#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
ইরফানের চাওয়াটা কি আদৌ সঠিক নাকি পুরোটাই আবেগ বুঝতে পারছে না বেলী । তাহলে কি এইজন্যই মিনুকে অন্য রুমে শুতে বলেছিল ইরফান । বেলীর হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে । ইরফান বেলীর সামনে দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয় । যা দেখে বেলী আরও চমকে যায় । ঘরে লাইটটাও বন্ধ । বেলী লাইট জ্বালাতে গেলে ইরফান বেলীর হাত ধরে নেয় । ইরফান বেলীর হাত ধরেই বুঝতে পারে যে বেলীর হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে । সে বুঝে যায় বেলী ভয় পাচ্ছে । তবে মুখে কিছুই বলছে না ।
– লাইট বন্ধ থাকুক ,
– অন্ধকার তো ?
– ড্রীম লাইট তো জ্বলতেছে ।
-…………..
– ভয় পাচ্ছিস ?
– নাহ কেন ভয় পাবো ।
– বস এইখানে ,
ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নিয়ে বেলীকে বিছানায় বসায় । বেলী তখন একদম চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে ।
– ” গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না ” কথাটার মানে কি ছিল রে ?
-…………….
– কিরে বল ,
-…………….
– হাতটা কিভাবে কাটলি ?
-…………….
– বলবি না ?
– কি ,
– হাতটা কিভাবে কাটলি ?
– অসাবধানতাবশত ছুরিটা লেগে গেছিলো ।
– ওহ ,
কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে থাকে বেলী আর ইরফান । ইরফান কি বলবে , কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে । সামনে দীর্ঘ পথ কিন্তু পারি দেয়ার মত কেউ নেই তার । তদ্রুপ বেলীও একদম চুপ করে বসে আছে । কিছু বলার নেই তার । সব কথা কেন যেন বুক অবদি এসে আটকে আছে তার । গলা অবদি উঠছেই না কিছু । এইবার ইরফানই বলতে শুরু করে ,
– তোকে যদি বলি , আমার তোকে চাই তখন কি করবি তুই ?
-…………..
– কিরে আজকে কি নিরব থাকার ডিসিশন নিয়েছিস নাকি ?
– শুনতেছি ,,,,,,
– শুনলে উত্তর দিতে হয় , তা তো জানিস ।
– উত্তর নেই ।
– কেন ?
– বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন সে তার বাবাকে হারাইছে । দ্বিতীয়বার বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন সে তার স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসার বদলে জুতার বারি খেয়েছে । তৃতীয়বার বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন তার স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিল । বেলীফুল বার বার ঝরে যাচ্ছে , কোনদিন জানি সারাজীবনের জন্য ঝরে পড়ে যায় , কে বলতে পারে তাই না ?
বেলী শান্ত গলায় কথা গুলো বলে গেছে আর ইরফান শান্ত মস্তিষ্কে বেলীর কথা গুলো শ্রবণ করছে । আজ সে শুনবে , হ্যাঁ সে শুনবে আজ বেলীর সব কথা । বেলীকে আজ নিজের সব মনের কথা ব্যাক্ত করতে হবে তার কাছে । ইরফান চায় বেলী আজ বলুক । তাই আবারও বেলীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,
– তারপর ?
– তার আর পর নেই ,
– তুই ভালো নেই , তাই না ?
– বালাই ষাট , কে বললো ভালো নেই আমি । আমি খুব ভালো আছি , নিয়ম করে স্বামীর মা’র , সতীনের হাতে চড় থাপ্পড় , আজেবাজে কথা গিলে আমি আলহামদুলিল্লাহ বেশ আছি ।
– তারপর ?
