ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল,১২,১৩

0
284

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল,১২,১৩
তন্বী ইসলাম
১২

বেশ খানিকক্ষণ সেলিমের সাথে কথা বলে যাচ্ছে শ্রাবণ। সেলিম তার বউকে নিয়ে বাড়ি এসেছে শুনে বেশ খুশিই হলো সে। তবে খুশিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না যখন শুনলো তার ভাবীর ছোট ভাই আশিকও এসেছে এখানে বেড়াতে। আশিকের নামটা শোনামাত্রই শ্রাবণের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। পরক্ষণে আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো সে। সেলিম কিছুক্ষণ ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকস্মিক তার ছোট ভাইয়ের ফোন কেটে দেওয়ার ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকলো না।
সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে পুরোদমে রাত নেমে এসেছে ততক্ষণে। আশিক পদ্ম’র খোঁজে খোঁজে আলেয়াদের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে তখন। সে এ বাড়ির নতুন মেহমান, কিন্তু দেখে বুঝার কোনো অবকাশ নেই। তার হাঁটার ধরন, কথাবার্তায় বুঝা যাচ্ছে সে এ বাড়িরই ছেলে। আলেয়া নিচে বসে বাঁশের বেতের ডালা বানাচ্ছিলেন। আর বিছানার উপর বসে শাপলা আর পদ্ম বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।

আশিক ঘরে ঢুকে কোনো কথা না বলেই পদ্ম’র পাশে গিয়ে বসলো। ব্যাপারটা কোনোভাবেই হজম হলো না আলেয়ার। চেনা জানা নেই, দুদিনের পরিচয়, এরমধ্যেই এতো সখ্যতা কিসের। তবে আত্মীতার খাতিরে তিনি মুখে কিছু বললেন না। শুধু কয়েক সেকেন্ড নিরবে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আশিকের দিকে। পদ্ম আর শাপলা দুজনকেই চোখ রাঙ্গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যেনো এই ছেলেটার সাথে বেশি মাতামাতি না করে। আশিকের হাতে একটা শপিং ব্যাগ৷ পদ্ম যথাসম্ভব আশিকের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না, সবাইকে অবাক করে দিয়ে পদ্ম’র হাতে শপিং টা গুজে দিয়ে আশিক তার হাস্যজ্বল মুখে বললো
“পদ্ম, তোমার লাইগা কিছু খাওন আনছি। পড়ার ফাঁকে খিদা লাগলে খাইও।
পদ্ম সর্বপ্রথম বিস্মিত চোখে হাতের পানে শপিং ব্যাগটার দিকে তাকালো। এরপর এক দুই না ভেবে সে মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। মা ভয়াবহ ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্ম ঢোক গিললো। আমতা-আমতা করে আশিককে বললো
“আমার এইসব লাগবো না আশিক। তুমি শুধু শুধু এইসব কেন আনতে গেলা।
আশিক হেসে বললো
“শুধু শুধু আনতে যামু কেন, তোমার লাইগা আনছি। খিদা নিয়ে পড়লে তোমার কষ্ট হইবো তো।

শাপলা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আশিক আর পদ্ম’র দিকে৷ মাঝেমাঝে মায়ের দিকেও তাকাচ্ছে সে। এই বুঝি আম্মা এখনই বোম্ব ব্লাস্ট করবে। শাপলার এই চিন্তা করাটা শেষ হতে না হতেই আলেয়া বেগম ভদ্রতার সহিত অত্যন্ত চাপাস্বরে আশিককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
“পদ্ম’র কষ্ট হইবো নাকি হইবো না সেই চিন্তা করার লাইগা আমিই যথেষ্ট বাজান। খামোখা কষ্ট কইরে ওরে নিয়া তোমারে চিন্তা করা লাগবো না।
আলেয়ার কথা শুনে আশিকের মুখটা হঠাৎ চুপসে গেলো। শাপলার হাসি পাচ্ছে খুব, বেচারা মনে মনে হয়তো মাকে বকাও দিচ্ছে। তবে পদ্ম’র বেশ খারাপ লাগছে। একটা মেহমান ছেলেকে এভাবে কথা বলার কি খুব বেশিই প্রয়োজন ছিলো? মায়ের উপর রাগও লাগছে কিছুটা, কিন্তু রাগ তো আর দেখানো যাবে না।

