং রুমে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে । ঘড়িতে প্রায় ১ টা বাজে । এই সময়ে কি কাজ করবে আবার । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইরফানকে দেখছে বেলী । এরই মাঝে ইরফান আবারও ডাক দেয় বেলীকে ।

– বেলী শুন তো ?
– হু ,
– আমার রুমে যা , সেলফের উপরে দেখবি একটা সাদা কৌটা রাখা আছে নিয়ে আয় ।
– হু ,

কৌটা এনে ইরফানের কাছে রাখে বেলী । অনেকগুলা জিনিসই রাখা আছে টি-টেবিলের উপরে । বেলী তাকিয়ে আছে সেইগুলার দিকে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফান নিজ থেকেই বেলীকে বসতে বলে ।

– কিরে দাঁড়িয়ে আছিস যে , বস এইখানে ।
– এইগুলা দিয়ে কি করবেন ?
– হাউজ বিল্ডিংয়ের প্রজেক্ট এর জন্যে । কাল অফিসে প্রেজেন্টেশন ।
– ওহ , বাড়ি বানাবেন ?
– হা হা , নাহ রে পাগলী । এটা যাস্ট একটা সেম্পল হবে ।
– ওহ ,

ইরফানের মুখ থেকে পাগলী শব্দটা বেলীর বুকে গিয়ে লাগে । তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে বেলী ।

– মানুষটাকে কত শান্ত লাগে দেখতে । কিন্তু কে বলবে এই মানুষটার হাতে কারণে অকারণে মা’র খেতে হয় আমার । আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা সে কখনো দেখবে না । নাহ কখনো জানতে চাইবে আমি কি চাই ? রুবিকে আপুকে মানুষটা খুব ভালোবাসে , তাহলে আমাকে কি একটু ভালোবাসতে পারে না সে ? বিয়ের পর থেকে অপমান , অবহেলা আর মারধর জুটে এসেছে এই পোড়া কপালটায় আমার । আমার জনম দুঃখি মা’টা ভাবে আমি স্বামীর ঘরে রানী হয়ে আছি । অথচ আমার মা তো আর জানে না আমার জীবনের এই ৭ টা মাস কিভাবে কাটছে ।

এইসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই চোখের পানি এসে যায় । মুখ মুছার ছলে চোখের পানি গুলো মুছে নেয় বেলী ।

– সেম্পল হলে তো বানাইতে হবে ।
– হ্যাঁ ,
– তাহলে নিবেন কিভাবে ?
– কাল অফিসের গাড়ি আসবে ,
– ওহ ,
– কাল যদি প্রেজেন্টেশন টা ভালো হয় , তাহলে প্রমোশন টা পাক্কা ।
– আলহামদুলিল্লাহ হয়ে যাবে ।
– কিভাবে সিউর হলি ?
– মন বললো , হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ ।

ইরফান একবার বেলীর মুখের দিকে চেয়ে আছে । বেলীর মুখটা আসলেই মায়ায় ভরা । উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের হলেও দেখতে মাশা-আল্লাহ । মনে মনে এখন আফসোস হয় ইরফানের । যদি তখন সে একটু বাস্তবিকতার সাথে ভাবতো তাহলে আজ হয়তো বেলী একাই তার ঘরে থাকতো । কিন্তু ভালোবাসা নামক পোকার কামড়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে । বেলী ফোম গুলো হাত দিয়ে ধরতে চাচ্ছে , কিন্তু ইরফানের ভয়ে ধরতে পারছে না । তাই অনুমতি নিতেই ইরফানের দিকে তাকায় সে ।

– এইগুলা একটু ধরি ?
– ধর ,

ফোম গুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে নেয় ।

– আমি না ক্লাস টেনে থাকতে একটা বাড়ি বানাইছিলাম । ওই যে গার্হস্থ্য অর্থনীতির ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ।
– ওহ ,
– আমি সাহায্য করি ?
– তুই পারবি না তো , এটা অন্য রকম ।
– কি রকম ,

ইরফান ল্যাপটপ থেকে একটা ঘরের ছবি দেখিয়ে বলে ,

– এই রকম বানাতে হবে ।
– আপনি পারবেন ?
– হ্যাঁ , পারবো তো ।
– আমিও পারবো , বানাই ?