– আর কিছু না ৷ রাত অনেক হয়েছে , রুমে যান আর ঘুমিয়ে পড়েন ।
ইরফান বেশ বুঝতে পেরেছে বেলী তার থেকে দূরে থাকতে চাইছে । কিন্তু ইরফান কেন জানি বেলীর প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে । তার আজ বেলীকে চাই , এইবার তা যে করেই হোক আর যেভাবেই হোক । বেলীর বাম হাতটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নেয় ইরফান ।
– আজ যদি তোর সাথে ঘুমাতে চাই , তখন ?
– এখানে ঘুমাইতে পারবেন না , তোশকটা শক্ত , আর আপনি তো ফোমের বিছানাতে ঘুমাইতে অভ্যস্ত ।
– ওইটা ফোমের বিছানা না , ওটা মেট্রিক্স যা জাজিমের মত হয় ।
– ওহ , তাইলে আর কি , যান ঘুমান গিয়ে ।
এই বলে বেলী উঠে যেতে নিলে ইরফান শক্ত করেই বেলীর হাত ধরে নেয় ।
– উঠে যাস কেন , এখনে বসতে বলছি না ?
– রাত অনেক হলো , আপনার কাল অফিস আছে ।
– আমার অফিসের কাজ কি তুই করতে যাবি ?
– নাহ ,
– তাহলে , এত পেরেশানি কেন তোর ? নাকি থাকতে চাস না আমার কাছে , কোনটা ?
– কি জানি ,
– মনকে জিজ্ঞাসা কর ?
– মনের ঘরে তালা দেয়া , আজকাল খবর রাখি না ।
ইরফান আর কথা বাড়ায় নি । বসা অবস্থাতেই বেলীকে কোলে তুলে নেয় ইরফান । বেলী কয়েকবার বারণ করে তবুও শুনেনি ইরফান । বেলীকে কোলে তুলে নিজেই অনেক অবাক , বেলীর ওজন এত কম হবে ভাবেই নি ইরফান । বিছানায় এনে শুইয়ে দেয় বেলীকে সে ।
তারপর গায়ের থেকে ওড়নাটা সরিয়ে বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইরফান । বেলীর চোখের মধ্যে পানি গুলো চিক চিক করছে । গভীর নিরবতায় চেয়ে আছে শান্ত চোখ জোড়া তার দিকে । এ যেন এক কালচে পরী । এরই মাঝে বেলী একটা ঢোক গিলে । ইরফান বেলীর দিকে একটু ঝুকে যায় , তারপর নিজেই বেলীর কানের কাছে এসে বেলীর গালে হাত রেখে বলে ,
– আমি শুধু তোর সাথে মিশতে চাই । তোর মাঝে বিচরণ করতে চাই । স্বাদ নিতে চাই তোর ঘ্রাণের । আর কিছু না বিশ্বাস কর , আর কিছু না ।
বলতে বলতে ইরফান বেলীর গাল থেকে ঘাড়ে হাত দেয় । আচমকা ঘাড়ে হাত দেয়ায় বেলী নড়ে উঠে আর হাল্কা চিৎকার দিয়ে ফেলে । যা ইরফানও আশা করেনি । বেশ অবাক হয়ে যায় ইরফান ।
– হায় হায় গো যা ভাবছিলাম আমি , আমার ফুলের মত ভাবীডারে ফিডাইতাছে অসিভ্য বেডাডায় । এল্লিগাই তো আমারে অন্য রুমে হোয়াইছে । আল্লায় সারাইছে উইড্ডা গেছি আমি । আমি ঘুমাইয়া গেছি আর হেইতে এই সুযোগে ভাবীরে ফিডাইতাছে । একবার দরজা খুলুক খালি , আইজ্জা আর ছাড়ুম না । এক্কেরে থানার বেডাগোরে খবর দিমু ।