আলেয়ার কথা শুনে কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণে সব ভুলে গেলো আশিক। আবারও মুখে হাসি টেনে আলেয়ার উদ্দেশ্যে বললো
“কি যে কন আন্টি। ওরে নিয়া চিন্তা করলে আমার কষ্ট হইবো কেন, বরং ওরে নিয়া চিন্তা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
এবার কপালে ভাজ পরলো আলেয়ার , মৃদু গলায় দাঁতে দাঁত চেপে আশিককে উদ্দেশ্য করে বললো
“আইচ্ছা বাজান। ও তো তোমার বোইনের মতনই। বোইনের জন্য ভাই চিন্তা করলে দোষের কিছু না। ভাই-ইতো বোনের লাইগা চিন্তা করবো। চিন্তা করো বাজান, তোমার বোইনরে নিয়া আরো বেশি কইরা চিন্তা করো।
থতমত খেয়ে গেলো আশিক। পরক্ষণে ভ্যাবলাকান্তের মতো হেসে আলেয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
“এই দুনিয়ায় আমার মায়ের পেটের মেয়েরে ছাড়া অন্য কোনো আন্টির মেয়েগোরে আমি বোইব ভাবি না আন্টি।
এবারে হতভম্ব হলো পদ্ম। শাপলা একহাতে মুখ আড়াল করে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে একা একাই বললো
“আজ তো আশিক গেলো, বেচারার আজ বেহাল দশা হবেই হবে।
আলেয়া কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আশিকের দিকে। আশিকের ঐ হাসিমুখটা তিনি যতবার দেখছেন ততবারই তার শরীর যেনো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তিনি হঠাৎ-ই চিৎকার করে উঠলেন। বজ্রপাতের মতো করে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বললেন
“পদ্ম’রে, তোরে সেই কখন কইছি বিছানার চাদর আর খেতা বালিশের কভার গুলা ধুওনের লাইগা। তুই অহনো এইখানে বইসা রইছিস কোন আন্তাজে?

মায়ের কথায় অবাক হলো পদ্ম। মা তাকে কখন এইগুলা ধোয়ার জন্য বলেছিলো? আর এই রাতের বেলা কেউ এইগুলো ধোয় নাকি!
পদ্ম’কে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি আবারও গর্জে উঠে বললেন
“এখনো তুই এইখানে বইসা রইছোস কেন? আমার মুখ দেখোস নাই আগে কখনো? যা কইছি তা কর।
পদ্ম মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। এরপর ঘরের অন্যপাশে গেলো, যেদিকে আলেয়া ঘুমায়। বাঁশের বেড়া দিয়ে আড়াল করা ওপাশ টা। পদ্ম সেখানে গিয়ে বোকার মতো বসে রইলো, মা হঠাৎ এইসব ধুতে কেন বললো? শুধুই কি আশিকের উপর রাগ দেখিয়ে? এখন সে কি করবে? ধুবে? যদি না ধুয় তাহলে মা রাগ করবেন, আবার এই রাতের বেলা এগুলো ধুতেও মন এগুচ্ছে না। পদ্ম কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসে রইলো বিছানার মধ্যিখানে । দুগালে হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে ভাবতে লাগলো এই মুহূর্তে শ্রাবণ ভাই যদি থাকতো তবে কি করতো? আশিককে নিশ্চয়ই কাঁচা চিবিয়ে খেতো। মনে মনে এটা ভেবে সে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো যে এখন শ্রাবণ ভাই নেই৷ থাকলে নির্ঘাত কোনো ঝামেলা হতোই।

আশিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে রইলো আগের যায়গায়। হঠাৎ পদ্ম’র মা এমন কেন করলো তার মাথায় ঢুকছে না। এদিকে পদ্ম’ও চলে গেছে অন্যপাশে, তাকে দেখতে না পেয়েও খারাপ লাগছে তার। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো আশিক৷ ওদিকে আলেয়া নিচে বসে সাপের মতো ফুসছে আর কাজ করছে। শাপলা একবার মায়ের মুখ দেখছে তো আরেকবার আশিকের মুখ দেখছে।
এমন সময় ফোনের ভাইব্রেশনটা বেজে উঠলো। শাপলা চমকে তাকালো ফোনের দিকে। পরক্ষণে দৃষ্টি তার স্বাভাবিক হলো, শ্রাবণ ভাই কল করেছে। কিন্তু এইসময় সে কেন কল করলো?
এদিকে মায়ের সামনে বসে কথা বলা যাবেনা, তাই সে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালো। আলেয়া হাতের কাজের দিকে চোখ রেখেই বললেন
“যাস কই শাপলা?
“বাথরুমে যাইতেছি আম্মা।
আলেয়া আর কোনো কথা বাড়ালো না।

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতেই কল কেটে গেলো। বাইরে গিয়ে একটা সুবিধামত যায়গায় দাঁড়িয়ে শ্রাবণ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করতে চাইলো শাপলা। কিন্তু ডায়াল করার আগ মুহূর্তেই আবারও শ্রাবণের কল এলো। এবার আর দেরি না করে কলটা রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পাচ্ছে শাপলা৷ ভাবলো এই সময় শ্রাবণ ভাই গাড়িতে করে যায় কোথায়! পরক্ষণে এইসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সে বললো
“কোনো দরকারে কল করছো শ্রাবণ ভাই?
শ্রাবণ অতিসত্বর গম্ভীর গলায় বললো
“পদ্ম কোথায় শাপলা?
“ঘরে। কেন?
“কি করে?
“এতোক্ষণ তো পড়তেছিল, এখন আম্মা ধমক দিছে তাই ঐপাশে গিয়া বসে আছে।