বেলীর কন্ঠস্বরটা ছোট । চিকন স্বরে কথা বলে সে । আবদার গুলো দেখলে যে কারো চোখে পানি আসার মত । ইরফান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর হ্যাঁ বলে দেয় । রাজ্য জয় করা হাসি দিয়ে ফোম গুলোতে গ্লু লাগাতে থাকে বেলী । ইরফানও সাহায্য করছিল বেলীকে ।
প্রায় দেড় ঘন্টা বেলী বাড়ি টা বানিয়ে ফেলে । একদম হুবুহু ল্যাপটপে থাকা ছবিটার মত । হস্তশিল্পে বেলীর হাত পাকা , কারণ বেলীর বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন ।

– বাড়ি তো হয়ে গেলো , নাম কি দিবি এই বাড়ির ?
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘

অজান্তেই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বেলীর । ইরফান চুপ করেই তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । পরে বেলী কথা কাটিয়ে নেয় ।

– মা,,,,মা,,, মানে , নাম যে কোন একটা দিয়ে দিয়েন ।
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ নাম টাই থাকবে ।
– ঘুমিয়ে যাইয়েন , আসছি

এই বলে বেলী উঠে যেতে নেয় ,

– বেলী শুন ,
– জ্বি ,
– কাল যদি প্রজেক্টটা হয়ে যায় , তাহলে কি চাই তোর ?
– কিছুই না ।
– বল , কি চাই তোর ?
– যদি চাই , দিবেন ?
– হ্যাঁ ,

ইরফান জানে বেলী বেশি দামি কিছু চাইবে না তাই নির্দ্বিধায় বলে ফেলছে হ্যাঁ ।
বেলীও তার ইচ্ছামত তার চাওয়া গুলো ব্যক্ত করে ।

– আপনি যখন আমাকে মারবেন আমি কাঁদবো না , একদম কাঁদবো না , শুধু ছাড়তে বলবেন না , সহ্য করতে পারবো না । আসছি , ঘুমিয়ে যাইয়েন ।

এই কথা বলে সেইখান থেকে চলে যায় বেলী । ইরফান একদম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বেলীর চলে যাওয়ার দিকে ।

[ বিঃদ্রঃ হয়তো এই হয় কিছু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে । যারা বিয়েকে অনেক সম্মান এবং স্বামীকে অনেক শ্রদ্ধা করে । তারা মা’র খেতে প্রস্তুত থাকে তবে সংসার ছাড়তে রাজি নয় । বর্তমান যুগের মেয়েরা আমরা ভাবি করলাম না স্বামীর ঘর খেলাম না স্বামীর ভাত , নিজে কামাই করে খাবো । আসলে বলা যতটা সহজ একজন মেয়ের পক্ষে করা ততটাই কঠিন । তবুও আজকের যুগে মেয়েরা পিছিয়ে নেই । কারণ আমাদের ঘুরে দাড়াতেই হয় এবং হবে । সব কথার শেষ কথা , আমরা নারী……… দিনশেষে আমরাই বিজয়ী ]

.
.

চলবে……………

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা উঠে বেলী সব নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে । আজ ইরফানের জন্যে একটি বিশেষ দিন । প্রেজেন্টেশন টা সবার পছন্দ হলেই এই প্রজেক্ট অনুযায়ী তাদের কাজ হবে । এর সাথে ইরফানেরও প্রমোশনটা হয়ে যাবে । সব কিছু মাথায় রেখেই আজ বেলীর আয়োজন । ইরফান লাচ্ছা সেমাইটা খুব পছন্দ করে তাও ডুবো দুধে । আর বেলী সেমাইটা দারুণ বানায় । তাই আজ সেমাইও বানিয়েছে । আজ মনে হচ্ছে ইরফানের থেকে বেলীর উদ্বিগ্নতা বেশি ।
রুমে ইরফান রেডি হচ্ছে । ফরমাল পরে পাক্কা সাহেব সাহেব লাগছে তাকে । সাদা শার্ট সাথে নেভিব্লু ব্লেজার । সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছিল ইরফানকে ।
সব গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বের হয় ইরফান । নাস্তা করতে টেবিলে এসে দেখে এলাহী কারবার । ইরফান যা যা ভালোবাসে সব বানিয়েছে বেলী । ইরফান এইসব দেখছে আর ভাবছে ,