চাপা গলায় নিজে নিজে বক বক করছে মিনু । মিনু তখন বেলীর দরজায় কান পেতে শুনছিল তাদের রুমে কি হচ্ছে । মিনুর ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় , ঘুম ভেঙে গেলে বেলীকে দেখতেই সে বেলীর রুমে আসে , এসে দেখে দরজা আটকানো । বুদ্ধি করে ইরফানের রুমে উঁকি দেয় মিনু , দেখে ইরফান সেখানে নেই তাই সে এসে কান পেতে থাকে বেলীর দরজায় । এসে শুনে বেলী চাপাস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে । তাই মিনুও ভাবতে শুরু করে নেয় ইরফান মনে হয় বেলীকে মানে তার ভাবীকে মারছে । আর এইদিকে ইরফান উঠে লাইট জ্বালায় দেখার জন্যে বেলী হঠাৎ চিৎকার দিল কেন । ইরফান তো কিছুই করে নি । শুধু আবাগের বশে হাতটা গাল থেকে গলায় চলে গেছে আর তাতে চিৎকার দেয়ার মত মেয়ে বেলী নয় । নিশ্চয়ই কিছু তো হয়েছে যার জন্যে বেলী এমন করেছে । আর ইরফান সেই কিছুটাই দেখবে আজ ।
ইরফান লাইট জ্বালিয়ে বেলীর কাছে এসে বসে । আর এই ফাঁকে ওড়নাটা দিয়ে আবার নিজেকে আবৃত করে নেয় । আর ওদিকে দরজার নিচ দিয়ে লাইটের আলো দেখে মিনুও ফ্লোরে শুয়ে পড়ে । দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভেতরে ইরফান কি করছে বেলীর সাথে । দরজার নিচে অল্প একটু ফাঁক সেই ফাঁকের মধ্যে মিনু পারে না তার পুরো মাথাটাই ঢুকিয়ে দেয় ।
– ধুর , ছাতার মাতা এইডার ভিত্রে দিয়া কিছুই দেহা যায় না । কিছু দেহা যায় না কিল্লাই , ভাবীরে কিয়াত্তাছে আল্লায় জানে । ভাল্লাগে না আর , মনডায় চায় দরজার ভিত্রে বারি মারি কিন্তু আমারেই ফরে যদি মাইরা লায় । হায় হায় গো মইরা যাইতাম চাই না এত্ত তাত্তারি ।
মিনু এইসব আবলতাবল বলছে আর দেখার চেষ্টা করছে ।
ইরফান দেখার চেষ্টা করছে বেলীর গলায় কি হয়েছে । অন্যদিকে বেলী একেবারে উঠে বসেই গেছে । ইরফান জোড়াজুড়ি করছিল তাকে অনেক ।
– কি হয়েছে , দেখি আমি ।
– কিছু হয় নাই ,
– তাহলে চিৎকার করলি কেন ?
– এমনিতেই ,
– কিছু হয় নাই , এমনিতেই , তাহলে ওড়না পরেছিস কেন ?
– শীত লাগে ,
– এইবার ঠাটিয়ে চড় মারবো একটা ।
– সহ্য করার মত ক্ষমতা আর শক্তি দুটোই আছে ।
ইরফান আর সহ্য করতে পারে নি । টান দিয়ে ওড়নাটা সরিয়ে নেয় বেলীর গা থেকে । তারপর ঘাড়ে নজর দেয় সে । দিনের বেলায় সে যতক্ষনই বাসায় থাকে বেলী তার সামনে মাথার কাপড় দিয়ে সব ঢেকে রাখে আর রাতে তারা আলাদা ঘুমায় । তাই ক্ষতস্থান গুলো ইরফানের নজর থেকে সহজেই আড়াল হয়ে যায় । সেইদিনের মা’রের দাগ বেলীর গলায় । কালো হয়ে আছ আর বেশ খানিকটা ফুলে আছে স্থানটা । ইরফান বুঝে যায় এই জায়গাটায় এইজন্যই ব্যাথা । হয়তো ভুলবশত তার হাতটা সেখানেই লেগেছে ।
– এটা এমন হয়ে আছে যে ?
– থাক ,
– মলম লাগাস নাই ?