শ্রাবণ অবাক হয়ে বললো
“চাচী ওরে বকছে কেন? ঐ আশিইককা কিছু করে নাই তো আবার? শ্রাবণের কপালে স্পষ্ট ভাজ।
শ্রাবণ ভাইয়ের মুখে এমন ভাবে আশিকের নাম শুনে হাসি পেলো শাপলার। তবুও না হেসে সে বললো
“কিছু করে নাই মানে, অনেক কিছুই করে ফেলছে সে।
“কি করছে?
শাপলা খুবই ধীরকন্ঠে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শ্রাবণের কাছে বললো। শ্রাবণের কপালের রগ ফুলে উঠেছে এরমধ্যে, চোখদুটো লালবর্ণ ধারণ করছে। ইচ্ছে করছে আশিককে গিলে ফেলুক সে। আর কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে ফেলল সে। শাপলা অবাক হলো, এভাবে না বলে কল কেটে দেওয়ায়। মনে মনে ভাবলো, “আজ একসাথে সবার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে কেন।

শাপলা ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ালো ঠিক তখনই পেছনে থাকা একটা ঝোপের আড়াল থেকে মনে হলো কেউ দৌঁড়ে চলে গেলো। শাপলা ভয় পেয়ে গেলো হঠাৎ। কে হতে পারে? এখানেই বা কি করছিলো? দৌঁড়ে চলেই বা কেন গেলো? শাপলার কপালে আবারও ঘাম। সে ভয়ের চোটে তারাতাড়ি করে ঘরে ঢুকে গেলো। ঘরে গিয়ে দেখলো আশিক ঘরে নেই, চলে গেছে। সে বিছানার উপর গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পরলো, বুকটা এখনো ভয়ে ধুকপুক করছে। সেখানে কি সত্যিই কোনো মানুষ ছিলো নাকি ভুতটুত! আহহহ! ভাবলেই গায়ে কাটা দিচ্ছে।

রাত প্রায় এগারোটা। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি এসে ঢুকলো শ্রাবণ। চোখমুখ লাল হয়ে আছে তার। বাড়িতে ঢুকে সর্বপ্রথম চোখ গেলো তার পদ্ম’দের ঘরের দিকে। ওদের ঘরের দরজা লাগানো, বুঝা যাচ্ছে ভেতর থেকে লাইটও অফ। হয়তো ওরা সবাই ঘুমিয়ে গেছে। শ্রাবণ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো পদ্মদের ঘরের দিকে। এক পর্যায়ে সে চোখ সরিয়ে নিলো, নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। এদের ঘরটাও লাগানো, ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্রাবণ দরজার মধ্যে গিয়ে টুকা দিলো৷ দু’বার টুকা দিতেই ভেতর থেকে জুবেদা ঘুম কাতুরে চোখে বলে উঠলো
“কেডা? ঘরের বাইরে কেডা?
জুবেদার সাথে সাথে শ্রাবণের বাবা সাইদুল ইসলামও গলা হাঁকিয়ে বললো
“বাইরে কে?
শ্রাবণ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো
“আমি, দরজাটা খোলো আব্বা।

শ্রাবণের কন্ঠস্বর পেয়ে ওর বাবা মা দুজনেই উঠে বসলো। কপালে তাদের চিন্তার ভাজ৷ মাত্র দুদিন হলো তাদের ছেলে শহরে গিয়েছে, এরমধ্যেই আজ কোনো খবর না দিয়ে এতো রাত করে ফিরে এলো। ছেলের কোনো সমস্যা হলো না তো? কোনো বিপদে পরে নি তো তাদের আদরের ছোট ছেলে? হন্তদন্ত হয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে দরজাটা খুলে দিলো জুবেদা। পেছনে সাইদুল মিয়াও এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলের চোখমুখ লাল হয়ে আছে, কপালের রগ ফুলে আছে। জুবেদা আঁতকে উঠলেন ছেলেকে এইরুপে দেখে। আতংক নিয়ে বললেন
“বাপ তোর কি হইছে? তুই এইবেলা কাউরে কিছু না বইলা আইলি যে? তোর চোখমুখ এমন শুকনা কেন?
“আহ জুবেদা, আগেই অতো উত্তেজিত না হইয়া পুলাডারে আগে ঘরে ঢুকবার দেও তো। হাঁকিয়ে বলে উঠলেন সাইদুল মিয়া৷
জুবেদা চুপ করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন৷ শ্রাবণ গম্ভীরমুখে ঘরে এসে ঢুকলো। বাবা মায়ের বিছানায় বসে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করলো
“আশিক কোথায় মা?