– এক রুবি , যে কিনা একটা থাপ্পড় দেয়াতে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে । খোঁজ খবর তো নেয়-ই না , আসারও নাম নেই । আর এক এই মেয়েটা , শত অবহেলা , শত মা’র খেয়েও আমার কথা ভেবে যায় নির্দ্বিধায় । আমার কি প্রয়োজন , কিসে আমি ভালো থাকি সবটাই তার জানা । আর এই মেয়েটাকে গ্রাম্য , অশিক্ষিত , গরীব মানুষ ভেবে কত অপমান , কত মারধর করেছি আমি । কতটা নির্বোধ হলে এইসব করতে পারলাম । এমনকি জিদ করে আরেকটা বিয়েও করে ফেললাম । ওর বয়সটাই বা কতটুকু ছিল , যার এখন প্রতিটা মুহুর্ত হাসার কথা তার মুখ থেকে হাসি নামক জিনিসটা কেড়ে নিয়ে নিলাম আমি । আর সে নিরবে চুপ করে থাকে । সত্যিই হাজারো মেয়ে রুবি হতে পারে , কিন্তু একজন মেয়ে বেলী হতে হাজারবার জন্ম নিতে হয় হয়তো হবে ।

ইরফান এর ভাবনায় ছেদ পরে মিনু ডাকে ,

– ও ভাই , ভাই ???
-……..
– ভাই , ও ভাই,,,,,,,,???
– হু,,,,,,, হু
– দাড়াইয়া আছেন যে ভাই , বসেন । নাস্তা কইরা লন ।
– এত নাস্তা বেলী বানিয়েছে ?
– হ ভাই ,
– এত কিছু কিভাবে খাবো ?
– সব কিছুর থিকা একটু একটু কইরা খাইয়া নেন , আর সেমাইডাও খাইয়েন ডুবা দুধে বানাইছে ভাবী । সেই সকাল থিকা সব বানাইছে ভাবী ।
– বেলী কোথায় ?
– ভাবী আইতাছে , আপনে খাইয়া নেন ।

ইরফান ভেবেছিল বেলী অন্তত এখন তার সামনে থাকবে । কিন্তু বেলী রুমে বসে আছে । বিষয়টা ইরফানের কাছে খটকা লাগছিল , কিন্তু হাতে সময়ও নেই তার । তাই নাস্তা খেতে বসে যায় সে । প্রত্যেকটা আইটেম থেকে কিছু কিছু খেয়ে নেয় সে । তবুও তৃপ্তি পাচ্ছে না সে , হয়তো তৃপ্তিটা বেলীর আগমনেই ঘুচে যেতো । আজ বেলীকে একটু ট্রাই করবে সে । সেমাইটা খেয়ে পানি খেয়ে ঘড়িতে টাইম দেখে নেয় ইরফান । গাড়ি আসতে এখনও ১০ মিনিট বাকি । ইরফান উঠে বেলীর রুমে যায় ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে বেলী বিছানায় ওপাশ ফিরে বসে কি যেনো করতেছে ।

– বেলী,,,,,,,,,,,?

ইরফানের মুখ থেকে নিজের নামটা শুনে চমকে যায় সে । কেঁপে ওঠে সে , বেলী এমনিতেও একটু ভীতু , আচমকা কেউ এসে ভাউ করলেও সে লাফিয়ে উঠে । গরীব ঘরের আদরের রাজকুমারী ছিল সে আর আজ সে স্বামীর ঘরের কাজের মেয়ে হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে পিছনে ফিরে দাঁড়ায় বেলী ।
ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ওড়না দিয়ে সুন্দর করে দুই পেচ দিয়ে ঘোমটা দেয়া তার মাথায় । এইভাবে বেলীকে খুব সুন্দর লাগে । আবার ওড়না ছাড়াও ভালো লাগে দেখতে । হাত দুটো দিয়ে জামাটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে সে । ইরফান ধীর পায়ে বেলীর সামনে এসে দাঁড়ায় ।

– কিছু বলবেন ?
– হু , নাস্তার টেবিলে গেলি না যে ?
– মিনু তো ছিল , আসলে আমি একটু কাজ করতেছিলাম ।
– টাই টা ঠিক করে বেঁধে দে ।

ইরফানের এমন কথায় হতভম্ভ হয়ে যায় বেলী । হঠাৎ টাই বাঁধার কথা বললো তাও আবার আজকেই । কিন্তু আজকেই তো,,,,,,,