– মিনু লাগিয়ে দিত ,
– কি মলম লাগাইছিস , যে এমন হয়ে আছে ।
– আপনি ঘুমাতে যান ।
– বার বার এক কথা বলতেছে , এইখানে চুপ করে বসে থাক আমি আসতেছি ।
মিনু ইরফানের পায়ের আওয়াজ পেয়ে আর দরজার ফাঁক দিয়ে ইরফানের পা দেখতে পেয়ে হুরমুর করে উঠে তাড়াতাড়ি সরে যায় । ইরফান দরজা খুলে নিজের রুমে যায় , সেখান থেকে একটা স্প্রে আর একটা মলম নিয়ে আবার বেলীর রুমে ফিরে আসে । এসেই দরজা লাগিয়ে দেয় সে । বিছানায় এসে একদম বেলীর কাছে বসে যায় ইরফান । তারপর বেলীর ক্ষতস্থানে হাল্কা স্প্রে করে দেয় । স্প্রের পানি গুলো পড়াতে জ্বলে ওঠে আর বেলী সহ্য করতে না পেরে সেলোয়ারে খামচি মেরে ধরে রাখে ।
– বেশি জ্বলবে না , একটু সহ্য কর
– আমার সহ্য শক্তি আলহামদুলিল্লাহ , সমস্যা নাই ।
– দেখি শুয়ে পড় ।
ইরফান বেলীকে কাত করে শুইয়ে দেয় । তারপর পেছন থেকে বেলীর জামার চেইনে হাত দিতেই বেলী আবার উঠে বসে যায় ।
– কি হলো ?
– আপনি এমন করতেছেন কেন ?
– কি করলাম আবার আমি ?
– চেইন খুলেন যে ?
– যার ঘাড়ে এমন আঘাত তাকে তো এলোপাথাড়ি লাথি ঘুষি চড় থাপ্পড় কম মারি নি , সেই চিহ্ন গুলো আজকে দেখতে মন চাইছে অনেক ।
ইরফানের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় বেলী । চুপ করে মাথা নিচু করে রাখে সে । ইরফান আবার শুইয়ে দেয় বেলীকে । বেলী ওপাশে মুখ করে চোখ মুখ খিটে শুয়ে আছে । আর ইরফান বেলীর জামার চেইনটা খুলে দেয় । চেইনটা দুপাশে সরিয়ে দেয় ইরফান । বেলী তখন না পারছে উঠে যেতে না পারছে শুয়ে থাকতে । কিন্তু এইভাবে সেও সহ্য করতে পারছে না । চেইনটা খুলার পর ইরফানের চোখের সামনে তখন বেলীর উন্মুক্ত পিঠ ছিল । যা দেখে সহজেই কোন ছেলের কাম-সাধণা জেগে উঠবে । কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ বিপরীতটা ঘটলো । বেলীর পিঠে অনেকগুলো ছোপ ছোপ দাগ । ইরফানের এক সেকেন্ডও সময় লাগে নি বুঝতে যে এইগুলো সব তার মা’রের চিহ্ন । যা সহজেই যে কারো চোখে পানি এনে দেয়ার মত । ইরফান বেলীর ব্রা এর হুক খুলে দেয় । বেলী তখন আরও খিটে যায় । বিয়ের ১০ মাস পরে এই প্রথমবার সে আর তার বর এতটা কাছাকাছি এসেছে । এর আগে ইরফান এমন করে কাছে আসে নি কখনো । বেলী ভেবেছিল হয়তো রুবি নেই সেইজন্যেই ইরফান তার কাছে এসেছে । কিন্তু এটা বুঝে নি যে শারিরীক চাহিদা তো যে কোন মুহুর্তেই মেটাতে পারে কিন্তু শারীরিক চাহিদার থেকে প্রয়োজন মনের চাহিদা । যা একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের প্রতি আকর্ষিত করে । ইরফান মলম দিয়ে ভালো করে বেলীর পিঠ টা ডোলে দেয় । পুরো রুম জুড়ে শুধু নিরবতা । ঘড়িতে তখন ২ টা বেজে ১০ মিনিট । ইরফান হুক লাগিয়ে দিয়ে জামার চেইন টেনে দেয় । তারপর উঠে লাইট অফ করে দিয়ে এসে আবার বেলীর পাশে শুয়ে পড়ে । বেলী তখনও ওপাশে মুখ করে আছে । ইরফান বেলীর একদম কাছে চলে আসে ।
– বেলী ,,,,,,,?