হঠাৎ ছেলের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হলো দুজনই। বিস্ময় নিয়েই বললো
“ঘুমাইতাছে। কেন? ওরে দিয়া কি করবি তুই? আর কাউরে কিছু না জানাইয়া হঠাৎ বাড়িই আইলি কেন? শ্রাবণ রেগে গিয়ে বললো
“আমি আসাতে কি তোমাদের কোনো সমস্যা হইছে? আসার পর থেকেই শুধু এক কথা, আসলাম কেন, আসলাম কেন।
ছেলের কথা শুনে জুবেদা চুপ মেরে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাদে তিনি বললেন
“হাতমুখ ধুইয়া আয় বাজান, অতটা দূর থেইকা আইলি, নিশ্চয়ই অনেক খিদা লাগছে।
শ্রাবণ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো কলপাড়ের দিকে।

সারা বিছানা জুড়ে হাত পা ছুড়ে গড়া গড়ি খাচ্ছে আশিক। যেনো নিজের বাড়ির বিছানাটা সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছে। খাটের এক পাশে লম্বালম্বিভাবে বসে আশিকের এমন উদ্ভট ঘুমানোর ধরণ দেখছে শ্রাবণ। প্রতিবারই দুর্ভাগ্য বশত এই আশিকের সাথেই কেন শ্রাবণকে শুতে হয়? যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলো তখনও ওর সাথেই তার যায়গা হয়েছিলো, আর যখন এখানে এসেছে তখনো ওর সাথেই। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে তার। ঘরে কি আর কোনো বিছানা ছিলো না নাকি যে বেছে বেছে এই আশিককে শ্রাবণের রুমেই থাকার যায়গা করে দিতে হয়েছে। আশিক নাক ডাকছে, শ্রাবণের ইচ্ছে করছে একটা লাত্থি দিয়ে ওকে বিছানা থেকে ফেলে দিক। মানবতার খাতিরে লাথিটা দিতে পারছেনা সে।

কয়েক মিনিট রেগেমেগে বসে রইলো সে, ওই আহম্মকের সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করছেনা শ্রাবণের। নিজের চুলগুলোকে বেশ শক্ত করে টেনে ধরে মাথায় চেপে ধরলো শ্রাবণ। এমন সময় কানে এলো শ্রাবণের ঘুমন্ত কন্ঠস্বর। ঘুমিয়ে থেকেও সে বলছে, “পদ্ম, তুমি আন্টিরে মোটেও ভয় পাইও না৷ আমি আছিতো, আন্টির মতো ভয়াবহ মহিলার হাত থেইকা একদিন আমি তোমারে উদ্ধার করমুই করমু। ”
শ্রাবণ অদ্ভুতভাবে তাকালো আশিকের দিকে৷ এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না সে। ঘুমের মধ্যেও তার পদ্ম’কে নিয়ে টানাটানি করা শুরু করে দিয়েছে এই ছেলে!
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আশিকের পেছন বরাবর একটা লাথি দিলো শ্রাবণ। লাথির জোর এতটাই ছিলো যে আশিক বিছানা থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে গিয়ে পরলো মাটিতে।

চলবে….

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -১৩

লাথি খেয়ে মাটিতে পরার পর ঘুম ভাঙ্গতে সময় নিলো না আশিক।
মেঝেতে পরার সাথে সাথে আর্তনাদ করে মাটিতেই উঠে বসলো সে। প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে সে। মাটি থেকে উঠতে উঠতে চোখ গেলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণকে দেখা মাত্রই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো আশিক। অস্ফুটে বললো
“আপনে কখন আইলেন শ্রাবণ ভাই?
“সেই কবেই। তুমি আমায় খুজোনি, তাই দেখো নি।
“ওহ! আচ্ছা আমি নিচে পড়লাম কেমনে?
আহম্মকের কথা শুনে হাসিও পাচ্ছে শ্রাবণের। তবে হাসা যাবেনা। গম্ভীরমুখে শ্রাবণ বললো
“সে আমি কি করে জানবো।
আশিক ভাবতে লাগলো কিভাবে সে নিচে পরলো। স্বপ্নের কথাটা মনে পরলো তার। পদ্ম’র হাতটা ধরে সে তাকে সান্ত্বনা বাক্য শোনাচ্ছিলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো
“পদ্ম’র মা আমারে লাথিটা দেয় নাই তো! আমি’তো তেমন কিছু বলি নাই উনারে নিয়া, শুধু উনার মেয়েরে সান্ত্বনাই তো দিছিলাম। তাই বইলা এতো বড় লাথি!!