– কিরে বেঁধে দে ,
– বাঁধা আছে তো ,
– ঠিক করে দে টাই টা ।

বেলীর প্রচন্ড ভয় লাগছিল । এখন হাত উপরে উঠাবে কিভাবে সে । উঠালেই তো ইরফান দেখে ফেলবে । আর দেখার পর যদি প্রশ্ন করে তখন কি হবে ? এরই মাঝে আবারও ইরফানের তাড়া ,

– কিরে , একটু পরে গাড়ি চলে আসবে , বেঁধে দে ঠিক করে ।
– ঠিকই তো আছে ,
– টাইতে হাত দিয়ে ঠিক করে দে বেলী ।

অগত্যা হাত টা কাঁপতে কাঁপতে ইরফানের বুকের কাছে আনে বেলী । আর তখনই ইরফানের চোখে অন্য কিছু পড়ে । বেলীর ডান হাতের অনামিকা আঙুলে পুরো ব্যান্ডেজ করা । হাতের দিকে তাকিয়ে আবার সে বেলীর মুখের দিকে তাকায় । ইরফান । সে জানতো বেলীর কিছু একটা হয়েছে যার কারণে বেলী নাস্তার টেবিলের কাছে ছিল না । বেলীর মুখটা একদম শুকনো হয়ে আছে । ইরফান অনেকটা শান্ত গলাতেই বেলীকে প্রশ্ন করে ,

– কিভাবে কাটলি ?
-…………
– কিরে , বল কিভাবে কাটলি ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না ।
– এইটা উত্তর ?
– টাই ঠিক আছে এখন ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না কথাটার জবাব রাতে পাবি , আসতেছি ।

ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলীর মনে ভয় ঢুকে যায় । হয়তো রাতে এসে আবারও মারবে বেলীকে ইরফান । এমনটাই ধারনা তার । তবে আপাতত সব কিছু ভুলে গিয়ে আজকে ইরফানের জন্যে মন থেকে দোয়া পড়ছে বেলী । অসুস্থতার কারণে নামাজ পড়তে পারছে না সে । তাই মনে মনে দোয়া পড়ে বেলী । বেলীর একটাই চাওয়া ।

– ‘ হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল ‘
হে আল্লাহ পাক আপনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং আপনিই উত্তম সাহায্যকারী । আল্লাহ পাক আজ যেনো মানুষটা সফল হতে পারে । তাকে আপনি সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষান করুন এবং তাকে সফলতা দান করুন ।

ঠিক সেই মুহুর্তে মিনু দরজার সামনে থেকে বলে উঠে ,

– মরইন্না দোয়া আছে নি ?

কথাটা শুনে চমকে যায় বেলী । অবাক নজরে মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে সে । হঠাৎ মরার কথা কেন বললো সে ।

– এইসব কি বলো মিনু ?
– না মানে কইছিলাম , মরার আগের দোয়া থাকলে পইড়া লন , কওন যায় না কোন সময় না সময় মাইরা লায় আপনেরে ।
– এইভাবে কেন বলতেছো মিনু ? উনি আমার গায়ে হাত তুলে তা ঠিক তবে আমাকে একেবারে মেরে ফেলবেন না তিনি ।
– হ , হাচাই তো । আরে ভাবী এইসব আপনের মত আলাভোলারাই কয় গো ভাবী । ভাইয়ে জানি কেমন হইয়া গেছে , চুপচাপ । নিশ্চয়ই মাতায় পেলেন করতাছে আপনেরে কিভাবে মারন যায় ।
সি আই ডি ‘ র মইদ্যে এই সব দেহায় ।
– তুমি আর এইসব দেখবা না । এইসব দেখে আর উলটাপালটা চিন্তাভাবনা মাথায় আনে ।
– হ হ , হের সোয়ামীরে লইয়া কিছু কওন যায় না এক্কেরে । এত ভালাবাসা ঠিক না , এই কইলাম আমি । এত ফিডায় তহন কই থাহে ভালাবাসা ।
– রান্নাঘরে যাও আমি আসতেছি ।
– হুহ উচিত কথা কইলেই আমি ভালা না , কি আর করনের আছে আমার । আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাহেন ।

মিনুর এমন পাকা পাকা কথায় এক গাল হেসে দেয় বেলী । তারপর নিজের রুম গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায় বেলী । কিন্তু মনটা উদ্বিগ্নতায় ভরপুর । স্বয়ং আল্লাহ পাকই জানেন অফিসে কি হচ্ছে এখন ।