-…….
– কিরে ঘুমিয়ে গেছিস নাকি ?
– উহু ,
– এইদিকে ফের ,
– আমার ঘুম আসে ।
বেলীর কন্ঠস্বর তখন অন্যরকম শুনা যাচ্ছিল । বেলী তখন হয়তো কাঁদছিল । তাই গলা বসে গেছে ।
– বেলী এইদিকে ফের ,
– আমার ঘুম আসে তো ?
– এইদিকে ফিরতে বলছি আমি ,,,
ইরফানের কথায় এইবার এই দিকে ফেরে বেলী । অন্ধকারের মধ্যেও বেলীর মুখটা দেখতে পাচ্ছে ইরফান ।
– কাঁদছিস যে ?
– কই ?
– তোকে হয়তো বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছি , তাই না ?
-…………
– এতটা পাথর কিভাবে হলাম , কবে হলাম টেরও পেলাম না জানিস ।
-…………
– আমাকে অনেক ঘেন্না করিস তাই না রে ?
– ঘেন্না করলে এইদিকে থাকতাম না ।
– আমি অনেকটা অমানুষ রে , আমার কাছে থাকলে তো মরে যাবি তুই ।
– কপালে এইভাবে মরণ থাকলে মরবো , এতে কি করা যাবে ।
– একটা সত্যি কথা বলবি আজকে বেলী ?
– বলেন ,
– আমাকে ভালোবাসিস ?
– জানা নাই ,
– কেন ?
– বেলীফুল আজ মৃত
ঝরে গেছে গাছ থেকে
তাকে খোঁজ করা আর
মরিচিকার পেছনে ছুটা
দুটোই সমান কথা
ইরফান অবাক হয়ে যায় বেলীর কথায় । বেলী এইভাবে সাজাতে পারে তা জানতো না ইরফান ।
– ভালো বললি তো ।
– ইন্টার পাশ টা করতে পারি নাই , পেটে একটু হলেও বিদ্যা আছে ।
বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান । মেয়েটা কতটা সরল সোজা । কতটা শান্ত , যার মুখের দিকে তাকালে সারা রাজ্যের শান্তি চলে আসে । ইরফানের আজ ইচ্ছে হচ্ছে বেলীতে মিশে যেতে । এক হাত দিয়ে বেলীর মাজায় টান দেয় ইরফান । এতে বেলী অনেকটাই ইরফানের কাছে চলে আসে । বেলী গাঢ় নজরে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে ।
মনে পড়ে যায় , তার নিজের চোখে দেখা প্রতি সকালে রুবির ভেজা চুলগুলো । তার মনে পড়ে যায় গত তিন আগে বেধড়ক মারধরের কথা । তার মনে পড়ে যায় আজ ১০ টা মাস এক অসহ্য নীয় যন্ত্রণার কথা । চাইলেই কি স্বামীকে সবটা দেয়া যায় ? চাইলেই কি সেই স্বামীকে নিজের শরীরটা দেয়া যায় সে স্বামী তারই সামনে অন্য রুমে সতীন নিয়ে সংসার করে ? এইসব ভেবে হঠাৎই নিজেকে ইরফানের থেকে সরিয়ে নেয় বেলী ।
– আমি অসুস্থ , আপনি ঘুমিয়ে পড়েন ।
এই বলে বেলী ওপাশে মুখ ফিরিয়ে নেয় । ইরফানেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ।
– সরে গেলি ? আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলি ?