কথাটা কানে এলো শ্রাবণের। সে বিস্ময়ে বললো
“কি বললে তুমি?
আশিক কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, ভাবলো এবার বুঝি শ্রাবণ সবটা ঘেটে দেয়। পদ্ম’র মাকে সবটা যদি সে বলে দেয় তাহলে হবে আরেক বিপদ। শ্রাবণ ভ্রু বাকিয়ে আবারও বললো
“এই, তুমি কি বলছিলে বলছো না কেন?
“না মানে….
“তুমি পদ্ম’কে সান্ত্বনা দিচ্ছিলে বলছিলে?
আশিক ঢোক গিললো। শ্রাবণ ভাই তো দেখি সব শুনে নিয়েছে। এবার কি হবে! আশিককে ঘাবড়াতে দেখে শ্রাবণ মজা পেলো বেশ। মনে মনে ভাবলো, একে শায়েস্তা এরার এটাই সুযোগ। বললো
“তুমি কি জানো পদ্ম’র মা এটা জানতে পারলে তোমার সাথে কি করবে?
আশিক ফট করে বললো
“যা করার করেই তো ফেলছে, কিছু করার কি আর বাকি আছি নাকি।
“যেটা করেছে সেটা স্বপ্নে করেছে। আর আমার চাচীর শক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে আশিক? স্বপ্নে তোমার সামান্য লাথি দিলো এতেই তুমি ছিটকে পরলো, ভাগ্য ভালো যে তোমার কোমড় টা ভাঙ্গেনি। বাস্তবে যদি কিছু করে তাহলে তোমার কি হাল হবে একবার ভেবে দেখেছো?

আশিক এবার কিছুটা হলেও ঘাবড়ালো। পদ্ম’র মায়ের মেজাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র হলেও সে জানে। এখন যদি উনি জানতে পারে তার মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, তাও উনার বিপক্ষে তাহলে উনি কি করতে পারবেন ভেবেই একটা শুকনো ঢোক গিললো আশিক। এরপর অসহায়ভাবে তাকালো শ্রাবণের দিকে একটু সাহায্যের আশায়। শ্রাবণ দেখতে লাগলো আশিকের কর্মকাণ্ড। সে করবে, কি বলবে এটা আন্দাজ করার ট্রাই করলো। এমন সময় হঠাৎ আশিক শ্রাবণের পা’দুটো জড়িয়ে ধরলো। চমকে উঠলো শ্রাবণ। তবে পা’গুলো সে টেনে নেয় নি। বরং ভাজ থেকে বের করে পা’দুটো কে আরো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো শ্রাবণ যেনো আশিকের ধরতে সুবিধা হয়। আশিক সুন্দরভাবেই ধরলো শ্রাবণের পা দুটো। আতংকিত গলায় বললো
“আমারে বাঁচান শ্রাবণ ভাই।
“আমি কিভাবে তোমায় বাচাবো?
“আমি যে পদ্ম’রে নিয়া স্বপ্ন দেখছি আর সেটাও পদ্ম’র মায়ের বিপক্ষে গিয়ে সেইটা তো শুধুমাত্র আপনিইই জানেন। আপনি কাউরে কইয়েন দয়া কইরা শ্রাবণ ভাই।

শ্রাবণ কিছুটা সময় ভাবুক ফেস করে কি যেনো ভাবলো। এরপর গম্ভীর গলায় বললো
“তোমার কথা আমি মানবো কেন?
“দয়া করেন শ্রাবণ ভাই। নইলে ওর মা আমারে কাঁচা গিলবো। আশিকের চোখেমুখে আতংক স্পষ্ট। শ্রাবণ মুখ ঘুরিয়ে নিশ্বব্দে হাসলো। এরপর আবারো ফেসটাকে গম্ভীর করে আশিকের দিকে তাকিয়ে বললো
“ওকে৷ তবে, আমিও তো পদ্ম’র কাজিন। ওর মা আমারো মায়ের মত। সে হিসেবে উনার অপমান মানে আমারও অপমান।
আশিক থতমত খেয়ে মাথা নিচু করে বললো
“হুম। এখন আমি কি করমু?
“একশত বার কান ধরে উঠবস করো।
“এ্যা….?
“বাঁচতে চাইলে তোমাকে এটাই করতে হবে। নইলে আমি এক্ষুনি চাচীর কাছে গিয়ে সব টা বলে দিবো।
আর কিছু করার নেই বিধায় আশিক সবটা মেনে নিয়ে কান ধরে উঠবস করতে লাগলো সে। যখন সে কান ধরে উঠবস করছিলো তখন লজ্জায় শ্রাবণের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়ে উঠেনি তার। বিছানার উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে মজা লুটতে লাগলো শ্রাবণ। সে নিশ্চিত, এই লজ্জা নিয়ে সকাল সকালই এখান থেকে কেটে পরবে আশিক। পদ্ম’র থেকে দূরে সরে যাবে ভেবেই খুশি লাগছে শ্রাবণের।