অন্যদিকে ,

রুবিকে তার বাবা এবং মা উভয়েই বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত । তারা যতই বোঝাচ্ছে সে কিছুতেই মানছে না । জাফর সাহেব সর্বপ্রকার মেয়েকে বুঝিয়েও কোন দিক করতে পারছেন না ।

– তুমি কি চাইছো রুবি , তোমার সংসার টা ভেঙে যাক ?
– বাবা সে আমাকে চড় মেরেছে ।
– মেরেছে তো কি হয়েছে , তোমার প্রোভোকেশনেই তো বেলীকে মারে ইরফান , তা তুমি না হয় একটা চড় খেলেই । তাতে সমস্যা কি ?
– বাবা,,,,,,,,,,?
– স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাসায় বসে আছো । তো বেলী কি সুযোগ পাবে না এই সুযোগে ইরফানকে হাত করার ।
– কখনোই না , ইরফান তো বেলীকে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই করে না ।

তখনই রুবির মা বলে ওঠে ,

– বার বার মানা করছিলাম বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করিস না করিস না , শুনছোস আমার কথা ? এখন সতীন নিয়ে সংসার করস ।
– ওহহহ মা , থামবা ।
– আমি বললেই থামবা , আরেক মেয়ের ঘর নষ্ট করছিস , আল্লাহ তোর সাথে কি করে দেখ এখন ।
– বাবা দেখলা মা কিভাবে বললো ?
– ভুল কিছু বলে নাই তোমার মা । কাল সকালে চলে যাবা ইরফানের কাছে ।
– আমি যাবো না , যতক্ষন না ও আমার পা ধরে ক্ষমা না চায় ততক্ষণ অবদি আমি কোথাও যাবো না ।
– তাহলে বাপের বাড়িতে বসে থাক সারাজীবন ।

মায়ের এমন কথায় রুবি জেদ দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয় ।

– এই মেয়ের যে কি হবে , আল্লাহ পাকই ভালো জানেন ।
– মেয়ের শিক্ষায় ঘাটতি আছে তাই মেয়ে এমন হয়েছে ।
– আমাকে কথা শুনাচ্ছো নাকি তুমি ?
– তুমি মেয়ের মা , তুমি বর্তমান থাকাকালীন সময়ে সে কিভাবে বিবাহিত ছেলের পাল্লায় পড়ে ?
– বিবাহিত ছেলে কি ধোয়া তুলসীপাতা ? যে মেয়ে ইশারা করলো আর ছেলেও গলে গেলো ?
– অবশ্যই গলে যাবে । একটা মেয়ে ইশারা করবে আর ছেলে কি বসে থাকবে । তোমার মেয়ে জানতো না ওই ছেলের বউ আছে ।
– তোমাকে যখন বলেছিল , তখন নিজে চুপ ছিলা কেন ? এখন আমার দোষ দাও কেন ?
– দোষ ছেলেরও দোষ মেয়েরও মাঝে থেকে ওই গরীম এতিম মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে । দেখবা অভিশাপ লাগবে আমাদের৷, ওই মেয়ের অভিশাপ ।
– ওই মেয়েও কম যায় না । চলে গেলেই তো পারে ?
– তুমি মা হয়ে কিভাবে বলো এইসব কথা , তা তোমার মেয়েও তো চলে আসতে পারে ? নিজের কাছে রেখে মেয়েকে বানিয়েছো আল্ট্রামর্ডান । দুই হাতে টাকা উড়ানো , বন্ধু বান্ধবী নিয়ে আমোদ ফূর্তক করা এইসব শিখিয়েছো , এখন মেয়ে এইসব ছাড়তে পারে না ।
– দেখো রুবির বাবা , আমি কোন বলে দেই নাই যে বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করতে আর তাকেই বিয়ে করতে । অতএব আমাকে বলবা না এইসব । আমি কিটি পার্টিতে যাবো আজকে ।
– ওই তো , এইসব পার্টি পুর্টি করেই জীবন পার করলা আর মেয়েকেও বানিয়েছো তেমন ।

রুবির বাবা মায়ের মাঝে রুবিকে নিয়ে তর্ক লেগে যায় । আর তার একপর্যায়ে রুবির মা চলে যায় রুমে আর রুবির বাবা বাসা থেকেই বেরিয়ে যায় ।