– কাল যখন রুবি আপু আসবে আপনি আবার আমায় ভুলে যাবেন । রুবি আপুর কথায় আমায় এসে মারবেন । কুকুরের মত আচরণ করবেন আমার সাথে । বিশ্বাস করেন এতে আমার কষ্ট হয় না , একটুও কষ্ট হয় না । শুধু কষ্ট হয় আপনার এই পাল্টে যাওয়া দেখলে । রুবি আপু অনেক ভালো মানুষ তাকেই ভালোবাসুন । আমি তো আপনার ঘরের বান্দি মাত্র । আমার জন্যে না হয় লাথি ঘুষি টাই ঠিক আছে । আদর সোহাগ আমার কপালে জুটে না ।
বেলী ফোপাতে ফোপাতে বহুত কষ্টে এইসব কথা বললো । এইবার ইরফানের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে । সে বেলীর একদম কাছে চলে আসে । সে নিজের করে পেতে চায় বেলীকে আজ । কিন্তু সে এটা মানতে পারছে না যে বেলীর মনের অবস্থা এই মুহুর্তে কি । দিক বিক না পেয়ে বেলী তার পুরো শরীরকে আলগা করে দেয় । তাকিয়ে আছে সে ইরফানের দিকে । ইরফানের চোখে আজ ঘোর লেগেছে । বেলীকে কাছে পাওয়ার ঘোর ।
তখন বেলী শুধু একটা কথা বলার জন্যে মুখ খুলে ,
– আমি অসুস্থ , তবুও এমন করতেছেন । ঠিকাছে যেমন ভালো মনে করেন তেমনই করেন । আমি বাঁধা দিবো না । আপনি আমার স্বামী আমার শরীরে উপর আপনার অধিকার আছে । আমি বাঁধা দিবো না ।
– আমি তোকে জোর করে পেতে চাই না বেলী । তোর সম্মতিতে চাই ,
– মন থেকে সম্মতি আসতেছে না , তবে বাঁধা দিবো না । যা মন চায় করতে পারেন আপনি ।
ইরফান আর সহ্য করতে পারে নি । দ্রুত উঠে বসে পড়ে সে । খাটের কার্নিশের সাথে একটা ঘুষি মারে ইরফান । তারপর সোজা রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে । আর বেলী সেখানেই পড়ে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে । তবে আজ বেলীর উপায় ছিল না , সত্যিই উপায় ছিল না । যদি উপায় থাকতো ফেরাতো না সে ইরফানকে । তবে বেলী জানে ইরফান আবার বদলে যাবে । রুবি আসলেই সে আবারও বদলে যাবে । তখন হয়তো বেলীর ছায়াও তার পছন্দ হবে না । তখন যাতে নিজেকে সামলাতে কষ্ট না হয় তারই চেষ্টা করলো বেলী । কিন্তু এইসব কিছু ভাবতে গিয়ে সে ইরফানকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে এটাই সব থেকে কষ্টের তার কাছে ।
[ বিঃদ্রঃ বর্তমান সমাজে পুরুষরা যারা একাধিক বিয়ে করেন তাদের দুটো সংসার সামলাতে হয় । এই বউয়ের মন রাখতে অন্য বউকে অবহেলা করা তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । সেখানে কিছু নারী আছে রুবির মত যারা নিজের টাই বুঝবে আর কিছু নারী আছে যারা বেলীর মত । নিজে কষ্টে থেকেও চায় স্বামী তার ভালো থাকুক । অনেকেই বলে এখনকার যুগে এমন নারী আছে নাকি । আমি বলবো আছে । হাজারে একজন আছে যে পুরোপুরি বেলী হতে পারে আর সেই পুরুষটিই ভাগ্যবান যার কপালে একজন বেলী জুটে । আর সেই একজন বেলীই অভাগী যার কপালে শেষ ভাগ টা অন্ধকার কবর দখল করে নেয় ]
.
চলবে………….