সকাল সকাল মায়ের হাক ডাকে ঘুম ভাঙলো শ্রাবণের। বেলা বেজে গেছে ন’টা। এখনো ছেলের পরে পরে ঘুমানোটা জুবেদার ভালো লাগছে না। মায়ের চিল্লাপাল্লাতে না চাইতেও উঠে বসলো শ্রাবণ। কিছুটা সময় বিছানায় বসে থেকে হাই তুলে এরপর ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো সে। নামার সময় মনে হলো এখনো পর্যন্ত তার পদ্মফুলকে সে দেখে নি। এবার পায়ে জোর লাগালো সে। দ্রুতগতিতে বেরিয়ে পরলো ঘর থেকে। যদিও পদ্মকে সে পাবে কিনা সে নিশ্চয়তা নেই। এতোক্ষনে স্কুলেও চলে যেতে পারে সে। শ্রাবণ যখন পদ্ম’দের ঘরের সামনে বরাবর গেলো তখনই ভেতর থেকে পদ্ম’র সুমিষ্ট কন্ঠস্বর ভেসে আসলো শ্রাবণের কানে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো তার। যাক, তার পদ্মফুল বাড়িতেই আছে। তবে স্কুলে যায় নি কেন এখনো? পরক্ষণে মনে হলো আজ তো শুক্রবার। স্কুল আসবে কোত্থেকে।

শ্রাবণ হাসিমুখ পদ্মদের ঘরের ভেতর ঢুকল। কিন্তু ঘরের ভেতর ঢোকামাত্রই হাসিটা মিলিয়ে গেলো তার। পদ্ম টেবিলের উপর খাতা রেখে একটা চেয়ারে বসে কি যেনো আকিবুকি করছে, আর তার পাশেই বিছানার মাথায় বসে আছে আশিক। যেভাবে পদ্ম’র দিকে সে হা করে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেনো তার পদ্ম’কে সে চোখ দিয়েই গিলে খাবে৷ রাগে শরীর জ্বালা করতে লাগলো শ্রাবণের। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি আশিকের মাথাটা ফাটিয়ে দিয়ে আসুক। যদিও পদ্ম আশিকের দিকে তেমন একটা তাকাচ্ছে না। তার নজর সম্পুর্ন খাতার দিকে। শ্রাবণ রেগে দরজার মধ্যে জুরে হাতে থাবা দিলো। শব্দে পদ্ম আর আশিক দুজনই চমকে তাকালো দরজার দিকে। শ্রাবণকে দেখা মাত্রই অবাক হলো পদ্ম। খুশিতে চোখ চিকচিক করতে লাগলো তার। উত্তেজিত গলায় সে বলে উঠলো
“শ্রাবণ ভাই তুমি!! কখন আইলা বাড়িতে?
শ্রাবণ আঁড়চোখে একবার আশিকের দিকে তাকালো। পদ্ম’র কথার উত্তর না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করে বললো
“চাচী কই?
“আম্মা তো মামাগো বাড়ি গেছে।
“আর শাপলা?
“তানি আপাগো বাড়ি গেছে মনে হয়।

হঠাৎ রেগে গেলো শ্রাবণ। ক্রোধ ভরা গলায় সে বলে উঠলো
“কেউ নাই তয় তুই এই ছেলের সাথে ঘরের মইধ্যে একা কি করিস?
শ্রাবণ ভাইয়ের কথায় অবাক হলো পদ্ম। এটা কি ধরণের কথা বললো সে? পদ্ম’র মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। সে মাথা নিচু করে ধীর গলায় বললো
“আমি কি এখন ওরে ঘর থেইকা বাইর কইরা দিমু?
শ্রাবণের মনে হলো পদ্ম’র সাথে এমনভাবে কথা বলা তার উচিত হয় নি। কিন্তু আশিক কিংবা অন্য কোনো ছেলের সাথে পদ্ম’কে মেনে নিতে নারাজ শ্রাবণ। সে আর কোনো কথা না বলে বিছানার কিনারায় গিয়ে বসলো। পদ্ম’র মন খারাপ, তবুও পদ্ম’কে উদ্দেশ্য করে সে বললো
“এক গ্লাস পানি নিয়া আয় আমার জন্য।
পদ্ম কোনো কথা না বলে চলে গেলো পানি আনতে। পদ্ম চলে যাবার পরই আক্রোশে আশিকের দিকে তাকালো শ্রাবণ। আশিককে দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছেনা সে গতরাতে তার সামনে ১০০ বার কান ধরে উঠবস করেছে। কতটা নির্লজ্জ ছেলেটা, ভেবেই রাগ হচ্ছে শ্রাবণের। তবুও নিজেকে শান্ত করে আশিককে উদ্দেশ্য করে শ্রাবণ বললো
“তুমি এখনো বাড়ি যাও নাই কেন?