[ বিঃদ্রঃ একজন মা-ই কিন্তু পারেন তার সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে । কারণ বাবারা সব সময় কাছে থাকেন । এখনকার যুগে কিছু কিছু মায়েরা আছেন যারা সন্তানকে এত বেশিই আহ্লাদি করে লালন পালন করেন যারা পরবর্তীতে এমন এক একটা রুবি তৈরি হয় । আবার কিছু কিছু সন্তান আছে হাজারো শাসনের মধ্যে থেকেও জানোয়ার তৈরি হয় , যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আবরার হত্যার খুনিরা । কারো বাবা ভ্যানচালক কারো বাবা অনেক কষ্টে ছেলে মেয়েকে মানুষ করছেন , তারা কিনা অন্য মায়ের কোল খালিই করে দিল সারাজীবনের জন্যে । আবার কারো বাসাতে নাকি টিভিই নাই যাতে করে নাকি সে ভিক্টিমের খবরই দেখেন নাই , তার সন্তান বুলেটে পড়ে । কিছু কিছু বাবা মায়ের প্রশ্রয়ে সন্তান উচ্ছন্নে যায় আবার কিছু কিছু পারিশ্রমিক বাবা মায়ের সন্তানও উচ্ছন্নে চলে যায় । আর কিছু কিছু মেয়ে হয় যারা জন্ম থেকেই একরোখা ছাড়পোকা যারা এক একটা রুবি তৈরি হয় ]

রাত প্রায় ৯ টা বাজছে ঘড়িতে । কিন্তু আজ ইরফান এখনও আসে নাই । অন্যান্য দিন তো ৮ টার পর পরই চলে আসে । তাহলে আজ এত দেরি কেন ? বেলীর চিন্তা বেড়েই যাচ্ছে । এই যাবত প্রায় ১৫ বার বারান্দায় গেছে বেলী । দেখার জন্যে ইরফান আসে কিনা । মিনু তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখছে । বার বার বেলীর বারান্দায় যাওয়া দেখে মিনুও বিরক্ত হয়ে যায় ।

– ভাবী কি অইছে আপনের ? এমন করতেছেন কিল্লাই ?
– এই মিনু দেখো ৯ টা ৫ বেজে গেছে , আজকে এখনও আসে নাই যে মানুষটা ?
– হায়রে আল্লাহ , এই বেডির শরম লইজ্জা কিছুই নাই । বেলাজা মাতারি এইদিকে আইয়েন , আর বইয়া বইয়া নাটক দেহেন আইয়েন ।
– কি বলো এইসব তুমি মিনু ?
– ভাবী ভাইয়ে দেহেন গিয়া হেই শয়তানির বাসায় গেছে গা । এখন শয়তানি হেইডার মা শয়তানি মিল্লা ভাইয়েরে ফাম দিবো আর ভাইয়েও ফাম নিবো । দেইক্ষেন আমার কতাই মিলবে ।
– কিযে বলো না তুমি আজকাল মিনু আর শুনো মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত তাদের শয়তান বলতে হয় না ।
– ভাবী হুনেন , সেই আশরাফুল মাখলুকাত যদি শয়তানের মত কাম করে তারে শয়তান কা আরও কত্ত কিছু কওন যায় । ওহন নাটক চাইতাছি কতা কইয়ে না ।

মিনু নাটক দেখায় মন দিচ্ছে । আর অন্যদিকে বেলীর মনে ভয় আরও গাঢ় হচ্ছে । এরই মাঝে হঠাৎ করেই ডোরবেল বেজে ওঠে । বেলীই যায় দৌড়ে । তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয় সে । ইরফান দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে । ইরফানকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেলী । তবে মানুষটাকে বড্ড বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো ।

– আসছেন আপনি , এত দেরি হলো যে ?
– আগে এক মগ কফি বানা , আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি । মাথা প্রচুর পরিমানে ধরে আছে ।
– আচ্ছা ,

বেলী এক দৌড়ে গিয়ে কফি বানাইতে থাকে । মিনুও দেখতেছে সব , হাল্কা মলিন হাসি দিয়ে সেও মনে মনে বলে ,

– আল্লাহ পাক তারে যে এত সরল সোজা কিত্তে বানাইলো । জামাই যা কয় তাই হুনে , জামাই তো ভালা না কোনদিন জানি মাইরাই ফালায় । বেচারি এইডাই বুঝপার পারে নাহ । জামাই যা কয় তাতেই হ হ করে । সহজ সরল মাইয়া মানুষ ।

মিনুর মনের ভয় তার বেলী ভাবীকে কোনদিন জানি ইরফান মেরেই ফেলে । কিন্তু বেলী তো তা বোঝে না । এটাই মিনুর খারাপ লাগে ।
বেলী কফি বানিয়ে ইরফানের রুমে যায় । ইরফান তখন গোসল করে বের হয় , ইরফান তখন মাথার পানি গুলো মুছতেছে । তখনই বেলী রুমে যায় ।

– আপনার কফি,,,,,,,?
– থ্যাংকস রে , এত ধকলের পরে এই কফিটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল ।
– খেয়ে নেন ।
– বেলী,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ প্রজেক্টটা সাইন হয়ে গেছে ।
– বুঝলাম না ঠিক ।
– বুঝলি না ?
– উহু ,

কফির মগে চুমুক দিয়ে বেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ইরফান । তারপর হাল্কা হেসে বেলীর চোখের দিকে তাকায় ইরফান ।

– তোর দেয়া নামটাই রেখেছি প্রজেক্টের । বস নামটা শুনে খুব খুশি হলেন । আমাদের কোম্পানির পরবর্তী প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ‘ স্বপ্ননীড় ‘। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা , আমার প্রমোশনটাও হয়ে গেছে আজকেই বস ডিক্লেয়ার করে দিলো ।
– আলহামদুলিল্লাহ , আমি বলেছিলাম না আপনাকে , ঠিক হবে সব ।
– হ্যাঁ , সবটাই ঠিক হয়েছে ।
– আচ্ছা আপনি কফি খেয়ে আসেন , আমি টেবিলে ভাত দিতেছি ।
– বেলী দাঁড়া ,
– জ্বি , কিছু বলবেন ?
– কি চাই তোর , আজ যা চাস মুখ ফুটে বল ।
– চাইছি তো কাল রাতে ।
– বেলী ,,,,,, শাড়ি গহনা কিংবা অন্য যা কিছু চাই বলতে পারিস ।
– এইসব কিছুই চাই না আমার , আমার যা চাই তা বলছিলাম তো কালকে । আপনি খাইতে আসে , আমি ভাত বাড়তেছি ।

ইরফানের কথা এড়িয়ে গিয়ে বেলী রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলী যেই কথা গুলো বলে গেলো কথা গুলো কি অভিমানের কথা নাকি বেলীর মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না ইরফান । তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে বেলীর সাথে করা অন্যায় গুলোর জন্যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে বেলীর কাছে । আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।
ইরফান ডাইনিং টেবিলে বসে আছে । বেলী ভাত সহ সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছে ইরফানকে । ইরফান কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । তারপর কি যেনো একটা ভেবে বেলীর সামনেই মিনুকে ডেকে আনে ইরফান ।

– জ্বে ভাই , আমারে ডাকছেন ?
– হু ,
– কি ভাই , কন ।
– আজকে তুই গেষ্ট রুমে থাকিস ।

কথাটা শুনে বেলীর কলিজায় এক কামড় দেয় । আর তার থেকেও বড় কথা মিনুর তো কলিজার সব পানি নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে । ইরফান হঠাৎ করেই কেন আজকে মিনুকে গেষ্ট রুমে শুতে বললো । মিনু বেলীর দিকে তাকায় আর বেলীও মিনুর দিকে তাকায় । মিনু চোখের ইশারায় বেলীকে বোঝাতে চাচ্ছে হয়তো আজ রাতই বেলীর শেষ রাত । ইরফান হয়তো আজ রাতেই বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই মিনুকে আলাদা শুতে বলেছে । এইদিকে বেলীও বিচলিত , হঠাৎ করে ইরফানের আজ কি হলো ? মিনু কথা ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেই বলা শুরু করে ,

– ভাই আমার একলা হুইতে ডর লাগে তো ,
– কিসের ডর আবার , বাসায় আমি আছি তোর ভাবী আছে , কিসের ডর আবার ।
– ভাবী আছে সমিস্যা নাই কিন্তু আপনে আছেন এইডাই আসল সমিস্যা (গুনগুনিয়ে)
– এই মিনু কি বলিস গুনগুন করে ।
– কই কি কইচি আবার , আমি ভিত্রের রুমে হুইতাম না , আমার ডর করে ।
– আচ্ছা তাহলে তুই বেলীর রুমে ঘুমাস , বেলী গেষ্ট রুমে ঘুমাবে ।
– কিল্লাই , ইরাম কিল্লাই ?
– কি কিল্লাই কিল্লাই করছিস , আর তোকে না কতবার বলছি নরমাল ভাষায় কথা বলতে ।