আশিক হেসে বললো
“বাড়ি যামু কেন শ্রাবণ ভাই। আমি’তো এইখানে কয়েক দিনের জন্য বেড়াইতে আসছি। আগে কিছুদিন থাকি, তারপর যামু।
শ্রাবণ অবাক হয়ে বললো
“তুমি কি ভুলে গেছো গতরাতের ঘটা ঘটনাটা?
আশিক কিছুক্ষণ ভেবে বললো
“কোন ঘটনা?
শ্রাবণ বিস্ময়ে বললো
“তুমি যে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখলে সব ভুলে গেছো?
আশিক হাসলো। বললো
“ওহ এইটা? ওইটা তো কাটকুট।
“মানে?
“আমি স্বপ্ন দেখছি তার বিনিময়ে তো শাস্তি পাইছিই। আপনে আমার কান ধরে উঠবস করাইলেন, দোষ কি এখনো রইছে নাকি। শাস্তি পাওয়ার পর আর কোনো দোষ থাকে না।
শ্রাবণের রাগ মাথায় চড়ে গেলো। সে চাপা গলায় বললো
“আমি কিন্তু চাচীকে বলে দিবো সবটা।
“আমিও কমু।
“তুমি কি বলবা? বিস্ময়ে বললো শ্রাবণ।
“আপনেও আমারে কান ধরে উঠবস করাইছেন সেইটাই কমু।

শ্রাবণের মাথায় হাত। এ ছেলে তো তার নিজের চেয়ে এক কাঠি উপরে। শ্রাবণ আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই জগ ভর্তি পানি নিয়ে ঘরে ঢুকলো পদ্ম। ঘরে পানি ছিলো না বিধায় কলপাড়ে গিয়েছিলো পানি আনার জন্য।
পদ্ম’কে দেখে আশিক আর শ্রাবণ দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে বসলো। গ্লাসে করে পানি এনে দিলে এক ঢোকে সবটুকু পানি খেয়ে শেষ করলো শ্রাবণ। ওর খাওয়া শেষ হলে আশিকও হাসিমুখে পদ্মকে বললো
“আমারেও একটু পানি দেও পদ্ম।
পদ্ম আশিককে পানি দিতে যাবে তার আগেই ওর হাত ধরে টেনে তুললো শ্রাবণ। চাপা গলায় বললো
“আমাদের কলের পানির স্বাদ বেশি। সো ঘরে গিয়ে নিজের বোনের থেকে মিষ্টি কলের মিষ্টি পানি চেয়ে চেয়ে খেয়ে নিও বেশি করে। আশিককে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। পদ্ম এখনো মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ ভাইয়ের কথাটায় সত্যিই সে অনেক কষ্ট পেয়েছে।

খানিক বাদে বাড়ি ফিরে এলো শাপলা। এবারেও তার মনে হয়েছিলো কেউ তাকে দেখছে, কেউ তার পিছু নিচ্ছে। তবে কে, সেটাই বুঝতে পারছে না। শাপলা বাড়ি ফিরে ঘরে না ঢুকে সোজা ঝিলের ধারে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো পদ্ম সেখানে মাচার উপর আগে থেকেই বসে আছে৷ শাপলা গুটিকয়েক পা ফেলে বোনের কাছে পৌঁছে গেলো, এরপর কিছু না বলে মাচার আরেক মাথায় বসে পরলো। গত দুদিনের তুলনায় আজ ঝিলের পানিটা কিছুটা কম। বৃষ্টির কারণে পানি বেড়ে গেছিলো সেদিন, রৌদ্রের প্রখর তাপে এখন সেটা কমতে শুরু করেছে। শাপলা খেয়াল করলো পদ্ম মনমরা হয়ে বসে আছে। সে প্রশ্ন করলো
“কি’রে কি হইছে?
“শ্রাবণ ভাই ধমক দিছে। নরম গলা উত্তর দিলো পদ্ম৷
শাপলা অবাক হয়ে বললো
“মোবাইল তো আমার কাছে। কার নাম্বারে কল দিয়া তোরে বকা দিলো?
“কারো মোবাইলে না, সে বাড়ি আইছে।
“কখন! বিস্ময়ে বললো শাপলা।
“জানি না। নিচের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বললো পদ্ম।