মিনুর মনে এইবার পুরোপুরি দাগ কেটে যায় , যে আজ রাতেই ইরফান বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই বেলীকে , চোখে ইশারা করে । তখন আবার বেলী বলা শুরু করে ।

– মিনু তো রোজ আমার কাছেই ঘুমায় তাহলে আজ কেন অন্য ঘরে ঘুমাবে ?
– আমি বলেছি তাই ,
– কিন্তু ও তো ভয় পায় ।
– পাবে না ভয় । এখন মিনু তুই কোন রুমে থাকবি ভেবে দেখ ।

এই বলে ইরফান খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজ রুমে চলে যায় । ইরফান যেতে না যেতেই মিনু শুরু করে দেয় ,

– দেখছেন ভাবী দেখছেন৷, কইছিলাম না মাইরা ফালাবে , আমারে অন্য রুমে দিয়া আপনেরে মাইরা ফালাইবো গো ভাবী ।
– কি সব বলো না তুমি । আমাকে মেরে ফেললেও তুমি দেখবে না মারলেও তুমি দেখবে , বাদ দাও । উনি যা বলছে তাই করো , আজকে বরং গেষ্ট রুমেই ঘুমাও ।
– কিন্তু আপনে ,
– যা আছে কপালে ।

রাত প্রায় ১২ টা নাগাদ বাজবে । মিনু চিন্তা করতে করতে গেষ্ট রুমেই ঘুমিয়ে গেছে । আর অন্যদিকে রুমে শুয়ে শুয়ে বেলী ভাবছে আজকে হঠাৎ মিনুকে কেন অন্য রুমে ঘুমাইতে বললো ইরফাজ । এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না বেলীর । এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে , বেলী দরজা খুলে দিয়ে দেখে ইরফাজ , টাউজারের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে । অনেকটাই চমকে যায় বেলী ইরফাজকে দেখে ।

– ভেতরে আসতে পারি ?
– এটা আপনার বাসা , সেই হিসাবে রুমগুলাও আপনার , আসেন ।
– ঘুমাস নাই এখনও ?
– শুইছিলাম , এখনি ঘুম আসতো ।
– ওহ , তখন বললাম কি চাই তোর কিছুই বললি না ?
– আমার কিছু চাই না । আর যা চাওয়ার ছিল চেয়েছি তো ।
– আজ যদি আমি তোর কাছে কিছু চাই , দিবি আমাকে ?
– এমন কিছু চাইয়েন না যা আমি দিতে পারবো না । আর যদি আমার জীবনটা চান সহজেই দিয়ে দিবো , তবুও এমন কিছু চাইয়েন না যা আমার আয়ত্তের বাহিরে ।
– জীবন চাইবো না কারণ এই জীবনটাই তো আমার ।
– মানে ??
– যদি বলি আমি তোকে চাই , তখন কি করবি তুই ??

ইরফানের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি বেলী । এই কথাটা পুরোটাই তার আশপাশের জগত থেকে অনেক দূরে ছিল যা বেলীর ধারণাতেই ছিল না । যেই মুহুর্তটা প্রত্যেক নারী আশা করে তার স্বামীর কাছে । সেই মুহুর্তটা যে এইটা হবে জানা ছিল না বেলীর । আর মুহুর্তটা যে আজকের রাতটা হবে তাও জানা ছিল না বেলীর ।।

.
.

চলবে………………

আসসালামু আলাইকুম ,

‘ ঝরে যাওয়া বেলীফুল ‘ আমার এই যাবত লিখার মধ্যে একদম ভিন্ন একটি উপন্যাস । যা কিছুদিন আগেই লিখা শুরু করেছিলাম । আলহামদুলিল্লাহ ৬ পর্বতেই সবার মনে জায়গায় করে নিয়েছে এই উপন্যাসটি । এই উপন্যাসের মাধ্যমে আমি আমাদের সমাজের কিছু বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র । জানি না কতটুকু সফল হতে পেরেছি । তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি অবিরত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here