ঝিলের স্বচ্ছ পানিটার দিকে তাকালো শাপলা। যদিও তার মন খারাপ নেই, তবে মনের মধ্যে বেশ দুশ্চিন্তা রয়েছে। কিছুদিন যাবৎ কেন তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করছে? আর যদি করেও থাকে তবে তাকে দেখতে কেন পাচ্ছে না সে? শাপলা চারিদিকে চোখ বুলালো। হঠাৎ একজনকে দেখে তার চোখ থেমে গেলো। শাপলা স্পষ্ট দেখলো ঝিলের ওপাশে থাকা বাড়িটার পেছন থেকে কেউ সরে গেলো। কেন যেনো শাপলার মনে হলো এ ছেলেটা তাকে এতোক্ষণ দেখছিলো। বাড়িটা ঝিলের ওপাশ থেকে কয়েকশ গজ দূরে হবে। তবে এপারে থেকেও বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। ছেলেটা চোখের আড়াল হতেই ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো সে। আন্দাজে কাউকে সন্দেহ করা ঠিক হবে না। সে’তো আর ছেলেটিকে তাকে ফলো করতে দেখেনি। শুধু সরে যেতে দেখেছে। এমনও হতে পারে ছেলেটি কোনো কাজে সেখানে ছিলো, কাজ শেষ করে চলে গেছে। এমনটা ভাবলেও মনকে সে কিছুতেই বুঝ দিতে পারছে না। একটা চিন্তা লেগেই রয়েছে। কোনো এক কারণে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে সে আগেও কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে? হয়তো এ বাড়িরই ছেলে, তাই আগেও দেখেছে। এমনটা ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো শাপলা।

শাপলা ফিরে তাকালো পদ্ম’র দিকে। পদ্ম এখনো আগের মতো মুখ গুজে বসে আছে। শ্রাবণ ভাইকে এদিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো শাপলা। শ্রাবণ ইশারায় শাপলাকে কথা বলতে নিষেধ করলে সে চুপচাপ সেখান থেকে সরে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। শ্রাবণ ধীরপায়ে এগিয়ে আসে পদ্ম’র দিকে। তার পদ্মফুলকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করে শ্রাবণ। নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে তার। তখন পদ্ম’কে এভাবে না বললেও পারতো সে। শ্রাবণ নিশ্বব্দে তার পদ্মফুলের পাশে গিয়ে বসলো। পদ্ম’র মনোযোগ পাওয়ার জন্য সামান্যই কাশলো সে। কিন্তু পদ্ম নড়লোও না পর্যন্ত। সে আবারও গলায় কাশির মতো করে শব্দ করলো। এবারেও ফলাফল শুন্য। অবশেষে শ্রাবণ তার বাহুডোরে আবদ্ধ করার জন্য পদ্ম’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। পদ্ম কোনো শব্দ না করলেও শ্রাবণ ভাইয়ের উপস্থিতিসহ সে কি করতে চাইছে সবটাই বুঝতে পারলো। যে কারণে পদ্মকে ধরতে যাবার আগ মুহূর্তেই শ্রাবণের কাছ থেকে কিছুটা দূরে চলে গেলো পদ্ম৷ রাগী রাগী মুখ করে যখন সে শ্রাবণের দিকে তাকালো তখন শ্রাবণ অসহায় মুখ করে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
“আমার পদ্মফুল একান্তই আমার। আমি কি করে অন্য কারো সাথে আমার পদ্মফুলকে দেখতে পারি? আর কি করেই আমার পদ্মফুলের দুঃখী চেহারাটা সহ্য করতে পারি?
পদ্ম মুখ ফুলালো, কিন্তু কিছু বললো না। যেনো মুখে কুলুপ এঁটেছে সে। শ্রাবণ এবার সামনের বিশাল আকাশটার দিকে তাকালো। নির্বাক চোখে কিছুটা সময় বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে থেকে একসময় আবেশে সে বললো
“পদ্মফুল, আমার পদ্মফুল..
কেন মিছে মিছে রাগ করে আছিস আমার উপর? কেন অভমানে আমার কাছ থেকে মুখ লুকাচ্ছিস? আর কেউ না জানুক, তুই তো জানিস.. তুই আমার কাছে ঠিক কি! আমার বুকটা যদি কেটে দেখছি.. আমার সারা শরীর টা যদি পুড়িয়ে ঝলসে ফেলতি.. হৃদপিন্ডটাকে কুচি কুচি করে কেটে পরখ করতি, তাহলে বোধহয় দেখতে পেতি, তোকে আমি আমার মনের ঠিক কোথায় ঠাঁই দিয়েছি। তুই আমার পদ্মফুল, শুধুই আমার। আমার উপর তুই যতই রাগ হোস, যতই অভিমান করিস, যতই আমার প্রতি তোর অভিযোগ থাকুক, আমি কখনোই তোকে অন্য কারো সাথে মেনে নিবো না। কক্ষনো না…

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here